You dont have javascript enabled! Please enable it! কুষ্টিয়ার যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
কুষ্টিয়ার যুদ্ধ
ভৌগােলিক অবস্থান ও গুরুত্ব উত্তরে পদ্মা নদী আর পূর্ব দিকে গড়াই নদী দ্বারা বেষ্টিত কুষ্টিয়ার সমতল ভূমি। ভৌগােলিক দিক থেকে কুষ্টিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এ কারণে পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধের শুরুতেই এ এলাকা দখল করে নেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা লগ্নে বিভিন্ন সেনানিবাস এবং সশস্ত্রবাহিনীর অবস্থানভিত্তিক যে-সব প্রতিরােধ গড়ে উঠেছিল, কুষ্টিয়ার যুদ্ধ’ তার মধ্যে অন্যতম। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত সংঘটিত এ যুদ্ধে পাকিস্তানি ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়। ইপিআর-এর ৪ নম্বর উইং ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী জনতার সম্মিলিত বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর গৌরব ধুলােয় মিশিয়ে দেয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভারত সীমান্তবর্তী জেলা শহর কুষ্টিয়া একটি আদর্শ যােগাযােগ কেন্দ্র। এ জেলার সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারতের নদীয়া, কৃঞ্চনগর প্রভৃতি এলাকা এবং পূর্বে ঝিনাইদহ হয়ে ফরিদপুর পর্যন্ত সড়ক যােগাযােগ বিদ্যমান। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এখান থেকে ২৫ কিলােমিটার উত্তরে এবং দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সেনাছাউনি যশাের সেনানিবাস ৭১ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এসব বিষয় বিবেচনা করলে কুষ্টিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। যুদ্ধের সংগঠন ও অবস্থান।
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের (রেকি ও সাপাের্ট ব্যাটালিয়ন) ১টি কোম্পানি যশাের সেনানিবাস থেকে এসে ১৯৭১ সালের ২৪-২৫ মার্চ রাত দেড়টায় কুষ্টিয়া শহরে অবস্থান নেয়। উল্লেখ্য, রেকি ও সাপাের্ট কোম্পানির ফায়ার শক্তি অন্যান্য সাধারণ পদাতিক কোম্পানির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। মেজর মােহাম্মদ শােয়েবের নেতৃত্বাধীন এ কোম্পানির দায়িত্ব ছিল অপারেশন সার্চ লাইটের আওতায় কুষ্টিয়া শহরে সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। মেজর শােয়েবের অধীনে বস্তুত ১ কোম্পানির অধিক সৈন্য (২০০জন) ছিল। প্রচুর ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এ কোম্পানিতে অধিনায়ক ছাড়াও ক্যাপটেন সাকিল, লে. সামাদ ও লে. আতাউলাহ। শাহ নামে ৩জন অফিসার ছিলেন। মেজর শােয়েব শহরে পৌছেই। ট্যাংকবিধ্বংসী ১০৬ মি.মি, আরআর ও ভারী মেশিনগানসহ ১টি করে প্ল্যাটুন যথাক্রমে পুলিশ লাইন ও সার্কিট হাউজে মােতায়েন করেন। অন্য ১টি প্ল্যাটুনসহ কোম্পানি হেডকোয়ার্টারসে নিয়ে নিজে জেলা স্কুল সার্কিট হাউজ এলাকায় অবস্থান নেন এবং সান্ধ্য আইন জারি। করেন । ফলে ২৫-২৬ মার্চ রাতেই কুষ্টিয়া শহর কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ।
খ. মুক্তিবাহিনী: ইপিআর যশাের সেক্টরাধীন ৪ নম্বর উইংয়ের সদর দপ্তর ছিল চুয়াডাঙ্গায় । এ ইউনিটের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, উপ-অধিনায়ক ক্যাপটেন এ আর আযম চৌধুরী এবং কোম্পানি অধিনায়কদের সবাই ছিলেন বাঙালি। এ উইংয়ের জনবল ছিল প্রায় ৬০০জন। সৈনিকদের ব্যক্তিগত .৩০৩ রাইফেলসহ ইউনিটের প্রতিটি কোম্পানিতে ৭টি করে ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র, ১টি করে মেশিনগান এবং ৭টি করে এলএমজি ছিল। তা ছাড়া উইং সদর দপ্তরে ছিল ৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং ২০০টি চাইনিজ রাইফেল। ২৬ মার্চ সকালে ইউনিটের বাঙালি হাবিলদার মুজিবুর রহমান নিজ উদ্যোগে অবাঙালি
সৈনিকদের নিরস্ত্র ও বন্দি করেন।
যুদ্ধের পরিকল্পনা ক. মুক্তিবাহিনী: কুষ্টিয়া শহর শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে ইপিআর ৪ নম্বর উইংয়ের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ২৬ মার্চ থেকেই। ব্যাপক জনসংযােগ শুরু করেন। ইপিআর ও মুক্তিকামী জনতার সমন্বয়ে সামান্য সময়ে একটি বিশাল বাহিনী গড়ে ওঠে। ২৭ মার্চ বিকালে এ বাহিনীর প্রধান মেজর আবু ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া। পুনর্দখলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল। ইপিআর ও জনতার সম্মিলিত বাহিনীর দ্বারা একই সাথে তিন দিক থেকে আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা। ইপিআর বাহিনীর দায়িত্ব ছিল সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করা, আর জনগণের দায়িত্ব ছিল আক্রমণের সময় রণ হুংকার দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ধ্বংস করা। কুষ্টিয়া শহর হানাদারমুক্ত করার লক্ষ্যে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তার বাহিনীর বিভিন্ন দলগুলােকে নিমলিখিত দায়িত্ব প্রদান করেন:১. এ কোম্পানি: প্রাগপুরে অবস্থানরত এ কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন সুবেদার মােজাফফর। প্রাগপুর ভেড়ামারার ২৪ কিলােমিটার পশ্চিমে অবস্থিত একটি বিওপি। এ কোম্পানির দায়িত্ব ছিল ২৮ মার্চ ১২টার পূর্বে ভেড়ামারা হয়ে কুষ্টিয়া পৌছে শহরের উপকণ্ঠে প্রাথমিক অবস্থান নেয়া এবং পরবর্তী সময় পশ্চিম দিক থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের পুলিশ লাইন অবস্থানে আক্রমণ করা। ‘বি’ কোম্পানি: এ কোম্পানিটি ধােপাখালীতে অবস্থান করছিল। ধােপাখালী একটি বিওপি, যা জীবননগর থেকে আনুমানিক ৫ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এ কোম্পানির দায়িত্ব ছিল চুয়াডাঙ্গা-পােড়াদহ কাচা রাস্তা ধরে যাত্রা করে কুষ্টিয়া পৌছা।
এবং ওয়্যারলেস স্টেশনে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ করা। এ কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন। সুবেদার খায়রুল বাশার। ‘সি’ কোম্পানি: বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান নাম মুজিবনগর) অবস্থানরত এ কোম্পানিটির দায়িত্ব ছিল চুয়াডাঙ্গা-পােড়াদহ কাঁচা রাস্তা ধরে কুষ্টিয়া পৌছা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর জিলা স্কুল অবস্থানে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করা। এ কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার মুকিদ, তবে আক্রমণে এ কোম্পানির নেতৃত্ব দেন ব্যাটালিয়ন উপ-অধিনায়ক ক্যাপটেন এ আর আযম চৌধুরী। ৪. ‘ডি’ কোম্পানি: এ কোম্পানির দায়িত্ব ছিল প্ল্যাটুনসহ কোটচাদপুর ও কালিগঞ্জে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে কোটচাদপুর, কালিগঞ্জ ও দত্তনগরে শত্রুর ক্ষুদ্র দলের অনুপ্রবেশ প্রতিহত করা। এ কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার আবদুল মজিদ মােল্লা, তবে কালিগঞ্জে মুক্তিযােদ্ধাদের সার্বিক অধিনায়কত্ব করেন ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। ‘ই’ কোম্পানি: এ কোম্পানির দায়িত্ব ছিল প্রথমত ঝিনাইদহযশাের সড়ক অবরােধের মাধ্যমে যশাের-কুষ্টিয়া সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে যশাের সেনানিবাস থেকে কুষ্টিয়ায় রিইনফোর্সমেন্ট বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত ১টি দল বিষয়খালীতে মােতায়েন করে চুয়াডাঙ্গা ইপিআর সদর দপ্তর রক্ষা করা। এ কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার রাজ্জাক। ঝিনাইদহে মুক্তিযােদ্ধাদের সার্বিক অধিনায়কত্ব করেন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক শফিক উল্লাহ। ৬. জনতার দল: মেজর ওসমান কুষ্টিয়ায় আক্রমণকারী প্রতিটি ইপিআর কোম্পানির পিছনে বাঁশের লাঠি সজ্জিত কমপক্ষে ৫ হাজার জনতার সমাবেশ করার দায়িত্বও ড, আসহাবের উপর ন্যস্ত করেন। ৭, সিগন্যাল যােগাযােগ: পর্যাপ্ত ওয়্যারলেস ও ফিল্ড টেলিফোন না।
থাকায় টেলিফোন বিভাগের সাহায্যে পােড়াদহের খােলা প্রান্তরে ফিল্ড এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা হয়। ফলে কুষ্টিয়া রণাঙ্গনের সাথে চুয়াডাঙ্গা ইপিআর-এর যােগাযােগ ও সমন্বয় সহজ হয়ে ওঠে। তা ছাড়া কুষ্টিয়ার সাথে বহির্বিশ্বের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে পােড়াদহের সাথে সরাসরি আন্তর্জাতিক যােগাযােগ স্থাপন করা। হয় । ৮, মেডিক্যাল দল: ডা, কোরেশী, ডা. করিম, ডা, সাইদুর রহমান ও ডা, আসহাবুল হকের সমন্বয়ে মেডিক্যাল দল গঠিত হয়। এ দলের দায়িত্ব ছিল রণাঙ্গনে ওষুধ সরবরাহ ও চিকিৎসা প্রদান। করা। খাদ্য সরবরাহ: ডা. আসহাবুল হকের নেতৃত্বে গঠিত। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আক্রমণের সময় (এইচ আওয়ার) প্রাথমিকভাবে ২৯ মার্চ ভাের ৪টায় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ‘এ’ কোম্পানির ১টি গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হলে কোম্পানিটি কুষ্টিয়া পৌছতে দেরি করে। ফলে আক্রমণের সময় ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে ৩০ মার্চ ভাের ৪টায় নির্ধারণ করা হয়। খ. পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি সেনারা মূলত প্রতিরক্ষা মনােভাব নিয়ে শুধু শহর এলাকায় ৩-৪টি ক্যাম্প করে কুষ্টিয়াকে প্রতিরক্ষা করার। চেষ্টা করে। তারা সাধারণত ডমিনেশন টহল ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিরােধমূলক পালটা হামলা ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। যুদ্ধের বিবরণ। ৩০ মার্চ ৪টায় ক্যাপটেন আযম চৌধুরীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু হয়। ‘এ’ কোম্পানি নায়েব সুবেদার মতিন পাটোয়ারির নেতৃত্বে পুলিশ লাইনের দক্ষিণ-পশ্চিমে মহাজনপুর হাজিবাড়ির তৃতীয় তলা থেকে পুলিশ লাইনের উপর আক্রমণ করে। এর কিছুক্ষণ পরই মেহেরপুর থেকে ১ কোম্পানি।
আনসার এবং ১ কোম্পানি মুজাহিদ যুদ্ধে যােগ দেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল গােলাগুলি শুরু হয়। সারাদিনের উলেখযােগ্য ঘটনাটি ঘটে দুপুর দেড়টার দিকে। এ সময় হাজিবাড়ি ধ্বংস করার জন্য শত্ৰু ট্যাংকবিধ্বংসী ১০৬ মি.মি, আরআর হাজিবাড়ির দিকে তাক করে। নায়েব সুবেদার মতিন একই সঙ্গে ১টি আরআর, ৩টি এলএমজি এবং ২ ইঞ্চি মর্টারের গােলা নিক্ষেপ করে দখলদার বাহিনীর অস্ত্রটি ধ্বংস করেন। এদিকে একই সময়ে ‘বি’ কোম্পানির নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামান পশ্চিম দিক থেকে জিলা স্কুলের ওপর আক্রমণ করেন। এ ত্রিমুখী আক্রমণ এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগী হাজার হাজার যােদ্ধার চিৎকারে পাকিস্তানি সেনারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। ৩০ মার্চ বিকাল নাগাদ জিলা স্কুল ছাড়া অন্য ২টি শত্রু অবস্থানের (পুলিশ লাইন ও ওয়্যারলেস স্টেশন) পতন ঘটে। পুলিশ লাইন ও ওয়্যারলেস স্টেশনের অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অবশিষ্টরা জিলা স্কুলে সমবেত হওয়ার চেষ্টা করে। যুদ্ধের এ পর্যায়ে শত্রু দল অসহায় ও অক্ষম হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত জনবল ছাড়া তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন অনুধাবন করে কুষ্টিয়ার পাকিস্তানি কমান্ডাররা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে যশাের সেনানিবাসের সাহায্য কামনা করে। কিন্তু যশাের সেনানিবাস থেকে সাহায্য প্রদানে অপারগতা জানানাে হয়। বলা হয়, “Reinforcement not possible. Try to live on your own.” বার্তাটি মুক্তিযােদ্ধাদের ওয়্যারলেসে ধরা পড়ে। ৩১ মার্চ ভাের রাতে ক্যাপটেন আযম চৌধুরী পুনরায় জিলা স্কুল আক্রমণ করেন।
পাকিস্তানি সেনারা ভারি অস্ত্রের সাহায্যে পালটা জবাব দেয়। সারাদিনের আক্রমণে প্রচুর পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। সন্ধ্যার দিকে পাকিস্ত নি বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের তীব্রতা কমে আসে। জিলা স্কুল এলাকায় পাকিস্ত যনি বাহিনী একটি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। তারা জিলা স্কুল এলাকায় আক্রমণের তীব্রতা কমিয়ে নিষ্ক্রিয় হওয়ার ভান করে। এ সুযােগে সূর্যাস্তের পর অফিসারসহ অবশিষ্ট ৪০-৫০জন পাকিস্তানি সেনা ২টি জিপ ও ২টি পিকআপে করে পালানাের চেষ্টা করে। মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল তৎক্ষণাৎ তাদের পিছু নেয়। পাকিস্তানি এ দলটি ঝিনাইদহের নিকটবর্তী গাড়াগঞ্জ ব্রিজে মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা অ্যামবুশে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধারা গাড়াগঞ্জ সেতুটি ধ্বংস করে সেখানে আলকাতরা মাখানাে বাঁশের চাটাই বিছিয়ে অনতিদূরে ওত পেতে বসেছিল। রাতের আঁধারে পিচ ঢালা পথ মনে করে সেতুর উপরে ওঠা মাত্রই প্রথম গাড়িটি | নিচে পড়ে যায়। অন্য গাড়িগুলােও দুর্ঘটনায় পতিত হয়। মেজর শােয়েবসহ বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা ঘটনাস্থলে নিহত হয়। অন্যরা পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামবাসী ও মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। লে, আতাউলাহ শাহ ও সুবেদার আইয়ুব আহত অবস্থায় গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়ে।
১ এপ্রিল কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয়। ফলাফল বিশেষণ। কুষ্টিয়ায় মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের ওপর ৩১ মার্চ ময়মনসিংহে পাকিস্তানি বেতার সেট মনিটরিং করে শােনা যায় ১৪ ডিভিশন সদরের কর্নেল স্টাফ কর্নেল সাদুল্লাহ যশােরের ব্রিগেড মেজরকে বলছেন, “You have been routed by rag-tags. You people have no shame. How could you be routed by unarmed people? You need kick. However, tell your commander if they need any help, we will send air sorties. We are, in any way, sending two air sorties to Kushtia Circuit House. We have been able to tackle Dacca which did not bother us much. We are Dhaka really concerned about Kushtia now.” যার অর্থ দাঁড়ায়, “তােমাল্লেকে অতি নিম্নশ্রেণির সৈনিকেরা ছিন্নভিন্ন করেছে। তােমাদের লজ্জা নেই। নিরস্ত্র জনগণ কীভাবে তােমাদের ছিন্নভিন্ন করল? তােমাদের পদাঘাত করা প্রয়ােজন। সে যাক, তােমার অধিনায়ককে বলাে সাহায্যের প্রয়ােজন হলে আমরা বিমান পাঠাব। অবশ্য এমনিতেই আমরা কুষ্টিয়া সার্কিট হাউজে দুইটা বিমান পাঠাচ্ছি। ঢাকাকে আমরা সামলে নিয়েছি, কোনাে বেগ পেতে হয় নি। আমরা এখন কুষ্টিয়ার জন্য সত্যিই চিন্তিত।” মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর অন্যতম সাফল্য কুষ্টিয়া যুদ্ধ। প্রথাগত যুদ্ধে অনভ্যস্ত ইপিআর এবং প্রশিক্ষণহীন জনতার সম্মিলিত বাহিনী এ লড়াইয়ে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী একটি পাকিস্তানি কোম্পানিকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ১জন জেসিওসহ ৪জন সৈনিক শহিদ হন। যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী নিম্নবর্ণিত অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে:
শিক্ষণীয় বিষয়সমুহ
ক. পরিকল্পিত যুদ্ধ: মেজর আবু ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া দখলের জন্য বিস্তারিতভাবে যুদ্ধ পরিকল্পনা করেন। সব দলের অধিনায়কদের আক্রমণের পুরাে পরিকল্পনা সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেন। যুদ্ধ পরিকল্পনাকালে তিনি একই সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩টি অবস্থানের উপর আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর একে অপরকে সাহায্যের পথ বন্ধ করে দেন। তা ছাড়া তিনি শক্রর রি-ইনফোর্সমেন্ট বা ডাইভারশনারি আক্রমণের কথা বিবেচনা করে সেভাবে দলকে দায়িত্ব প্রদান করেন। সঠিক ও বিশদ যুদ্ধ পরিকল্পনার ফলেই মুক্তিবাহিনী সহজে শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। গােপনীয়তা ও আকস্মিকতা রক্ষা: মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তার অধিনায়কদের সম্পূর্ণ গােপনীয়তা বজায় রেখে অতর্কিত হামলা চালানাের নির্দেশ দেন। গােপনীয়তার গুরুত্ব তিনি তাঁর অধিনায়কদেরকে বুঝিয়ে দেন এই বলে যে, “Absolute surprise achieved half.the battle won.” পরিকল্পনা অনুযায়ী এ যুদ্ধের সম্পূর্ণ গােপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল বলেই আকস্মিকতা (Surprise) অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। ফলে ঘুমন্ত ও অপ্রস্তুত অবস্থায় ত্রিমুখী আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ। এলােমেলাে পাকিস্তানি সেনাদের একত্র করে পালটা। আক্রমণ চালানাে সম্ভব হয় নি। সঠিক কারণ: মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার জন্য ভালােবাসা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি নারী-পুরুষ যার যা কিছু ছিল তাই নিয়েই ঝাপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য। ঘ, জনগণের সহায়তা: এলাকার জনগণের ভিতরে যে উদ্দীপনা, সাহস ও দেশপ্রেম দানা বেঁধেছিল, মেজর ওসমান তা যুদ্ধক্ষেত্রে কাজে লাগান। স্থানীয় পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্রদের মধ্য থেকে বাছাই করা কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মূল দলে অন্তর্ভুক্ত করে দলের শক্তি বৃদ্ধি করেন। তা ছাড়া স্থানীয় চিকিৎসক, শিক্ষক, স্বেচ্ছাসেবীদের যুদ্ধে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান, ওষুধ ও খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব প্রদান। করেন, যা স্থানীয় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করেন।
ঙ. যুদ্ধের নতুন উদ্ভাবিত কৌশল: শক্তিশালী শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করার মতাে আধুনিক অস্ত্র বা গােলাবারুদ মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিল না। তাই শত্রুপক্ষের ক্ষমতাশীল ফায়ার ক্ষমতাকে হাস বা নিষ্ক্রিয় করার লক্ষ্যে মেজর ওসমান প্রতিটি ইপিআর কোম্পানির পিছনে হাজার হাজার জনতাকে লাঠিসোটাসহ নিয়ােগ করেন। ফলে যুদ্ধের সময় সম্মিলিত জনতার রণ হুংকারে শক্রর মনােবল ভেঙে যায়, তারা মুক্তিবাহিনীর প্রকৃত সংখ্যা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে নি।
চ. প্রতিবন্ধকতা: আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী যাতে পালিয়ে যেতে পারে, সে জন্য মুক্তিযােদ্ধারা ব্রিজ ধ্বংস করে সেখানে ফাদ পেতে রেখেছিলেন। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর পলায়নমান দুটি জিপ ফাঁদে পড়ে কমান্ডারসহ অনেক হতাহত হয় এবং অন্যরা পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীর হাতে নিহত হয়। প্রথমবারের মতাে বিশ্বের জনগণের কাছে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ: কুষ্টিয়ার যুদ্ধে হস্তগত যুদ্ধোপকরণ ও যুদ্ধবন্দি এবং ৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার ওপর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বােমা বর্ষণ, স্থল বনাম বিমান যুদ্ধ ইত্যাদির ওপর ফরাসি টেলিভিশন করপােরেশনের একটি ভ্রাম্যমাণ দল যে সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, তা সারা বিশ্বে আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। ফরাসি টেলিভিশন ৫২টি দেশে এ প্রতিবেদনটি বিক্রয় করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত করে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের সাহায্য ও সহানুভূতি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল। এর মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যার ভয়াবহতা এবং নাপাম বােমা ব্যবহারের সচিত্র প্রতিবেদন। উদ্ভাবিত উপায়ে যােগাযােগ স্থাপন: যুদ্ধে যােগাযােগব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধ যখন চরম পর্যায়ে, অপর্যাপ্ত যােগাযােগ ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে কমান্ডাররা স্থানীয় টেলিফোন বিভাগের সাহায্যে পােড়াদহের খােলা প্রান্তরে ফিল্ড এক্সচেঞ্জ স্থাপন করেন। ফলে রণাঙ্গনের সাথে চুয়াডাঙ্গা ইপিআর-এর যােগাযােগ ও সমন্বয় সহজ হয়ে ওঠে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড