You dont have javascript enabled! Please enable it! অপারেশন আলফাপুর - সংগ্রামের নোটবুক
অপারেশন আলফাপুর
 
(শৈলকূপা এবং শ্রীপুর থানার সীমান্তে কুমার নদীর উত্তর পাড়ে) সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে পাকবাহিনীর সম্প্রসারিত অভিযানের অংশ হিসেবে মাগুরা এবং ঝিনাইদহ টার্গেটে আসে। এ এলাকায় তখন পাকবাহিনী ক্রমশঃ প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। অক্টোবরের দিকে তখন আমরা আমাদের আবাইপুর মীন গ্রামের ক্যাম্পে আছি। আশপাশের চারদিকে শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে নিয়মিত ওয়াচিং এর জন্য গ্রুপে ভাগ করে আমার সেনাদলকে পাঠাচ্ছি । রেকি করার জন্য এক গ্রুপ এবং ক্যাম্প পাহাড়ায় এক গ্রুপ এমনিভাবে আমার বাহিনীকে সতর্কাবস্থানে রেখেছি। এর মাঝে হঠাৎ এক রাতে আমার রেকি বাহিনীর কমান্ডার মুক্তিযােদ্ধা আমিনুল ইসলাম চাঁন মিঞা এসে সংবাদ দিল ঝিনাইদহ থেকে ৪/৫ প্লাটুন আর্মি আমাদের ক্যাম্পের দিকে আসছে। কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা সহ চাঁন মিঞাকে আবাইপুর থেকে ৬ মাইল দূরে র্যাকি করতে পাঠানাে হয়েছিল। আকস্মাৎ চাঁন মিঞা পাকবাহিনীর অগ্রসরমান অবস্থা দেখে নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে ফায়ার দেয়। পাক বাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী ফায়ারের জবাব ফায়ার। এমনকি ওরা একটি ফায়ার এর জন্য একশত, প্রয়ােজনে এক হাজার ফায়ার দেবে। আমার মুক্তি যােদ্ধাদের এ মােতাবেকই নির্দেশ দেয়া ছিল। পালাতে হলেও ফায়ার দিয়ে শক্রদের ব্যস্ত করে রিট্রিট করবে। চাঁন মিঞা যেহেতু আর্মির লােক সহজেই সে এ কৌশল অবলম্বন করে এ পদ্ধতি অনুসরণ করে ফায়ার দিয়েই পেছনে চলে আসে। বেশ রাত; আমি তখন নিজের বাড়ীতে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিলাম হঠাৎ চাঁন মিঞা হন্তদন্ত হয়ে এসে আমাকে পাকবাহিনীর সংবাদ দিল। এই প্রান্তে তখন একমাত্র আমাদের ক্যাম্পই মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তিশালী অবস্থান। এ কারণে রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীর প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ওরা আমাদেরকেই টার্গেট করেছে। এই অবস্থায় কয়েকজন কোম্পানী কমান্ডার ছুটে এলাে আমার কাছে, আমাকে বললাে ‘এ অবস্থায় আমরা হাল্কা অস্ত্র নিয়ে কি করতে পারি?’ আমি বললাম এ মুহূর্তে আমাদের একমাত্র করনীয় বিষয় হচ্ছে সুষ্ঠু পরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর হওয়া। গেরিলা কায়দায় অগ্রসর হতে হবে-নইলে পাকবাহিনীর সাথে। আমরা টিকে উঠতে পারবনা। আমাদের আগে জীবন বাঁচাতে হবে তারপর আক্রমণ। নইলে আবাইপুরের শেষ চিহ্নটুকু আমরা রাখতে পারবনা। এ এলাকার এক ইঞ্চি মাটি রক্ষা করতে আমরা শেষ রক্ত বিন্দু দিয়েও লড়ে যাব।
 
কিন্তু রণকৌশল ছাড়া আগানাে যাবেনা। প্রথমতঃ যেহেতু ওরা ক্যাম্পকে টার্গেট করেছে। সেহেতু ক্যাম্পে থেকে যুদ্ধ করা ঠিক হবেনা। ভারী অস্ত্রে অর্থাৎ মর্টার দিয়ে শেলিং করতে পারে তাই আমাদের ক্যাম্প ছাড়তে হবে। দ্বিতীয়তঃ এলাকা ছেড়ে বেশী। দূর যাওয়া যাবে না। কারণ তাতে আমরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ব। আমরা তখন চারদিক থেকে ছিলাম শক্র পরিবেষ্টিত। শ্রীপুর থানা, লাঙ্গল বাঁধ, শৈলকূপায় আর্মিদের ঘাটি। অতএব আমাদের এলাকায় নির্দিষ্ট রেঞ্জের মধ্যে থেকেই ওদের মােকাবিলা করতে হবে। আমি দ্রুত বেগে সবাইকে মীন গ্রাম স্কুলের মাঠে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলাম। ভাের ৪টায় আমরা সমবেত হলাম। গ্রামের লােকজন আর্মি আসার সংবাদে ভীষণভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কেননা আর্মিরা যেখানে একবার ঢুকে শূন্য হাতে ফেরে না। মুক্তিযােদ্ধাদের না পেয়ে অপারেশনে ব্যর্থ হলে ওরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে বিভীষিকার সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় আমি গ্রামের লােক এবং মুক্তিযােদ্ধাদেরও অভয় দিলাম। মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ সম্পর্কে আমি ব্রিফিং করছিলাম অর্থাৎ পৌনে ৫টার দিকে। আমাদের অদূরে হঠাৎ ফায়ারিং এর শব্দ শােনা গেলাে; অতর্কিত এ ফায়ারিং-এর শব্দে নতুন মুক্তিযােদ্ধাসহ অনেকেই ছত্রভঙ্গ হবার উপক্রম করলাে। আমি তাদের এই বলে শান্ত করলাম যে ওরা বিনা প্ল্যানিং এ আমাদের মধ্যে আসবে না। বিশেষ করে র্যাকি করে ইন্টিলিজেন্স ইনফরমেশান এর মাধ্যমে ওরা আক্রমণ করবে। অতএব এতটা ভীত হবার কোন কারণ নেই ! এরপর আমার মুক্তিযােদ্ধা সােনা মােল্লা-মন্টু, কাজী আলম এরা দক্ষিণে বিলের ভিতরে কতগুলাে গ্রামে আছে সেখানে গিয়ে অবস্থান নিলাে। আমি বললাম আমরা ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করে তবেই মুভ করব। আমাদের মাঠ ছেড়ে মাত্র এক ফালং দূরে আলফাপুর খেয়া ঘাট। আমি দ্রুত ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে সেদিকে অগ্রসর হতেই আবার ফায়ারিং এর শব্দ পেলাম। শব্দের দূরত্ব হিসেব করে বুঝলাম এতক্ষণে আমাদের ক্যাম্পের উপর ফায়ারিং হচ্ছে। আমরা যখন খেয়াঘাটে পৌছলাম তখনও চারদিকে আলাে আঁধারীর আবছায়া। কুমার নদীর দক্ষিণ ঘাটে এসে দেখলাম পার হওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। এপারে কোন নৌকা কিংবা লােকজন কিছুই নেই। এহেন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আমার দু’জন মুক্তিযােদ্ধা বলল ওপারে ডুবন্ত নৌকা আছে আপনি অর্ডার দিলে সাঁতরিয়ে গিয়ে নৌকা সেচে আনতে পারি। আমি যাবার অনুমতি দিয়ে বললাম যা কর সব দ্রুততার সাথে করতে হবে। ওরা হুকুম মত খুব তাড়াতাড়ি নৌকা সেচে নিয়ে এলাে। কিন্তু ৩০ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে এক নৌকায় উঠা সম্ভব নয়। অথচ একবারেই সবাইকে পার হতে হবে। আমি কোন মতে কাউকে আলাদা কিংবা দলছুট হতে সুযােগ দিচ্ছিনা।
 
এ মুহূর্তে একত্রিত অবস্থান একত্রিত মার্চ করাই রণকৌশল। অবস্থা বিবেচনা করে আমি সাথে আনা গামছা পরে অস্ত্র নৌকার উপর। রাখলাম। সবাইকে একই পদ্ধতি অবলম্বন করার নির্দেশ দিলাম। নির্দেশ মত সবাই। নৌকার উপর অস্ত্র রেখে পানিতে নেমে নৌকা ধরে সাঁতরিয়ে ওপার গেলাম। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য অস্ত্র রক্ষা করা। এভাবে নদী পার হয়ে আলফাপুর খালের পূর্ব পারে অবস্থিত এক প্রাইমারী স্কুলে অবস্থান নিলাম। স্কুলে পৌঁছেই আমরা ট্রেন্স করে ফেললাম। এদিকে সকাল বেলা এলাকার লােকজন আমাদের স্কুলের মাঠে দেখে অল্প সময়ের মধ্যে বাড়ী থেকে খিচুরী রান্না করে এনে খাওয়ালাে। খেয়ে দেয়ে পুনরায় একদলকে ট্রেন্স করতে দিয়ে অপর তিনটি গ্রুপ পাঠালাম রেকি করতে। রেকি বাহিনী কিছু সময় পর এসে জানালাে পাক বাহিনী আবাইপুরে আছে। ওরা ওয়াপদার বিল্ডিং-এর উপর উঠে বালির বস্তা দিয়ে খুব মজুত অবস্থান বানিয়েছে। রাত্রে ওদের অবস্থান সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে আমি ৬ জনের খুব স্ট্রং একটা গ্রুপ পাঠালাম। এদেরকে ৩টি ফ্লাঙ্কে বিভক্ত হয়ে অপারেশন করার নির্দেশ দিলাম। এরা আবাইপুরের পাশের গ্রাম বগুড়া এবং মীনগ্রাম থেকে ওদের অবস্থানও গতিবিধি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে আমাকে সংবাদ জানালাে। আমি ওদের অবস্থান জেনে আশ্বস্ত হলাম। ওরা এখনও ওখানেই আছে এই ফাকে আমি আমার প্রস্তুতী সম্পন্ন করতে পারব। আলফাপুরের মধ্যদিয়ে একটি মাত্র রাস্তা চলে গেছে শৈলকূপা এবং শ্রীপুরের দিকে। এই একমাত্র রাস্তা ছাড়া অন্যকোন রাস্তা নেই। নদীর উত্তর দিকে একটা খাল আছে। যে খালটি শৈলকূপা এবং শ্রীপুরকে বিভক্ত করেছে। তার উপর একটা পুল আছে। এই পুলের পূর্ব পাশে খালের পারের উঁচু জায়গা আলফাপুরের নদীর মুখে কিছু জঙ্গল ছিল।
 
এই জঙ্গলের মধ্যে আমি কয়েকটি ট্রেন্স করে প্রস্তুতি নিলাম। একটা ফ্লাংক রাখলাম খালের মুখে আর অন্যটি ব্রীজের পূর্বে। আমরা জানি আর্মিরা অগ্রসর হলে একমাত্র এই রাস্তা এবং পুলের উপর দিয়েই অগ্রসর বেলা ১২টার দিকে যখন আমরা দুপুরের খাবার খাব এমন সময় বগুড়া থেকে। র্যাকি পার্টি এসে সংবাদ দিলাে পাকবাহিনী আলফাপুরের দিকে আসছে আপনারা তৈরি হন। আমরা দ্রুত স্কুলের মাঠ থেকে খালের পারে আলফাপুর জঙ্গলে নির্মিত ট্রেন্সে অবস্থান নিলাম। একে বর্ষার মৌসুম, চারদিকে জল, অন্য পথ নেই কেবল মাত্র এই একটি পথে আর্মিদের আসতে হবে। তার উপর আলফাপুরে আমাদের পজিশন ছিল একেবারেই কুদরতী। কেননা এই অবস্থান থেকে আমরা শত্রুর গতিবিধি বুঝতে পারব, ওদেরকে লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়তে পারব ঠিকই, পক্ষান্তরে ওরা আমাদের দেখতে পারবে না। এমন একটা ঐশ্বরিক সুযােগ পেয়ে খােদা তায়ালাকে ধন্যবাদ জানালাম। আশপাশে যত নৌকা ছিল সব ডুবিয়ে দিলাম। কয়েকটি গ্রুপে সৈন্যদের বিভক্ত করলাম। এর এক গ্রুপ খালের নীচে অন্যটা পূর্ববর্তী অবস্থানে, তৃতীয় গ্রুপকে ব্রীজের নীচে দিলাম। এভাবে আলফাপুরে আমার সৈন্যদের বিন্যস্ত করলাম। আমি মুক্তিযােদ্ধাদের বিশেষভাবে নির্দেশ দিলাম যত সুযােগই বুঝ নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ফায়ার দেবে না এবং শেষ সংকেত না। পাওয়া পর্যন্ত কোনক্রমেই কেউ ফ্লাঙ্ক ছেড়ে যাবে না ।
 
অবশেষে আমাদের পরিকল্পিত ফাঁদেই ওরা পা দিলাে। আলফাপুর ব্রীজে এসেই ওরা বুঝতে পারল আশপাশে মুক্তিযােদ্ধা আছে। এসেই ফায়ার দিলাে। আমরা একটি মাত্র ফায়ার দিলাম ফায়ারের জবাবে। ওরা একটানা দেড় ঘন্টা ধরে ফায়ারিং করতে থাকে। আমরা বিভিন্ন অবস্থান থেকে একটা করে মাত্র ফায়ার দিয়ে ওদের ব্যস্ত করে রাখলাম। ক্রমাগত দেড় ঘন্টা ফায়ারিং করে করে ওরা বুঝতে পারল মুক্তিযােদ্ধাদের ওঠানাে যাবে না। (ওরাএই ফায়ারিং-এ এইচ,এম.জি-এল.এম.জি ব্যবহার করেছে)। কিন্তু আমাদের কিছুই হয়নি। যেহেতু আমরা নিরাপদ অবস্থানে আছি ওরা গুলী করলে সবই আমাদের উপর দিয়ে চলে যায়। পক্ষান্তরে আমরা ওদের দেখছি তবুও ওদের বিশেষ কায়দায় ফেলতে ফায়ার দিচ্ছি না। তাছাড়া এখানে ওরা মর্টার দিয়ে শেলিং করতে পারে। মাঝে মধ্যে আমার মুক্তিযােদ্ধারা অস্থির হয়ে ওঠে আক্রমণের জন্য। আমি ওদের শান্ত করি-ধীরে; আমাদের জন্য আরাে ভালাে সুযােগ অপেক্ষা করছে। এদিকে আর্মিরা দেড় ঘন্টা ফায়ার করে ব্যর্থ হয়ে রিট্রিট করে। কিন্তু ওরা নিয়মানুযায়ী যে পথে। এসেছে সে পথে ফিরে না গিয়ে উত্তর দক্ষিণ কর্ণার ধরে খালের পার দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। আমি এই সুযােগেরই অপেক্ষায় ছিলাম। কেননা আমি জানি ওরা রণকৌশল হিসেবে এটাই করবে এ পথে আর ফিরবে না। আর বাকী যে পথেই ফিরবে সেটা হবে ওদের জন্য মরণ ফাঁদ আর আমার জন্য চমৎকার সুযােগ। পরিণতিতে তাই হলাে। পুরাে এক কোম্পানী সৈন্যসহ ওরা পার দিয়ে সমতলে পরিস্কার জায়গায় এসে পৌছলে আমি অর্ডার দিলাম ‘ফায়ার’। অমনি ৩ দিকে বিভক্ত ৩টি ফ্লাঙ্ক থেকে অবিরাম বৃষ্টির মত গুলী বর্ষণ শুরু হলাে। নিকটবর্তী দূরত্বে আমার ফ্লাঙ্কে ছিল মুক্তিযােদ্ধা চাঁন মিঞা, আঃ বারিক, রাজু জোয়ার্দার, সােবহান জোয়ার্দার, করিম, রানু অনবরত ফায়ার এবং উল্লাসে গালিগালাজ করতে থাকে। ওরা এইচ.এম.জি লাগাতে কিংবা পজিশন নিতে বিন্দুমাত্রও সময় পেলাে ৩ দিক থেকে একযােগে আক্রমণ । ওরা বিন্দুমাত্রও ভাবতে পারেনি এমন গেরিলা কায়দায় এখানে আক্রান্ত হবে। চোখের পলকে পুরাে এক কোম্পানী সৈন্যের সব শেষ হয়ে গেলাে। শুধু একজন মেজর যার হাতে অয়্যারলেস সেট ছিল সে গুলী খেয়ে আহত হয়ে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে অবস্থান নেয়। তাও কিছুক্ষণ পর মারা যায়। পরবর্তীতে আর্মিরা এই মেজরের লাশ নিয়ে লাঙ্গল বাঁধ বাজারের কাছে কবর। একটু পরেই বুঝতে পারলাম আমাদের চোখ গলিয়ে কোন মতে ৩জন পাক সেনা। ক্রলিং করে জীবন নিয়ে পালাচ্ছে। আমরা নৌকা সেচে পার হয়ে ওদের পিছু ধাওয়া করলাম ধরার জন্য। কিন্তু কিছুক্ষণ পর এলাকার লােকজন সংবাদ দিলাে। ওরা আবার আসছে। আমরা ব্যাক করে আলফাপুরে পুনরায় পজিশন নিলাম। আর্মিরা এবার এলাে শুধু ডেড বডি নিতে। কিন্তু তাও এসে ৩ ইঞ্চি মর্টার ব্যবহার। করলাে। আমাদের অবস্থান বরাবর কিছুক্ষণ শেলিং করলাে কিন্তু শেলিং ওভাররেঞ্জ করছে বরাবরই। শেলের আঘাতে আমাদের করিম আহত হলাে। আমরা ভাবলাম মূল অপারেশন হয়ে গেছে এখান থেকে আমরা অনেক অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করেছি অতএব এখন আমাদের হাল্কা অস্ত্রে মােকাবিলার চেয়ে রিট্রিট করাই শ্রেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্রিজের পিছন দিক দিয়ে রিট্রিট করলাম। আমাদের জন্য মন্টু মিয়া আগেই নৌকা প্রস্তুত করে রেখেছিল। নৌকায় করে আমরা মালতিহা আহমেদ সাহেব নামক এক ব্যবসায়ীর বাড়ীতে প্রথমে অবস্থান নিলাম। উনি আন্তরিকভাবে আমাদের গ্রহণ করে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। ইতােমধ্যে দল ত্যাগকারী কতিপয় মুক্তিযােদ্ধা, লিডার ও আশপাশের লােকজন আমাদের এ বিজয়ে সাধুবাদ। জানাতে লাগলেন। কিছু সংখ্যক আবার দলে অন্তর্ভুক্তির আবেদন জানালাে। আলফাপুরের এ অপারেশন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অপারেশন থেকে। পাকবাহিনী এখানে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হয়। যার ফলে মাগুরা অনেকাংশে সুরক্ষিত হয়। একদিন অবস্থান নেয়ার পর অনুমান করলাম যেহেতু এখানে ওদের পুরাে একটা কোম্পানী সৈন্য শেষ হয়ে গেছে সেহেতু ওরা সহজে ছাড়বে না। মরিয়া হয়ে উঠবে, সমগ্র এলাকা তছনছ করবে। আমাদের এখানে অবস্থান আর নিরাপদ নয় ভেবে একটা বড় নৌকা নিয়ে গড়াই নদী দিয়ে ফরিদপুর জেলায় প্রবেশ করলাম। ফরিদপুর জঙ্গল ইউনিয়নে পৌছে দেখলাম এটা অধিকাংশই হিন্দু এলাকা। সবাই ঘর বাড়ী ছেড়ে ভারত চলে গেছে। ফলে সবই ফাকা। এখানে এক বাড়ীতে ৫/৬ দিন অবস্থান করে-পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম পাকবাহিনী এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।
 
Source: রক্তে রাঙা বিজয় – ৭১ মোঃ কামরুজ্জামান