দর্শনার যুদ্ধ
বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতাে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা মহকুমার অন্তর্গত সাধারণ এলাকা দর্শনায় গড়ে ওঠে প্রবল প্রতিরােধ। দর্শনা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্তবর্তী একটা মফস্বল শিল্প শহর। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে এ এলাকায় কর্মরত ছিলেন (১৯৭১ সালের মার্চ হতে আগস্ট পর্যন্ত)। পরবর্তী সময় আগস্ট হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেজর এম এ মঞ্জুর ৮ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। অফিসারদের মধ্যে ক্যাপটেন মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান (পরবর্তী। সময় সেনাবাহিনী প্রধান) অত্র এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। এ এলাকার মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধের মধ্যে দর্শনার যুদ্ধ অন্যতম। ভৌগােলিক অবস্থান ও গুরুত্ব দর্শনা মফস্বল এলাকাটি বর্তমান চুয়াডাঙ্গা জেলা শহর হতে ১৮ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। দর্শনার ৩ কিলােমিটার উত্তরে জয়রামপুর, ২ কিলােমিটার পূর্বে চাদপুর-উজালপুর, ৪ কিলােমিটার দক্ষিণে ভারতের গেদিয়া (গেদে) রেল। স্টেশন এবং এ এলাকার মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা ইছামতি নদী বয়ে গেছে। এ গ্রাম থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত মাত্র ২ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এটা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতােই সমতল ও সবুজে ঘেরা একটা গাছপালা ও কৃষি জমিনসমৃদ্ধ বসতি এলাকা। দর্শনার ভৌগােলিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। দর্শনা হতে আশপাশের সব গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় চলাচলের জন্য পাকা রাস্তা ও রেললাইন ছিল। দর্শনা রেল জংশন হওয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের কাছে এ স্থানের গুরুত্বও ছিল খুব বেশি। দর্শনার সাথে যােগাযােগের মাধ্যমগুলাে ছিল নিম্নরূপ:
ক, দর্শনা-চুয়াডাঙ্গা দ্বিমুখী পাকা রাস্তা।
খ, দর্শনা-মেহেরপুর দ্বিমুখী পাকা রাস্তা।
গ, দর্শনা-জীবননগর-কালিগঞ্জ দ্বিমুখী পাকা রাস্তা ।
ঘ. দর্শনা-চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়া হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ব্রডগেজ রেললাইন।
ঙ. দর্শনা-ভারত আন্তঃরাষ্ট্রীয় ব্রডগেজ রেললাইন।
দর্শনা চিনিকল ছিল একটি জনবহুল শিল্পকারখানা, যেখানে গড়ে উঠেছিল। বিশাল মুক্তিপিপাসু গণবাহিনী।
যুদ্ধের সংগঠন
ক. মুক্তিবাহিনী: ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলাে’ আওয়াজের সাথে চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনায়ও গড়ে ওঠে দুর্গ। গড়ে ওঠে স্থানীয় জনগণের সমন্বয়ে এক বিশাল মুক্তিবাহিনী। এ এলাকাটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের বানপুর সাব-সেক্টরের অধীন। এ এলাকার মুক্তিবাহিনীর সংগঠন ছিল নিম্নরূপ: ১, সেক্টর অধিনায়ক ৮ নম্বর সেক্টর: মার্চ হতে আগস্ট পর্যন্ত মেজর। আবু ওসমান চৌধুরী এবং আগস্ট হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেজর। এম এ মঞ্জুর। ২. সাব-সেক্টর বানপুর (৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে):
• সাব-সেক্টর অধিনায়ক: ক্যাপটেন মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান।
• তৎকালীন ইপিআর-এর ৪ নম্বর উইংয়ের বাঙালি সদস্য।
• স্থানীয় ও বিভিন্ন স্থান হতে জড়াে হওয়া পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ বাহিনী ইত্যাদির বাঙালি সদস্যরা। • ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা কিছু সদস্য। এবং তাদের সাথে প্রায় ৩০০-৪০০জন মুক্তিযােদ্ধা। (স্থানীয় জনগণসহ)। খ, পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনী ৯ পদাতিক ডিভিশন যশাের সেনানিবাস তথা যশাের এরিয়ায় অবস্থান করছিল। ৯ পদাতিক ডিভিশনের ৫৭ ব্রিগেড হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হতে দর্শনা পর্যন্ত প্রতিরক্ষা অবস্থানে এবং ১০৭ ব্রিগেড দর্শনার দক্ষিণ প্রান্ত হতে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১০৭ ও ৫৭ ব্রিগেডের আন্তঃব্রিগেড় বাউন্ডারি ছিল দর্শনা। লাইন কিন্তু দর্শনা ছিল ৫৭ ব্রিগেডের মধ্যে শামিল। পাকিস্তানি বাহিনীর সংগঠন ছিল নিম্নরূপ: ক. ৫৭ ব্রিগেডের ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর শোয়েবের নেতৃত্বে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা এরিয়ায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। খ, ১৮ পাঞ্জাবের ১টি কোম্পানি ক্যাপটেন এস এম হান্নানের নেতৃত্বে দর্শনায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। গ. ৫০ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কিছু সংখ্যক সৈন্য চুয়াডাঙ্গায় রিজার্ভ
(সংরক্ষিত সৈন্য) হিসেবে মােতায়েন ছিল।
যুদ্ধের অবস্থান
ক, মুক্তিবাহিনী: ৮ নম্বর সেক্টরের বানপুর সাব-সেক্টর সদর দপ্তর ছিল ভারতের সীমানার ভিতরে দর্শনা-কলকাতা রেললাইন সংলগ্ন বানপুর রেল স্টেশনের পাশেই। ক্যাপটেন মুস্তাফিজ ছিলেন বানপুর সাবসেক্টরের অধিনায়ক। বানপুর হতে সব যুদ্ধ পরিকল্পনা করা হতাে। তা ছাড়া গেদে রেল স্টেশন ছিল এ সাব-সেক্টরের একটি ক্যাম্প। এ ক্যাম্পে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে আনুমানিক ১ প্ল্যাটুন অনিয়মিত মুক্তিযােদ্ধার অবস্থান ছিল এবং এ এলাকার দক্ষিণপশ্চিম দিকে সীমান্ত রেখা বরাবর বারাদি গ্রামে মুক্তিযােদ্ধা সহকারী অধিনায়ক রেজাউল করিমের নেতৃত্বে এবং ছােটো বলদিয়া গ্রামে মুক্তিযােদ্ধা সহকারী অধিনায়ক খায়রুল ইসলামের (খয়ের) নেতৃত্বে ১টি করে ২টি মুক্তিযােদ্ধা সাব-ক্যাম্প ছিল। প্রতিদিন নিয়মিত টহল করা, শক্র সেনাদের চলাচল, অবস্থান, অভ্যাস ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা ছিল এ ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধাদের কাজ। তবে মাঝে মাঝেই এ এলাকায় বা পাশের এলাকায় যুদ্ধের প্রয়ােজনে এরা গমন করতেন বা যে-কোনাে কাজের জন্য প্রস্তুত থাকতেন। পাকিস্তানি বাহিনী: দর্শনা এলাকায় রেলওয়ে জংশন ডাঙাপাড়া গ্রামে। দর্শনা-উথলী-কালিগঞ্জ রেলওয়ে এবং দর্শনা-গেদে-বানপুর-কলকাতা রেললাইন কাভার করে মুক্তিযােদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর যে-কোনাে অনাকাক্ষিত আগমন প্রতিহত করার জন্য শত্রু বাহিনী অবস্থান গ্রহণ করে। কোম্পানি সদর দপ্তর ছিল কেরু অ্যান্ড কোং’ (দর্শনা চিনিকল) চিনিকলের রেস্ট হাউজে। মাথাভাঙা (ইছামতি নদীর পূর্ব পাড় ধরে নিজস্ব বাহিনীর আগমনের পথ লক্ষ্য রেখে শক্র তাদের ভারী অস্ত্র ও কিছু সংখ্যক সৈন্য মােতায়েন করেছিল। উল্লেখযােগ্য অবস্থানগুলাের মধ্যে রামনগর (হুদা লােকনাথপুর) স্কুল, যা মাথাভাঙা। নদীর তীরেই অবস্থিত ছিল।
এ স্কুলের সামনেই ছিল মাথাভাঙা নদীর উপর খেয়াঘাট এবং ছােটো একটি গ্রাম্য বাজার শক্রর আরও একটা। শক্ত অবস্থান ছিল মাথাভাঙা নদীর ওপর প্রতাপপুর ফেরিঘাটে। পাকিস্তানি বাহিনী ভবিষ্যতে ভারতীয়বাহিনীর ট্যাংক বা সাঁজোয়া যানের সম্ভাব্য আগমন প্রতিহত করার জন্য দর্শনা এলাকায় বহু অ্যান্টি-ট্যাংক ডিচ (ট্যাংকের ভূমি প্রতিবন্ধক) তৈরি করেছিল, যা প্রধানত শ্যামপুর এলাকায় মাথাভাঙা নদীর দুই বাঁককে সংযুক্ত করে তৈরি করেছিল। এ অ্যান্টি-ট্যাংক ডিচ বা প্রতিবন্ধক ৫০ ফুট চওড়া ও ৭ ফুট গভীর ছিল, যা সব ধরনের সাঁজোয়া যানের অগ্রযাত্রার প্রতি ছিল হুমকিস্বরূপ।
শক্রর আর্টিলারি অবস্থান ছিল ডাঙাপাড়া গ্রামের উত্তরে অবস্থিত দুধপাতিলা গ্রামে। এ গ্রাম হতেই মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উপর শত্রু প্রায়শই আর্টিলারি গােলা বর্ষণ করত। যুদ্ধের বিবরণ ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাইয়ের যুদ্ধ (মদনা-দর্শনা) সীমান্তবর্তী শহর দর্শনা এবং এর আশপাশের গ্রামগুলােয় পাকিস্তানি বাহিনী। প্রতিরক্ষা অবস্থানে মােতায়েন ছিল। ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি। নিয়ে ক্যাপটেন এস এম হান্নান এ এলাকার দায়িত্বে ছিলেন। এ বাহিনীর সাথে কিছু রেঞ্জার ও রাজাকার ছিল, পাশাপাশি ট্যাংকের অগ্রযাত্রা বন্ধ করার জন্য ৫০ ফুট চওড়া ও ৭ ফুট গভীর প্রতিবন্ধক তৈরি করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ২৮-২৯ জুলাই রাতে মুক্তিবাহিনীর প্রায় ২ প্লাটুন যােদ্ধাকে ভারতের গেদে রেল স্টেশন ক্যাম্পে সমবেত করা হয় এবং ৪টি উপদলে ভাগ করে বিভিন্ন কাজ দিয়ে দর্শনা এলাকায় প্রেরণ করা হয়। প্রথম দলের অধিনায়ক ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা আব্দুর রহমান। তার কাজ ছিল আকন্দবাড়িয়ার কাছে পাকিস্তানি যুদ্ধ সরঞ্জাম, রসদ ও জনবল বহনকারী ট্রেন বােমা মেরে ধ্বংস করা। সারারাত বসে থাকেন মুক্তিযােদ্ধারা, কিন্তু ঐ ট্রেন না আসায় তারা ফিরে যান। আর্টিলারি কোরের সদস্য হাবিলদার মহব্বত ও হাবিলদার কচিকে ১টা। বেতারযন্ত্র দিয়ে দর্শনা এলাকায় পাঠানাে হয় মিত্র বাহিনীর গােলন্দাজ ফায়ার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিন্তু উচু গাছের ডালে বসে শক্রর অবস্থান পরিষ্কার না দেখা যাওয়ায় সম্পূর্ণ অনুমানের উপর মিত্র বাহিনীর আর্টিলারি ফায়ার নিয়ন্ত্রণ করেন, এর ফলে শত্রু বাহিনী ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ৪টি দলের অবশিষ্ট ২টি দল দর্শনা এলাকায় গিয়ে বিশেষ কোনাে আক্রমণ বা অপারেশন করতে পারে নি। এ দলগুলাের অ্যাকশন পরিচালনার জন্য রণ ঘণ্টা ছিল ২৯ জুলাই সকাল ৫টা।
আর্টিলারি ফায়ার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া তেমন কোনাে কাজই এ দিন করা সম্ভব হয়নি। লােক মারফত জানা যায়, সর্বসাকুল্যে শত্রুর ৩৪জন সদস্য মারা যায়। মুক্তিবাহিনীর ১জন সদস্য আহত হন। ১৯৭১ সালের ১২ আগস্টের যুদ্ধ (মদনা-দর্শনা) মুক্তিযোেদ্ধা অধিনায়ক লিয়াকত এবং তার সাথে সহযােদ্ধারা যেমন: বেল্লাল, মহসীন, মােবারক, নওশের, তােতা, তানজীর, ইপিআর সদস্য তবিবুল্লাহসহ অন্য সবাই প্যাট্রল বা টহল করতে করতে প্রতাপপুর, বর্তমানে গলায়দড়ি খেয়াঘাট (মাথাভাঙা নদীর উপর) পার হয়ে মদনা গ্রামে আসেন। মদনা গ্রামের মাঝ দিয়ে ইংরেজি অক্ষর টি আকারের মাটির রাস্তা বয়ে গেছে। মুক্তিযােদ্ধারা যখন এ গ্রামে পৌছেন তখন গ্রামবাসীরা তাদেরকে খবর দেয় যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অধিনায়ক লিয়াকত তৎক্ষণাৎ তাঁর দলকে ৩ ভাগে ভাগ করে তড়িঘড়ি করে ৩টি অবস্থান গ্রহণ করেন। বাজারের উপকণ্ঠে গফুর মাস্টারের বাড়ির পাশে ১টি দল এবং আরেকটি দল মুক্তিযােদ্ধা। গােলাম নবীর নেতৃত্বে গ্রামের পূর্ব পাশে অবস্থান গ্রহণ করে। অধিনায়ক লিয়াকত এবং আরেক সহযােদ্ধা তানজীরসহ গফুর মাস্টারের বাড়ির দক্ষিণপূর্ব কোণে মাটির দেওয়ালওয়ালা বাড়ির কোণে অবস্থান গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর টহল দল হাঁটতে হাঁটতে ঐ দিনের খর রােদ্রে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ঠিক দুপুর আনুমানিক ১টার দিকে মুক্তিযােদ্ধারা গুলি চালান পাকিস্তানি বাহিনীর উপর। প্রথম গুলি বিনিময়েই ৭জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করার জন্য দর্শনা ও রামনগর হতে অতিরিক্ত সৈন্য ও গােলাবারুদ আসে। হামলা, পালটা হামলা ও গােলাগুলি চলতে থাকে বিকাল আনুমানিক ৪টা পর্যন্ত। গ্রামবাসীদের মাধ্যমে খবর পৌছে যায় গেদে ও বানপুর মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে।
ক্যাপটেন মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি টহল দল ও গােলাবারুদসহ আনুমানিক ৪টার দিকে মদনা গ্রামে পৌছে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা পশ্চাদপসরণ করে দর্শনা ও রামনগরে ফিরে যায়, কিন্তু রেখে যায় তাদের ৭জন সহযােদ্ধার লাশ। মদনা গ্রামের প্রায় সব বাড়ির টিনের চাল, মাটির দেয়াল যুদ্ধের গােলাগুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১১ সেপটেম্বরের যুদ্ধ (মদনা-দর্শনা) দর্শনা এলাকায় মদনা ও হৈবতপুর ২টি পাশাপাশি ছােটো পাড়া সদৃশ গ্রাম। আনুমানিক দুপুর ১টার দিকে ছােট বলদিয়া ক্যাম্পে খবর আসে যে, পাকিস্তানি বাহিনী হৈবতপুর গ্রাম ও মদনা গ্রাম ঘিরে ফেলেছে এবং জনগণ গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। রাজাকাররা গ্রাম আক্রমণ করেছে। ছােটো বলদিয়া ক্যাম্প ও বারাদি ক্যাম্পের কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে সাথে নিয়ে অধিনায়ক রেজাউল করিম মদনা-হৈবতপুর আগমন করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের ডেপুটি অধিনায়ক রহমান (পরে মারা যান) তার নিজের কাছে থাকা গ্রেনেড শত্রু সেনাদের প্রতি ছুড়ে মারেন, ফলে মুখােমুখি যুদ্ধ শুরু হয়। তুমুল গােলাগুলির মধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা গুলি করতে করতে পিছু হটে যায়, পাকিস্তানি সৈন্যরাও মুক্তিযােদ্ধাদের ধাওয়া করে। যুদ্ধে ৭-৮জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযােদ্ধাদের তাড়িয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু ঐ মুহূর্তে বানপুর সাব-সেক্টর ক্যাম্প হতে তকালীন ক্যাম্প অধিনায়ক ক্যাপটেন মুস্তাফিজ অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে হৈবতপুর গ্রামের তিন রাস্তার মােড়ে হাজির হন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এবার পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে হৈবতপুর ও মদনা গ্রামের বহু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এ যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি সৈন্যরা ২ ইঞ্চি মর্টার ফায়ার করে এবং সাহায্যকারী আর্টিলারি হতে মুক্তিযােদ্ধাদের উপর।
গােলা বর্ষণ করে। ঐ দিনই দুপুরের পর মদনা গ্রামের মাঠের মাঝে ৪জন নিরপরাধ অসামরিক লােককে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করে। এ ছাড়া ১জন মুক্তিযােদ্ধাকে পাকিস্তানি বাহিনীর লােকেরা ধরে ফেলে এবং দর্শনা এলাকা হতে কার্পাসডাঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ধৃত মুক্তিযােদ্ধা আ. মান্নানকে কার্পাসডাঙা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে তথ্য সংগ্রহ করত, পরে তাকে গাছে ঝুলিয়ে নিচে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবরের কুড়ালগাছি-ধান্যঘড়া যুদ্ধ (দর্শন) কার্পাসডাঙা পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্প হতে ২৫ অক্টোবর বেলা ১১টার দিকে কুড়ালগাছী গ্রামে শক্রর ১টি টহল দল আসে। কুড়ালগাছি গ্রামে একটা রাজাকার ক্যাম্প ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দল প্রায়ই এ গ্রামে রাজাকার সদস্যদের সমন্বয়ে আসতাে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাশের পাড়া সদৃশ গ্রাম ধান্যঘড়ায় টহলের জন্য অবস্থান করছিলেন। দুপুর আনুমানিক ১২টার দিকে মুক্তিবাহিনীর ১৩জন সদস্যের ১টি দল ধান্যঘড়া গ্রামের এক বাসিন্দার আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়ে দুপুরের খাবার গ্রহণ করছিলেন, এমতাবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে। খাবার ফেলে রেখে যুদ্ধে লিপ্ত হন। মুক্তিযােদ্ধারা। পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণের তীব্রতায় মুক্তিযােদ্ধারা অধিনায়ক আ. রহমানের নেতৃত্বে পিছু হটতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে ফুলবাড়িয়া গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা শামসুল হক মালিথা মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। পরে জানা যায়, ঐ আপ্যায়নকারী ছিল ১জন রাজাকার। মুক্তিযােদ্ধাদের খাবার খেতে দিয়ে সে পাকিস্তানি সেনাদের খবর দিয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারা। শহিদ শামসুল হক মালিথার লাশ ধান্যঘড়া গ্রামে মাঠের ভিতর রেখে দিয়ে ফাঁদ পেতে বসেছিল প্রায় ১৫ দিন, যেন মুক্তিবাহিনী লাশ নিতে আসলে গুলি করে তাদেরকে হত্যা করা যায়। পরে মুক্তিযােদ্ধারা ঐ আপ্যায়নকারীকে ধরে তার বাড়ি হতে ৪টি .৩০৩ রাইফেল ও বেশ কিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করে ক্যাম্পে নিয়ে যান। শিক্ষণীয় বিষয় –
ক, সঠিক কারণ: এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। নিজের জীবন বাজি রেখে দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করেছে, মুক্তিযােদ্ধারা। অপর পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধ করতে হবে তাই তারা যুদ্ধ। করেছে। খ. তথ্যসংগ্রহ: তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে মুক্তিযােদ্ধারা সর্বদা এগিয়ে ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী ঘাঁটি থেকে বের হলেই মুক্তিযােদ্ধারা খবর পেয়ে যেতেন খুব সহজে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের শুধু রাজাকারদের উপর বেশি নির্ভর করতে হতাে। জনগণের সহায়তা: অধিকাংশ বাংলাদেশি মুক্তিযােদ্ধার পক্ষে, পক্ষান্তরে, সীমিত সংখ্যক এ দেশীয় দালালেরা পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে থাকায় মুক্তিযােদ্ধারা যে-কোনাে সময়ে যে-কোনাে ধরনের সাহায্য স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে পেতেন। কিন্তু এ সুবিধা পাকিস্ত নি বাহিনীর জন্য ছিল দুষ্প্রাপ্য। যুদ্ধে উদ্ভাবিত কৌশল; মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিটি অপারেশন ছিল সক্রিয়তাপূর্ণ। নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ পরিচালনা করে পাকিস্তানি বাহিনীকে সর্বদা অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখত। ঙ, অধিনায়কের কৌশল: অধিনায়কের উপস্থিত বুদ্ধি, সঠিক রণকৌশল, সর্বোপরি যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করেছে। চ, দৃঢ় মনােবল: দুর্যোগকালীন দৃঢ় মনােবলের অধিকারী অধিনায়করা অধীনস্থদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন এবং সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেন। ছ, চলাচলের গােপনীয়তা: যুদ্ধকালীন চলাচলের গােপনীয়তা রক্ষা অপরিহার্য। উল্লেখ্য, প্রতিটি যুদ্ধেই মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচলের উপর সর্বোচ্চ গােপনীয়তা রক্ষা করা হতাে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড