You dont have javascript enabled! Please enable it! যশাের সেনানিবাসে প্রাথমিক প্রতিরােধ - সংগ্রামের নোটবুক

যশাের সেনানিবাসে প্রাথমিক প্রতিরােধ

অবস্থান ও ভূমির বর্ণনা যশাের সেনানিবাস যশাের শহরের পশ্চিমে অবস্থিত এর উত্তরে যশােরঝিনাইদহ মহাসড়ক, দক্ষিণে যশাের-বেনাপােল রেললাইন ও সড়ক, পূর্বে যশাের-খুলনা রেললাইন এবং পশ্চিমে বিমানবাহিনীর রানওয়ে অবস্থিত সেনানিবাসের চারদিক গ্রাম বেষ্টিত গ্রামগুলাে সমতল ও নিচু ভূমিতে অবস্থিত সংগঠন ও অবস্থান ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াত খানের নেতৃত্বে ১০৭ ব্রিগেড জীবননগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিল। যার সদর দপ্তর ছিল মাগুরায় ১টি অ্যাডহক ব্রিগেড দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় খুলনা এলাকায় তাদের সংগঠন ছিল ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস

এবং রাজাকারদের নিয়ে। ডিভিশন সদরের অবস্থান ছিল যশােরে । খ. মুক্তিবাহিনী: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যশাের সেক্টরে কেবল ৩টি ইউনিটে বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল। এসব ইউনিটের মধ্যে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল যশাের সেনানিবাসে। ইপিআর-এর ২ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তরের ৫ নম্বর উইং চুয়াডাঙ্গায় এবং ৩ ও ৪ নম্বর উইং ছিল খুলনায় । পরিকল্পনা ক. পাকিস্তানি বাহিনী: অপারেশনাল প্ল্যান মােতাবেক পাকিস্তানি বাহিনীর দায়িত্ব ছিল বেনাপােল ও দর্শনা বাজার লাইন বরাবর মুক্তিবাহিনীকে প্রতিহত করা। পাকিস্তানি বাহিনী কলকাতা-বেনাপােল-যশাের, কৃষ্ণনগর-দর্শনা-চুয়াডাঙ্গা এবং মুর্শীদাবাদ-রাজাপুর-কুষ্টিয়া এ ৩টি অক্ষকে মুক্তিবাহিনী আসার সম্ভাব্য অক্ষ হিসেবে নির্ধারণ করে। এ লক্ষ্যে ঐ অক্ষ বরাবর পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। খ, মুক্তিবাহিনী: মুক্তিবাহিনী শেষ পর্যন্ত ৩টির কোনােটিই ব্যবহার না করে গরিবপুর ও দর্শনা, যেখানে আগেই তাদের ফোর্স ছিল, সেখান থেকে আক্রমণ পরিচালনা করার পরিকল্পনা করে।

প্রতিরােধের বিবরণ

২৫ মার্চের পূর্বে পাকিস্তানি বাহিনীর ১০৭ পদাতিক ব্রিগেড এবং ১টি আর্টিলারি রেজিমেন্ট যশােরে অবস্থান করছিল। ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল ১০৭ পদাতিক ব্রিগেডের একমাত্র বাঙালি ইউনিট। ইউনিটটি চৌগাছায় শীতকালীন যৌথ প্রশিক্ষণে নিয়ােজিত ছিল।

২৫ মার্চ এবং পরবর্তী ঘটনা

১৯৭১ সালের জুন মাসে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাকিস্তান শিয়ালকোট সেনানিবাসে বদলি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে প্রায় ৩৫০জন সদস্যকে প্রি-এম্বারকেশন ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং মাত্র ৪০০জন সদস্য ইউনিটে উপস্থিত ছিলেন। ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল। এ ইউনিটে আরও ৩জন বাঙালি অফিসার ছিলেন, তাঁরা হলেন: লেফটেন্যান্ট হাফিজ, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনােয়ার ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সফি তা ছাড়া কয়েকজন পাকিস্তানি অফিসারও ছিলেন। ২৯ মার্চ রাতে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেনানিবাসে ফেরত আসে। ৩০ মার্চ সকাল ৭টায় ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার দুররানী ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজেমেন্টে এসে অধিনায়ককে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের কাছে কোয়াটার গার্ড (অস্ত্রাগার) হস্তান্তর করার আদেশ দেন। বাঙালি সাহসী সৈনিকেরা পরিস্থিতি অনুমান করতে পেরে কোত ও ম্যাগাজিন ভেঙে অস্ত্র ও গােলাবারুদ হস্তগত করে নেন। ব্রিগেডিয়ার দুররানী এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিকে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থানের উপর অনবরত শেলিং করার নির্দেশ দেন এবং একই সাথে ভারী মেশিনগান ও মর্টার ফায়ার চালাতে থাকে। 

যশাের সেনানিবাস মুহূর্তেই যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালটা ফায়ার করতে থাকে সংখ্যায় ও শক্তিতে বেশি হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে দমাতে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পর পর কয়েকবার তিন দিক থেকে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থানে আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়। যশাের সেনানিবাসে যুদ্ধ চলাকালীন কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করতে রাজি না হয়ে অফিসে বসে থাকেন, ফলে লেফটেন্যান্ট হাফিজকেই নেতৃত্ব দিতে হয়। দুপুর নাগাদ অ্যামুনিশন প্রায় শেষ হয়ে আসলে লেফটেন্যান্ট হাফিজ তার। সৈন্যদের নিয়ে সেনানিবাস এলাকা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধ চলাকালে সেনানিবাস ত্যাগ করার সময় সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনােয়ার হােসেন পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে শহিদ হন। তিনি যুদ্ধে শাহাদতবরণকারী প্রথম আফসার। অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর-উত্তম উপাধিতে ভূষিত করে। যশাের সেনানিবাসের যুদ্ধে ৪০জন বাঙালি সেনা শহিদ হন। অন্যদিকে, প্রায় ৪০জন পাকিস্তানি সেনাসদস্যও হতাহত হয়।

উপসংহার

পাকিস্তানি বাহিনী শহিদ বীর বাঙালি সৈনিকদের মৃতদেহ একত্র করে কোনােপ্রকার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই স্থানীয় মনােহরপুর গ্রামে একটি গর্ত করে পুঁতে রেখেছিল। পরবর্তী সময় ১৯৭২ সালে ঐ গর্ত থেকে ১৭জন। সৈনিককে শনাক্ত করে পূর্ণ ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আলাদা করে মনােহরপুর হ্রদের দক্ষিণ পাশে পৃথক পৃথক কবরে সমাধিস্থ করা হয়। বীর। শহিদদের রক্তের ঋণের কথা স্মরণ করে তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে যশাের সেনানিবাসে ‘রক্তঋণ’ নামক একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড