You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুষ্টিয়া জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পূর্বে প্রায় ১০০ বছর অবিভক্ত নদীয়া জেলার অংশ ছিল। এ জেলা নদীয়া জেলাভুক্ত হওয়ার পূর্বে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অংশে পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর, যশাের, রাজশাহী, পাবনা প্রভৃতি জেলা অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে বিখ্যাত ভৌগােলিক টলেমির মানচিত্রে গঙ্গা নদীর অববাহিকায় কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ দেখা যায়। এ ক্ষুদ্র দ্বীপাঞ্চলকে কুষ্টিয়া অঞ্চল মনে করা হয়। বাংলাদেশে সমতট, বঙ্গ ও গৌড় এ ৩টি রাজ্যের শাসনামলে কুষ্টিয়া অঞ্চল কোনাে সময়ে সমতট আবার কোনাে সময়ে গেীড়ের শাসনাধীন ছিল। কুষ্টিয়া অঞ্চল সপ্তম শতাব্দীতে শশাঙ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল বলে অনুমিত হয়। ৭৫০ সালে পাল রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হলে কুষ্টিয়া অঞ্চল তার রাজ্যভুক্ত হয়। পাল রাজত্বের অবসানকাল (দশম শতাব্দীর শেষাংশ) পর্যন্ত এ অঞ্চল পাল রাজ্যভুক্ত ছিল। কুষ্টিয়া অঞ্চল কিছুকালের জন্য চন্দ্রবংশীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। ভারতকোষে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পূর্বকালে কুষ্টিয়া সেনরাজগণের রাজত্বাধীন ছিল। বখতিয়ার খিলজীর নদীয়া বিজয়ের পর কুষ্টিয়া অঞ্চল মুসলিম শাসনে এসেছিল। ত্রয়ােদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ পর্যন্ত ৫৬২ বছরে মােট ৭৬জন সুবেদার, নাজিম, রাজা ও নবাব বাংলাদেশ শাসন করেছেন। কুষ্টিয়া তাদের প্রায় সকলেরই শাসনের অন্তর্গত ছিল। বাংলার নবাব মুর্শীদকুলী খাঁর শাসনকালে কুষ্টিয়া ও যশাের অঞ্চলে রাজা সীতারাম ১৭১১ সালে মােগল শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ১৭২৮ সালে নদীয়ার গদিতে বসেন। তিনি রাজা সীতারামের রাজ্যেরও কিছু অংশ লাভ করেন। তার রাজ্য এলাকায় চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। নীলবিদ্রোহের কারণেই ১৮৬০ সালে কুষ্টিয়া মহকুমা গঠন করার প্রয়ােজন হয়েছিল। নবাব মুর্শীদকুলী খাঁর নবাবি আমলের শেষ দিক থেকে কুষ্টিয়া অঞ্চল ৩টি জমিদারির অধীন ছিল।

মেহেরপুরের কিছু অংশ নদীয়া রাজ্য খােকসা, কুমারখালী নলডাঙ্গা রাজ্য এবং অবশিষ্ট অংশ নাটোর রাজ্য। কুষ্টিয়া অঞ্চলে মহারানি ভবানী ছিলেন সর্বাপেক্ষা বড়াে জমিদার। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর কুষ্টিয়া জেলায় ছােটোবড়াে ২৬১টি জমিদারির সৃষ্টি হয়। তবে অধিকাংশ জমিদার কৃষ্ণনগরের মহারাজা, নাটোরের মহারানি, মুর্শীদাবাদ এস্টেট, নলডাঙ্গার রাজা এবং মেদিনীপুর এস্টেটের অধীনে ছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কুষ্টিয়া জেলায় কয়েকজন নীলকর জমিদারি ক্রয় করেছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামল থেকে সমগ্র ব্রিটিশ রাজত্বকাল পর্যন্ত কুষ্টিয়া জেলায় জমিদার, নীলকর, জোতদার প্রভৃতি সামন্ত প্রভুরা প্রজা সাধারণের উপর অকথ্য অত্যাচার করেছে। জমির মালিক ছিল জমিদার, নীলকর ও জোতদারগণ। জমিদার ও নীলকরদের অসহনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিতুমীর সাধারণ চাষী সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্য তাদেরকে সংগঠিত করেন। নদীয়া, যশাের, ২৪ পরগনা ও মুর্শীদাবাদ জেলাঞ্চল নিয়ে তিতুমীর এক বিস্তৃত অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন। তিতুমীরের প্রধান সহকারী ছিলেন গােলাম মাসুম। তিতুমীরের বিরুদ্ধে দেশের সকল হিন্দু জমিদার ও নীলকর সংঘবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ সরকারের সাথে তাঁকে দমন করার পরিকল্পনা করেন। তিনি নারকেলবাড়িয়াতে একটি বাঁশের কেল্লা তৈরি করে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সজ্জিত করেন। কৃষকদের নিয়ে গঠিত তার মুক্তিবাহিনী নিয়ে নীলকর, জমিদার ও ব্রিটিশের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হন।

১৮৩০ সালে আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে পরিচালিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে কামানের গােলার আঘাতে এ কৃষক বীর শহিদ হন। (১৯ নভেম্বর)। তার সহকারী গােলাম মাসুমসহ প্রায় ১৪০জন মুক্তিসংগ্রামীর ফাসি হয়, বহু লােককে দ্বীপান্তর ও জেল দেওয়া হয়। ওয়াহাবি আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা কাজী মিয়াজান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর নিকটবর্তী দুর্গাপুর গ্রামে উনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৬১ সালে ওয়াহাবি মুজাহিদ বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীর এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। আফগানদের বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও ব্রিটিশ বাহিনী এ লড়াইয়ে পরাজিত হয়। ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম নেতা কাজী মিয়াজান কুষ্টিয়ায় ইসলামি সংস্কার আন্দোলনের অগ্রদূত ছিলেন। কুমারখালী অঞ্চল ছাড়াও সমগ্র কুষ্টিয়া জেলাতেই ওয়াহাবি আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করেছিল। হাজি শরিয়ত উল্লাহ পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলন ফরায়েজি আন্দোলন নামে পরিচিত। হাজি শরিয়ত উল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন কুষ্টিয়া জেলায় সামান্য প্রভাব ফেলেছিল। কুষ্টিয়া জেলার আলমডাঙ্গা থানায় ফারাজী পাড়া নামক পল্লিতে এখনাে কিছু ফরায়েজি বসবাস করছেন। সিপাহি বিদ্রোহের সময় কুষ্টিয়া জেলায় কিছু গােলযােগ হয়েছিল। নদীয়ার বিরহামপুরে নদীয়া ডিভিশনে দেশীয় সিপাহিরা বিদ্রোহ করে। সিপাহিবিদ্রোহ দমন করার পর বহু দেশি সিপাহি কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে। আত্মগােপন করেছিল। পরবর্তী সময় আত্মগােপনকারী সিপাহিদেরকে খুঁজে বের করে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহী সিপাহিদের আশ্রয়দানের জন্য বহু গ্রামবাসীকেও হত্যা করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৭ সাল) সময় থেকে ইউরােপীয় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলাে মুসলমানদের একমাত্র শক্তিশালী স্বাধীন রাষ্ট্র তুরস্ককে ধ্বংস করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তুরস্ক সাম্রাজ্যের বহু অংশ মিত্র বাহিনী দখল করে। এসব ঘটনার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানগণ আফগানিস্তানের মওলানা জামালউদ্দিন আফগানি ইসলামি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে খেলাফত আন্দোলন গড়ে তােলেন। কুষ্টিয়া অঞ্চলে বর্তমান শতকের শুরুতে ফুরফুরার পির হজরত আবুবকর সিদ্দিকী ও মুনশি শেখ জমিরুদ্দিন বিদ্যাবিনােদ প্রমুখ ইসলামি সংস্কারকদের প্রচেষ্টায় ইসলামি সংস্কার আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে জাতীয় চেতনা বৃদ্ধি করায় খেলাফত আন্দোলন বিপুল সাড়া জাগায়। খেলাফত আন্দোলনের সময় কুষ্টিয়া জেলায় গ্রামে গ্রামে। মুসলমানদের সভা-মিছিল ইত্যাদি হতাে। খেলাফত আন্দোলনে ব্যাপক ব্রিটিশ বিরােধী প্রচার কার্যের জন্য মাে. আফছার উদ্দিন আহমদ ও শামউদ্দিন আহমদ দুই সহােদর গ্রেপ্তার হন। খেলাফত আন্দোলন ছিল মুসলমান নেতৃবৃন্দ পরিচালিত একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। এ আন্দোলনের সফলতা দেখে ১৯২০ সালের ৮ আগস্ট মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এ আন্দোলন সমর্থন করায় দেশের স্কুলকলেজ বন্ধ করে ছাত্রসমাজ এগিয়ে আসেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!