You dont have javascript enabled! Please enable it!

ষড়যন্ত্রকারী ও সমাজবিরোধীদের রুখিয়া দাঁড়াও – স্বাধীনতার সূর্যসৈনিক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বান। দুইদিনব্যাপী মুক্তিযোদ্ধা সম্মেলনের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে জাতির জনক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

২১ জানুয়ারি ১৯৭৩, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

পেপার কাটিং। পূর্ণ ভাষণ ও ভিডিও আছে।

পূর্ণ ভাষণ –

এই ময়দান হইতেই আমি একদিন তোমাদের নিকট স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়াছিলাম। তোমাদের যার যা আছে তাই লইয়া বর্বর পাকিস্তানি হানাদার শক্তির বিরুদ্ধে ঝাপাইয়া পড়িয়াছিলে। বহু ত্যাগ আর লক্ষ লক্ষ মা বোনের অশ্রুতে বাংলা স্বাধীন হইয়াছে। বর্বর শক্তি বাংলার মাটি হইতে নিশ্চিহ্ন হইয়া গেলেও তাহাদের অনুচরেরা শোষকশ্রেণী গা ঢাকা দিয়া রহিয়াছে। বাংলার অমূল্য স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করার জন্য তাহারা গোপনে ষড়যন্ত্র চালাইয়া যাইতেছে। বিদেশি শক্তির এজেন্ট হইয়া তাহারা দেশকে অন্ধকারের আবর্তে ঠেলিয়া দিতে চাহিতেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আবার আমি আহ্বান জানাইতেছি, এই চক্রান্ত প্রতিহত করার জন্য তোমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হইবে। আপন শক্তি দিয়াই বাংলাদেশ তাহার সার্বভৌমত্বকে বিশ্বের বুকে চিরদিন অক্ষুন্ন রাখিতে পারিবে।

বাংলাদেশ যতদিন আছে, বাংলার ইতিহাস যতদিন থাকিবে, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের ইতিহাস ততদিন অবিস্মরণীয় গাথা হইয়া বিরাজ করিবে

বাংলার মুক্তিসংগ্রাম বহু আগে হইতে শুরু হইয়াছিল। বাংলার মানুষের পক্ষে আমি কথা বলিয়া আমাকে উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আখ্যা দিয়া ঘৃণা করিত, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজাইয়া আমার কণ্ঠরোধ করিতে চেষ্টা করিয়াছিল। জনতার জোয়ারে মড়যন্ত্রকারীদের সকল ষড়যন্ত্র ভাসিয়া গিয়া বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতি মর্যাদার আসন লাভ করিয়াছে।

জাতির জন্য দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার এক বছরের মধ্যেই সংবিধান রচনা করা হইয়াছে। সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকারের সুনিশ্চয়তা প্রদান করা হইয়াছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে সুখী-সমৃদ্ধিশালী করিয়া গড়িয়া তুলিতে হইবে। স্বাধীনতা অর্জন ও রক্ষা করা দুই-ই কষ্টকর। বাংলার স্বাধীনতার শত্রুরা এখনো চক্রান্ত করিয়া বেড়াইতেছে, তাহাদের উৎখাত না করা পর্যন্ত মানুষ শান্তিতে ঘুমাইতে পারে না।

ভুয়া মুক্তিবাহিনীর সার্টিফিকেট দেখাইয়া বহু দুষ্কৃতিকারী কুমতলব হাসিল করার চেষ্টা চালাইতেছে। প্রত্যেক থানায়, ইউনিয়ন ইউনিয়নে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান চালাইয়া এই সব ভুয়া সার্টিফিকেটধারীদের শাস্তি দিতে হইবে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের নিকট নাম রেজিস্ট্রি করার আহ্বান জানাই। তোমরা আমার লালঘোড়া।

কিছুদিন আগে এই ময়দানেই আমি ঘোষণা করিয়াছিলাম নির্বাচনে যদি জনগণ আমার উপর আস্থা স্থাপন করেন। সমাজবিরোধীদের উৎখাত করার জন্য আমি লালঘোড়া দৌড়াইয়া দিব। আমার এই কথার প্রকৃত অর্থ কেহ কেহ বুঝিতে না পারিয়া নানা মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছে। যে কথা সেদিন বলি নাই, সমাজবিরোধীদের আমি জানাইয়া দিতে চাই, মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা তোমরাই আমার লালঘোড়া। বাংলার স্বাধীনতা অর্জনে তোমরা যেমন সর্বস্ব ত্যাগ করিয়াছ, আশাকরি, আমি হুকুম দিলে তোমরা সমাজবিরোধী গাড়ি-বাড়ি হাইজ্যাককারী, চোর-ডাকাতদের নির্মূল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করিবে।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত কর। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অন্যায়কে কখনও প্রশয় দিতে পারে না এ বিশ্বাস আমার রহিয়াছে। সহস্র সহস্র মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে যদি দুই-একজন নীতিভ্রষ্ট হয়, ইহার জন্য সম্পূর্ণ মুক্তিযোদ্ধাদের উপর দোষ চাপাইয়া দেওয়া যায় না। বহু রাজাকার, আলবদর ও সমাজবিরােধী ব্যক্তি ভুয়া মুক্তিবাহিনী নাজিয়া গ্রামে গ্রামে শ্রম সষ্টি করিয়া চলিয়াচ্ছে। অস্ত্রের ভয় দেখাইয়া লুণ্ঠন-পর্ব চালাইয়াছে, খুন-জখম-রাহাজানিতে শান্তিপ্রিয় মানুষের ঘুম কাড়িয়া লইয়াছে। তাহাদের দুষ্কর্ম প্রতিহত করার দায়িত্ব তোমাদের গ্রহণ করিতে হইবে।

বাংলার মানুষ শান্তি চায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাকে পুনর্গঠনের কঠোর দায়িত্ব আমাদের পালন করিতে হইবে। দেশব্যাপী খাদ্য ঘাটতি। বিদেশ হইতে খাদ্য আনিতে হইবে। প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানি করিতে হইবে। ‘৭০-এর ঘূর্ণিঝড়, ‘৭১-এর মুক্তিসংগ্রাম, ‘৭২-এর অনাবৃষ্টি দেশব্যাপী করুণ অবস্থার সৃষ্টি করিয়াছে। চোর-ডাকাতের দল মানুষের চোখের ঘুম কাড়িয়া লইয়াছে। ঐক্যবদ্ধ শক্তি নিয়া সমস্ত জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা আমাদের করিতে হইবে। আমাদের সাহায্য দিয়া ভারত, রাশিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও অন্যান্য রাষ্ট্র যে সহায়তা করিয়াছে, উহাদের আমি কৃতজ্ঞতা জানাই । দেশকে সমৃদ্ধিশালী করিয়া মানুষের শান্তি বিধান করার জন্য সকলের সহযোগিতা আমি কামনা করি।

নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হইবে। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। জনতার রায়ের উপর অন্য কিছুকে স্থান দিতে পারি না। তাই ক্ষমতা আকড়াইয়া না থাকিয়া নির্বাচন ঘোষণা করিয়াছি। আমার অঙ্গীকারমত জাতিকে গণতন্ত্র দিয়াছি, গণতন্ত্র রক্ষা করিতে হইলে উহার নীতিমালা অবশ্যই মানিয়া চলিতে হইবে। গণতান্ত্রিক অধিকারকে অমর্যাদা করিয়া যাহারা অস্ত্রের ভয় দেখাইয়া মমতা দখলের বড়ন্ত্রি চালায়, তাহাদেরকে বাংলার মানুষ মান্য করিবে না। বিদেশি শক্তির এজেন্টরা নির্বাচন বানচাল করার চক্রান্ত করিতেছে। তাহাদের সম্পর্কে জনগণকে এশিয়ার থাকিতে হইবে।

জনগণই ক্ষমতার উৎস। নির্বাচনে জনগণ যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান করে আমি সসম্মানে আসন ত্যাগ করিয়া জনতার কাতারে গিয়া দাড়াইব। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করিয়া রাখা যায় না। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করার অধিকার সকলেরই রহিয়াছে। তবে নির্বাচন বানচাল করার অধিকার কাহাকেও দেওয়া হয় নাই। চক্রান্তকারীরা বাংলার জনগণের শর্ত বলিয়া চিহ্নিত হইবে এবং বাংলার জনগ ও শত্রুর মোকাবিলা করার শক্তি রাখে।

বাংলাদেশ কোন বিদেশি শক্তির উপনিবেশে পরিণত হইবে না। বাংলাদেশ সর্বদা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করিবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান নীতিতে আমরা বিশ্বাসী। ভারত আমাদের মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষ সাহায্য করিয়াছে এবং আমাদের বর্তমান অবস্থায় খাদ্য ও নানাভাবে সাহায্য দিয়া আমাদের কৃতজ্ঞতা অর্জন করিয়াছে। ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা কোন কোন মহলের ‘ফ্যাসন হইয়া দাঁড়াইয়াছে। দুর্দিনের বন্ধুকে আমরা ভুলিয়া যাইতে পারি না। আর এই কথাও সত্য, পারস্পরিক বন্ধুত্বের স্বার্থেই ভারতের সাহায্য আমরা গ্রহণ করিব, আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ভারতের কিছু বলার নাই। কোন বিদেশি শক্তির আশ্রয়ও আমরা গ্রহণ করিতে পারি না। জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমাদের আদর্শ। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সহিত আমরা বন্ধু কামনা করি। তবে আমাদেরকে কেহ পকেটে ভরিতে চাহিলে উহা আমরা বরদাশত করিব না।

চীনের জনগণের সহিত কোন শক্রতা নাই। সাম্রাজ্যবাদের শত্রু নির্যাতিত মানুষের বন্ধুর দাবিদার চীন-সরকার বাংলার নির্যাতিত মানুষের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সমর্থন জোগাইয়াছে। স্বাধীন বাংলার সার্বভৌমত্ব সারা বিশ্বে স্বীকৃত হইয়াছে। বাংলাদেশ তাহার অধিকার লইয়া জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য আবেদন জানাইলে চীন পাকিস্তানের সমর্থনে বিশ্ববিবেককে উপেক্ষা করিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করিয়াছি। জাতিসংঘের সদস্য হোক বা না হোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করার মত শক্তি পৃথিবীতে কাহারও নাই। বন্ধুত্বের নীতিতে আমরা বিশ্বাসী। চীন সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ রহিয়াছে, চীনদেশের জনগণের সহিত আমাদের কোন শত্রুতা নাই। স্বাধীন হওয়ার পরও চীন দীর্ঘদিন জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করিতে পারে নাই। আমি চীনকে সেই সত্য পুনঃউপলব্ধি করার জন্য আহ্বান জানাই। বাংলার অধিকারও চীন দীর্ঘদিন ধরিয়া ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবে না।

Reference:

দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ জানুয়ারি ১৯৭৩

বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র, সংগ্রামের নোটবুক

 

ভিডিও

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!