You dont have javascript enabled! Please enable it! ভারতের প্রস্তুতি ছিলো পাকিস্তান ও চীন এর সাথে একসাথে যুদ্ধ চালানোর - সংগ্রামের নোটবুক

দ্বিতীয় অধ্যায়

ভারতের প্রতি হুমকি

খুব দ্রুত পাকিস্তানী শাসক পূর্ব বাংলায় তাদের দমন-পীড়ন নীতি শুরু করে। এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে রাজনৈতিক সমাধান সহসাই হবেনা। এবং পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এতোটাই চরম আকার ধারণ করে যে এক সময় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াই জড়িয়ে পরে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকেই পূর্ব বাংলার ঘটনা ভারতের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে এক সময় লোকসভা ও রাজ্যসভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে বাংলাদেশকে অস্থায়ী সরকার গঠন, মুক্তিফৌজ গঠন এবং রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়দান সবকিছুই দেয়া হবে। জাতীয় স্বার্থেই এগুলো এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ ছিলোনা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয় ছিলো ভারতের নিরাপত্তা। এটা সত্য যে একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে বিমান ছিনতাইয়ের পরে তেমন কিছু ঘটনা ঘটে নাই; তবে নিরাপত্তার বিষয়টা কিন্তু আরও দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করেই সতর্কতা বা ব্যবস্থা নিতে হয়। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র তড়িৎ কোন ঘটনার উপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত হয়না।

জাতীয় নিরাপত্তার গভীরে চিন্তা করলে স্বাভাবতই জাতীয় নীতি, কূটনীতি এগুলো আমলে নিতে হয়। এবং প্রয়োজনে তার জন্য হুমকি বা বল প্রয়োগের বিষয়টি আসে। কিন্তু আমরা নিরাপত্তার কথা আসলে শুরুতে শুধু ডিফেন্সের কথাই ভাই, কিন্তু মূলত নিরাপত্তা আরও বৃহৎ পরিসরের একটি বিষয়। Walter Lippman বলেছিলেন, “A nation has security when it does not have to sacrifice its legitimate interests to avoid war and is able, if challenged, to maintained by war.” ফলে যখনই অকস্মাৎ কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তখনই নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি বিবেচনায় আসে। এবং সেই মত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।

জাতীয় নীতির ভেতরে ভারতের নিজস্ব মূল্যবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য, রাজনীতিতে গণতন্ত্রের চর্চা রক্ষা অন্যতম। পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক বাংলাদেশে সঙ্ঘটিত জেনোসাইড এবং লাখ লাখ শরনার্থীর অবাধে ভারতে প্রবেশ করার ফলে এই বিষয়গুলো হুমকির সম্মুখীন হয়ে পরে। লাখ লাখ শরনার্থীর হঠাৎ প্রবেশের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয়। সামাজিক বৈষম্য থেকে শুরু করে প্রশাসন প্রায় ভেঙ্গে পড়ার যোগাড়। এছাড়া পুরো দেশ জুড়ে ধর্মীয় সহাবস্থানের বিষয়টি ঝুঁকির মধ্যে পরে।

বিষয়টি এমন হতে থাকে যে যদি এই অবস্থায় ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে কোন রাজনৈতিক ও মিলিটারি একশন না নেয় তবে অদূর ভবিষ্যতে পুরো ভারতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়বে। এমনকি সেই বিদ্রোহ পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য এলাকায় চরম আকার ধারণ করবে যা হয়ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এবং শরনার্থীদের ঢালাও বেহিসাবি প্রবেশ কিছু অঞ্চলে ভৌগলিক আগ্রাসনের সৃষ্টি করবে। ফলে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতভাবেই হুমকিতে পড়বে।

তবে এটা স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় যে ভারত সরকার শুরুতেই মিলিটারি একশনের মাধ্যমে এর সমাধা করতে চাইবেনা। শুধু তাই নয়, সেরকমের সামান্যতম ব্যবস্থাও ভারত-পাকিস্তানকে যুদ্ধের দিকে থেকে দিতে পারে। পাশাপাশি চাইনিজ হস্তক্ষেপ ও পাকিস্তানে আমেরিকান মিলিটারি সয়াহতার সম্ভবনা থাকবে। এই অবস্থায় ভারতের আসলে কী করনীয় সেটি সত্যিকার অর্থে বুঝতে হলে ১৯৭১ এর শুরুর দিকের কিছু ঘটনা এবং পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা দরকার।

১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় চীন সরাসরি হুমকি দেয় যে যদি ভবিষ্যতে কোন লড়াই হয় তবে তারা মিলিটারি একশনে যাবে। অর্থাৎ এথেকে এটা স্পষ্ট হয় যে সামনে চিন বা পাকিস্তান যার সাথেই ভারতের যুদ্ধ বাধুক না কেন একের বিপদে অন্যে এগিয়ে আসবে। তাই প্রতিরক্ষা এমনভাবে প্রস্তুত করতে হয়েছে যাতে উভয়ের সাথে একসাথে যুদ্ধ করার মত সক্ষমতা ভারতের থাকে। আরও একটি বড় অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালের অপারেশনের সময় ভারতকে ফরেন এইডের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর উপর অনেকটা বেশী মাত্রায় নির্ভর করে থাকতে হয়েছে। কাজেই ভবিষ্যতে এরকম সুবিধা নাও পাওয়া যেতে পারে – যদি পশ্চিমা দেশগুলো ভারতের নীতির সঙ্গে কোন কারণে একমত না হয়।

Source: The Lightning Campaign – Indo-Pakistan War 1971 – D. K Palit