৮ নম্বর সেক্টরের পরিচিতি
এক বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে ৮ নম্বর সেক্টর গঠিত ছিল। এপ্রিল মাসে এ সেক্টরের অপারেশনাল এলাকা ছিল কুষ্টিয়া, যশাের, ফরিদপুর এবং খুলনা জেলার দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত। পরবর্তী সময় অপারেশনাল এলাকা। সংকুচিত করে কুষ্টিয়া, যশাের, খুলনা জেলা সদর, সাতক্ষীরা মহকুমা এবং ফরিদপুরের উত্তরাংশ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। প্রথমে সেক্টর অধিনায়ক ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। পরবর্তী সময় মেজর আবুল মঞ্জুর ১৮ আগস্ট মেজর ওসমানের কাছ থেকে সেক্টরের দায়িত্ব বুঝে নেন। সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছিল ৩,৩১১জন এবং গণবাহিনীর সদস্য ছিল ৮ হাজার। সেক্টর সদর দপ্তর বেনাপােলে স্থাপিত হলেও কার্যত এর একটা বিরাট অংশ ভারতের কল্যাণী শহরে অবস্থিত ছিল। সেক্টর এলাকাকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। সাব-সেক্টরসমূহ গড়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের লালগােলা সীমান্ত থেকে খুলনার অপর প্রান্ত পর্যন্ত। নিম্নে সাবসেক্টরসমূহের নাম ও অধিনায়কদের প্রদান করা হলাে:
• বয়রা সাব-সেক্টর: এ সাব-সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপটেন খন্দকার নাজমুল হুদা।
• হাকিমপুর সাব-সেক্টর কমান্ড করেছেন ক্যাপটেন সফিকউল্লাহ।
• ভােমরা সাব-সেক্টর: প্রথমে ক্যাপটেন এ টি এম সালাহউদ্দিন এবং পরে ক্যাপটেন মাহবুবউদ্দিনকে এ সাব-সেক্টর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া
• লালবাজার সাব-সেক্টর: অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপটেন এ আর আযম চৌধুরী।
বানপুর সাব-সেক্টর: অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপটেন মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান। বেনাপােল সাব-সেক্টর: অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপটেন আব্দুল হালিম ও ক্যাপটেন তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী।
• শিকারপুর সাব-সেক্টর: অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপটেন তৌফিক-ই এলাহি চৌধুরী ও লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর। ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামাল উদ্দিন চৌধুরী, ক্যাপটেন আব্দুল ওহাব, লেফটেন্যান্ট এনামুল হক, মেজর শামসুদ্দিন, মেজর মুজিব এ সাব-সেক্টরে যােগদান করেন।
সেক্টরের দায়িত্ব পালনে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামাল উদ্দিন, ইপিআর-এর উপসহকারী পরিচালক মােজাফফর আহমদ প্রমুখ প্রশংসার দাবি রাখেন। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে মেজর শামসুদ্দিনের ভূমিকা ছিল উল্লেখযােগ্য। ৮ নম্বর সেক্টরের প্রতিটি সাব-সেক্টরেই তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন। ২৭ মে পাকিস্তানি সেনাদের ২টি কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর বয়রা অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। বয়রা সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছিল বয়রা সীমান্তবর্তী একটি বাঁধের উপর এবং তার পিছনে এ অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের উপর বার বার আঘাত হানায় তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপটেন সালাহউদ্দিন ইপিআর বাহিনীর ১টি কোম্পানি নিয়ে ঘাঁটিতে অবস্থান করছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা ২৭ মে ভাের ৪টার দিকে ২টি কোম্পানি নিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা সুবিধা করতে পেরে পিছনে সরে যায়। কিন্তু সকাল ৬টার দিকে পুনরায় পাকিস্তানি সেনারা পালটা আক্রমণ করে থেমে থেমে এ সংঘর্ষ দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। পাকিস্তানি সেনাদের ১টি ব্যাটালিয়নের বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন সময় এ সংঘর্ষে অংশ নেয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তানিদের পক্ষে ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক আহত হয় এবং ১জন ক্যাপটেনসহ ১৩০জনের মতাে পাকিস্তানি সেনা প্রাণ হারায়। মুক্তিবাহিনীর ২জন শহিদ এবং ৮ জন আহত হন। এ সংঘর্ষে নায়েব সুবেদার জব্বার, হাবিলদার বেলায়েত হােসেন ও হাবিলদার তরিকউল্লাহ বীরত্বের পরিচয় দেন। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক আক্রমণের মুখে ক্যাপটেন সালাহউদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে পিছনে সরে যান। অন্যদিকে ক্যাপটেন নাজমুল হুদা বয়রার অপুর এলাকায় অ্যামবুশ করে বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন। ১০ মে ক্যাপটেন নাজমুল হুদা তার বাহিনী নিয়ে চৌগাছা ও মাসালিয়া সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে ওত পেতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনাদের ১টি টহল দল ঐ পথে অগ্রসর হতে থাকে। ক্যাপটেন হুদা।
গুলি চালালে উভয়পক্ষে গােলাগুলি শুরু হয়। সংঘর্ষে ৮ জন পাকিস্তানি সেনা। নিহত হয় এবং অবশিষ্ট সৈন্যরা বেশ কিছু গােলাবারুদ ফেলে রেখে পালিয়ে। যেতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ২জন সদস্য শহিদ হন। ১৫ মে ক্যাপটেন নাজমুল হুদা কাশীপুর বিওপি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের টহল। দলের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৬জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে ১টি এলএমজি, ৮টি রাইফেল, ১টি মানচিত্র এবং বেশ কিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করেন। এখানে পাকিস্তানি সেনাদের ১টি জিপ ধ্বংস হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী, পুলিশ ও তার সহযােগী দালাল অবাঙালিরা ছুটিপুর গ্রামে ঢুকে আগুন জ্বালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালাতে থাকে। ক্যাপটেন হুদা এ সংবাদ পেয়ে ইপিআর বাহিনীর ২টি প্লাটুন নিয়ে ২৭ মে ছুটিপুর গ্রাম ঘিরে ফেলেন। ক্যাপটেন হুদা পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে বলেন। কিন্তু তারা সে কথা গ্রাহ্য না করে গুলি চালায়। ক্যাপটেন হুদা তার বাহিনীকে পালটা গুলি চালানাের নির্দেশ দিলেন। বেশ কিছুক্ষণ সংঘর্ষ স্থায়ী হয়। সংঘর্ষে ৪জন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং ১১জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ঝিকরগাছা থানার বাঙালি পুলিশ অফিসারও ছিলেন। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের ১টি জিপসহ বেশ কিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করে। অবশিষ্ট পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। ক্যাপটেন হুদা ২৭ মে’র মধ্যে প্রায় ১৫০ বর্গমাইল এলাকা নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। ২৭ মে কাশীপুর বিওপিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের ২টি কোম্পানির সঙ্গে ক্যাপটেন হুদার বাহিনীর পুনরায় সংঘর্ষ হয়। অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে ক্যাপটেন হুদা সুবেদার মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে ১টি প্ল্যাটুনকে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি সেনাদের বাধা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের তীব্রতা বুঝে ক্যাপটেন হুদা নিজে কিছু সংখ্যক সৈন্য দিয়ে কাশীপুর বিওপি’র ডান দিক থেকে শক্রদের উপর তীব্রভাবে আক্রমণ চালালেন। পাকিস্তানি সেনারা এ সংঘর্ষে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে, কিন্তু তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানি সেনাদের হতাহতের সংখ্যা ছিল ভয়াবহ। রণাঙ্গন থেকেই ৬০জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ৩জন। ১টি রকেট লঞ্চারসহ ৩০টি চাইনিজ রাইফেল পাকিস্ত নি সেনাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর ৪টি ট্রাক ঐদিন মুক্তিবাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সুবেদার মনিরুজ্জামান শহিদ হন এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। মে মাসের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে ভােমরা এলাকা দখল করে নিলেও জুলাই মাসে ক্যাপটেন মাহবুবের নেতৃত্বে তাদের উপর হামলা চালিয়ে ভােমরা পুনরুদ্ধার করা হয়। কৈখালীতেও পাকিস্তানি সেনাদের একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। বস্তুত জুলাই মাসেই ক্যাপটেন মাহবুব তার বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের উপর হামলা চালিয়ে কৈখালী দখল করেন।
৫ আগস্ট ক্যাপটেন নাজমুল হুদা প্রায় ২ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের মজবুত ঘাটি বর্ণী বিওপি আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি সেনারা সংখ্যায় প্রায় ৭৫জনের মতাে ছিল। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা তাদের ২৫জনের লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। ক্যাপটেন নাজমুল হুদা তাড়াতাড়ি বর্ণী বিওপি থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিজেদের মূল ঘাটিতে নিয়ে যেতে শুরু করেন। এমন অবস্থায় পাকিস্তানি সেনারা পিছন থেকে অগ্রসর হয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী এ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ব্যাপক সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর ৪জন শহিদ হন এবং ক্যাপটেন নাজমুল হুদা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। এদিকে ১৭ জুলাই মুজিবনগরের কাছে বাগুয়ান ও রতনপুর ঘাটের মাঝামাঝি জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে নায়েব সুবেদার পাটোয়ারির মুক্তিযােদ্ধা দলের এক সংঘর্ষ হয়। ২৪ আগস্ট ১ কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা নাটোলা থেকে মুজিবনগরের দিকে অগ্রসর হয়। ক্যাপটেন এ আর আযম চৌধুরী এ সংবাদ জানতে পেরে মুক্তিবাহিনীর ১টি কোম্পানি নিয়ে বাগুয়ান ও মানিকনগরে এসে ডিফেন্স নেন। সকাল ১০টার সময় পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর রাইফেলের রেঞ্জে আসা মাত্র গুলি ছুড়তে থাকেন। উভয় পক্ষে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ স্থায়ী হয়। সংঘর্ষে ৯জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং বেশ কিছু আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ১জন এলএমজিধারী যােদ্ধা গুরুতর আহত হন। মার খেয়ে পিছনে সরে যায় পাকিস্তানি সেনারা। অন্যদিকে, ক্যাপটেন মুস্ত ফিজুর রহমান, ক্যাপটেন তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী, ক্যাপটেন মাহবুব, লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর, প্রমুখ অফিসার তাদের স্ব স্ব সাব-সেক্টর এলাকায় পাকিস্তানিদের উপর হামলা অব্যাহত রাখেন।
১৭ আগস্ট গয়েশপুরে পাকিস্তানি সেনাদের ১টি টহল দলের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। ক্যাপটেন মুস্তাফিজুর রহমানের নির্দেশে হাবিলদার মফিজুল হক তার প্লাটুন নিয়ে গয়েসপুর এলাকাতে অবস্থান করছিলেন। ১৭ আগস্ট হাবিলদার মফিজুল হক পাকিস্তানি সেনাদের ১টি টহল দলকে আসতে দেখে তার দল নিয়ে ২টি কলামে ভাগ করে বসে থাকেন। টহল দল গয়েশপুর গ্রাম পেরিয়ে যাওয়ার শেষ পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর রাইফেল গর্জে উঠে। এ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা এতটাই ভীত হয়ে পড়ে যে, পালটা আক্রমণ করার পরিবর্তে তারা জিপ ফেলে পালিয়ে যায়। হাবিলদার মফিজ তার বাহিনী নিয়ে বেশ কিছু গােলাবারুদসহ জিপটি সাব-সেক্টর সদর দপ্তরে (বানপুরে) পৌছে দেন। ৮ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক মেজর মঞ্জুর প্রতিটি সাব-সেক্টর সফর করে মুক্তিবাহিনীকে সুসংহত ও সুসংগঠিত করে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর আঘাত হানা শুরু করেন। বেনাপোেল সাব-সেক্টর অধিনায়ক ক্যাপটেন নাজমুল হুদাকে ৫ সেপ্টেম্বর সেক্টর অধিনায়ক মেজর মঞ্জুর আরও একটি অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে আগত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গেরিলাদের ফরিদপুর জেলা এবং ঝিনাইদহ মহকুমার ২টি থানা ব্যতীত সমগ্র যশাের জেলার অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে গেরিলা অবস্থান প্রস্তুত করে সেখান থেকে গেরিলাদের প্রত্যন্ত এলাকায় পাঠাতে বলেন। ক্যাপটেন নাজমুল হুদা তার সাবসেক্টরের দায়িত্ব ছাড়াও এ অতিরিক্ত দায়িত্বটি সুষ্ঠুভাবে পালন করেন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড