মনে হত বঙ্গবন্ধুর বাইরের আবরণের মানুষটি তাজউদ্দীন আহমদ। তাঁর আর একটি দিক দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি। সেটা হল, সব ধরনের সুযােগসুবিধা থাকা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন ভাই খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। এবং তিনি অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করতে পারতেন। থিয়েটার রােডের একটি কক্ষে একটি চৌকি, কাঠের স্ট্যান্ডের উপরে পেরেক দিয়ে আটকানাে সাড়ে তিন টাকা দামের সাধারণ মশারি, একটি বালিশ, একটি মাদুর, একটি কাঁথা এবং একটি চাদর নিয়ে রাতে ঘুমাতেন। সে ঘুমও মাত্র মাপা দু’ঘণ্টার জন্য। অর্থাৎ রাত ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। বাকি ২২ ঘণ্টার ২ ঘন্টা বাদ দিলে ২০ ঘণ্টাই তিনি কাজ করতেন—বিভিন্ন বৈদেশিক প্রতিনিধিদলসহ নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে আলােচনা করে, দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দাপ্তরিক নির্দেশ দিয়ে, কাগজেকলমে কাজ করে কিংবা রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে। তার নিজস্ব কোন ব্যয় ছিল না। সিগারেট খেতেন না, কোন সৌখিন জিনিস ব্যবহার করতেন না। মদ স্পর্শ করতে দেখিনি, কিংবা কোন নারীর প্রতি তার কোন ধরনের আসক্তি তাে দূরের কথা সামান্যতম দুর্বলতাও আমি লক্ষ্য করিনি। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মিসেস তাজউদ্দীন ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলকাতা এসে পৌছেন। কলকাতার সিআইটি রােডে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তাজউদ্দীন ভাই একটি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। বাংলাদেশের মাটিতে যতদিন স্বাধীনতার পতাকা তিনি না ওড়াতে পারবেন, ততদিন পর্যন্ত তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ স্বজনদের কারাে সাথে দেখা করবেন না। এ কথা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। থিয়েটার রােড থেকে মাত্র ৩/৪ মাইলের দূরত্বে তার পরিবার থাকতেন। যুদ্ধ চলাকালে তাঁর একমাত্র ছেলে সােহেল প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়। ১০৪-এর ওপর জ্বর, সে ভুল বকছে। অবস্থা ভাল না, ভীষণ ছটফট করছে। এ খবর তাকে দিতে গিয়ে আমি তাঁর কাছ থেকে ভীষণ ধমক খেয়েছি। আমি তাকে বাসায় যাবার জন্য অনুরােধ করেছিলাম। তিনি আমাকে ধমকের সুরে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে আর কখনাে এ ধরনের কথা আমার সামনে উচ্চারণ করবেন না। এখন আমার স্ত্রী-সন্তান নেই। সমস্ত বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষ আমার সন্তান। আমি এখন তাদের চিন্তায় ব্যস্ত। তাই আমাকে এসব ব্যাপার নিয়ে আর বিরক্ত করবেন না।’ এ থেকেই জানি তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞায় ছিলেন অটল।
Source:
আলী তারেক
তাজউদ্দীন আহমদ – আলোকের অনন্তধারা