খুলনা জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ইছামতি, যমুনা, কপােতাক্ষ, শিবসা, ভদ্রা, পশুর, রূপসা, বলেশ্বর এবং এসব নদীর শাখাপ্রশাখা যে ভূখণ্ডকে শতধা বিভক্ত করেছে তারই নাম খুলনা। জেলার পূর্বাংশের উত্তরে মধুমতি নদী। মধুমতির অপর পাড়ে গােপালগঞ্জ জেলা। মধ্য ও পশ্চিমাংশের উত্তরে নড়াইল এবং যশাের সদর মহকুমা, দক্ষিণে। বঙ্গোপসাগর। পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। মধুমতি এবং ভৈরবের মধ্যবর্তী অঞ্চল জেলার অপেক্ষাকৃত নিম্নাঞ্চল। ভৈরব এবং ভদ্রার মধ্যবর্তী এলাকায় ফুলতলা ও ডুমুরিয়া থানার বিরাট নিমভূমি। উত্তর-পশ্চিমে সম্পূর্ণ কলারােয়া এলাকা এবং ফুলতলা থানার উত্তরাংশ উঁচু সমতল ভূমি। কলারােয়া এলাকার উত্তরে এবং উত্তর-পশ্চিমে যশাের এবং ২৪ পরগনা জেলার উচু সমতল ভূমির। দক্ষিণ-পূর্বমুখী ক্রম বিস্তৃতির শেষ অধ্যায়। নতুন দ্বীপাঞ্চল এবং পুরাতন দ্বীপসমূহের পরিধিবৃদ্ধিসহ হিসাব করলে জেলার বর্তমান আয়তন দাড়াবে প্রায় ৪,৭০০ বর্গমাইলের কাছাকাছি। এ পরিধিবর্ধন শুধু সুন্দরবনের আয়তনের পরিধি বৃদ্ধি। সমগ্র জেলা গাঙ্গেয় পলি দ্বারা গঠিত। উত্তর-পশ্চিমাংশ এবং উপকূলীয় বাঁধ এলাকা ছাড়া এখনাে জেলার বৃহত্তর অংশ প্লাবন এলাকা। এখনাে জেলার বিরাট অংশে পলি অবক্ষেপণে ভূ-গঠন চলছে। স্বভাবতই জেলার ভূভাগ পলি সমৃদ্ধ। অনেকের মতে জেলার নিমাঞ্চল, বিশেষ করে সুন্দরবনের মাটির উচ্চতা আবহমানকাল থেকে প্রায় একই রূপ। খুলনার ভূমি গঠন সু-প্রাচীন নয়। পশ্চিমবঙ্গের অজয় দামােদর উপত্যকা, বর্ধমান, উত্তরবঙ্গ বা চট্টগ্রাম অঞ্চলে নতুন প্রস্তর বা তাম্রযুগের লােকবসতির প্রমাণ পাওয়া গেলেও তার উপর ভিত্তি করে বলা যায় না সমসাময়িক যুগে খুলনার সৃষ্টি হয়েছিল বা লােকবসতি ছিল। গঙ্গার প্রবাহই আজকের জেলা খুলনার ভূমি গঠন করেছে যুগ যুগ ধরে পলি সঞ্চিত করে।
রামায়ণে গঙ্গার স্বর্গত্যাগ, সাগর রাজার ৬০ হাজার পুত্রকে উদ্ধার করার জন্য সাগর যাত্রা এবং অবশেষে সাগরসংগমের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। গঙ্গার সাগরসংগমস্থলে সাগর দ্বীপ অবস্থিত। সাগর দ্বীপের অবস্থানের সাথে বর্তমান খুলনার অবস্থান তুলনা করে অনায়াসে খুলনার প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে কিছুটা অনুমান করা যায়। সুন্দরবনের ইতিহাস প্রণেতার মতে, ভাগীরথীর পূর্ব দিকের স্থানগুলাের নাম ছিল বঙ্গ, সীতার পিতৃভূমি ছিল মিথিলায় এবং সেই মিথিলা বর্তমান মালদহ জেলা এবং রাজশাহী জেলার অংশ, অর্থাৎ মহানন্দা নদীর পশ্চিম দিকের ভূভাগ। ইছামতি থেকে বলেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত খুলনা জেলার উত্তরাংশ বৃদ্ধ দ্বীপ বা বুড়ন। সাতক্ষীরার কুমিরা, তালা, শােভনা ও সেনহাটি বৃদ্ধ দ্বীপের কয়েকটা পুরাতন নগর। খুলনা জেলার পূর্বাংশ চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্গত ছিল। জেলার বিভিন্ন অঞ্চল সমুদ্রের বুক থেকে জেগে উঠেছে, জেলার কোনাে কোনাে অংশ প্রাচীন কালে গঠিত হয়েছে, তবে অতি সু-প্রাচীন নয়। দাউদ খান কররানীর সময়েই যশাের রাজ্য প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় বর্তমান খুলনার অধিকাংশ এলাকা যশাের রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। কথিত আছে যে, রাজা বিক্রমাদিত্য ছিলেন দাউদ খানের মুখ্যমন্ত্রী এবং তার খুড়তুতাে ভাই বসন্ত রায় প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা। পরবর্তী সময় এ বিক্রমাদিত্যের পুত্র প্রতাপাদিত্য মােগলদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং খুলনার দক্ষিণাঞ্চলে স্বাধীনভাবে প্রতাপাদিত্যের প্রতিপত্তির এলাকা খুলনা, যশাের এবং ২৪ পরগনার বিস্তৃত অঞ্চল। তার রাজধানী ছিল খুলনা জেলার অভ্যন্তরে। দেশের অন্যান্য এলাকার মতাে খুলনাও দীর্ঘ সময় স্বাধীনতার সুখ থেকে বঞ্চিত থাকে। প্রতাপাদিত্যের পতনের পর এলাকার শাসনভার ভার মােগলরা এ দেশীয়দের হাতে ন্যস্ত করা সমীচীন মনে করেন নি। পূর্ববর্তী আমলের অভিজ্ঞতা তাদের শিক্ষা দেয় এ দেশীয়দের হাতে ক্ষমতা রাখা নিরাপদ নয়। ১৮৬০ সালের কৃষক অসন্তোষ ইংরেজ শাসনকে ভাবিয়ে তােলে এবং নীল।
চাষের ব্যাপারে আইন প্রণয়নে বাধ্য করে। ১৮৬১ সালে ২৪ পরগনা জেলার অধীন সাতক্ষীরা মহকুমা এবং ১৮৬৩ সালে যশাের জেলার অধীন বাগেরহাট মহকুমা সৃষ্টি করা হয়। বাকেরগঞ্জ জেলা থেকে কচুয়া থানাকে বিচ্ছিন্ন করে বাগেরহাটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সমসাময়িক যুগে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও প্রজাদের অসন্তোষ অনেক সময় প্রকাশ্য বিদ্রোহে রূপ নেয়। ইংরেজরা পুলিশ মিলিশিয়া দিয়ে সেগুলাে ঠেকাবার চেষ্টা করে। এ সময় খুলনা অঞ্চলে তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য বিপ্লবাত্মক ঘটনা ঘটেছে কি না জানা যায় নি। তবে ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে নিকটবর্তী ২৪ পরগনা জেলা এবং ফরিদপুর জেলার ঘটনাবলি খুলনাকে অত্যন্ত প্রভাবিত করে। অনেকে মনে করেন ১৮৫৭ সালের সিপাহি আন্দোলন সর্বপ্রথম উপমহাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম। বিদ্রোহের শুরু হয় খুলনার অদূরে বারাকপুরে।
১৮৮২ সালে খুলনাকে একটা পৃথক জেলা হিসেবে ঘােষণা করা হয়। এ নতুন জেলায় প্রাক্তন যশাের জেলার খুলনা ও বাগেরহাট মহকুমা এবং ২৪ পরগনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বস্তুত গেজেট বিজ্ঞপ্তি হয়। ১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিল। নতুন জেলা সৃষ্টির প্রত্যক্ষ এবং প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সুচারুরূপে সুন্দরবনের প্রশাসন চালানাে। উরু এম কে ছিলেন খুলনার প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর এবং পদাধিকার বলে জেলা রােড সেচ কমিটির প্রথম চেয়ারম্যান। খুলনায় যারা জাতীয় কংগ্রেসের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাঁদের অনেকেই প্রথম থেকে কংগ্রেসকে একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের মুখপাত্র হিসেবে গ্রহণ করেন, ফলে এখানে সাম্প্রদায়িকতার বিষ সমাজ জীবনকে কলুষিত করতে শুরু করে। তবে সাম্প্রদায়িকতার বিষময় ফল অন্যত্র যেভাবে দেখা দেয় খুলনা জেলায় তেমন ভয়াবহ রূপ নেয় নি। খুলনায় হিন্দুদের অনুপাতে মুসলমান কিছুটা কম ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়। মুসলিম প্রধান এলাকা নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলাে। কিন্তু নিদারুণ দুঃখ ছিল খুলনার মুসলমানদের জন্য। অবশ্য ঐ বছর ৩ জুন স্থির হয়েছিল যে, খুলনা। ভারতের অন্তর্গত হবে আবার ঐ তারিখেই ভারতের সাময়িক বিভাজন ঘােষিত হয়। ঘােষণার পর পরই খুলনাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বাউন্ডারি কমিশনে আপিল করা হয়। মুসলমানদের ধারণা ছিল ১৪ আগস্টের অর্থাৎ যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের যাত্রা শুরু হবে তার আগে মামলার রায় হবে এবং খুলনা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে। কয়েক জায়গায় সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। অনেক নেতৃবৃন্দ যশােরের নােয়াপাড়াতে আশ্রয় নেয়। ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায়। বেতারে ঘােষিত হলাে র্যাডক্লিফ মিশনের রােয়েদাদ খুলনা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড