You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ব পাকিস্তানের বিপর্যস্ত মানুষ
নিউইয়র্ক টাইমস
৫ আগস্ট ১৯৭১

এশিয়ায় বিপর্যয় সংঘটিত হচ্ছে। মানব দুর্যোগ এত বড় যে এটি ভবিষ্যতকে রক্তেস্নাত করে ফেলতে পারে। শুধু এশীয়দের জন্য নয়, সেই সাথে পশ্চিমেরও। তবুও বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অফিসিয়াল প্রতিক্রিয়া ন্যূনতম এবং নৈতিকভাবে একেবারেই নিকৃষ্ট।

আমি শুধু কলকাতা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ফিরে এসেছি, যেখানে আমি পাকিস্তানে পাকিস্তানি গণহত্যার আক্রমণের ফলে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের বোমা মেরে, পুড়িয়ে দিয়ে হত্যা করে এবং তাদের গ্রামগুলোতে লুটপাট করে এবং তাদের নিজের এলাকা থেকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।

আমি কিছু সময় একটি কানাডিয়ান সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ভ্রমণ করেছিলাম। আমরা দেখেছি ত্বক শুকিয়ে যাওয়া শিশুদের, শরীরের হাড় বেরিয়ে আছে, মহিলারা কান্নাকাটি করছে। তারা আমাদেরকে বলেছিল যে তারা এখানে মারা যাবে তবু তাদের দেশ পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাবেনা কারণ সেখানে তারা যেসব দুক্ষজন ঘটনাগুলো দেখেছে তার পরে যাওয়া সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি শরণার্থী শিবিরের মানুষের হতাশা এবং অবিশ্বাস্য মাত্রার মানব ঢল- চার মাসে ৬.৭ মিলিয়ন শরণার্থী ভারতে ঢুকে পড়েছে।

আমি দেখলাম ভারতীয় গ্রামগুলি নিঃস্বার্থ উদ্বাস্তুতে পুর্ন। প্রতিটি ইঞ্চি মানুষে পূর্ন যারা আঝোড় বৃষ্টি আর খরা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য আশ্রয় খুঁজছেন। আমি দেখেছি শরনার্থীরা এখনও রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কোন বিশ্রামস্থল খুঁজে পাচ্ছে না। আমি দেখেছি ভারতীয় গ্রামবাসীরা তাদের সামান্য খাবার ওইসব ভীত এবং ক্ষুধার্ত মানুষদের সাথে ভাগ করে খাচ্ছে। আমি দেখেছি হাজার হাজার পুরুষ, নারী ও শিশু লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, তারা রোদের ভেতর ঘণ্টার পড় ঘণ্টা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে তাদের রেশনের জন্য। সামান্য কিছু চাল, গম এবং ডাল দেয়া হচ্ছে যা দিয়ে হয়ত তাদের পুষ্টির নূন্যতম চাহিদা মেটান যাবে না। পুষ্টির পরিমাণ এত কম যে এটি অনিবার্যভাবে প্রোটিন ভাঙ্গা, যকৃতের অসুস্থতা এবং কলেরা, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস সৃষ্টি করবে যা অন্যান্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি অন্যান্য বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করবে। আমি দেখেছি ভারতীয় ত্রাণ কর্মকর্তাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এবং অবাধ ব্যক্তিগত সহানুভূতি, তারা মানুষের জোয়ারের তরঙ্গের সঙ্গে মোকাবেলা করছে – এবং তার জন্য তাদের বাজেট দিনে মাত্র এক রুপি – প্রতি জনে মাত্র ১৩ সেন্ট।

এটা এখন স্পষ্ট যে দুর্ভিক্ষ পূর্ব পাকিস্তানকে আরও ধ্বংস করবে এবং লক্ষ লক্ষ লোক ভারতে আশ্রয় নেবে যেখানে ভারত ইতিমধ্যে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে।

এই পরিস্থিতিতে আমেরিকান নীতির নির্মমতা এবং নির্বুদ্ধিতা প্রতিবাদ করতে মানুষ বাধ্য হবে। এক দিকে আমরা ভারতে ত্রাণ তহবিলে ৭০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। অন্যদিকে, আমরা পশ্চিম পাকিস্তানী জেনারেলদের অস্ত্র সরবরাহ করছি যারা রক্তক্ষয় শুরু করেছে, যাতে তারা সন্ত্রাস করে ভারতীয়দের সীমান্তে পালানোর জন্য আরও বেশি সংখ্যক লোককে পাঠাতে পারে। এই সপ্তাহে হাউজে সামরিক সামরিক সহায়তা সহ অন্যান্য সহায়তা স্থগিত করার জন্য ভোট হয়।

প্রকৃত রাজনীতির ক্ষেত্রে, পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক সহায়তা অব্যাহতভাবে আমাদের শাসক জান্তার উপর প্রভাব বিস্তার করবে এবং রেড চীনের প্রভাবকে দূরে রাখতে সহায়তা করে। (বিস্ময়করভাবে, লাল চীনারাও পশ্চিম পাকিস্তানী জেনারেলদের সহযোগিতা করছে।)

তবুও শরণার্থীদের সর্বাধিক প্রবাহ পশ্চিমবঙ্গে আসছে, যা কেবলমাত্র ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র এবং সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য নয় বরং রাজনৈতিকভাবেও সবচেয়ে অস্থির। সীমান্তে কলকাতা ও বনগাঁের মাঝামাঝি প্রায় ৫০ মাইল দূরবর্তী স্থানে আমি এমন একটি বাড়ি দেখেছিলাম যেটিতে একটি হাতুড়ি এবং কাস্তে আঁকা ছিল। মাওবাদীরা, অরাজকতাবাদীরা এবং প্রচলিত মার্কসবাদীরা একে অপরকে এখানে আক্রমণ করে এবং সহিংসতা, স্ট্রাইক, বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ইতিমধ্যেই এখানে একটি দৈনন্দিন ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে ক্রমাগত শরণার্থীদের প্রবেশ ঘটছে তা প্রায় বিস্ফোরিত হবে বলে মনে হচ্ছে।

পশ্চিম পাকিস্তানীদের অস্ত্র চালান পাঠানোর মাধ্যমে আমরা আংশিকভাবে সেখানে লাখো ক্ষুধার্ত, রুগ্ন ও রাগান্বিত উদ্বাস্তুদের টেন্ডার বক্সে ঢোকানোর জন্য দায়ী। এতে ভারতের সীমান্তে রক্তক্ষয়ী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে – পাশাপাশি মাওবাদী আন্দোলনকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। সুতরাং এমনকি যদি কেউ নিঃসন্দেহে চীনা কমিউনিস্টদের প্রভাব বিস্তার থামাতে চায় তবে সেই লক্ষ্যে আমাদের এই পদক্ষেপ বোকামিই বটে। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রভাব বিস্তারের বিনিময়ে ভারতের উপর প্রভাব হারাচ্ছি। ভিয়েতনামের চাইতেও খারাপ, বড়, রক্তাক্ত পরিস্থিতি এশিয়ায় তৈরি করতে যাচ্ছি।

কিন্তু খুব সহজ কারণেই আমাদের সাহায্য নীতি পরিবর্তন করা আবশ্যক – যার একটি কম রাজনৈতিক উপায় আছে। সহজ মানবতার ভিত্তিতে, আমাদের সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাত্মক জনসাধারণের প্রতি আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার কারণ ইসলামাবাদের অগণতান্ত্রিক জেনারেলদের সাথে জোট, এবং হত্যাকারীদের আরো বেশি অস্ত্র পাঠানোর ব্যাপারটি নৈতিকভাবে বিরক্তিকর।

পূর্ব পাকিস্তানের জরুরী অবস্থা সামান্য প্রতিক্রিয়ার চেয়ে বেশি দাবি করে। অবিলম্বে আমাদের সেখানে জীবন বাঁচানো শিশুর খাদ্য, গুড়ো দুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, , এন্টি কলেরা টিকা এবং ভারতে অনুরূপ সরবরাহ দিতে হবে। কিন্তু এর চেয়েও বেশি দরকারি হল নৈরাজ্য এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুসারে অস্ত্র চালান অবিলম্বে বন্ধ করা।

– এলভিন টফলার।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!