You dont have javascript enabled! Please enable it! প্রকাশ্যে ঘােষণা দিয়েই মুজিবকে ফাসি দেয়া হবে - ইয়াহিয়া - সংগ্রামের নোটবুক

প্রেসিডেন্ট ভবন, রাওয়ালপিন্ডি। জুলাই, ‘৭১। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের কক্ষে জুলফিকার আলী ভুট্টো চাতক-অপেক্ষায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে গুরুত্বপূর্ণ এপয়েন্টমেন্ট। নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ১১টা ৩০ মিনিট। অথচ ঘড়িতে দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট বেজে গেলেও প্রেসিডেন্ট আসেন না। দেখতে দেখতে আরও ৩০ মিনিট। এ বিলম্বে ভুট্টো তিক্ত বিরক্ত। তখনও ইয়াহিয়ার দেখা নেই। তাহলে কী প্রেসিডেন্ট এপয়েন্টমেন্টের কথা বেমালুম ভুলেই গেছেন? কিন্তু তিনি যে নিজ হাতেই ডেস্কের ক্যালেন্ডার প্রােগ্রামটা লিখেছেন। ভুট্টোর মনে বিক্ষিপ্ত ভাবনা, সংশয়ের একখণ্ড মেঘের আনাগোনা। ক’দিন যাবত প্রেসিডেন্টের কোনাে এপয়েন্টমেন্টই ঠিক থাকছে না। ডেস্কে আসতেও প্রায় প্রতিদিনই বিলম্ব। গুঞ্জন আছে, নয়া এক মিসট্রেস জুটেছে সপ্তাহ দু’য়েক আগে। জীবনের নয় নম্বর প্রণয়িনীকে নিয়ে ইয়াহিয়া বেশিরভাগ সময় মশগুল। ভুট্টো তখনাে জানেন না তার সাথে এপয়েন্টমেন্টের সময়সূচির পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওটা বেলা ১টায় চলে গেছে। দিনটি ছিল প্রােগ্রামে ঠাসা। আমেরিকা ও চীনের রাষ্ট্রদূতের সাথে সিরিয়াস বৈঠক ছাড়াও আছে প্যারেড, ডিনার। প্রেসিডেন্টের মনটাও সেদিন ভালাে নয়। সকাল থেকে কোনাে কাজেই মন বসছে না। তবু সকালে মিলিটারি প্যারেডে অভিবাদন নেয়ার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে ঘণ্টাখানেক সময় ধরে বৈঠক করেন। গােলাবারুদের সরবরাহ যাতে তাড়াতাড়ি হয় সে ব্যাপারে তাগিদ দেয়াই ছিল আলােচনার আসল উদ্দেশ্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইয়াহিয়া খানকে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিক অস্ত্র সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। বৈঠকের পর ইয়াহিয়া তাঁর সহকর্মী জেনারেলদের সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং দেয়ার পাট চুকিয়ে কিছু সময় সাক্ষাৎ প্রার্থিনী এক মিসট্রেসের সঙ্গে কাটান। এভাবে সময় গড়াতে গড়াতে প্রায় দুপুর। তখনও অপর একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি। প্রেসিডেন্ট তার বারবারস শপে (নাপিত দোকানে) ঢুকলেন। সেখানে ইটালিয়ান এক স্মার্ট তরুণ প্রেসিডেন্টের হেয়ারে ড্রেসিংয়ের জন্য অপেক্ষায়। নাম লুইগি। সুন্দরী কিশােরী ফাতেমা বিন লুইগির সহকাৱিনী। হাতে পায়ে ম্যাসেজ করে চমৎকার। এদের দু’জনের সযত্ন পরিচর্যায় প্রেসিন্টের পরিস্তি দূর হয়। বারবার শপে গিয়ে নিত্যদিন একবার ড্রেস মাশেজ না করলেই নয়। বারবার শপ থেকে প্রেসিডেন্ট সেদিন যখন ডেস্কে এসে বসেন তখন ঘফির কাটায় পৌনে ১টা। ভেঙ্গে এক পালা ফাইল। এগুলাে দেখতে হবে, দস্তখত করতে হবে। প্রেসিষ্টেদের মন ভারাক্রান্ত। আগ্রহ, নেই কোনাে কাজে। ঘুরে ফিরে শুধু বারবার একটা সমস্যাই মাথায় কিলবিল করে। শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত যে নিতেই হয়। আর দেরি করা চলে না। সময় দ্রুত বয়ে যাস। হয় শেখ মুজিবের ট্রায়াল অথবা অত ঝামেলায় না গিয়ে সরাসরি মুত্যুদ-এর যে কোনাে একটা পথ বেছে নিতেই হবে। জেনারেলরা ক্রমাগত চাপ দিচ্ছেন। বাইরের প্রেসারও আসছে। ইয়াহিয়া এ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। বেলা প্রায় ১টা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ক্লান্ত দুটা এসে ঢুকলেন প্রেসিডেন্টের অফিস কক্ষে। ইয়াহিয়া খান তখন ফাইলের কূপের মধ্যে ডুবে গেছেন। একটার পর একটা পশত করে যাচ্ছেন। যাকে দেখেই বললেন ; জুলফি, আমি সত্যি ব্যস্ত তােমাকে শুধু শুধু বসিয়ে রেখেছি। একটু পরে আবার চীনের রাষ্ট্রদূত আসছেন। তোমার সাথে বরং এখনই সেরে ফেলি। বলো, যা বলবে তুমি। খানিকটা বসতে ভূট্টো বলেন ; তােমার ব্যস্ততার মানে আমি বুঝি। দিনের অর্ধেকটাই কাটিয়েছ শুধু সাজগােজ করতে করতে । একটু শান্ত হয়ে ইয়াহিয়াকে আবার বললেন : তোমার সাথে যে একটা জরুরি বিয়ে সলাপরামর্শ করবার সময় এসে গেছে। ইয়াহিয়া : সময় এসে গেছে মানে তুমি কী বলতে চাও জুলফি খুলেই বলাে। ভূট্টো : তুমি জানাে আমি কি বলতে চাচ্ছি। মিঃ প্রেসিষ্টেন্ট, দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। মজুরি কমেছে, অথচ ট্যাক্স বেড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের আর্মিকে অহেতুক কলহে জড়ানাে হয়েছে। এতে কী লাভ হয়েছে? ওরা তাে ইতোমধ্যেই দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। জাতি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের। সুনাম ক্ষুন্ন হয়। এ নিয়ে সিরিয়াল চিন্তা-ভাবনার দরকার। ইয়াহিয়া : ভূমি এখন কী করতে বলাে? ভূট্টো : আমার বক্তব্য খুব সংক্ষিপ্ত এবং সােজা। পূর্ব পাকিস্তানের সাথে একটা সমঝোতায় আসা দরকার। আর সেজন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া আবশ্যক। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। ইয়াহিয়া : ভূলে যেও না জুলফি, তােমার সম্মতি ছাড়া আমরা এ কাজে হাত দিই নি। ভূট্টো : হ্যা, আমার সায় ছিল। ক্র্যাকডাউনে মত ছিল। কিন্তু গৃহযুদ্ধ, রক্তপাতের জন্যে নয়-কেবল গ্রেফতার পর্যন্তই চেয়েছিলাম আমি। ইয়াহিয়া ; সব ব্যাপারেই তুমি একমত ছিলে। এখন কেন উল্টো কথা বলছে। দেখাে, অযথা বাজে বকে সময় নষ্ট করাে না। দায়িত্ব এড়াতে যেও না। আমাকে আর যা-ই বলাে শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে কিছু বলবে না। শেষ নিঃশ্বাস থাকতেও ওটা আমি হতে দেবাে না। ভুট্টো : শেখ মুজিব কি জীবিত? ইয়াহিয়া : অবশ্যই। প্রকাশ্যে ঘােষণা দিয়েই তাকে ফাসি দেয়া হবে। ভুট্টো : দোহাই খােদার ওটা করাে না যেন। ইয়াহিয়া : কেন না? একজন বিশ্বাসঘাতকের যা প্রাপ্য তাই তাঁকে দেয়া উচিত। আমি এ সুযোেগ আর হাতছাড়া করতে রাজি নই। শেখকে আমি ঝুলাবােই। ভুট্টো : ওটা হজম করতে পারবে না। শেখ মুজিব এমন বিরাট ব্যক্তিত্ব যে তােমার পক্ষে ওকে মেরে ফেলা অত সহজ কাজ নয়। ভূট্টো কথা শুনে ইয়াহিয়ার মুখমণ্ডলে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। প্রেসিডেন্ট বললেন ; জুলফি, তাহলে কি তুমি বলতে চাও যে শেখকে মারবার মতাে সাহস আমার নেই। ভুট্টো : আমি কিন্তু ওটা বলি নি। আমার বক্তব্য হচ্ছে শেখকে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করলে গােটা পৃথিবী আমাদের ওপর ক্ষেপে যাবে। এমনকি আমেরিকানরাও এটা চাইবে না। ইয়াহিয়া : আমেরিকানরা তাে আমার পকেটেই রয়েছে। তুমি কী মনে করাে যে শেখের ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নিক্সন যেতে পারেন? জুলফি ওই বন্ধন অত শিথিল নয়। মিছেমিছি কেন অত ভাবাে। আমরা পরস্পরকে ভালােভাবেই জানি। এমন কি ডঃ কিসিঞ্জারেরও একই কথা। কিসিঞ্জার পরিষ্কারভাবে বলেছেন ওটা তােমাদের (পাকিস্তানের) নিজস্ব ব্যাপার। ভুট্টো বললেন : এই হেঁয়ালিতে আর নাক না গলানােই ভাল। ইয়াহিয়া ঝটপট ফাইলে দস্তখতের কাজ সেরে ফেলছেন। ভুট্টোর বদ্ধমূল ধারণা। ফাইলগুলাের অধিকাংশই মৃত্যুদণ্ডের।

Source:

পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু -রবার্ট পেইন