You dont have javascript enabled! Please enable it!
ভােমরা বাঁধের যুদ্ধ
ভৌগােলিক অবস্থান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় ভােমরা একটি বিওপি ও কাস্টমস্ চেকপােস্ট। ভােমরা সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত। জেলা শহর থেকে ভােমরার দূরত্ব ১৫ কিলােমিটার। ভােমরা একটি স্থলবন্দর। এ বন্দরের উপর দিয়ে একটি রাস্তা সীমানা পেরিয়ে বশিরহাট এবং আরও পরে কলকাতার সাথে যােগাযােগ স্থাপন করেছে। তা ছাড়া বিকল্প যােগাযােগ ব্যবস্থা ইছামতি নদী রাস্তা থেকে ১৫ কিলােমিটার দূর দিয়ে প্রবাহিত, যা দক্ষিণ দিকে বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে সীমারেখা নির্ধারণ করেছে। নদী ও রাস্তার প্রায় আড়াআড়ি এ এলাকায় একটি বন্যা প্রতিরােধ বাধ আছে। এ বাঁধ সীমানা রেখা বরাবর অবস্থিত। রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে এলাকার গুরুত্ব। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভােমরা একটি সাব-সেক্টর ছিল। শত্রু ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের কাছেই এ এলাকা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণগুলাে হলাে: ক, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এ বৃহৎ এলাকায় যােগাযােগের একমাত্র পাকা রাস্তা ভােমরার উপর দিয়ে গেছে। এ রাস্তা দিয়ে সীমানা পেরিয়ে প্রায় ৩ কিলােমিটার দূরে নিজস্ব বাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। এ একই কারণে ১৯৬৫ সালেও এখানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। খ, সড়ক পথের বিকল্প ইছামতি নদীপথ রাস্তার খুবই সন্নিকটে। এ নদীপথ ধরেই মুক্তিযােদ্ধারা ভারত থেকে অস্ত্র, গােলাবারুদ ও অন্যান্য সরঞ্জামসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করতেন। এ বৃহৎ এলাকার মধ্যে ভােমরার এ স্থানই মুক্তিবাহিনীর জন্য ভারত থেকে বাংলাদেশের প্রবেশপথ ছিল। গ, সীমানা বরাবর প্রতিরক্ষা বাঁধ তার আশপাশের সবকিছু থেকে বেশ উঁচু হওয়ায় এ বাঁধ রণকৌশলগতভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এলাকাটি বেশ খােলামেলা হওয়ায় বাঁধের উপর থেকে দূরে পাকিস্তানি বাহিনীর সকল ধরনের গতিবিধি দৃষ্টিগােচর হতাে। তা ছাড়া এ বাঁধ নদী ও সড়ক উভয় পথকেই রণকৌশলগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। এ কারণে। পাকিস্তানি বাহিনী যে-কোনাে মূল্যে এ এলাকা দখল করতে বদ্ধপরিকর ছিল। যুদ্ধের সংগঠন ও অবস্থান ক. পাকিস্তানি বাহিনী: এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি ব্যাটালিয়ন অংশ নিয়েছিল। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে শক্র সংখ্যায় ছিল ২ কোম্পানি (+)। তাদের অবস্থান ছিল সীমান্ত বা প্রতিরক্ষা বাঁধ থেকে প্রায় ৪ কিলােমিটার পূর্ব দিকে। এখানে তারা কোনাে প্রথাগত প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল না বরং আক্রমণে যাওয়ার জন্য সাময়িক প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল। খ, মুক্তিবাহিনীঃ এ যুদ্ধে নিজস্ব বাহিনীর ১টি কোম্পানির অধিক জনবল অংশ নিয়েছিল। কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপটেন সালাহউদ্দিন। এ কোম্পানিতে ছিল প্রধানত ইপিআর, পুলিশ, আনসার এবং এলাকার মুক্তিযােদ্ধারা। মাে. শাহজাহান, যাকে এলাকাবাসী ক্যাপটেন শাহজাহান মাস্টার বলে ডাকেন, তার নিজস্ব বাহিনীকে মুজাহিদ পাটি বলে সবাই জানত। মুজাহিদ পার্টি ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে একই এলাকায় ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। নিজস্ব বাহিনীর প্রতিরক্ষা ছিল বর্ডার লাইন বরাবর এবং বাঁধ ছিল এফডিএল। এ প্রতিরক্ষা ছিল সুনিপুণ রেকি ও সুবিন্যস্ত প্রতিরক্ষা। প্রতিরক্ষা দিনের ২৪ ঘণ্টা দখল। করে রাখা হতাে না বরং স্থানীয় প্রতিরক্ষা এবং আরলি ওয়ার্নিং এলিমেন্ট ঠিক রেখে বাকি প্রতিরক্ষায় পালাক্রমে ডিউটি রাখা হতাে।
বর্ডার পেরিয়ে রাস্তা ধরে প্রায় ৩ কিলােমিটার দূরে খােজাডাঙা নামক স্থানে এক মাদ্রাসায় নিজস্ব বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। যুদ্ধের বিবরণ। ২৭ মে রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টায় পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলার। পরিকল্পনা করে। দক্ষিণ দিকে ইছামতি নদী থাকায় বাকি তিন দিক দিয়ে তারা অগ্রসর হয়। মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর এ আক্রমণের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর ৩টি মেশিনগান এত সঠিকভাবে ও সঠিক জায়গায় স্থাপন করা ছিল যে, এ ৩টি অটোম্যাটিক মেশিনগানই শত্রুর আক্রমণ থামিয়ে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী ৩টি অটোম্যাটিক মেশিনগান নিষ্ক্রিয় করার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। ৩টি মেশিনগান সমগ্র শত্রু বাহিনীর উপর ফায়ার সুইপিং করতে থাকে। শত্রুর আক্রমণ রুখে দেওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধারা ছােটো আকারে পালটা আক্রমণ করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। সকাল আনুমানিক ৬টায় পাকিস্তানি বাহিনী পুনরায় আক্রমণ রচনা করে কিন্তু এবারও মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে দেন। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিপুল পরিমাণ হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক তার ৩ কোম্পানি দিয়েই একের পর এক নানাভাবে আক্রমণে যান কিন্তু কোনােভাবেই মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ভেদ করা সম্ভব হয় নি। প্রায় ১৭ ঘণ্টা যাবৎ এ যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানি সেনারা ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে প্রতিরক্ষার কাছে আসার চেষ্টা করে কিন্তু মুক্তিবাহিনীর শক্ত প্রতিরােধের মুখে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ফলাফল পর্যালােচনা এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচুর হতাহত হয়, আক্রমণকারী ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক আহত হন এবং তাকে চিকিৎসার জন্য পিছনে পাঠানাে হয়। তা ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর ১জন কোম্পানি অধিনায়কসহ আরও ১৩০জন সৈনিক এ যুদ্ধে নিহত এবং শতাধিক আহত হয়। পক্ষান্তরে, তুলনামূলকভাবে তেমন প্রশিক্ষিত ও সুসংগঠিত সামরিকবাহিনী না হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনীর মাত্র ২জন শহিদ এবং ৮জন আহত হন।
এ যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে কোম্পানি অধিনায়ক নিহত হন, তাঁর। মৃত্য ঘটে এফডিএল থেকে প্রায় ৩০০ মিটার সামনে। সবকিছু মুক্তিযােদ্ধাদের চোখের সামনে ঘটে। শক্রর অধিনায়ক নিহত হতে দেখে মুক্তিবাহিনীর মালেক এবং ফারুক নিহত কোম্পানি অধিনায়কের লাশ নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন। এ কাজ করতে গিয়ে ফারুক শহিদ হন। কিন্তু তাঁরা এতই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, শত্রুর বুলেটের তােয়াক্কা না করে মৃতদেহ নিয়ে আসেন। পরে শনাক্ত করা হয় যে, মৃত পাকিস্তানি কোম্পানি অধিনায়কের নাম ক্যাপটেন এজাহার মৃতদেহ পরে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর জয়লাভের কারণ ক, যুদ্ধের সঠিক কারণ: মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন নিজ মাতৃভূমি রক্ষা করার জন্য তারা ছিল আত্মত্যাগী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, যুদ্ধ যখন প্রায় শেষ, ফলাফল নির্ধারিত, এরূপ পর্যায়ে নিজের জীবন দিয়ে শত্রুর অধিনায়কের মরদেহ নিয়ে আসার হয়ত কোনাে কৌশলগত মূল্য নেই, কিন্তু তবুও তারা তা করেছিলেন। করেছিলেন দেশপ্রেম ও শত্রুর উপর তীব্র ঘৃণা থেকে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা: ভৌগােলিক ও রণকৌশলগতভাবে ভােমরা খুব। গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এখানে একই স্থানে ১৯৬৫ সালে এবং ১৯৭১ সালে যুদ্ধ হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশেরই ১৯৬৫ সালে একই অবস্থানে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল। বিশেষ করে মুজাহিদ পার্টি, যারা সক্রিয়ভাবে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ করেছিল। তা ছাড়া একই এলাকার সাধারণ জনগণও যুদ্ধের সাথে পরিচিত ছিল বলে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে সব পর্যায়ে তারা মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে পিছপা হয় নি।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বিরাট অবদান রেখেছিল এবং যথাসম্ভব এ কারণেই ভােমরা যুদ্ধে নিজস্ব হতাহতের সংখ্যা এত কম ছিল। প্রতিরক্ষা অবস্থান নির্বাচন: মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ছিল রণকৌশলগতভাবে আদর্শ। ইছামতি নদীর কারণে দক্ষিণ দিক ছিল শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপদ, পশ্চিমে সীমারেখার উপরে ভারত, প্রতিরক্ষার সম্মুখ ভাগ ছিল বাঁধের উপর, যা থেকে পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব দিকে প্রায় ৩ কিলােমিটার দূর পর্যন্ত সব ধরনের চলাফেরা দেখা যেত অটোম্যাটিক অস্ত্রের অবস্থান: নিজ বাহিনীর অটোম্যাটিকঅস্ত্রগুলাে এমন অবস্থানে সঠিকভাবে স্থাপন করা হয়েছিল যে, তা সম্পূর্ণরূপে কোনােপ্রকার বাধা ছাড়া পুরাে এলাকায় ফায়ার আনতে পারত। তা ছাড়া তাদের অবস্থান এরূপ ছিল যে, শত্রু প্রাণপণে চেষ্টা করার পরও ১টি এমজিও নিষ্ক্রিয় করতে পারে নি। আক্রমণে শত্রু জনবলের অপ্রতুলতা: মুক্তিবাহিনীর ১ কোম্পানির। অধিক জনবলের সুবিন্যস্ত এবং দীর্ঘ প্রস্তুতি সম্পন্ন শক্ত প্রতিরক্ষার উপর শত্রুরা মাত্র ৩ কোম্পানি জনবল নিয়ে আক্রমণ করে, যা যুদ্ধ। শেষে অপ্রতুল বলে প্রমাণিত হয়। তা ছাড়া এ যুদ্ধে শক্রর পর্যাপ্ত আর্টিলারি ও বিমান ফায়ার সহায়তারও অভাব ছিল। উপসংহার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সব যুদ্ধ যখন আমরা শ্রেণিবিভাগ করি, তখন ভােমরা প্রতিরক্ষাকে আমরা মাইনর ব্যাটেল বলি। কিন্তু দেশপ্রেম, সাহস, দক্ষতা বা আত্মত্যাগের যে ইতিহাস এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা রচনা করেছেন, তা কখনাে মাইনর নয়। এ যুদ্ধের সবকিছুই আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযােদ্ধারা ভােমরা বিওপি’র সামনে এ যুদ্ধের শহিদদের উদ্দেশ্যে একটি ছােটো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!