বেনাপােলের যুদ্ধ
ভৌগােলিক অবস্থান বেনাপােল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে যােগাযােগ স্থাপনকারী একটি সীমান্ত শহর। আশপাশের অন্যান্য গ্রামের মাঝখানে এ ক্ষুদ্র বন্দর শহরটি মূলত যশাের-বেনাপােল সড়ককে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। কয়েকটি বাণিজ্যিক দালান, বাজার, ছােটো-বড়াে দোকানপাট, বিডিআর কোম্পানি সদর দপ্তর, কাস্টমস্ অফিস এলাকা এবং কয়েকটি স্কুল ও মাদ্রাসা নিয়ে গড়ে উঠেছে এ শহর। বেনাপােল শহরটি যশাের জেলার শার্শা থানার অন্তর্গত। ছােটো শহরটি ছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতাে এ এলাকাটিও অনেক ছােটো ছােটো গ্রাম নিয়ে গঠিত। প্রতিটি গ্রামের চারদিকে যথেষ্ট গাছপালা রয়েছে, যা যে-কোনাে ধরনের স্থলবাহিনীর প্রতিরক্ষা ও আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য সহায়ক। শহরটি চারপাশের গ্রামের আবাদি জমি ও জলাভূমি থেকে বেশ খানিকটা উঁচু। বেনাপােল হতে প্রধান সড়ক ধরে প্রায় ১ কিলােমিটার পূর্বে কাগজপুকুর গ্রাম অবস্থিত। কাগজপুকুর গ্রামটি মূলত রাস্তার উত্তর দিকে অবস্থিত রাস্তার দক্ষিণে রয়েছে গয়রা গ্রাম। কাগজপুকুর হতে ১ কিলােমিটার পূর্বে শার্শা থানা সদর ও উপজেলা অফিস অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধে বেনাপােল এলাকার গুরুত্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাফল্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের আমাদের মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ভারতের এ সহায়তা মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে এসে পৌছেছে বিশেষত বেনাপােলস্থ বাংলাদেশভারত সীমান্ত দিয়ে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী যদি বেনাপােলে তাদের শক্ত অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারত, তবে হয়ত ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন কষ্টকর হতাে। ১৮ এপ্রিল বেনাপােলে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সদর দপ্তর স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকে এটি ব্যবহৃত হতাে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও ব্রিটিশ এমপি মি, ডগলাস ম্যানের আলােচনা কেন্দ্ররূপে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান। সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সমন্বয় কেন্দ্র হিসেবে বিশেষত বেনাপােলকে ব্যবহার করতেন। তা ছাড়া মেজর আবু ওসমান চৌধুরী মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ, রসদ এবং প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আইজি’র সাথে সরাসরি যােগাযােগ করতেন বেনাপােলের মাধ্যমে তাই এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সফলতার জন্য বেনাপােল যুদ্ধের ভূমিকা ব্যাপক ছিল।
যুদ্ধের সংগঠন
বিভিন্ন দলিল, প্রবন্ধ ও স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধার সাক্ষাঙ্কার থেকে বেনাপােল যুদ্ধের সংগঠন সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্য পাওয়া যায়: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ২টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন (১২ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নসহ) এবং ২টি আর্টিলারি ব্যাটারি। খ, মুক্তিবাহিনী: মুক্তিবাহিনী অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ক্যাপটেন হাফিজ উদ্দিন ও উপ-অধিনায়ক নায়েব সুবেদার মুজিবুল হকসহ ২০০জন সদস্য; ইপিআর অধিনায়ক। সুবেদার মােশারফ হােসেন এবং ১৫০জন সদস্য; মুজাহিদ (শার্শ। কোম্পানি) অধিনায়ক হাজি মশিউর রহমান ও উপ-অধিনায়ক সুবেদার কদর আলী এবং ১৩০-১৫০জন সদস্য; আনসার অধিনায়ক রবিউল হােসেন এবং ১০০-১৫০জন সদস্য। অন্ত্র ও সরঞ্জাম। বেনাপােলস্থ কাগজপুকুর এলাকায় মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর প্রতিরক্ষা। ব্যুহের প্রথাগত প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্রশস্ত্র এবং সাজসরঞ্জাম যথেষ্ট ছিল না। তা। ছাড়া প্রতিরক্ষায় যােগাযােগের জন্য কোনাে ওয়ারলেস বা ফিল্ড টেলিফোন ছিল। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র ও সরঞ্জাম ছিল নিম্নরূপ: ক. ৪টি ৩ ইঞ্চি রকেট লঞ্চার খ, ২/৩টি মর্টার গ, ১/২টি এমজি ঘ, ইপিআর সৈনিকদের .৩০৩ রাইফেল ৬. মুজাহিদ ও আনসারদের কোনাে অস্ত্র ছিল না। তারা ইপিআর-এর অস্ত্র ব্যবহার করতেন।
অবস্থান
ক, পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনী যশাের সেনানিবাস দখল করার পর ১৬ এপ্রিল অপরাহ্নে ঝিনাইদহ দখলে আনে। পরবর্তী সময় মাগুরায় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। ধীরে ধীরে তারা মুক্তিবাহিনীর নতুন সদর দপ্তর বেনাপােলের দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানি বাহিনী সাধারণ এলাকা নাভারনে সমবেত হয়। মুক্তিবাহিনী: মুক্তিবাহিনীর মূল প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল মূলত কাগজপুকুর, গয়রা ও কাগমারা গ্রামে। বিদ্রোহ করে আসা ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দলটি ক্যাপটেন হাফিজের সঙ্গে কাস্টমস অফিস এলাকায় রিজার্ভ হিসেবে ছিল। ইপিআর, মুজাহিদ ও আনসারের সমন্বয়ে তৈরি কোম্পানিগুলােকে সামনে রেখে প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করা হয়েছিল। বেনাপােল-যশাের সড়কের বাম দিকে। কাগজপুকুর গ্রামে বাম সম্মুখ এবং বাম গভীর কোম্পানি বা প্ল্যাটুন এবং কাগমারী ও গয়রা গ্রামে ডান সম্মুখ ও ডান গভীর কোম্পানি বা প্লাটুন নিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি হয়েছিল। গয়রা গ্রামের ডান পাশের খালের কাছে ১টি স্ট্যান্ডিং প্যাট্রল ছিল। প্রতিরক্ষার মধ্যভাগে পাকা রাস্তার বামে বর্তমান শহিদ স্মৃতি সরণির কাছে একটি আমগাছের নিচে রাস্তার দিকে মুখ করে ১টি আরআর বসানাে হয়েছিল। রেললাইনের বাম দিকে গুমটি ঘরের ছাদের উপর ১টি এমজি বসানাে হয়েছিল। ২টি মর্টারের ১টি রেললাইনের ডানে এবং অপরটি পাকা রাস্তার উপর ছিল।
যুদ্ধ পরিকল্পনা
ক, পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনী তীব্র গতিতে অগ্রাভিযান পরিচালনা করে যশাের জেলার নাভারন পর্যন্ত নিজেদের দখলে নিয়ে আসে। কিন্তু নাভারনের পরবর্তী এলাকা অর্থাৎ কাগজপুকুর থেকে বেনাপােল পুরােটাই ছিল মুক্তিবাহিনীর দখলে। পাকিস্তানি বাহিনীর পরিকল্পনা ছিল আধুনিক ও ভারী অস্ত্র দ্বারা অতর্কিত আক্রমণ পরিচালনা করে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেঙে দেওয়া এবং বেনাপােল বন্দরের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপনের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে সবরকমের সাহায্য ও সহযােগিতার পথ বন্ধ করা। মুক্তিবাহিনী: সাধারণ এলাকা কাগজপুকুর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর। প্রতিরক্ষা অবস্থানের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাগজপুকুর ও গয়রা এলাকায় ১টি ইপিআর, কোম্পানি ১টি আনসার কোম্পানি, ১টি মুজাহিদ কোম্পানির সমপরিমাণ জনবল নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করা হয় এবং ক্যাপটেন। হাফিজের নেতৃত্বে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সংগঠিত (যশাের সেনানিবাস হতে আগত) প্রায় ১৫০জন সৈন্যের ১টি রিজার্ভ বাহিনী বেনাপােলের কাস্টম্স কলােনির দক্ষিণ পাশে অবস্থান গ্রহণ করে যুদ্ধের বিবরণ নাভারন রেইড। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া গ্র্যান্ড ট্রাংক রােড ধরে হাজার হাজার উদ্বাস্তু নরনারী বেনাপােল সীমান্ত দিয়ে ভারতের দিকে যাচ্ছিল।
উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যায় যে, পাকিস্তানি বাহিনীর গােলন্দাজের একটি অংশ নাভারনে ঘাঁটি গেড়েছে। তাদের অবস্থান, গতিবিধি ও লােকবল সম্পর্কে পুরােপুরি খোঁজখবর নেয়ার পর ক্যাপটেন হাফিজ পাকিস্তানি আর্টিলারি গান পজিশনের উপর রেইড করার পরিকল্পনা করেন। ২১ এপ্রিল ২০জন সৈনিক নিয়ে গঠিত রেইড পাটিকে ব্রিফ করেন রেইড অধিনায়ক ক্যাপটেন হাফিজ। হালকা অস্ত্র এবং ১টি আরএল ও ১টি মর্টার সজ্জিত রেইড পার্টিকে নিয়ে রাত ১০টার সময় অধিনায়ক নিজ অবস্থান কাগজপুকুর থেকে প্রায় ৮-১০ কিলােমিটার পূর্বে নাভারনের উদ্দেশ্যে। রওনা হন এবং নাভারনের সামনে বেতনা খাল পেরিয়ে পুরানবাজার পাটের গুদামের কাছে শক্রর গান পজিশনের উপর সফল রেইড পরিচালনা করেন। এতে ১০জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ১৫জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে হাবিলদার মতিন শত্রুর বুলেটে আহত হন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী রেইড পার্টির অবস্থান জানার জন্য ইলুমিনেটিং শেল ফায়ার করে, ফলে সম্পূর্ণ এলাকা আলােকিত হয়ে যায়। রেইড শেষ করার পর দ্রুত রেইড পার্টি নিজ প্রতিরক্ষা অবস্থান কাগজপুকুরে ফিরে আসে। রেইড পার্টিকে ধাওয়া করে পাকিস্তানি বাহিনী পােতাপাড়া, লাউতলা এলাকা পর্যন্ত চলে আসে এবং কয়েকজন সন্দেহভাজন বাঙালিকে হত্যা করে। পরদিন ভারতীয় সিগন্যাল কোর পাকিস্তানি বাহিনীর রেডিও মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে জানতে পারে যে আগের দিন রাতে রেইডের ফলে একটি কামানের সাইট নষ্ট হয়ে যায় এবং কামানটি অকেজো হয়ে পড়ে।
মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি ব্যাটালিয়ন শার্শা থেকে পােতাপাড়া হয়ে লাউতলা দিয়ে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। পথিমধ্যে তারা লাউতলার আমবাগানে তাদের সমাবেশ এলাকা করে এবং আরও সামনে এসে গ্রামের শেষ ভাগে সংগঠিত করে। শক্রর আগমনের পথে গয়রা খাল এলাকায় অবস্থিত ১টি স্ট্যান্ডিং প্যাট্রল সর্বপ্রথম শত্রুর উপর ফায়ার আনে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ কিছু সময়ের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী পালটা। ফায়ার করে এবং তাদের পিছু ধাওয়া করে। মুক্তিবাহিনীর কেউ কেউ ধরা পড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহিদ হন। ২৩-২৪ এপ্রিল ভাের ৪টা থেকে প্রচণ্ড আর্টিলারি গােলা বর্ষণের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী কাগজপুকুর প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর হামলা পরিচালনা করে। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের এ হামলায় মেইন রােড ব্যবহার না করে যশাের-বেনাপােল সড়কের উত্তর দিকে পান্থপাড়া, ভুজতলা এবং দক্ষিণ দিকে অবস্থিত গয়রা, কাগমারা এলাকাগুলাে দিয়ে দুই দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ পরিচালনা করে। মূলত উত্তর দিকের পান্থপাড়া এলাকা থেকে প্রথমে তারা গ্রুপ-অ্যাটাক করে এবং দক্ষিণ দিক থেকে পরিকল্পিত আক্রমণ করে। কাগজপুকুর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর বামের প্রতিরক্ষা অবস্থান প্রায় কোনােরকম প্রতিরােধ স্থাপন না করেই পিছু হটতে বাধ্য হয়, কিন্তু ডানের প্রতিরক্ষা অবস্থান প্রাকৃতিক সুবিধা এবং আড়াল থাকার কারণে মােটামুটি সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে।
কাগজপুকুর বাস স্ট্যান্ডের দক্ষিণ দিকে রেলওয়ে সিগন্যালম্যানের গুমটি ঘরের উপরেই ছিল ১টি এমজি। এ ভাইটাল পজিশন থেকে এমজি নিয়ে এমজিম্যান যখন পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করছিল, তখন নায়েব সুবেদার মুজিবুল হক সেখানে উপস্থিত হন এবং এমজিম্যানের কাছ থেকে এমজি ছিনিয়ে নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে অগ্রগামী শত্রুর উপর ফায়ার করতে থাকেন। রেলওয়ে সিগন্যালম্যানের গুমটি ঘরের অবস্থান ছিল কিছুটা উঁচু জায়গায়, যার কারণে নায়েব সুবেদার মুজিবুল হক উঁচু অবস্থানে থেকে অগ্রগামী শত্রুর উপর ফায়ার করতে সুবিধা পান। যুদ্ধের এ অবস্থায় মেজর ওসমান তাঁর ১টি ১ টন ডজ গাড়িতে করে ৩ ইঞ্চি মর্টারগুলাে পাঠিয়ে দেন যুদ্ধরত সৈনিকদের ফায়ার সহায়তা প্রদানের জন্য। তারা কিছুটা অগ্রসর হয়ে সুবিধাজনক স্থানে পজিশন নিয়ে শত্রুর ওপর গােলা বর্ষণ করতে থাকেন। চতুর হানাদার বাহিনী ইপিআর-এর পােশাক পরে ভাের ৬টায় মুক্তিবাহিনীর দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করে। তাদের এ চাল। মুক্তিবাহিনী ধরতে ব্যর্থ হয়। কাছাকাছি আসার পর মুক্তিবাহিনী তা বুঝতে পারে এবং পালটা আক্রমণ চালায়। এদিকে নায়েব সুবেদার মুজিবুল হক একটি মাত্র এমজি দিয়ে তীব্র ফায়ারের মাধ্যমে শক্রর অগ্রযাত্রা প্রায় ব্যাহত করে দেয়। কিন্তু যেহেতু এমজির অবস্থানটি অন্যান্য অবস্থান থেকে কিছুটা দূরে ছিল, সে জন্য মুজিবুল হক শক্রর চতুরতা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন। মুক্তিবাহিনীর এ প্রতিরক্ষা অবস্থানে কারাে সাথে কারাে যােগাযােগ করার জন্য কোনাে ফিল্ড টেলিফোন বা ওয়্যারলেস ছিল না, যার ফলে কখন, কোথায় কী ঘটছে সে ব্যাপারে সবাই অজ্ঞ ছিল।
মুজিবুল হকের ফায়ারে যখন শত্রু সেনা প্রায় বিধ্বস্ত, তখন শত্রুর প্রায় ১ প্লাটুন সেনা ইপিআর-এর পােশাক পরে এমজি পজিশনের দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হয়। নায়েব সুবেদার মুজিবুল তাদের নিজস্ব বাহিনী মনে করে তাদের ওপর ফায়ার করা থেকে বিরত থাকেন। শত্রু আরও কাছাকাছি এলে তিনি বুঝতে পারেন, কিন্তু ততক্ষণে যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়। ঝাকে ঝাকে বুলেট এসে বীর মুক্তিযােদ্ধা নায়েব সুবেদার মুজিবুল হকের দেহ ঝাঝরা করে দেয়। পাশে থাকা প্রকৃত এমজিম্যান অলৌকিক উপায়ে বেঁচে যান এবং পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৫০জন এবং মুক্তিবাহিনীর ১৫জন শহিদ হন। নায়েব সুবেদার মুজিবুল হকের বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মুজিবুল হকের মৃত্যুর সাথে সাথে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর মর্টার বাহিনী তাদের মর্টার গুটিয়ে গাড়িতে করে পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করে, কিন্তু অল্প দূরে শত্রু সৈন্যদের অবস্থান দেখতে পেয়ে ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাস্তার আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে পালিয়ে যান। উপায়ান্তর না দেখে মটার বাহিনীর অধিনায়ক সুবেদার মােমিনুল হকও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেন। গাড়ি ও মর্টার শত্রুর হস্তগত হয়।
নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান
কাগজপুকুর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পশ্চাদপসরণ করে মুক্তিবাহিনী প্রথমে কলােনির পিছনে আমবাগানে সমবেত হয়। তারপর নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তােলে। বেনাপােল সীমান্তের কাছাকাছি কাস্টমস কলােনির ঠিক পিছনেই এবার প্রতিরক্ষায় সামনে থাকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানি। বেনাপােল চেকপােস্টকে ১ মাইল পিছনে রেখে দান প্রতিরক্ষা ব্যুহ স্থাপন করা হয়। এপ্রিলের শেষ ৩ দিন এবং মে মাসে সহাবু” সপ্তাহে প্রতিদিন নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর পাকিস্তানি বাহিনী ক্ষেত্রে ব্যয়িতা নিয়ে বার বার। আক্রমণ চালায়, কিন্তু তাদের প্রতিটি আক্রমণই ঘণ্ডীয়-পর্যবসিত হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী ইত্যবসরে দেশের প্রায় সমস্ত প্রধান শহর ও সীমান্ত চৌকিগুলাে দখল করে ফেললেও বেনাপোল সীমান্তের কাছাকাছি ২ বর্গমাইল এলাকা ছিল শত্রুমুক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী বার বার চেষ্টা করা সত্ত্বেও ঐ ২ বর্গমাইল এলাকা দখল করতে পারে নি। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা কাগজপুকুর আক্রমণে সাফল্য অর্জনের পর পাকিস্তানি বাহিনী কাগজপুকুর এলাকায় পুনরায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। তাদের মূল অবস্থান ছিল আমড়াখালী, যা কাগজপুকুর থেকে ২ কিলােমিটার পূর্বে। বেনাপোেল শহরের একটি স্কুলে তারা একটি স্ট্রং পয়েন্ট গড়ে তােলে। ত্ৰিমনি সামলাগাছিতে অবস্থান নেয় আর্টিলারি গান।
যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা মে মাসের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বেনাপােল মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। তখন প্রতিদিন দলে দলে সাংবাদিকেরা আসত কলকাতা থেকে। বিদেশি সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার চেকপােস্টে এলে বাংলাদেশ সরকার সদ্য গঠিত ইমিগ্রেশন বিভাগ তাদের পাসপাের্টে এন্ট্রি সিলমােহর বসিয়ে দিত। বিবিসি’র প্যানারােমা