You dont have javascript enabled! Please enable it!
বৃহত্তর যশাের জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বৃহত্তর যশাের জেলার উত্তরে কুষ্টিয়া ও পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ ও ২৪ পরগনা জেলা, দক্ষিণে খুলনা এবং পূর্বে ও উত্তর-পূর্বে ফরিদপুর জেলা। গড়াই বা মধুমতি নদী প্রকৃতিগতভাবেই যশাের ও ফরিদপুর জেলার মধ্যে সীমানা নির্দেশক। প্রাচীন যশােরের সীমানা কতটুকু ছিল তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায় না। তবে এটুকু বলা চলে যে, খুলনা জেলার দক্ষিণাংশ, ২৪ পরগনা, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর জেলার একাংশ জুড়ে যশাের রাজ্য বিস্তৃত ছিল। ১৭৬৯ সালে তক্কালীন পূর্ববঙ্গে জেলা সৃষ্টি করা হয় এবং তখনই যশাের জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৭৮১ সালে কোম্পানি সরকার রাজস্ব সংগ্রহের জন্য একজন কালেক্টর নিযুক্ত করে যশােরে প্রেরণ করেন। যশাের জেলা সৃষ্টির পর একাধিকবার এ জেলার সীমানার পরিবর্তন হয়েছে। ১৮৬০-৬১ সালে। নীলবিদ্রোহ দমনের জন্য প্রশাসনিক কৌশল হিসেবে যশাের জেলাকে খুলনা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল ও যশাের মহকুমায় বিভক্ত করা হয়। আয়তনের দিক থেকে বৃহত্তর যশাের জেলার অবস্থান ত্রয়ােদশ। নদনদী ও জলাশয়সহ এ জেলার মােট আয়তন ৬,৫৬৭ বর্গকিলােমিটার। বৃহত্তর যশাের জেলা সাবেক যশাের, ঝিনাইদহ, মাগুরা এবং নড়াইল মহকুমা নিয়ে গঠিত। মহকুমাগুলােকে ১৯৮৪ সালে জেলায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। যশাের জেলায় ২১টি থানা ও ২৩২৩টি ইউনিয়ন আছে। যশাের জেলায় মৌজার সংখ্যা ৩২৬৮টি। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বৃহত্তর যশাের জেলার জনসংখ্যা ৪৮,৪৮,০২৩জন, যা সমগ্র বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৫.০২%। মােট জনসংখ্যার মধ্যে ২৪,৯২,২৩৫জন পুরুষ এবং ২৩,৫৫,৭৮৮জন নারী। প্রতি কিলােমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ৭৪০জন। বৃহত্তর যশাের জেলা পৃথিবীর বৃহত্তম গাঙ্গেয় বদ্বীপের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। সমুদ্র সমতল থেকে যশাের অঞ্চলের উচ্চতা প্রায় ৮ মিটার। ভূ-প্রকৃতিগতভাবে এ অঞ্চলটিকে ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়:
ক. উত্তরাংশের উঁচু এলাকা
খ, মধ্যবর্তী এলাকা
গ. দক্ষিণাংশের নিচু এলাকা
আজ থেকে ১০ লক্ষ বছর আগে হিমালয়ের শেষ পর্যায়ের উত্থান হয়েছিল বলে ভূতত্ত্ববিদরা অনুমান করে আসছেন। এ উত্থানের ফলে বাংলাদেশের যেসব অঞ্চল গঠিত হয়েছিল বৃহত্তর যশাের জেলা সেই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। বৃহত্তর যশাের জেলা বাংলাদেশের মৃতপ্রায় বদ্বীপ অঞ্চলের অংশবিশেষ। জেলার দক্ষিণাংশ ফরিদপুরের নিমাঞ্চলের অনুরূপ। জেলার সমভূমি গঠনে পদ্মা নদী। এবং তার প্রধান ২টি শাখা মাথাভাঙা ও গড়াই নদীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যশাের অঞ্চলের সর্ববৃহৎ এবং প্রধান নদী মধুমতি। কুষ্টিয়া শহরের নিকট পদ্মা নদী থেকে এর উৎপত্তি। বৃহত্তর যশাের জেলায় গড়াই-মধুমতির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০৬ মাইল। পদ্মা নদীর একটি শাখানদী কুমার। যশাের জেলার সর্ব-উত্তরে এ নদীর অবস্থান। এ জেলায় নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ কিলােমিটার। নবগঙ্গা নদী মাথাভাঙা নদীর একটি শাখানদী।
কুমার নদীর সমান্তরালে নদীটি দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে। বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা থেকে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে যশাের জেলায় প্রবেশ করে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে ঝিনাইদহের কাছে এসে এটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। যশাের জেলার প্রধান প্রধান নদীগুলাের মধ্যে কপােতাক্ষ নদ একটি। এক সময়ে এ নদ প্রবহমান ও বেগবান ছিল। কিন্তু বর্তমানে (দক্ষিণ অংশ ব্যতীত) এটি মৃত নদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর গতিপথ আঁকাবাঁকা। ভৈরব বৃহত্তর যশাের জেলার একটি প্রধান ও সবচেয়ে বড় নদ। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে। এ নদ পলিতে ভরাট হয়ে যায়। বর্তমানে এটি মরা নদী। কপােতাক্ষ নদ থেকে ভদ্রা নদীর উৎপত্তি। ত্রিমােহনীর নিকট মূল নদী থেকে দ্রা নদীর উৎপত্তি। কেশবপুরের ২ মাইল দক্ষিণে হরিহর নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে নদীটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরবনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। বেতনা বৃহত্তর যশাের। জেলার সর্ব-পশ্চিমের একটি উল্লেখযােগ্য নদী। বেতনা ভৈরব নদীর একটি শাখানদী। কুমার ও মধুমতি নদীকে যে নদীটি সংযােগ করেছে তার নাম মুচিখালী নদী। অতীতে এক সময় এ নদীটির নাম ছিল বারসিয়া। বেং একটি আড়াআড়ি প্রবাহ নদী, যেটি নবগঙ্গা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে এঁকেবেঁকে বুনাগতির কাছে চিত্রা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। চিত্রা মাথাভাঙা নদীর একটি শাখানদী। এ নদী বৃহত্তর যশাের জেলার ভিতর দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে এবং কালিগঞ্জ, গােরাখালি, নড়াইল এবং গােবরা অতিক্রম করে জেলার দক্ষিণে উজিরহাটের কাছে আত্রাই নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। টলেমির মানচিত্র থেকে জানা যায় যে, খ্রিষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে যশাের জেলাসহ বাংলার সমগ্র বদ্বীপ অঞ্চল গঙ্গারাষ্ট্র নামে এক শক্তিশালী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এ থেকে প্রায় নিশ্চিতরূপে মনে হয় যশাের অঞ্চল তখন মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্য ভাগে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং উত্তর ভারতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের আবির্ভাব হয়।
এ সময় বাংলায় ২টি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। প্রথম স্বাধীন রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবাংলার দক্ষিণাঞ্চলে। এটি প্রাচীন বঙ্গ (সমতট) নামে পরিচিত ছিল। এর ফলে যশাের জেলা প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। দ্বিতীয় স্বাধীন রাজ্য ছিল। পশ্চিম ও উত্তর বাংলাব্যাপী। এ রাজ্য গৌড় নামে পরিচিত। সপ্তম শতাব্দীর গােড়ার দিকে শশাঙ্ক গৌড় রাজ্যের সার্বভৌম ক্ষমতা দখল করেন এবং তখন যশাের জেলা তাঁর রাজ্যাধীন ছিল বলে অনুমান করা হয়। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর যশাের জেলা উত্তর ভারতের শেষ হিন্দু নৃপতি হর্ষবর্ধনের শাসনাধীনে আসে। ১৪৫৯ সালে বাগেরহাটস্থ খান জাহান আলী (র.)-এর সমাধিস্তম্ভে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়, যশাের ও খুলনা অঞ্চল নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে মুসলিম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। খান জাহান আলী (র.) বিজিত অঞ্চলকে মাহমুদাবাদ এবং খলীফাতাবাদ নামক ২টি প্রশাসনিক এলাকায়। বিভক্ত করেন। বৃহত্তর যশাের জেলা উপরিউক্ত ২টি প্রশাসনিক এলাকার অন্ত। ভুক্ত ছিল। ১৪৮৭-৯৩ সাল পর্যন্ত ৬ বৎসর গােলযােগপূর্ণ কাল। এ ৬ বছর বাংলাদেশে হাবশি শাসন বজায় ছিল। হাবশি শাসনামলে যশাের জেলা তাদের। শাসনাধীন ছিল না। শের শাহ ও তাঁর উত্তরাধিকারী ইসলাম শাহের (১৫৪৫৫৩ সাল) রাজত্বকালে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গসহ সমগ্র বাংলাদেশ তাদের শাসনাধীন ছিল। মােগল শক্তি ১৫৭৬ সালের পরেও বঙ্গদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে নি। মােগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে (১৫৫৬-১৬৬০ সাল) এ জেলা মােগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বাংলার বার ভুইয়াদের অন্যতম। প্রতাপাদিত্য এ সময় যশাের রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
ষােড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রতাপাদিত্য যশাের রাজ্যের রাজা হন। অবশেষে ১৬০৩ সালে রাজা মানসিংহ এক বিশাল সৈন্য দল নিয়ে যশাের অভিমুখে যাত্রা করেন। প্রথমে মানসিংহ পরাজিত হলেও পরবর্তী সময় মােগল বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে প্রতাপাদিত্য পরাজিত হয়ে সন্ধিপত্রে আবদ্ধ হন। ইসলাম খা প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য সেনাপতি এনায়েত খাকে যশাের আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন। সেই সাথে তিনি প্রতাপাদিত্যের জামাতা বাকলার রাজা। রামচন্দ্রের বিরুদ্ধেও সৈন্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধে প্রতাপাদিত্য শােচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং তার রাজ্য মােগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ইব্রাহীম খানের সুবেদারি আমলে নুরউল্লাহ খান যশোের, বর্ধমান এবং হুগলীর ফৌজদারের পদে আসীন ছিলেন। মুর্শিদকুলী খানের (১৭০৩-২৭ সাল) শাসনামলে বর্তমান যশাের জেলায় অর্থাৎ ভূষণায় রাজা সীতারাম বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। ভূষণার মােগল ফেীজদার মীর আবু তােরাব সীতারামকে দমন করার জন্য সচেষ্ট হন। যশোের রাজ্য সাধারণত চাচড়া রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। পূর্বে সমগ্র যশাের অঞ্চলে ৪টি থানা ছিল। ভূষণা, মীর্জানগর, ধরমপুর এবং খুলনায় নয়াবদ অঞ্চলে। ১৭৮৬ সালে যশােরকে একটি পৃথক জেলায় পরিণত করা হয়। এটিই হচ্ছে বাংলার প্রথম জেলা এবং হ্যাংকেল সাহেব ছিলেন জেলার প্রথম কালেক্টর।
যশাের জেলা গঠিত হয়েছিল ইশপপুর, সৈয়দপুর এবং চাচড়া রাজ্য নিয়ে। ১৭৮৭ সালে মামুদশাহী পরগনা যশােরের সাথে যুক্ত হয়। ১৭৯৩ সালে। নলদীসহ ভূষণাকে যশােরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮১০ সালে শুরু হয় যশােরে নীলবিদ্রোহের ইতিহাস। উনবিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে ফরায়েজি ও তরীকায়ে মুহম্মদীয়া (জিহাদ) আন্দোলনের দ্বারা যশাের জেলার লােকেরা খুবই প্রভাবিত হয়। এ আন্দোলন ধর্মযুদ্ধরূপে শুরু হলেও পরবর্তী সময় তা ইংরেজ শাসন বিরােধী সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়। ফরিদপুরের হাজি শরিয়ত উল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০ সাল) ও তার পুত্র মহসিন উদ্দিন ওরফে দুদু মিয়া (১৮১৯-৬২ সাল) ফরায়েজি আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন। ফরায়েজি আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান সমাজকে নানারূপ কুসংস্কার ও অনৈসলামিক রীতিনীতি থেকে মুক্ত করা। পরে জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুসলমান। কৃষকদের সংগঠিত করে একটি শক্তিশালী প্রজা বিপ্লব গড়ে তােলা এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। জেলার সাধারণ মুসলমানদের কাছে এ আন্দোলন খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর অনুসারী ছিল কৃষক, তাঁতি, জেলে ইত্যাদি সমপ্রদায়ের লােকেরা। ১৮৫৭ সালের সিপাহিবিদ্রোহের সময় যশােরে তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য ঘটনা লক্ষ্য করা যায় নি। সিপাহিদের প্রতি। যশােরের কৃষকদের তেমন কোনাে উৎসাহ ছিল না। এর কারণ হলাে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকগণ সিপাহি বিদ্রোহে যােগদান করেনি।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!