You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.05.24 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | শান্তির সংগ্রাম ও মুক্তিকামী মানুষ | অবাধ লাইসেন্সে বস্ত্র আমদানী | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
২৪শে মে, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ১০ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

শান্তির সংগ্রাম ও মুক্তিকামী মানুষ

গতকাল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এশীয় শান্তি সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন। বিশ্ব শান্তি পরিষদের সেক্রেটারী জেনারেল শ্রী রমেশ চন্দ্র ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে সেক্রেটারী জেনারেল শ্রী রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রদানে ভূষিত করেছেন। সম্মেলনে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সেক্রেটারী জেনারেল ও অন্যান্য কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা বক্তৃতা করেছেন। বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে সেক্রেটারী জেনারেল শ্রী রমেশ চন্দ্র তাঁর বক্তৃতায় শান্তি আন্দোলন ও বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের অন্যতম নায়ক বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রদান করতে পেরে গৌরবান্বিত বোধ করেছেন। এরপর কেন এশীয় শান্তি সম্মেলনের স্থান হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচন করা হলো সে কথা উল্লেখ করে তিনি অভিমত পোষণ করেন যে, বাংলাদেশে যে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং সে যুদ্ধে শান্তিকামী বীর জনতার যে জয়লাভ সুচিত হয়েছে তার মূল্য এশিয়া তথা বিশ্বে অপরিসীম। শান্তির স্বপক্ষে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের যে বিজয় তা এশিয়া মহাদেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের জন্য বাংলাদেশের গুরুত্ব শুধু এশিয়া মহাদেশেই নয় গোটা বিশ্বেই আজ সু-প্রতিষ্ঠিত। এই মহাগৌরবের অধিকারী বাংলাদেশ তাই এশীয় শান্তি সম্মেলনের স্থান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়া এদেশেই সেই মহান নেতা রয়েছেন যাঁর ঐতিহাসিক জনপ্রিয়তা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মর্যাদা গোটা বিশ্বব্যাপী এক দারুণ সাড়া জাগিয়েছে। আজীবন তিনি শান্তির জন্যে সংগ্রাম করেছেন। বিশ্বের দুঃখী মেহনতী মানবাত্মার আর্তধ্বনি হয়ে প্রকাশিত হয়েছেন। বিশ্ব শান্তি পরিষদ নেতা আরো বলেছেন—বাংলাদেশের বীর সংগ্রামী জনসাধারণ যে সত্যিকার শান্তিকামী তার বহু প্রমাণ রয়েছে। ইতিমধ্যেই এদেশের নেতা ও জনগণ বিশ্বের বিভিন্ন মুক্তিকামী দেশের সংগ্রামী জনসাধারণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন এবং আরো তারা অব্যাহতভাবে শান্তির স্বপক্ষে আন্দোলন করে চলেছেন।
শ্রী রমেশ চন্দ্র বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও বিজয়কে বিশ্বের মুক্তিসংগ্রাম ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বলে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, বাংলাদেশের মানুষের এ বিজয় বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের বিজয়। এ বিজয় শুধু পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধেই বিজয় নয়, বিশ্বের সকল সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিকবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিজয়। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম যে ইতিহাসের স্বাক্ষর রেখে গেছে তার তুলনা হয় না। এবং বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা তুলনাহীন। বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদান করে যোগ্য ব্যক্তির প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করছে। শ্রী রমেশ চন্দ্রের ভাষণের আলোকে আমরাও বলবো—বঙ্গবন্ধু এদেশের জনগণের গৌরব, ইতিহাসের অমর ব্যক্তিত্ব। তাঁর শান্তি পদক লাভ যেমন ঐতিহাসিক তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তিতে বিশ্বাসী। উপমহাদেশীয় তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বাংলাদেশ অগ্রণী। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে তার অভিমত ঘোষণা করেছে। শান্তি পরিষদের এ সম্মেলনের মাধ্যমে আমরাও বিশ্বের সংগ্রামরত ও স্বাধীনতাকামী মানুষের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি। বিশ্ব শান্তির অমরত্ব কামনা করছি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের শান্তি ও প্রগতির জন্যে সংগ্রাম করে যাওয়ার শপথ গ্রহণ করছি।

অবাধ লাইসেন্সে বস্ত্র আমদানী

সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ কাপড় আমদানী ও বস্ত্র সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে অবাধ সাধারণ লাইসেন্সের অধীনে বেসরকারী খাতে কাপড় আমদানীর অনুমতি দেওয়ার জন্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগ গত মঙ্গলবার এক প্রেসনোটে ঘোষণা করেন যে, বেসরকারী খাতের এই কাপড় আমদানী হবে টিসিবি যে কাপড় আমদানী করেছে তার অতিরিক্ত। সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা এবং নিম্নে ৫০ হাজার টাকার বস্ত্র আমদানীর অনুমতি দেওয়া হবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে জেলাসমূহের মধ্যে মোট বৈদেশিক মুদ্রা বন্টন করা হবে। প্রতিটি জেলার বৈদেশিক মুদ্রার কোটা কেবলমাত্র সেই জেলার আমদানীকারকরা ব্যবহার করতে পারবে। বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের পরিমাণ হবে (১) তাঁতের শাড়ীসহ সূতী কাপড় ৫০ শতাংশ (২) তাঁতের ও স্টেপল ফাইবার লুঙ্গিসহ ২৫ শতাংশ (৩) মার্কিন কাপড় ১৫ শতাংশ এবং (৪) লং ক্লথ ১০ শতাংশ। আমদানীকারকদের তাদের অথোরাইজেশনের পুরো টাকার শাড়ী লুঙ্গি অথবা মার্কিন কিংবা উপরোক্ত তিনটির যেকোন একটির জন্যে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে।
অবাধ লাইসেন্সের বস্ত্র আমদানীর যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছেন তা অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। কেননা টি.সি.বি. এ পর্যন্ত যে পরিমাণ কাপড় আমদানী করেছেন, তাতে দেশের বস্ত্র সংকট নিরসন করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া টি.সি.বি. আমদানীকৃত শাড়ীর কেলেঙ্কারীর দরুণ সাধারণ সাদামাটা সূতী শাড়ীর দামও জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিলো। শুধু তাই নয়, টি.সি.বি’র কাপড় সবার হাতেও এ পর্যন্ত পৌঁছায়নি। এ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী সূতী বস্ত্রের আমদানীর পরিবর্তে টিসিবি জাপানী ট্রেটন, মূল্যবান শাড়ী আর শাল আমদানী করে সমস্যার সমাধান দূরে থাক, গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার সৃষ্টিই করেছে। এতে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হয়েছে অন্যদিকে আমদানীকৃত কাপড়ও চোরাবাজারের অলিতে-গলিতে হারিয়ে গেছে।
এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার জেলাওয়ারী জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিটি জেলার জন্যে বস্ত্রের কোটা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার ফলে সাধারণ ক্রেতাদের হাতে কাপড় পৌঁছবে বলেই আমরা মনে করি। তাছাড়া মোট বস্ত্রের মধ্যে অর্ধেক মিলের শাড়ী, সূতী লুঙ্গি শতকরা ২৫ ভাগ, মার্কিন ও লং ক্লথের পরিমাণ যথাক্রমে ১৫ ও ১০ ভাগ হওয়াতে সাধারণ কাপড়ের চাহিদাও পূরণ হবে।
আমরা এ প্রসঙ্গে একটি সমস্যার কথা উল্লেখ করতে চাই। সাধারণ মানুষের বস্ত্র সমস্যা সমাধানের জন্যে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছেন তো গোড়াতেই বিনষ্ট হয়ে যাবে, আমদানীকৃত কাপড়ের উপর যদি ট্যাক্স আরোপ করা হয়। ট্যাক্স ধার্যের ফলে কাপড়গুলো যখন বাজারে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছবে তখন দেখা যাবে, বারো টাকার শাড়ীর দাম হয়েছে বত্রিশ টাকা আর চার টাকার লুঙ্গির দাম হয়েছে চব্বিশ টাকা। আর তাই যদি হয়, তাহলে এই দুর্মূল্যের বাজারে কাপড় কেনার মতো অবস্থা থাকবে না সাধারণ ক্রেতাদের। তাহলে সমগ্র ব্যাপারটাই হরষে বিষাদই হবে। ট্যাক্স ধার্য করা হোক তবে তা কোন অবস্থাতেই সমাজের বৃহত্তর সংখ্যক মানুষের চাহিদা মেটানোর মতো সূতা বস্ত্রের উপর নয়। আশা করি, সরকার এ বিষয় গভীরভাবে বিচার বিবেচনা করে দেখবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন