বিষয়খালীর যুদ্ধ
ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকের প্রতিরােধ যুদ্ধগুলাের মধ্যে ঝিনাইদহ জেলার বিষয়খালীর যুদ্ধ ছিল অন্যতম। এটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরােধের ঘটনা। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল বিষয়খালী বাজারে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
ভৌগােলিক অবস্থান
যশাের শহর থেকে ৩৮ কিলােমিটার উত্তরে এবং ঝিনাইদহ থেকে ৮ কিলােমিটার দক্ষিণে ঢাকা-যশাের মহাসড়কে বিষয়খালী অবস্থিত। এলাকাটি খােলা ও সমতল। বর্তমানে এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ। এ এলাকার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে বেগবতী নদী চলে গেছে এবং নদীর ওপর দণ্ডায়মান ব্রিজটি কৌশলগত দিক দিয়ে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। যুদ্ধের সংগঠন ক. মুক্তিবাহিনী: চুয়াডাঙ্গার ৪ নম্বর উইং ইপিআর-এর উইং অধিনায়ক মেজর ওসমান (পরবর্তী সময় ৮ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক) মুক্তিযােদ্ধাদের বিক্ষিপ্ত প্রতিরােধকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। এরূপ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ২জন অসামরিক অফিসার। যথাক্রমে মেহেরপুরের এসডিও (মহকুমা প্রশাসক) তৌফিক -ঈএলাহি চৌধুরী এবং ঝিনাইদহের এসডিপিও (মহকুমা পুলিশ অফিসার) মাহবুব উদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। মেজর ওসমান ৭ এপ্রিল এক বিশেষ আদেশে ঐ ২জন অফিসার এবং ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক শফিকউলাহকে ‘ক্যাপটেন’ পদে অভিষিক্ত করেন। বস্তুত এরাই ঝিনাইদহ ও বিষয়খালী এলাকায়। মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করেন। পাকিস্তানি বাহিনী: ১৯৭১ সালের মার্চে ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের প্রায় ১৬০জন সৈন্য কুষ্টিয়া শহরের পুলিশ স্টেশন, পুলিশ লাইন, ওয়্যারলেস স্টেশন ও জেলা স্কুলে অবস্থান নেয়। ৩০ মার্চ মেজর ওসমানের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা এদের অবস্থানে আক্রমণ চালান। ৩১ মার্চের মধ্যে ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানিটি সম্পূর্ণভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে ঝিনাইদহের দিকে পলায়ন করে। পরে এদের অনেকেই শৈলকুপা ও ঝিনাইদহ এলাকায় অসামরিক জনগণের দ্বারা নিহত অথবা বন্দি হয়। এমতাবস্থায় কুষ্টিয়া শহর নিয়ন্ত্রণে। আনার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী যশাের সেনানিবাস থেকে ১টি পদাতিক কোম্পানি প্রেরণ করে। এ কোম্পানিটিই ১ এপ্রিল বিষয়খালীতে মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মুখীন হয়।
যুদ্ধ পরিকল্পনা
ক, পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশন যশাের সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। ১ এপ্রিল একটি সুসজ্জিত পদাতিক কোম্পানিকে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়। সামরিক কনভয়ে যাত্রারত এ বাহিনীর সংগঠিত প্রতিরােধ যুদ্ধ সম্পর্কে কোনাে পূর্বধারণা ছিল না। মুক্তিবাহিনী: মুক্তিবাহিনী পূর্বেই বিষয়খালীর রণকৌশলগত গুরুত্ব অনুধাবন করে। মেজর ওসমান কয়েকজন স্থানীয় আনসার সদস্যকে পূবেই সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য নির্ধারিত স্থানে বাংকার অবস্থান দেখিয়ে দেন। ৩১ মার্চের মধ্যেই আনসার সদস্যগণ স্থানীয় জনগণের সহায়তায় যথাস্থানে বাংকারগুলাে খনন করেন। ঝিনাইদহ ও মাগুরা হতে ১ এপ্রিল সকালে ৩টি ট্রাকে করে যশাের সেনানিবাস হতে আগত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক, ইপিআর-এর সদস্য, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের প্রশিক্ষক এবং মহকুমা আনসার বাহিনীর সদস্যরা বিষয়খালীতে অবস্থান নেন। তাদের সাথে যােগ দেন। এলাকার বিপুল সংখ্যক জনসাধারণ বেগবতী নদীর উপরে ব্রিজটি আংশিকভাবে ভেঙে ফেলা হয়। উপরন্তু এর দক্ষিণ দিকে রাস্তার উপর গাছ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয় যুদ্ধের বিবরণ। ১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার মূলত মুক্তিযােদ্ধাদের চতুর্মুখী ফায়ারে বেগবতী নদীর দক্ষিণ তীরে পাকিস্তানি সেনারা বাধাগ্রস্ত হয়। পাকিস্তানি সেনারা এ স্থানকে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি শক্তিশালী অবস্থান হিসেবে ধরে নেয়।
সকাল আনুমানিক ১০টায় পাকিস্তানি সেনারা আধুনিক সমরাস্ত্রে ফায়ার চালালে মুক্তিযােদ্ধারা। ৩০৩ রাইফেল দিয়েই তাদের বাধা দেন। সারাদিনই যুদ্ধ চলতে থাকে। বিকাল আনুমানিক ৪টায় পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধ বন্ধ করে দেয় এবং হতাহতদের বহন করে যশাের সেনানিবাসে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। এ সংঘর্ষে বহু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। তবে তাদের সঠিক সংখ্যা জানা যায় নি। কনভয়টি ফেরার পথে যাবতীয় লাশ বহন করে নিয়ে যায়। তবে সন্ধ্যায় এলাকার লােকজন নদীর দক্ষিণ পাড়ে রক্তের ছাপ ও লাশ টেনে নেয়ার চিহ্ন দেখে বিপুল সংখ্যক হতাহতের অনুমান করে। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৬জন শহিদ হন। ব্রিজের পূর্ব দিকে ইপিআর সদস্য শামসুল মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদতবরণ করেন। এলাকার পশ্চিম দিকের সর্বর্ডানের মরিচায় একই সাথে ৪জন শহিদ হন। তা ছাড়া আরও ১জন শহিদ হন। এ যুদ্ধে শহিদ তৎকালীন ছাত্র গােলাম মােস্তফার (এম এন এ ইকবাল আনােয়ারুল ইসলামের পুত্র) নামে বর্তমানে শহিদ মােস্তফা উচ্চবিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়। স্কুলের পশ্চিম দিকে আজও মােস্তফাসহ সবার কবর রয়েছে। প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ পাকিস্তানি সেনারা আরও অস্ত্রশস্ত্র ও জনবলসহ ১৫ এপ্রিল পুনরায় বিষয়খালীর দিকে অগ্রসর হয়। এবার মুক্তিবাহিনীর পক্ষে তাদের থামানাে সম্ভব হয় নি। ফলে বিষয়খালীর ব্রিজ দখল করে পাকিস্তানি সেনারা ঝিনাইদহ অভিমুখে যাত্রা করে শিক্ষণীয় বিষয় ক. পরিকল্পিত যুদ্ধ: বিষয়খালীর সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের মূল কারণ ছিল সঠিক যুদ্ধ পরিচালনা। মেজর আবু ওসমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বিষয়খালী এলাকায় কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়ার ফলেই পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত এবং পালটা আক্রমণের মাধ্যমে তাদের ছত্রভঙ্গ করা সম্ভব হয়েছিল।
সঠিক রেকি: যে-কোনাে সামরিক অভিযানের সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পনার জন্য সঠিক রেকি অপরিহার্য। মেজর ওসমান ও তাঁর রেকি দল বিষয়খালী এলাকায় পূর্ব থেকে বিস্তারিত রেকির মাধ্যমে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলাে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে, পাকিস্তানি বাহিনী বিস্তারিত রেকি ব্যতিরেকে শুধু তাদের দালাল বা চরের মাধ্যমে তথ্যসংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীর। অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। ফলে মুক্তিবাহিনী সহজেই তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। গ. জনগণের সহায়তা: যে-কোনাে যুদ্ধে এলাকার জনগণের সহায়তা যুদ্ধকে অনেকখানি প্রভাবিত করে। পাকিস্তানি বাহিনী (তাদের কিছু দালাল ব্যতীত) এলাকার জনগণ থেকে ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ফলে জনগণের কাছ থেকে কোনাে ধরনের সহায়তা তারা পায় নি। অন্যদিকে এ যুদ্ধে এলাকার জনগণ যুদ্ধের প্রস্তুতি পূর্ব হতে শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে সব ধরনের সাহায্য ও সহযােগিতা প্রদান করেন যা মুক্তিবাহিনীর বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। মনােবল: উঁচুমানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকিস্তানি বাহিনী স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর তাদের মনােবল যথেষ্ট নিচে নেমে যায়। এ যুদ্ধের বিজয়ের পর মুক্তিযােদ্ধাদের তথা জনগণের সাহস, বিশ্বাস ও উদ্দীপনা আকাশচুম্বী রূপ গ্রহণ করে। পরবর্তী সময় অন্যান্য যুদ্ধে এ মনােবল বাড়তি শক্তি যােগায়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড