পাক হানাদার সৈন্যরা ১৯৭১ সনের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ট্রেনযোগে কুড়িগ্রাম নতুন শহরের (খলিলগঞ্জ) ষ্টেশনে পৌঁছে। ষ্টেশনে পৌছেই প্রথমে তারা ষ্টেশনের পশ্চিম দিকের জনসাধারণের পরিত্যাক্ত বাড়ীগুলোতে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে। এরপর হানাদার সৈন্যরা খলিলগঞ্জ বন্দরে ঢুকে পড়ে। ঐ সময় খলিলগঞ্জের ছফর উদ্দিন (এলোপ্যাথি) ডাক্তার বাসাই ছিলেন। বন্দরসংলগ্ন তার বাসগৃহ ছিল। পাক সৈন্যরা বন্দরে ঢুকে পড়ায় তিনি নিরাপত্তার জন্য বাসার পেছনে একটি খালে আত্নগোপন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পাক সৈন্যরা তাকে দেখে ফেলে এবং গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার পূর্বদিন আমি ঘোষপাড়ার চায়ের দোকানে ছিলাম। পাক সৈন্যরা খলিলগঞ্জ উক্ত চারজন লোককে হত্যা করে সেদিনই ট্রেনযোগে তিস্তা চলে যায়।
হতভাগ্য চারজনকে খান সেনারা বন্দরসংলগ্ন দিঘীর পাড়ে একত্র করে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা। কয়েকদিন পর হানাদার সৈন্যরা ট্রেনযোগে কুড়িগ্রাম নতুন শহরে প্রবেশ করে এবং জেলখানায় প্রহরারত ৫ জন পুলিশরে হত্যা করে দ্রুত চলে যায়।
বুড়ির মেলা বাজারের কাছে একটি উঁচু স্থানে খান সেনারা নিরপরাধ বাঙালিদের গুলি করে হত্যা করে এবং তাঁদেরকে শূন্যে নিক্ষেপ করে বেয়োনেট দিয়ে গাঁথে।
কুড়িগ্রাম পুরাতন শহরের রিভারভিউ স্কুলের কাছ দিয়ে সন্তর্পণে হেঁটে ধরলা নদী অতিক্রমের সময় হঠাৎ হানাদার বাহিনীর মর্টারের গুলি পায়ে, হাঁটুতে এবং পিছন দিকে কোমরে লেগে আমি আহত হই। সঙ্গী সশস্ত্র তিনজন বাঙ্গালী ইপিআর আমাকে নদীর তীরে চানমারীতে অপেক্ষা করতে বলে দ্রুত শহরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ধরলা নদীর খেয়া তখন বন্ধ ছিল। চানমারীর কাছে একটি বাঙ্কারে আমি ঢুকে পড়ি এবং ক্রমেই আমার অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটে। বাঙ্গালী ইপিআর তিনটি আর পুনঃ আমাকে খোঁজ করতে আসে নি।
গুরুতর আহত অবস্থায় আমি উক্ত বাঙ্কারে ১১ দিন অনাহারে ছিলাম। হানাদার বাহিনী সমগ্র কুড়িগ্রাম দখল করে। এই এগার দিন আমি দৃঢ়তার সঙ্গে অতিবাহিত করি। কখনো জ্ঞান হারাই নি। ১২ দিন পর ৩ জন খান সেনা ৩ জন দালালসহ উক্ত স্থান অতিক্রমের সময় আমাকে দেখে ফেলে। খান সেনারা আমাকে কুড়িগ্রাম ডাক বাংলোয় নিয়ে যায়। ডাক বাংলোর দিকে যাবার পথে বর্তমান ইউনিয়ন কাউন্সিলের কাছে কুড়িগ্রাম রেলওয়ে অফিসের এক বৃদ্ধ দারোয়ানকে বিহারী নেয়ামত কসাই জবাই করছে দেখতে পাই। এ দৃশ্য আমার নিকট ছিল পৈশাচিক।
ডাক বাংলোয় পৌঁছে আমি ডাক বাংলোর কাছে স্যানিটারী অফিসের বারান্দায় ৮ জন লোককে চোখ ও পেছনে হাত বেঁধে কোমরে দড়ি লাগিয়ে বারান্দার খামে দাঁড়ানো অবস্থায় বেঁধে রাখতে দেখি। ডাক বাংলোয় খান সেনারা অবস্থান করত। আমি পৌঁছামাত্র আমার চোখ, পেছন দিকে হাত বেঁধে দড়ি লাগিয়ে অপর একটি খামে বাঁধা হয়। বারান্দায় বেঁধে রাখা সবাইকে মেজর গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। পরদিন ভোরে আনুমানিক সকাল আটটার দিকে নেয়ামত কসাই আসে এবং সবাইকে জবাই করবে বলে জানায়। নেয়ামত কসাই এক একটি জবাইয়ের বিনিময়ে ৬০(ষাট) টাকা পায় বলে জানায়। বেঁধে রাখা ব্যক্তিদেরকে মেজরের নির্দেশে বিকাল পাঁচটার সময় গুলি করে হত্যা করা হবে জানালে নেয়ামত কসাই চলে যায়।
বিকাল ৫ টায় ২ জন খান সেনা সবাইকে চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় ধরলা নদীর তীরে চানমারীর পেছনে আমাকেসহ হতভাগ্য ১১ জনকে নিয়ে আসে। বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে চানমারীর পেছনে যাবার সময় অসংখ্য মৃত লাশ আমার গায়ে লাগছিল। চানমারীর পেছনে সবাইকে লাইন করানো হয় এবং সবাইকে বুকটান দিয়ে দাঁড়াতে বলা হয়। এক এবং দুই গোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি পেছন দিকে হেলে পড়ি। সঙ্গে সঙ্গে মেশিনগানের গুলি বর্ষিত হয় আমি তৎক্ষণাৎ মাটিতে শুয়ে পড়ে নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে মৃতবৎ পড়ে থাকি পাঞ্জাবীরা সবাইকে মৃত ভেবে চলে যায়। আমার তন্দ্রা কেটে গেলে বুঝতে পারি সৌভাগ্যক্রমে গুলিতে আহত হই নি। তবু আমি ভয়ে ৪-৫ ঘন্টা মৃতবৎ পড়ে থাকি। চারিদিকে একই সঙ্গে কুকুর এবং শৃগালের তুমুল কোলাহল চলছিল। রাত ১২ টার দিকে হঠাৎ দড়িতে টান পড়লে আমি জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে বসি, কে দড়ি টানছে। জিজ্ঞাসা করলে অপর প্রান্ত থেকে একজন জীবিত ব্যক্তির কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।তার বাড়ী রংপুর জেলার গাইবান্ধা বলে জানায়। তাঁর গায়ে গুলি লাগেনি বলে সে জানায়। অতঃপর উভয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পরস্পরের সম্মুখীন হই এবং পরস্পরের হাতে বাঁধন খুলে দিতে সাহায্য করি। উভয়ে মুক্ত হবার পর চোখের বাঁধন খুলি এবং চারিদিকে তাকিয়ে কমপক্ষে ৪ শত লাশ দেখতে পাই শৃগালগুলো চারপাশে ছোটাছুটি করছিল। উভয়ে নদীর তীরে উপস্থিত হই। গাইবান্ধার লোকটি সাঁতার দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। অতঃপর আমি তার হাত ধরে গা ভাসিয়ে দেই। নদীতে কয়েকবার লোকটি আমার হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল কিন্তু অতি কষ্টে পরস্পর পরস্পরকে ধরে রেখে নদী পার হতে সক্ষম হই। তীরে পৌঁছতেই ভোর হয়ে আসে। উভয়েই ভারতে আশ্রয় গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবং ভারতের পশ্চিম বাংলার চৌধুরী হাটে প্রবেশ করি।
স্বাক্ষর/-
মোঃ মনোয়ার হোসেন
গ্রাম- মোল্লাপাড়া
পোঃ কুড়িগ্রাম
জেলাঃ রংপুর
৩০/০৭/৭৩