You dont have javascript enabled! Please enable it!

মানিকহারের যুদ্ধ

ভূমিকা

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরােধের সময় গােপালগঞ্জ জেলায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের দৃঢ় প্রতিরােধের একটি অন্যতম উদাহরণ হলাে মানিকহারের যুদ্ধ। মানিকহারের যুদ্ধ মূলত মানিকহার, শসাবাড়িয়া, পাইককান্দি ও উরফি গ্রামে সংঘটিত হয়। মুষ্টিমেয় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈনিক ও ছাত্র-জনতার এ প্রতিরােধ গােপালগঞ্জবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দিনগুলােয় অদম্য সাহস আর অসীম প্রেরণা জুগিয়েছে। ভৌগােলিক অবস্থান মানিকহার, শসাবাড়িয়া, পাইককান্দি ও উরফি গ্রামগুলাে পূর্বে বিলরুট ক্যানেল। (মধুমতি নদীর শাখা) ও পশ্চিমে মধুমতি নদী দ্বারা বেষ্টিত। মানিকহার গ্রামটি গােপালগঞ্জ শহর থেকে ৫ কিলােমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। পাইককান্দি ও ডুমুদিয়া গ্রাম ২টি মানিকহারের যথাক্রমে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। পাইককান্দির উত্তরে সােনাসুর এবং পাইককান্দি ও ডুমুদিয়ার মাঝে উরফি অবস্থিত। মানিকহারের উত্তর-পশ্চিমে শসাবাড়িয়া এবং শসাবাড়িয়ার উত্তরপশ্চিমে ঘােড়াদাই গ্রাম অবস্থিত। ঘােড়াদাই গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে মধুমতি নদী এবং মধুমতির এ অংশেই স্বাধীনতা যুদ্ধের বহুল আলােচিত স্থান তালাঘাট অবস্থিত। মানিকহারের দক্ষিণে মধুপুর গ্রাম অবস্থিত।

মধুপুর গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি থেকেই উৎপন্ন হয়েছে বিলরুট ক্যানাল, যা পরবর্তী সময় মানিকহার ও ডুমুদিয়ার পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মানিকহারের দক্ষিণ-পূর্বে বিলরুট ক্যানেলের পূর্ব পাড়ে মানিকদাহ গ্রাম অবস্থিত মানিকদাহ গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মধুমতি নদীর তীরে। বিখ্যাত মানিকদাহ ঘাট অবস্থিত। সম্পূর্ণ এলাকাটিই নিাঞ্চল এবং মধুমতি নদীর বেশ কয়েকটি শাখা-উপশাখা এলাকাটির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মানিকহার-পাইককান্দি খাল বিলরুট ক্যানেল থেকে উৎপন্ন মধুমতি নদীর একটি উপশাখা, যা মানিকহার ও পাইককান্দির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মধুমতি নদী এ এলাকায় প্রায় ৮০০ গজ প্রশস্ত ছিল। বিলরুট ক্যানাল ৩০০ গজ এবং মানিকহার-পাইককান্দি খাল ৩০-৫০ গজ প্রশস্ত ছিল। গোপালগঞ্জ শহরের পশ্চিমে মধুমতির অপর শাখাটি ৫০০ গজের মতাে প্রশস্ত ছিল। এসব নদনদী বা খালগুলাের গভীরতা সে সময় ন্যূনতম ৬-৮ ফুট ছিল। মুক্তিযুদ্ধে গােপালগঞ্জ জেলা ৮ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধপূর্ব তৎপরতা

পাকিস্তানি সেনাদের অনুপস্থিতিতে মুক্তিবাহিনী মূলত ঐ এলাকার নদীপথগুলাে স্টিমার চলাচল বাধাগ্রস্ত করে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করার পরিকল্পনা করে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা নিমে বর্ণিত অভিযান পরিচালনা করে: তালাঘাটে লঞ্চ ডােবানাে মুক্তিবাহিনী ১৫-১৬ এপ্রিল তালাঘাট এলাকায় মধুমতি নদীতে পাট বােঝাই ৫টি বার্জ ডুবিয়ে দেয়। ঐ ৫টি বার্জ পাট নিয়ে খুলনার দিকে যাওয়ার সময় আক্রমণ পরিচালনা করে। বার্জগুলােকে বহনকারী বিরালা নামের ছােটো জাহাজটিকে উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী নদীপথে প্যাট্রলিংয়ের কাজে ব্যবহার করতে থাকে। গাজী রকেট ডােবানাে ১৮-১৯ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সরকারের অধীনে চাকরিরত বাঙালিদের বহনকারী গাজী রকেট নামের স্টিমারটিকে তালা স্টেশনের অদূরে ডুবিয়ে দেয়। স্টিমারের সকল যাত্রীকে পূর্বেই জাহাজ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় এবং পাকিস্তানি সরকারের পক্ষে চাকরিতে যােগদান করবে না, এরূপ অঙ্গীকার করিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়। গােপালগঞ্জ শহরে অভিযান ২৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী গােপালগঞ্জ শহর জ্বালিয়ে দেয়। তারপর পাকিস্তানি প্রশাসনকে অচল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এবং অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ৩০ এপ্রিল রাতে মুক্তিবাহিনী গােপালগঞ্জ শহরে অভিযান চালায়। এ অভিযানের সময় তারা মুসলিম লীগের ২-৪জন নেতা এবং গােপালগঞ্জ মহকুমার তদানীন্তন সেকেন্ড অফিসারকে (অবাঙালি) হত্যা করে। অতঃপর গােপালগঞ্জ জেলখানা ভেঙে বন্দিদের মুক্ত করে এবং বেশ কয়েকটি অস্ত্র উদ্ধার করে। যুদ্ধের সংগঠন ক. পাকিস্তানি বাহিনী: সৈন্য সংখ্যা ১টি কোম্পানি (প্রশিক্ষিত সৈনিক); অস্ত্র (১টি পদাতিক কোম্পানির জন্য প্রাধিকৃত অস্ত্র) এবং জলযান (২টি মাঝারি আকারের লঞ্চ)। মুক্তিবাহিনী: সৈন্য সংখ্যা ২টি কোম্পানি পদাতিক (সৈন্য, ইপিআর ও স্থানীয় জনসাধারণের সমন্বয়ে গঠিত); অস্ত্র (৪০-৪৫টি .৩০৩ রাইফেল, ৩-৪টি চাইনিজ রাইফেল, ১টি এলএমজি); জলযান (১টি প্যাট্রল বােট)।

যুদ্ধের অবস্থান

ক. পাকিস্তানি বাহিনী: সার্কেল অফিস, গােপালগঞ্জ (১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে)।
খ. মুক্তিবাহিনী: মানিকহার স্কুল (১৯৭১ সালের ১ মে থেকে)।

যুদ্ধ পরিকল্পনা

ক. পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় দালাল মারফত মানিকহার গ্রামে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের অবস্থান শনাক্ত করার পর ১৯৭১ সালের ৩ মে ৩টায় মানিকদাহ ঘাট থেকে ২টি লঞ্চে করে প্রথমে মধুমতি নদী এবং পরে বিলরুট ক্যানাল ধরে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পথিমধ্যে মধুপুরে ১৫-২০জনের ১টি দল নামায়। তারপর ১টি লঞ্চ মানিকহার লঞ্চঘাটে এবং অন্যটি ডুমুদিয়া লঞ্চঘাটে থামায়। মধুপুর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর দলটি উত্তরে মানিকহারের দিকে রওনা হয়। মানিকহার লঞ্চঘাট থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ৫০-৬০জনের ১টি দল মানিকহার গ্রামে প্রবেশ করে। ডুমুদিয়া লঞ্চঘাট থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ১৫-২০জনের ১টি দল তুদবাটি হয়ে সােনাপুর ও পাইককান্দির দিকে রওনা হয়। মুক্তিবাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনীর আকস্মিক আগমন সংবাদে কিছুটা হতভম্ব মুক্তিবাহিনী তাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প মানিকহার স্কুল থেকে পশ্চাদপসরণ করে মানিকহার-পাইককান্দি খালের পশ্চিম পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করে। ১টি কোম্পানি মানিকহার ও শসাবাড়িয়া গ্রামে এবং অপর কোম্পানিটি পাইককান্দি ও সােনাপুর গ্রামে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। যুদ্ধের বিবরণ পাকিস্তানি বাহিনীর যে দলটি মানিকহার গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়, তারা মানিকহার-পাইককান্দি খালের পূর্ব পাড়ে পৌছালে উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হয়। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যবধান হয়ে দাঁড়ায় শুধু ৩০ গজ প্রশস্ত মানিকহার-পাইককান্দি খালটি। মুক্তিযােদ্ধা নায়েক রউফ ১টি এলএমজি দিয়ে তার প্রতিরক্ষার ডান পাশ রক্ষা করতে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনী কাঠের সেতুর উপর দিয়ে খাল অতিক্রমের চেষ্টা করলে তিনি ৩-৪জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন। অতঃপর অসীম সাহসী এ যােদ্ধার অবস্থান টের পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী তার উপর এলএমজি ফায়ার করে। নায়েক রউফ হাতে গুলিবিদ্ধ হন। নায়েক রউফ আহত হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষার ডান পাশ দুর্বল হয়ে পড়ে, যা মুক্তিযােদ্ধা কোম্পানিটিকে বিচলিত করে তােলে এবং তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

মুক্তিবাহিনী ঐ এলাকা থেকে পশ্চাদপসরণের পর মধুপুর থেকে আগত পাকিস্তানি বাহিনীর দলটি তাদের মূল দলের সাথে একত্র হয়ে পাইককান্দির দিকে রওনা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর যে দলটি ডুমুদিয়ায় অবতরণ করে, তারাও তুবাটি হয়ে পাইককান্দি-সােনাসুরের কাছে এসে পড়ে। উভয় পক্ষের মধ্যে গােলাগুলির এক পর্যায়ে পাইককান্দি-সােনাসুরে। অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ডান পাশের মুক্তিযােদ্ধা কোম্পানির প্রত্যাবর্তনের সংবাদে পিছু হটতে শুরু করে। মানিকহার এলাকা থেকে পশ্চাদপসরণ করে গােপালগঞ্জের মুক্তিযােদ্ধারা পুনরায় গােপীনাথপুর হাই স্কুল ও রামদিয়া বাজারে সমবেত হয় এবং প্রশিক্ষণের তাগিদে বিভিন্ন সময়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে সৃষ্ট গােপালগঞ্জে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাথমিক প্রতিরােধের সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধের ফলাফল মানিকহারের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী মূলত নিম্নবর্ণিত কারণে পরাজয় বরণ করে: ক. পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব: মুষ্টিমেয় কিছু সেনা, ইপিআর ও আনসার সদস্য ব্যতীত অন্য মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধের তেমন কোনাে প্রশিক্ষণ ছিল মুক্তিযােদ্ধারা মূলত প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে মানিকহারে ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। ফলে যুদ্ধের পরিস্থিতি তাদের বিচলিত করে তুলেছিল এবং তারা বড় ধরনের প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সমর্থ ছিল তা ছাড়া পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শক্রর যুদ্ধকালীন কলাকৌশল তাদের মনােবল ভেঙে নেয়। ফলে তারা এ যুদ্ধে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে নি।

পাপ্ত অস্ত্র ও গােলাবারুদের অভাব: মানিকহারের যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট ৩-৪টি চাইনিজ রাইফেল ও একটি মাত্র এলএমজি ব্যতীত অন্য কোনাে কার্যকরী অস্ত্র এবং পর্যাপ্ত গােলাবারুদ থাকায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। গ, অগ্রিম তথ্যসংগ্রহ: মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের সংবাদ সময়মতাে না পাওয়ায় সঠিক সময়ে যুদ্ধের জন্য সঠিক অবস্থান গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে, পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় দালালদের সহায়তায় মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পের সঠিক অবস্থান জানতে সমর্থ হয়, যা তাদের অভিযানে সহায়তা করে। উপসংহার মানিকহার যুদ্ধের ফলাফল উল্লেখযােগ্য কিছু নয়। কিন্তু এ যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে বিশেষ গুরুত্ববহ। প্রশিক্ষিত সৈনিক, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং তথ্যের নিশ্চিত সরবরাহ একটি যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণে যে। নিয়ামক ভূমিকা রাখে মানিকহারের যুদ্ধ থেকেই সে শিক্ষাই পাওয়া যায়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!