২৭ শে মার্চ আমার বাবাকে বাড়ী থেকে ধরে কারফিউ চলাকালে সকালবেলা একটি সামরিক জীপে করে ৪ জন সামরিক লোক এবং ২ জন স্থানীয় অবাঙ্গালী অস্ত্রসহ এসে নক করে। দরজা খুললে তারা বাড়ীতে ঢুকে সিন্দুক খুলে সমস্ত সোনাদানা, টাকা-পয়সা নেয় এবং বাড়ীতে অথবা দোকানে ওয়্যারলেস আছে বলে বলে অভিযোগ করে। তাঁদের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের জন্য দোকান খুলেও দেখান হয়। পরিশেষে আমাকে একটি লাথি মেরে ফেলে দিয়ে আমার বাবাকে জীপে করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।
৯ই এপ্রিল বেলা সাড়ে এগারটার দিকে জনৈক অবাঙ্গালী এসে আমাকে টেলিগ্রাফ অফিসে সামরিক কর্তৃপক্ষ ডাকছে বলে জানায়। সাথে আমার ছোট ভাইকেও নেবার নির্দেশ দেয়। ধৃত অবস্থায় আমার ছোট ভাই এবং আমাদেরই ভাড়াটে একজন স্বর্ণকারকে উল্লিখিত স্থানে জনৈক মেজরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। নাম ধাম জিজ্ঞাসা করার পর মেজর আমাদেরকে বন্দি করার নির্দেশ দেয়। তারপর থানায় নেয়া হয়। সেখানে কিছুক্ষণ পর ঐ টেলিগ্রাফ অফিসের সুপারিনটেনডেন্ট (টি এণ্ড টি) হাতিম আলী খালিফাকে ধরে আনে। রেলওয়ে ওয়ার্কশপ থেকে শ্রমিক ও চার্জম্যানসহ কিছু লোককে ধরে আনে। সর্বমোট ২৪-২৫ জনকে একত্রে বন্ধ ওয়াগনে করে কড়া সামরিক পাহারায় ক্যান্টনমেন্টে নেয়া হয়। ক্যান্টনমেন্টে নামানোর সাথে সাথে সকলের এক হাত করে বেঁধে দাউন গেঁথে স্থানীয় অবাঙ্গালী ও পাক সৈন্যরা বেদম প্রহার করা শুরু করে। বেল্ট, বেত, লাথি, চড়, কিল, ঘুষি এবং রাইফেলের বাঁট, বৈদ্যুতিক তার দিয়ে প্রহার করতে থাকে এবং বলতে থাকে “আচ্ছা চিজ মিলা “। মারের পর্ব শেষ হলে ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে ছোট ছোট ঘরে ১০-১২ জনকে একই ঘরে ঢুকায়।
তারপর সকলকে আবার বারান্দায় বের করে দেয়ালের দিকে মুখ করে হাত দেয়ালের সাথে ফাঁক করে রেখে দাঁড় করায় এবং ঐ অবস্থায় ওয়াপদার মোটা বৈদ্যুতিক তার দিয়ে প্রহার করতে থাকে। এ অবস্থায় অত্যাচার চলার পর প্রাচীরের সাথে যে বাঁশ টাঙ্গানো ছিল সে বাঁশের সাথে কোমরে দড়ি বেঁধে উল্টো অবস্থায় টাঙ্গিয়ে দেয় এবং পিঠে প্রহার করতে থাকে। প্রহারের ফলে অজ্ঞান হলে অথবা অজ্ঞান হবার উপক্রম হলে ছেড়ে দেয়।
এ সময় টিএণ্ডটি ডিপার্টমেন্টের ঐ ভদ্রলোকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যে, এখানে আমার কে কে আছে। আমি আত্নীয়দের সাথে আমার যুবতী মেয়ের কথাও বলি। তখন ঐ পশুরা বলে যে তোমার সেই ১৫-১৬ বছরের মেয়েকে এখনই এখানে নিয়ে আসা হচ্ছে এবং এদের সামনে তোমাকে তোমার মেয়ের সাথে ‘সহবাস’ করতে হবে। অস্বীকৃতি জানালে আমার উপর এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী অত্যাচার করে। শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে দরবিগলিত ধারায় রক্ত ঝরতে থাকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঐ খানেই সকলে ছিলাম। যে আসত সে-ই মারত এবং কাফের লোক কো খতম করো বলে গাল দিত। এ সময় কয়েকজন দাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে যে, তোমরা মুলমান কি না এবং নামাজ পড় কিনা? হ্যাঁ-বাচক উত্তর দিলে তাদেরকে কলেমা পড়তে বলে। কলেমা পড়তে থাকলে তাদেরকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয় এবং বলে যে, ‘তোম লোগ কাফের হ্যায়, তুম ঝুটা বলতা হ্যায়। ‘
সন্ধ্যার পর একটি ঘরে সকলকে বসায় এবং শুকনো রুটি ও ডাল এনে দেয়। খাওয়ার পর মুসলমানেরা নামাজ পড়তে চাইলে তাদেরকে মসজিদে না যেতে দিয়ে সেখানেই নামাজ পড়তে নির্দেশ দেয়। নামাজ পড়া যেই শেষ হয়েছে, অমনি জনৈক কোয়ার্টার মাষ্টার বেত হাতে এসে প্রহার শুরু করে। তোম লোগ নামাজ পড়তা হ্যায়। তোম লোগ বাঙ্গালী মুসলমান, তোম লোগ কাফের হ্যায়।
সেখান থেকে অতঃপর আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অনেকগুলো বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক বন্দি অবস্থায় ছিল। সেখানে দরজা খুলে সকলকে ঢুকিয়ে দেয়। সেখানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকদের মুখে জানতে পারি যে, তারা সীমান্তবর্তী এলাকায় ছিলেন। ডিউটি অন্যত্র দেয়া হবে নিয়ে এসে বন্দি করে। তারা সংখ্যায় প্রায় ৫০-৬০ জন ছিলেন। ঘন্টাখানেক পর উল্লিখিত কোয়ার্টার মাষ্টার দরজা খুলে সিভিলিয়ানদের বেরিয়ে আসতে নির্দেশ দেয় এবং বেরিয়ে আসলে অন্য আর একটি ছোট ঘরে নিয়ে যায়। ঘরের সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ ছিল এবং ঘরের ভিতর কোন আলো ছিল না। কেউ যেন না বসে এমন নির্দেশ দিয়ে সে চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পর ঐ একই ব্যক্তি এক এক করে ঘরের বাইরে ডেকে নেয় এবং আমার প্রতি অকথ্য অত্যাচার করতে থাকে। যখন আমার পালা আসে তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, শহরের কে কে বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিল, কে কে মুজিব ত্রাণ ফান্ডে চাঁদা দিয়েছে এবং কে কে নেতা?
পরদিন সকালে আমাদের দিয়ে একটি পুকুরের বাঁশ উঠিয়ে নেয়া হয় এবং মাঠের ঘাস পরিষ্কার করে নেয়া হয়। তারপর অপর একজন এসে আমাদেরকে বন্দি করতে নির্দেশ দেয়। তখন আমার পূর্বে ধৃত আমার বাবার খবর জানতে চাইলে তাদের সকলকে যে ঘরে আমার বাবা এবং স্থানীয় এমসিএ জিকরুল হকসহ ১৫-১৬ জন বন্দি ছিলেন সেখানে বন্দি করে রাখে।
কিছুক্ষণ পরে মেজর জাভেদ এসে সকলকে একদিক থেকে ঐ ঘরেই প্রহার করে। ডাঃ জিকরুল হককে প্রহার করার সময় সে বলে ‘ডঃ জিকরুল তোম বলতা হ্যায় মিলিটারী ফাঁকা ফায়ার করতা হ্যায়। তোম হিয়াসে মব লাগাতা হ্যায় ? বানচোত, তোম সবকো গুলি কর দিয়ে গা।’ তারপর ক্যাপ্টেন বখতিয়ার লাল আসে এবং একই প্রক্রিয়ায় অত্যাচার করে।
পরদিন সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন গুল এসে তার মাথায় শিরোস্ত্রাণ খুলে তা দিয়ে সকলকে প্রহার করে। মারের চোটে কেউ চিৎকার করতে চাইলে সে বলতে চীৎকার মাৎ কারো। এদিন ডাক্তার সাহেবকে বেশী অত্যাচার করে ও অকথ্য এবং অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করে। তাঁকে লাথি দিয়ে বাইরে ফেলে দেয় এবং সেখানে তার প্রতি গুল ও অন্যান্য মিলিটারীর হৃদয়হীনভাবে অত্যাচার করে। এতে তার চশমা ভেঙ্গে যায়; মাথা ফেটে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। অতঃপর তার মাথা ব্যান্ডেজ করে লাথি মেরে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়।
ডাক্তার সাহেব ঘরে ঢুকলে সকলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ডাক্তার সাহেব সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ওরা অত্যাচার করুক না। আর না হয় কাল দিন আসবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।
তারিখ সেণ্ট্রি এসে জানায় যে, আপনাদের যা খাবার খেয়ে নেবেন, আপনাদের আজ কোথাও যেতে হবে। ১২ টার দিকে দরজা খুলে বাইরে বেরোলেই উল্লিখিত কোয়ার্টার মাষ্টার সকলকে একটি দুটি করে লাথি মেরে ট্রাকে ঊঠতে নির্দেশ দেয়। ট্রাকে উঠলে তিনজন করে একত্রে পেছনে শক্ত করে হাত বেঁধে দেয়। তিনটি ট্রাকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকসহ প্রায় ১৫০ জনকে ঊঠায়। ট্রাক রংপুরের রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে যাচ্ছিল। যাবার পথে পাহাড়ারত সামরিক লোকেরা বেল্ট দিয়ে, রাইফেলের বাঁট দিয়ে অথবা বুট দিয়ে খুঁচিয়ে অত্যাচার চালাতে থাকে। শেষাবধি রংপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে পৌঁছার পরই সকলের উপর অকথ্য অত্যাচার করে। তারপর অফিসার এসে সকলের নামের তালিকা বের করে সকলের নাম মিলিয়ে নেয়। তারপর রংপুর উপশহরের দিকে অফিসাররা জীপে যাত্রা করে এবং পিছনে পিছনে ট্রাকগুলোও যেতে থাকে। উপশহরের পাশে বালি তোলা খাদের কাছে নিয়ে গাড়ি দাঁড় করায় এবং সেখানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৬ জন ৬ জন করে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তারপর সিভিলিয়ানদের এক একজন করে পাশাপাশি একবারে ছয়জন করে দাঁড় করায়। তাদের সামনে খুব নিকটে ছয়জন বন্দুকধারী সিপাই থাকে এবং পাশে জোড়া লাগানো কালো প্যান্ট-শার্ট পরিহিত একজন সিপাই। দাঁড় করিয়ে দেয়া হলে ঐ কালো কাপড় পরিহিত লোক বলল ‘সিঙ্গল ফায়ার’ বলে রাইফেল উপরে তুলে গুলি করত আর গুলি করার সাথে বলত ‘স্টার্ট ফায়ার’। সাথে সাথে উল্লিখিত ছ’জনকে দাঁড় করানো হতো।
আমি ও আমার ছোট ভাই কমলাপ্রসাদ ঐরুপ তৃতীয় গ্রুপে ছিলাম। আমরা নিজেদের মধ্যে কিছু সলাপরামর্শ করে গুলি করার পূর্বমুহূর্তেই ইচ্ছাকৃতভাবে পড়ে যাই। ফলে গুলি লক্ষ্যভেদ হয়ে আমার হিপে (উরুর উপরে) এবং আমার ছোট ভাইয়ের হাঁটুর উপরে উরুতে লাগে। আমরা মরার ভান করে পড়ে থাকি এবং সমস্ত লক্ষ্য করতে থাকি।
এ হত্যাযজ্ঞের মাঝামাঝি সময়ে ডাঃ জিকরুল হককে একাই দাঁড় করায় এবং জিজ্ঞাসা করে যে, ‘এই তোমহারা জিন্দেগী আওর মউত কো স্যোয়াল হ্যায়। হাম জনতা হ্যায় তোমস্যে মুজিবরস্য ফোন মে বাত হোয়া।’ তিনি উত্তর দিলেন আমি মরার সময় মিথ্যা কথা বলে গুনাহগার হব না। আর এ কথা বলার সাথে সাথে তাকে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পড়ে যান এবং বলেন ‘আল্লাহ তোমার এখানে বিচার নেই, বিচার কর।’ এটাই তার শেষ কথা। শেষের দিকে স্থানীয় প্রভাবশালী ডাঃ শামশুল হককেও ঐ একা দাঁড় করিয়ে হত্যা করে।
এ অবস্থায় সকলকে হত্যা করতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে অন্ধকার হয়ে যায়। এবং আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ও মেঘ ডাকতে থাকে।
হত্যাপর্ব শেষ হলে সকল মৃত ব্যক্তিকে ৫-৭ জনে পা ধরে টেনে উল্লিখিত খাদে ফেলে দেয় এবং আর ১০-১২ জনে মাটির উপর থেকে মাটিচাপা দিচ্ছিল। সে সময় অনেকে জীবিত ছিল। তারা গগনবিদারী করুণ চিৎকার করে আর্তনাদ করছিল। কেউ বা শেষবারের মত এক গ্লাস পানি পান করতে চাইছিল। আবার কেউ বা এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আর একটা গুলি ভিক্ষা করছিল।
মাটি চাপা দিতে দিতে ভীষণ বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে তারা আমার শরীরের অর্ধাংশ মাটি চাপা দিয়েই পরবর্তী সময়ে মাটি চাপা দেয়া হবে বলে চলে যায়।
ওরা চলে যাবার পর আমি ঐ গর্ত থেকে একজনকে উঠে দৌড়ে পালাতে দেখি। সে সময় আমার ভাই উক্ত পলায়নরত ব্যাক্তিকে লক্ষ্য করে বলে যে মিঠু আমাকে বাঁচা। আমার কেউ নেই এখানে। কিন্তু ঐ ব্যক্তি শুনতে না পেয়ে চলে যায়।
এদিকে আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে উঠবার চেষ্টা করছিলাম। আমার নড়াচড়াতে আমার দেহের উপর থেকে বেশ ক’টি লাশ গড়িয়ে পড়ে যায়। সে সময় আমার পাশেই এক বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক জীবিত ছিলেন। তার একটি হাত ছিল না। তিনি আমাকে পালিয়ে যেতে বলেন এবং অপর হাত দিয়ে আমার হাতের বাঁধন খুলে দেয়ার শেষ চেষ্টা করেন; কিন্তু তিনি তা পারেন নি। কারন তার হাত অবশ হয়ে যাওয়ায় তা সামনে আসেনি।
আমি নিজে নিজে বহু চেষ্টা করে হাতের বাঁধন খুলে ফেলি এবং আমার ভাইকে সাথে করে নিয়ে গর্তের উপর উঠতে চেষ্টা করি। উপরে ওঠার পর হঠাৎ পা পিছলে নিচে পড়ে যাই। গর্ত থেকে আমি ভাইকে গ্রামে আশ্রয় নেবার নির্দেশ দেই।
গর্ত থেকে উঠে আমার ভাইকে আর পাই না। অতি কষ্টে কিছু দূরের গ্রামে একটি বাড়ীতে আশ্রয় নেই। সেখানে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে আরও দূরে এক গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেই। উক্ত গ্রামের জনৈক মহিউদ্দিনের আন্তরিক সেবা-যত্নে কিছুটা সুস্থ হই। তারপর সেখান থেকে উক্ত ব্যাক্তির সাহায্যে প্রথমে তার এক আত্নীয়ের বাড়ী এবং পরবর্তীকালে জলঢাকা (নীলফামারী) যাই এবং সেখান থেকে মুক্তিবাহিনীর গাড়িতে করে ভারতের জলপাইগুড়ি পৌঁছি।
অপর পক্ষে আমার ভাই উক্ত ব্যাক্তির অক্লান্ত সেবা-যত্নের ফলে সুস্থ হয়ে ওঠে। রংপুর হাসপাতালে চিকিৎসার পর তাকেও ভারতে পাঠানো হয়।
এখানে উল্লেখ্যোগ্য যে, উক্ত গর্ত থেকে সেদিন মাত্র চার ব্যাক্তি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল।
স্বাক্ষর/-
নারায়ন প্রসাদ
সৈয়দপুর বাজার
জেলা-রংপুর