অনুষ্ঠানে মেজর ওসমান ও ক্যাপটেন হাফিজের। সাক্ষাৎকার প্রচার করা হলে দেশবাসীর মাঝে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। ১৮ মে প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী মুক্ত এলাকা পরিদর্শনে আসেন। সকল পদবির সদস্যদের সাথে মতবিনিময় করেন এবং সারা দেশের অন্যান্য সেক্টরের যুদ্ধাবস্থার খোঁজখবর জানান এবং ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ৭০০ সৈনিকের পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়নরূপে গড়ে তােলার নির্দেশ দেন। অতঃপর ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বেনাপােল থেকে ময়মনসিংহে ‘জেড’ ফোর্সের সাথে যােগদান করে। মেজর ওসমান তার বাহিনীকে ইপিআর, মুজাহিদ, আনসার, পুলিশ ও কিছু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক দিয়ে পুনর্বিন্যাস করে ৭টি কোম্পানিতে বিভক্ত করেন এবং ৭জন অধিনায়কের নেতৃত্বে সীমান্তবর্তী ৭টি এলাকায় ঘাঁটি তৈরি। করেন এবং সম্মুখযুদ্ধ পরিহার করে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ শুরু করেন। শিক্ষণীয় বিষয়। ক, যােগাযােগ ব্যবস্থা: যে-কোনাে যুদ্ধ সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য সুষ্ঠু যােগাযােগ ব্যবস্থা অপরিহার্য। কাগজপুকুরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় মুক্তিবাহিনী কোনোরকম ফিল্ড টেলিফোন বা ওয়্যারলেস সেট ব্যবহার করতে পারেনি -র কারণে একটি সমন্বিত প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে আ Reinfor করা সম্ভব হয় নি।
শত্রু পক্ষে রক্তযােদ্ধাদ্রেক কৌশল: পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু অংশ যুদ্ধের আন্তর্জাতিক নিয়ম ভঙ্গ করে ইপিআর-এর পােশাক পরে মুক্তিবাহিনীর খুব কাছে চলে আসে এবং ধূর্ততার সাথে তারা বিস্ময় অর্জন করতে সক্ষম হয়। অতএব, যে-কোনাে যুদ্ধে শত্রুর সবরকম গতিবিধির উপর সর্বদা কঠোর নজর রাখতে হবে। সংরক্ষিত সৈন্যসামন্তেরর অপ্রতুলতা: যদিও বেনাপােলের যুদ্ধে ১ কোম্পানি সৈন্য রিজার্ভ ছিল, তবুও প্রয়ােজনের সময় তা ছিল নিতান্ত অপ্রতুল অপর্যাপ্ত অস্ত্র ও গােলাবারুদ: কাগজপুকুর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনীর পিছু হটার অন্যতম কারণ হলাে অপ্রতুল অস্ত্র ও গােলাবারুদ। ৬. দেশের প্রতি মমত্ববােধ: দেশের প্রতি মমত্ববােধের জন্যই নায়েব সুবেদার মজিবুল হকের মতাে বাংলার বীর সন্তানেরা নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। যুদ্ধের একেবারে প্রথম অবস্থায় কোনােরকম সুসংগঠিত প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই তারা শত্রুর আক্রমণ মােকাবিলা করেছেন বীরদর্পে, যা আমাদের কাছে দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। পাকিস্তানি বাহিনীর রণকৌশল এবং দৃঢ় মনােবল: চ. পাকিস্তানি বাহিনীর রণকৌশল এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনােবলের কারণে এ যুদ্ধে তারা জয়লাভ করে। প্রতিরক্ষার উত্তর দিক থেকে তারা প্রথম আক্রমণ করলেও মূল আক্রমণ করে দক্ষিণ দিক থেকে। অনেক হতাহতের পরও তারা আক্রমণ অব্যাহত রেখে মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। যদিও তারা ইপিআর-এর পােশাক পরে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড