নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড : মহাজীবনের যবনিকা
মার্কিনঘেঁষা ও পাকিস্তানের সেবাদাস খােন্দকার মােশতাক আহমদ কিন্তু মনে-প্রাণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়নি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে তার ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। তার মূল টার্গেট ছিল নিজেকে বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন করা এবং তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া। সে তার কূটচালে সফল হলাে। তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী পরিষদ থেকে বাদ দেন এবং রাজনীতির মঞ্চ থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেন। তাজউদ্দীন আহমদকে তিনি যতই দূরে ঠেলে দিতে চেয়েছেন। ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে, তবু তিনি ছায়ার মতাে বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন। সহকর্মীদের সঙ্গে দুঃখ করতেন আর বলতেন, বঙ্গবন্ধু ভুল পথে হাঁটছেন। ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে তাদের ষড়যন্ত্রের জালে এমনভাবে আবদ্ধ করেছিলেন যে, তাকে সেখান থেকে বের করার কোনাে পথ ছিল না। নির্লোভ এবং নিরহঙ্কার চিত্তের মানুষ তাজউদ্দীন তার আচরণে এমন কিছু দেখাননি যে তিনি ক্ষমতার জন্য পাগল। ক্ষমতার বাইরে একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে দলের জন্য কাজ করে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠীর বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর উদারতা এবং সরলতার সুযােগ নিয়ে ‘৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালির সে স্বপ্নসাধ পূরণ রুদ্ধ করেছিল। ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। ইতিহাসের আরেক নিষ্ঠুর পরিহাস।
বিপথগামী বদমায়েশ সেনা সদস্যদের এক সামরিক অভ্যুত্থানের নামে এই বর্বর হত্যাকাণ্ড চলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের কথা তাজউদ্দীন আহমদ কোনােদিন বলার সুযােগ পেলেন না। আর বঙ্গবন্ধু কোনাে কথা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চাননি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে দুজনই ব্যস্ত ছিলেন বলে বলা হয়ে উঠল না। রেডিওতে বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ জানতে পেরে বাক হারালেন তাজউদ্দীন স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বিষন্ন গলায় বলে উঠলেন, ‘মুজিব ভাই জেনেও গেলেন না কে তাঁর বন্ধু ছিল আর কে শত্রু। আমি যদি মন্ত্রিসভায় থাকতাম তবে কারাে ক্ষমতা ছিল না মুজিব ভাইয়ের শরীরে বিন্দুমাত্র ছোঁয়া দেয়।’ সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ও আত্মীয়স্বজনরা তাকে বাসা থেকে চলে যেতে বললেন। না, তিনি গেলেন না। কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনী তাজউদ্দীনের বাসা ঘিরে ফেলল। ক্যাপ্টেন শহীদ বাসায় এসে তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করে বলল, “আপনারা কেউ বাইরে যেতে পারবেন না এবং বাইরে থেকে কেউ ভেতরে আসতে পারবে না।’ তারপর টেলিফোন লাইন কেটে দিলাে, নিচতলায় কন্ট্রোল রুম করে এবং ছাদে এন্টি এয়ার ক্রাফটগান বসালাে। তাজউদ্দীন ক্যাপ্টেনকে বললেন, বলুন আমরা গৃহবন্দি।
গভীর রাতে মেজর ডালিম বাসায় ঢুকে বলল, ‘আপনার নিরাপত্তার জন্যই এই ব্যবস্থা। সব ঠিকঠাক আছে তাে?’ তাজউদ্দীন ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুমি নিজ চোখে দেখতে এসেছ আমাকে সত্যি বন্দি করা গেছে কিনা। সত্যি আমি বন্দি হয়েছি কিনা।’ এরপর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করল ডালিম। তার আগমনের উদ্দেশ্য তাজউদ্দীনকে সচক্ষে দেখে যাওয়া। ২২ আগস্ট আর্মির জিপ তাজউদ্দীনের বাসার সামনে এলাে। তারা তাদের সঙ্গে তাজউদ্দীনকে যেতে বলল। তাজউদ্দীন স্ত্রী, কন্যা, পুত্রের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। সিড়ি দিয়ে নামার সময় তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে ছাড়বে।’ উত্তরে। তাজউদ্দীন বললেন, “Take it forever. ধরে নাও চিরজীবনের জন্য যাচ্ছি।’ তিনি হাসিমুখে জিপে উঠলেন। তাকে এবং অন্য নেতাদের জেলে বন্দি করে রাখা হলাে। পরের দিন খবরের কাগজে সংবাদ বের হলাে, দুর্নীতির অভিযােগে নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ এরপর আগস্ট থেকে নভেম্বর চলে সেনাবাহিনীতে কু, পাল্টা কু, হত্যা-পাল্টা হত্যা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তা জায়েজ করার জন্য খােন্দকার মােশতাক জাতীয় চার নেতাকে তার মন্ত্রী পরিষদে যােগদান করতে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু তারা তার এই প্রস্তাবে রাজি হননি। পরবর্তী সময়ে মােশতাক তার সরকারকে সমর্থন জানাতে বলে। কিন্তু তাতেও তারা সায় দেননি। খােন্দকার মােশতাকের সকল ধরনের প্রস্তাব তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। খােন্দকার মােশতাক চিন্তা করল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, এই চার জাতীয় নেতা বেঁচে থাকলে সাম্রাজ্যবাদী গােষ্ঠী এবং পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠীর স্বপ্ন পূরণের পথে এরা অন্তরায় হিসেবে কাজ করবে। সেহেতু জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়।
৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় বন্দিরত অবস্থায় হত্যা করা হয় । জেলখানা তুলনামূলক নিরাপদ ও সংরক্ষিত এলাকা। এখানে নিয়মনীতির তােয়াক্কা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সহায়তায় জেল প্রশাসনের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে বন্দুকের। নলের মুখে জেলখানায় বন্দি রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাকাণ্ড ঘটানাে খুবই অদ্ভুত, প্রশ্নবােধক, বিরল এবং পৈশাচিক ঘটনা। সেদিন তাজউদ্দীন আহমদ এবং নজরুল ইসলাম এক সেলে এবং মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান পাশের সেলে ছিলেন। পরে সবাইকে তাজউদ্দীনের সেলে। আনা হয় এবং অত্যন্ত কাছ থেকে অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়। তিনজনের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়। তাজউদ্দীনের পেটে ও পায়ে গুলি লাগে। জেল হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের হত্যার খবর জানতে পারেন তার পরিবার। ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত তাকে কোনাে দর্শনার্থীর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। ২ নভেম্বর রাতে ৫ জন জেল কর্মকর্তা ও কয়েকজন ইনটেলিজেন্সের লােকের সামনে তার স্ত্রীকে আধা ঘণ্টার জন্য দেখা করার অনুমতি দেয়। দর্শনের সময় মিলিটারি ড্রেসে মিলিটারিসহ চারজন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে দেখা করার নির্দেশ দেওয়া হয় সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন তার স্বামীকে বললেন যে তিনি রাতে মৃত্যু-স্বপ্ন দেখেছেন। তাজউদ্দীন হেসে বললেন, ‘অবস্থা খুবই খারাপ এবং আমার মনে হয় আমাদের জীবিত এ স্থান থেকে ফেরত দেওয়া হবে ২ নভেম্বর রবিবার রাতে জোহরা তাজউদ্দীন বেশ উদ্বিগ্ন ও অন্যরকম হয়ে পড়েছিলেন। জেলখানা থেকে বাসায় ফিরে তিনি তার মেয়ে সিমিন হােসেন রিমিকে বলেছিলেন, ‘আজ জেলখানার পরিবেশকে অন্যরকম মনে হয়েছে। তারা। আমার সঙ্গে ভালাে আচরণ করেনি।’ রাতে সৈয়দা জোহরা অনেক চিন্তিত ছিলেন। ভাের রাতে মায়ের ডাকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় রিমির। এর আগে রিমি স্বপ্নে দেখেছিলেন বাবা যেন বাসায় ফিরে এসেছেন। ওই দিন সকালে আকাশে জঙ্গি বিমানের খুব শব্দ ছিল। ভাের হতেই মনটা যেন কেমন হয়ে গেল তার।
৩ তারিখ সারাদিন নানা জল্পনা-কল্পনা আর গুজবের মধ্যে দিয়ে কাটল। জেলখানায় কী হয়েছে তা জানা গেল না। তবে ৪ তারিখ সকালে অন্যরকম গুজব। ছিল যে, জেলখানায় পরশু রাতে পাগলা ঘণ্টা বেজেছে, গুলির শব্দ শােনা গেছে। ইত্যাদি। ওই দিন বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় রিমি ফোন করেছেন। তাজউদ্দীনের মেয়ে পরিচয় দিয়ে কথা বলেছেন বিভিন্ন জায়গায় । কিন্তু কোনাে কিছুই জানতে পারেননি। তাই তিনি ও রিতি পাশেই তাদের মফিজ কাকুর বাসায় যান। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন নারী বাসায় ঢােকে। একজন নিজেকে খালেদ মােশাররফের মা পরিচয় দিলেন। পরে তিনি রিমির ছােট ফুফুর ছেলে ঢাকা কলেজের ছাত্র বাবুলকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের হত্যার কথা জানান। বাবুল বললেন, ‘মামা আর নেই। ভর সন্ধ্যায় তাজউদ্দীনের কয়েকজন বন্ধু বাসায় আসেন। তারা এসে ডা. করিমের মাধ্যমে তাজউদ্দীন হত্যার ঘটনা জানান সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে। | রাত ১২টা ২৫ মিনিটে তাজউদ্দীনের মৃতদেহ বাসায় এলাে। সৈয়দা জোহরা পাথর মূর্তি। তিনি রাতভর তার নিথর দেহের পাশে বসে মাথায় হাত বােলালেন। রিমি ছােট ভাই সােহেলকে সঙ্গে নিয়ে বাবার কাছে গেলেন, দেখলেন তার প্রিয় বাবার ডান পায়ের গােড়ালিতে বুলেটের রক্তাক্ত ক্ষত। পরদিন জানাজা ও লাশ দাফন নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হলাে। অনেকে সাময়িক গ্রেফতারও হলেন। পরে সেনা সদস্যরা এসে জোর করে লাশ নিয়ে যায় এবং বনানী গােরস্তানে দাফন করে।
প্রিয় পাঠক, এখানেই যবনিকা ঘটল একটি মহাজীবনের, বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ – স্বকৃত নোমান – উৎস প্রকাশন, ৩ নভেস্বর ২০১৫