You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.17 | মুজিবনগর সরকার - মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ - সংগ্রামের নোটবুক
মুজিবনগর সরকার, মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে আগরতলা রওনা দেন। ১১ এপ্রিল ময়মনসিংহ সীমান্ত থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নিয়ে আগরতলা পৌছেন। এ দিন আগরতলা সার্কিট হাউজে এমএন ও এমপিদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ সরকার গঠনসহ যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা অনুমােদিত হয়। ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে জারিকৃত স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হয়। এর মাধ্যমে ইতােপূর্বে প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘােষণাকে প্রতিপাদন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। রাষ্ট্রপতি পাকিস্তানে অন্তরীণ থাকার কারণে উপরাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের এখতিয়ার দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৯টা থেকেই সেখানে নেতৃবৃন্দ ও আমন্ত্রিত অতিথিদের আগমন শুরু হয়। দেশি বিদেশি প্রায় শতাধিক সাংবাদিক এই শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, এর আগে কলকাতায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়েছিল। প্রবাসী সরকার ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করে সেখানে সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদ ঘােষণার ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের গােপন সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই কার্যক্রমের গােপনীয়তা ফাঁস হয়ে যায় এবং পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ১৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বৃষ্টির মতাে বােমা বর্ষণ করে এবং পাকহানাদার বাহিনী ওইদিনই চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। ওই বিপর্যয়ের পর তাজউদ্দীন আহমদ সিদ্ধান্ত নেন পরবর্তী শপথ গ্রহণের দিনক্ষণ ও স্থান তিনি কাউকে জানাবেন না। পাকবাহিনীর বিমান হামলার কথা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে সর্বোত্তম নিরাপদ একটি স্থান তিনি বাছাই করেন। এই গােপনতম কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য তার বিশ্বস্ত সহকর্মী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে শ্ৰী গােলক মজুমদার এবং বিএসএফের শ্রী চট্টোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দ্বিতীয়বার বিপর্যয় এড়াতে তাদের মধ্যে এ বিষয়ে কথা চলত আকার ইঙ্গিতে এবং কোড ব্যবহারের মাধ্যমে অবশেষে অনেক কৌশলগত দিক বিবেচনা করে এবং জমিনে ও আকাশে। ভারতের সামরিক নিরাপত্তার আচ্ছাদন নিশ্চিত করে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে ১৭ এপ্রিল সকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের সময় ও দিন তারিখ নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশের জন্মলগ্নের অকৃত্রিম বন্ধু ও বাঙালি জাতির দুঃসময়ের অভয়দাত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর হুকুমে ১৭ এপ্রিলের সকালে দমদম এয়ারপাের্টে গােপনে। সজ্জিত হয় ভারতীয় যুদ্ধ বিমান বহর।
মেহেরপুর সীমান্তের ভারতীয় ভূখণ্ডে মাথা উচু করে দাড়ায় ভারতের অজেয় ক্ষিপ্রগতির সামরিক বাহিনী। মেহেরপুর আম্রকাননের দূর-দূরান্তে ঘাস-পাতা বিছানাে জালের ছাউনিতে ভারতীয় বাহিনীর অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান মেহেরপুরের আকাশ নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে দেয়। এদিকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রােডে বাংলাদেশের সরকারের অফিসের কেউ জানে না কলকাতা থেকে শত শত মাইল দূরে বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসের এক স্বর্ণালি অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে। মেহেরপুরে ১৭ এপ্রিলের গােপন পরিকল্পনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এতই কঠোর-কঠিন গােপনীয়তা অবলম্বন করেন, শুধু বাংলাদেশের এমপিরা নন, মন্ত্রিসভার কোনাে সদস্যও তা ঘুণাক্ষরে জানতে পারেনি। তাদের শুধু বলা হয় তারা কেউ যেন কলকাতার বাইরে বের না হয়। ১৪ এপ্রিলের বিপর্যয়ের বেদনা ও গ্লানি মুছে ফেলতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধুর যােগ্য উত্তরসূরি তাজউদ্দীন আহমদের এই কোষবদ্ধ কঠোর গােপনীয়তা। ১৭ এপ্রিলের মেহেরপুরের পুণ্যময় প্রভাতের জন্য ১৬ এপ্রিল মধ্যরাতে কলকাতার বুকে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। বিএসএফের কর্নেল চট্টোপাধ্যায় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ১০০টি গাড়ি ও বাসের ব্যবস্থা করেন। ৫০টি বাস ও গাড়িতে করে কলকাতা শহর ও আশপাশে ২০০ কিলােমিটারের মধ্যে অবস্থিত বাংলাদেশের এমপিদের ঘুম ভাঙিয়ে একে একে গাড়িতে ভােলা হতে থাকে  সকাল সাড়ে পাঁচটায় কলকাতা প্রেসক্লাব এবং হােটেল এ্যান্ড ও হােটেল পার্কের সামনে থেকে ৫০টি গাড়িতে ও বাসে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ক্যামেরাম্যান ও টিভি ক্রুদের তােলা হয়।
কলকাতা প্রেসক্লাবে মৌমাছির মতাে সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানদের তুলতে গেলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ‘রহমত আলী ছদ্মনামে পরিচিত ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও টাঙ্গাইলের এমপি আবদুল মান্নান। অনেক প্রশ্ন করা হলাে। তাদের অনেক প্রশ্নের কোনাে উত্তরই পেল না। কেউ তাদের যাত্রা কোথায়? বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি রহমত আলী শুধু বললেন ; ‘অজানার উদ্দেশে। হ্যাঁ, ১৭ এপ্রিল বাঙালি জাতির সামনে তখন সবকিছুই ছিল অজানা ও অনিশ্চিত পথযাত্রা। শুধু নিশ্চিত ছিল স্বাধীনতা। মেহেরপুরের উদ্দেশে সেই স্বাধীনতার পথযাত্রার প্রথম ধাপ ১৭ এপ্রিলের যাত্রা। কাকডাকা ভােরে কলকাতা প্রেসক্লাব থেকে এবং হােটেল পার্ক ও গ্র্যান্ড হােটেল থেকে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান এবং টিভি ক্রুদের নিয়ে একে একে ৫০টি গাড়ি ও বাস কলকাতা শহরকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে। তাদের গাইড হিসেবে অগ্রবর্তী গাড়িতে ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি রহমত আলী (আমীর-উল ইসলাম) এবং আবদুল মান্নান এমপি। অন্যদিকে ভারতীয় কমান্ডাে বাহিনীর নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে কলকাতা থেকে রহমত আলী ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার’ সাইক্লোস্টাইল করা ইংরেজি ও বাংলার বহু কপি সঙ্গে নিয়েছিলেন সাংবাদিকদের মধ্যে বিতরণের জন্য। ১৭ এপ্রিল সকাল সাড়ে পাঁচটায় বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ মন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মােশতাক আহমদ এবং কর্নেল (অব.) আতাউল গনি ওসমানী একটি গাড়িতে রওনা হন। সকাল ১১টায় বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার ভিআইপিরা সেখানে পৌছান। তার আগে সাংবাদিকরা সেখানে পৌছে যায়।
মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তওফিক এলাহী চৌধুরী এবং এসডিপিও মাহবুবের নেতৃত্বে বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে ছােট্ট একটা মঞ্চ সাজানাে, ছােট দুটি কার্পেট বিছানাে এবং দেবদারুর কচিপাতার তােরণ নির্মাণ কার্যক্রম তখনাে চলছিল। তােরণের দু’পাশে বঙ্গবন্ধুর বড় বড় ছবি ঝােলানাে হয়। দুপুরের মধ্যে বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন লােকে লােকারণ্য হয়ে যায়। মেহেরপুরের মুক্তিযােদ্ধারা শেষ মুহূর্তে খবর পেয়ে যে যেখানে ছিল মধুপের মতাে উড়ে আসতে লাগল। আনন্দ-আবেগে উদ্বেলিত শত শত কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে’, গগনবিদারী শ্লোগানে মেহেরপুরের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে স্লোগানে, মুখরিত বৈদ্যনাথতলার মঞ্চে দুপুরের পরপরই উঠলেন অনুষ্ঠানের পরিচালক আবদুল মান্নান এমপি পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী কোরআন থেকে তেলাওয়াতের জন্য। একজন মাওলানার নাম তিনি মাইকে ঘােষণা করলেন। কিন্তু সেই মাওলানাকে সেখানে পাওয়া গেল না। তার কারণ সকাল থেকে মেহেরপুরের জামায়াত ও পাকিস্তানপন্থী দলগুলাে বৈদ্যনাথতলায় হিন্দুদের পুজোর অনুষ্ঠানে কেউ যাতে কোরআন তেলাওয়াত না করতে পারে সেজন্য মেহেরপুর মহকুমার সব মসজিদের ইমাম ও মােয়াজ্জেমদের তাড়িয়ে নিয়ে মেহেরপুর ছাড়া করে। ফলে সেখানে মুক্তিযােদ্ধারা সমবেত ভিড়ের মধ্য থেকে মেহেরপুরের কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র মহেশনগরের বাকের আলীকে মঞ্চে তুলে আনলাে ভারি মিষ্টি গলায় কেরাত পড়তেন বাকের সেই বাকের আলীর কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হলাে অনুষ্ঠান এরপর আবদুল মান্নান এমপি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ করার জন্য মাইকে চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলীর নাম ঘােষণা করেন। তিনি মঞ্চে উঠে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে’ শ্লোগানের মধ্যে ৪৬৪ শব্দে রচিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার সনদ পাঠ করেন।
স্বাধীনতা ঘােষণার এই সনদে সুস্পষ্টভাবে ও সুনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক আইনের অনুসরণে উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তানি বর্বর সশস্ত্রবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যা শুরু করার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের মেজরিটি দলের নেতা হিসেবে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। স্বাধীনতা ঘােষণার সনদে আরাে বলা হয়, সেই হেতু আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিতেছি। এবং উহার দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা অনুমােদন করিতেছি। আমরা আরাে সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিতেছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘােষণা ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে। বলে রাখা ভালাে, এই স্বাধীনতার ঘােষণার খসড়া রচনা করেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম । ভারতের বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুব্রত রায় চৌধুরী দেখে দিয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ খসড়াটি চূড়ান্ত করেছিলেন ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের এমপিদের অনুমােদনের জন্য।
‘স্বাধীনতার ঘােষণা’ পাঠের পর অনুষ্ঠানের পরিচালক আবদুল মান্নান এমপি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের নাম ঘােষণা করেন এবং একে একে মঞ্চে এসে দাঁড়ান ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মােশতাক আহমদ। মুহুর্মুহু করতালি ও গগণবিদারী ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে’ স্লোগানের মধ্যে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠকারী অধ্যাপক ইউসুফ আলী। তাদের সবাইকে শপথবাক্য পাঠ করান। বৈদ্যনাথতলার যে আম্রকাননে স্বাধীন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সূর্য ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল উদিত হয়, সেখান থেকে মাত্র কয়েক কিলােমিটার দূরে পলাশির আম্রকাননে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার স্বাধীনতার সূর্য একদিন অস্তমিত হয়েছিল। বাঙালির গলায় গােলামির জিঞ্জির পরানাে হয়েছিল। দীর্ঘ দুইশত চৌদ্দ বছর পর বাঙালি জাতির মুক্তিদূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই গােলামির জিঞ্জির ভেঙে খানখান করে দিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্ত, স্বাধীন জাতির স্বাদ লাভের পথ করে দেন। বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বাংলাদেশ সরকারের সদ্য শপথ গ্রহণকারী উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদেম সম্মানে ক্যাপ্টেন আবু ওসমানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দলের গার্ড অফ অনার দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা পৌছতে পারেনি বলে মেহেরপুরের এসপি মাহবুব কয়েকজন পুলিশ ও আনসার নিয়ে তাদের গার্ড অফ অনার দেন। এর কারণ হলাে, অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত। করার সিদ্ধান্ত ছিল।
এরইমধ্যে আকাশে দু’বার গুড়গুড় আওয়াজ শােনা গেলে জেনারেল ওসমানী ‘হারি আপ, হারি আপ’ বলে মঞ্চ থেকে দ্রুত নামতে গেলে কার্পেটে পা বেঁধে তিনি প্রায় পড়ে যান। এখানে বলে রাখি, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পরার মতাে কোনাে সামরিক ড্রেস তার ছিল না বলে বিএসএফ তৎক্ষণাৎ দর্জি ডেকে তার মাপ অনুযায়ী একটি সামরিক ড্রেস তৈরি করে দেয়। স্বাধীনতা ঘােষণা ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেখানে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সােনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য কোনাে শিল্পী ছিল না। অগত্যা ছাত্রনেতারা মঞ্চে উঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন শপথ গ্রহণ শেষে কয়েকজন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, ‘আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল। আমরা আমাদের দেশের মাটি থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিতাড়িত করবােই। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা আজ না জিতি কাল জিতবােই। আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্তপ্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দি। তার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই হবে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর দেওয়ার আগে সেখানে সমবেত সবার এবং দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত । হানাদার পাক সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সর্বত্র গণহত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। বাংলাদেশের লাখ লাখ ভাইবােনের মৃতদেহের স্তুপের নিচে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কবর হয়ে গেছে। পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর গণহত্যা, জ্বালাও-পােড়াও এবং আমাদের মা-বােনদের ওপর তাদের পাশবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আমাদের আর কোনাে বিকল্প নেই।
১৯৭০-এ আওয়ামী লীগ ৬ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতেই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মােট ৩১৩টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসন লাভ করেছিল। নির্বাচনী বিজয় এতােই চূড়ান্ত ছিল যে, আওয়ামী লীগ শতকরা আশিটি ভােট পেয়েছিল। এই বিজয়ের চূড়ান্ত রায়েই আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া ও বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তাকে বন্দি করে এবং নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যাযজ্ঞ চালায়। বাঙালি জাতি এখন মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত। বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। বাঙালি জাতি এখন বিশ্বের বুকে স্বাধীন একটি জাতি তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং বৈষয়িক ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতিগুলাের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহস্র মানুষের অকালমৃত্যু এবং বাংলাদেশের মূল সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন আর কালবিলম্ব করবেন। এই মুহূর্তে এগিয়ে আসুন এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুন।’ ভাষণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, “আজ থেকে আমাদের শপথ গ্রহণের এই মেহেরপুরের নাম হবে বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম অনুসারে ‘মুজিবনগর এবং এই মুজিবনগর আজ থেকে হবে বাংলাদেশের রাজধানী।” ‘৭১-এর ২৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের প্রতি অস্ত্র সাহায্য ও স্বীকৃতি প্রদানের জন্য অনুরােধ জানান।
তিনি বিদেশে বসবাসরত সকল বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের আবেদন জানান। ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ১৮ দফা নির্দেশাবলি জারি করেন। ২৯ মে তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণে বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানের জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম এবং এ লক্ষ্যে আমরা সাধ্যমতাে চেষ্টা করেছি। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করেছি। কিন্তু ইয়াহিয়ার নির্লজ্জ সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন বাঙালির জন্য স্বাধীনতা ঘােষণা ব্যতীত আমাদের অন্য কোনাে উপায় ছিল না।’ এই সময় ইয়াহিয়া খানের দূত মীমাংসার জন্য প্রস্তাব দেয়। আমেরিকাও যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা চালায়। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র’ কোনাে প্রকার সমঝােতার সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়ে বলে, পাকিস্তানের সাথে আলােচনার কোনাে প্রশ্নই ওঠে না। ২ জুন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ‘জয় বাংলা পত্রিকার প্রতিনিধির সঙ্গে আলােচনাকালে বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। পাকিস্তানের কাঠামােতে কোনাে আপস মীমাংসার প্রশ্ন উঠতে পারে না।  ১১-১৭ জুলাই কলকাতাস্থ ৮ নম্বর থিয়েটার রােডে সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন আহ্বান করেন তাজউদ্দীন আহমদ। সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিপরিষদ, সংস্থাপন, প্রতিরক্ষা, তথ্য, বেতার, অর্থনৈতিক প্রভৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদের সভার আলােচ্যসূচি ও কার্যবিবরণী নিজ হাতে লিখতেন। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচটি ইমাম তা টাইপ করে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর গ্রহণ করতেন। সাবেক সচিব মােহাম্মদ নূরুল কাদেরের মতে, ‘মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত সরকার কাঠামাে ছিল বাস্তবমুখী এবং প্রকৃত অর্থে বেসামরিক প্রশাসনের প্রতিভূ। এটা সম্ভব হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং প্রজ্জজনিত পদক্ষেপের কারণে। প্রকৃত অর্থে সিভিল সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে এ ধরনের পদক্ষেপ হতে পারে অনুকরণীয়। তিনি এমন একটা প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যেখানে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ হবে সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী। আবার আমলাতন্ত্রের প্রয়ােজনীয়তাকেও তিনি অবমূল্যায়ন করেননি।
আমলারা জনগণের সেবক এবং জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এমন একটা ধারণা মুজিবনগর প্রশাসন দেখে স্পষ্টভাবে বলা যায়। এই চিন্তা চেতনা থেকেই জোনাল কাউন্সিল গঠিত হয়।’ এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, একটা স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ও সুদূরপ্রসারী সাংবিধানিক পদক্ষেপ ছিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠান আয়ােজন করে বিশ্বব্যাপী প্রচারের ব্যবস্থা করা। এর ফলে বাঙালিদের সদ্য শুরু হওয়া সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ লাভ করে বিশাল ব্যাপকতা এবং শুরু হয় বিশ্বব্যাপী আমাদের সপক্ষে জনসমর্থন অর্জনে ব্যাপক সাড়া। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতাদের দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকার গঠন করাটা ছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সপক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনে একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযােগ্য প্রক্রিয়া যা একদিকে যেমন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সরকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে অন্যান্য রাজনৈতিক তৎপরতার সপক্ষের কর্মকাণ্ডের বিশ্ব মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচারণা, অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র দেশবাসীদের ওপর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অমানুষিকভাবে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার লােককে নির্মমভাবে হত্যা করার কাহিনীর ব্যাপক প্রচারণা ও বিশ্বব্যাপী নিন্দার জোয়ার সবচেয়ে বড় কথা হলাে মুজিবনগর সরকার এবং এই সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাদের বিভিন্ন বক্তৃতা, বিবৃতি ও প্রচারে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানব অধিকার ও অন্যান্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতিমালা মেনে চলার বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ থাকার কারণে বিশ্বব্যাপী সমর্থনের পাল্লা ভারি হচ্ছিল প্রতিনিয়তই।
তাজউদ্দীন পরিবারের কলকাতায় যাওয়া আগেই বলেছি, ২৭ মার্চ সকাল আটটায় কারফিউ তুলে নেওয়া হলাে। তখন সৈয়দা জোহরার ভাই ক্যাপ্টেন সৈয়দ গােলাম কিবরিয়া বােনকে তার আশ্রয়দাতার বাড়ি থেকে নিয়ে যান। সৈয়দা জোহরা প্রস্তুতি নিলেন বন্ধুর যাত্রাপথ অতিক্রমের জন্য। স্বামীর সেই চিঠি তার মধ্যে অসামান্য প্রেরণার সঞ্চার ঘটাল। গােলাম কিবরিয়ার বাড়ির উপরও পাকিস্তানি সেনাদের চোখ পড়তে পারে এই আশঙ্কায় জোহরা তার ভাইয়ের প্রবল ইচ্ছার বিরুদ্ধে আশপাশের কিছু বাড়িতে ক্ষণস্থায়ী অবস্থানের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। কিন্তু হায়, এক বাড়ির দরজাই খুলল না এবং অন্য বাড়ির সরকারি কর্মকর্তা তাকে ঘরে আশ্রয় দিলেও বাসায় অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে’ এই অজুহাতে পাশের বাড়িতে নিয়ে যাবার কথা বললেন। সৈয়দা জোহরা তার শিশুপুত্র ও শিশুকন্যাকে নিয়ে গভীর রাতে বাসা ত্যাগ করলেন। একটা জিনিস আনার কথা বলে তাদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে বাড়ির মালিক দরজা বন্ধ করে দিলেন। সৈয়দা জোহরা রাস্তায় দাড়িয়ে আছেন। চারদিকে গােলাগুলি, কার্ফ চলছে। তারপর জোহরা ফিরে গেলেন ভাইয়ের বাসায়। ৩০ মার্চ সকালে শারমিন ও সিমিন তাদের ছােট মামার বাসায় যান এবং সেখানে মায়ের সঙ্গে দেখা হয়। তারপর তারা চলে যান গ্রামের বাড়ি দরদরিয়ায়। তাজউদ্দীনের মেজভাই মফিজউদ্দীন তাদের পেয়ে খুব খুশি হলেন। ১৯ এপ্রিল শােনা গেল ঢাকা শহরে মিসেস তাজউদ্দীনকে পাকবাহিনী খুঁজছে। শহর থেকে তাদের কাজের ছেলে হাসান এসেছে। তার কাছে ঢাকার অবস্থা জানা গেল। ২৭ এপ্রিল পাকবাহিনী শ্রীপুর আক্রমণ করে। তাই দরদরিয়ায় থাকা তাদের জন্য নিরাপদ নয়। গভীর রাতে তারা নৌকায় চড়ে গ্রাম ত্যাগ করে নদীতে একটি লঞ্চে উঠে ডেমরায় পৌছলেন সেখান থেকে হাসানের শ্বশুরবাড়ি জোরপুর গ্রামে চলে যান। না, এখানেও থাকা হলাে না। কারণ পাশেই বিহারীদের বাসা। সেখান থেকে তারা বাসাবাের এক বাসায় উঠলেন। পরে সৈয়দা জোহরা আওয়ামী লীগের এমএনএ আবদুল হামিদের শ্বশুরবাড়িতে যান কিন্তু সেখানে আবদুল হামিদ নেই। তিনি বানরী গ্রামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীর বাড়িতে আছেন পরের দিন একটি ছােট লঞ্চে বানরী গ্রামে রওনা দেন সৈয়দা জোহরা  উন্মত্ত পদ্মায় ঝড় শুরু হলাে। লঞ্চটি একটি চরে আটকে গেল অনেক কষ্টে লঞ্চ নিয়ে সন্ধ্যায় বানরী গ্রামে পৌছলেন।
৯ মে আবার খবর ছড়িয়ে পড়ল তাজউদ্দীনের পরিবার এই গ্রামে আছে। আগামীকাল আর্মি আসবে। পরের দিন সকালে ছােট লঞ্চে চড়ে বসলেন সৈয়দা জোহরা। পথে সিরাজদিখানে আর্মির গােলাগুলির সম্মুখীন হলেন। সিরাজদিখানে রাত কাটালেন। ওদিকে বানরী গ্রাম পুড়িয়ে ফেলেছে আর্মিরা। যে বাড়িতে জোহরা আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই বাড়ির মালিককে হত্যা করল পাকআর্মিরা। দুপুরে আবার তিনি শুনতে পেলেন আর্মিরা এদিকে আসছে সঙ্গী হামিদ মিয়া ও সৈয়দা জোহরা ওই বাড়ি ত্যাগ করে নৌকায় গভীর রাতে গুইয়াগাইছা গ্রামে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। খালি মাটিতে শুয়ে রাত কাটালেন তার মেয়েরা। হামিদ মিয়ার স্ত্রীর আচরণ ভালাে ছিল না। ১৭ মে একটি নৌকায় সৈয়দা জোহরা ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওনা দিলেন। সদরঘাট টার্মিনালে আর্মি তল্লাশি চালাল। সৈয়দা জোহরা অত্যন্ত কৌশলে ধানমন্ডির ১৩ নম্বর রােডে ভাইয়ের বাসায় চলে এলেন  হাসান ঠিক করলেন সৈয়দা জোহরা ও তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিমানে যশাের যাবেন। কিন্তু সংবাদটি আর্মিরা জেনে গেল। জোহরার ভাইয়ের এক ব্রিগেডিয়ার বন্ধু এই সংবাদটি জানান। তিনি জানান যে তারা যশাের গেলে গ্রেপ্তার হবেন ফলে যশাের যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হলাে।  ওদিকে শ্রীপুরের রহমত আলী সৈয়দা জোহরা ও তার ছেলেমেয়ের খোঁজ করছেন। রহমত আলী আগরতলা থেকে কলকাতায় তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করেছেন। ২১ মে রহমত আলী মিসেস তাজউদ্দীন ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে ডেমরার উদ্দেশে রওনা দিলেন। তারা কাচপুর পৌছে নদী পার হয়ে বৈদ্যের বাজার গেলেন। সেখান থেকে লঞ্চে কুমিল্লার রামচন্দ্রপুর গ্রামে পৌছেন সৈয়দা জোহরা বােরকা পরা । সব জায়গায় আর্মির তল্লাশি চলল গ্রামের পথ দিয়ে তারা হাঁটছেন।
এমন সময় ঢাকার তেজগাঁও থানার শিরু দারােগা দৌড়ে এসে তার পরিচয় দেন। তাজউদ্দীনের বাসায় প্রায়ই শিরু দারােগা যেতেন। তাই তিনি সবাইকে চেনেন। পরে তারা আওয়ামী লীগের এমএনএর বাড়ি পৌঁছেন। রাতেই খবর এলাে আগামীকাল এই গ্রামে আর্মি আসবে। সুতরাং রাতেই আবার নৌকাযাত্রা শিরু দারােগা সড়কের পুলের কাছে নিয়ে আসে তাদের। সবাইকে পাটক্ষেতে নামতে হবে। পানি পাড়ি দিয়ে আবার ডিঙি নৌকায় উঠে পুলের নিচ দিয়ে যেতে হবে। আর্মিরা দেখলে গুলি করে হত্যা করবে। তারা হাঁটছেন। পাশেই মৃতদেহ। তিন দলে বিভক্ত হয়ে পথপ্রদর্শকের সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ পুল অতিক্রম করে আবার পায়ে হেঁটে এক বাড়িতে পৌঁছলেন। আবার নৌকায় চড়ে পেীছেন সিদলা গ্রামে। সঙ্গে শিরু দারােগা ও রহমত আলী। এরপর বিদায় নিলেন শিরু দারােগা। সামনে সীমান্ত রেললাইন। পায়ে হেঁটে যেতে হবে। খুব দ্রুত সবাই রেললাইন পার হলেন। বাংলাদেশ ত্যাগ করে আগরতলায় এলেন শরণার্থী হয়ে । সৈয়দা জোহরা সীমান্ত পার হওয়ার সময় নিয়ে এলেন স্বদেশের দু’মুঠো মাটি তারপর তারা বক্সনগর পৌছে বন বিভাগের ডাকবাংলােয় উঠলেন। এরপর জিপে চড়ে পৌছেন সােলাসুরা সার্কিট হাউজে  কিছুক্ষণ পর তারা জিপে আগরতলা সার্কিট হাউজে পৌছেন এই সময় নারায়ণগঞ্জ এমএনএ শামসুজ্জোহার সঙ্গে দেখা হয়। ২৭ মে তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার প্লেনে কলকাতায় পৌছে ট্যাক্সিতে করে তারা পার্ক সার্কাস বাংলাদেশ মিশনে যান। গেস্ট হাউজে তারা থাকছেন। গভীর রাতে তাজউদ্দীন পরিবারের সদস্যদের দেখতে এলেন। শুধু বললেন, “ভালােভাবে থেকো।’ ৫ মিনিট থেকে তিনি চলে গেলেন আবার। তার মধ্যে কোনাে উচ্ছ্বাস বা ভাবাবেগ দেখা গেল না। ২৯ মে পার্ক স্ট্রিটের কোহিনূর ম্যানসনের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু করেন তাজউদ্দীন পরিবার। মওলানা ভাসানী একই ভবনে থাকেন। ভাসানী তাজউদ্দীনের স্ত্রী ও মেয়েদের সঙ্গে আলােচনা করতেন এবং বলতেন, ‘তাজউদ্দীন আমার যােগ্য ছেলে, ওর প্রতি আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট। এই ভবনে এক সপ্তাহ থাকার পর। তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার সিআইডি রােডের আটতলা ফ্ল্যাটবাড়িতে ওঠে সেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। একই ভবনে আরাে তিন মন্ত্রী থাকেন। মন্ত্রীরা বাসায় আসেন এবং খাওয়া-দাওয়া করেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ আসেন না।
তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন দেশ স্বাধীন না হলে তিনি দাম্পত্য জীবনযাপন করবেন।  চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তিনি বিশ ঘণ্টাই কাজ করছেন। পরে জানা যায়, তেজগাঁও থানার যে শিরু দারােগা সৈয়দা জোহরাকে সীমান্ত পার করে দেন, তাকে এবং তার পুত্রকে স্ত্রীর সামনে গুলি করে পাকসেনারা হত্যা করে। হত্যা করা হয় ওয়ারলেস অফিসের যুবক অপারেটরকে, কারণ সেখানে সৈয়দা জোহরা কয়েক ঘণ্টা ছিলেন। ঢাকায় তাজউদ্দীনের বাসভবনে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। সেখানে তারা তাজউদ্দীনের শ্বশুর সৈয়দ সেরাজুল হককে থাকতে দিয়েছেন। থাকতে দেওয়া মানে প্রায় গৃহবন্দি অবস্থা। তাকে সেনাবাহিনীরা বলত, ‘আপনি সৈয়দ, অথচ মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন একজন হিন্দুর কাছে। তার নাম তাে তাজউদ্দীন নয়, ত্যাজারাম। সে এক ভারতীয় হিন্দু। পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করেছে পাকিস্তান ভাঙার জন্য।’ ভাড়াটে আজিজ মিয়াকে আর্মিরা ধরে নিয়ে গেছে। তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য বােমা তৈরি করতেন। প্রথম আর্মির যে দলটি ক্যাম্পের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাদের উর্ধ্বতন অফিসার বিভিন্ন অছিলায় সেরাজুল হকের কাছ থেকে তার মেয়ে এবং মেয়েজামাইর সন্ধান জানার চেষ্টা করে বিফল হয় । প্রথম ব্যাচের অফিসারটি ছিল আচরণে শ্রদ্ধাশীল। সেরাজুল হক তার জ্ঞানের ঝুলি থেকে তাকে নানারকম মূল্যবান উপদেশ দিতেন। কবি শেখ সাদীর নীতি উপদেশগুলাের মধ্যে দিয়ে তিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার অমানবিক নীতি ও কার্যকলাপের সমালােচনা করতেন। পাকিস্তান বাহিনীর ঐ অফিসার তাকে তাজউদ্দীনের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বারান্দায় পাকারে রাখা খবরের কাগজের সামনে তাকে নিয়ে বললেন, এই খবরের কাগজগুলাে পড়লেই আপনি তাজউদ্দীন সম্বন্ধে জানতে পারবেন।
রণাঙ্গণে বীর মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে
রংপুর জেলার মুক্তাঞ্চলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এসেছিলেন মুক্তিবাহিনীরই একজন সেনানী হিসেবে। সেদিন ছিল ১০ অক্টোবর। বঙ্গবন্ধুর মহান জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ বাংলার বীর মুক্তিযােদ্ধাদের অসম সাহসিক রণনৈপুণ্যে এবং বিজয়ের অগ্রাভিযানকে প্রধানমন্ত্রী নির্যাতিত বিশ্বের জাগ্রত জনমানবের এক নতুন উজ্জ্বল ইতিহাস বলে উল্লেখ করেন। তিনি আগের দিন বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা স্বাধীন বাংলার একদল সৈনিক অফিসার ক্যাডেট হিসেবে কমিশন লাভ অনুষ্ঠানে যােগদানের পর মুক্তাঞ্চলের এই সফরে বের হন। প্রথমে তিনি মুক্তাঞ্চলে বুড়িমারিতে শিক্ষা সমাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত দুর্জয় সেনানীদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ-আলােচনার পর বুড়িমারী স্কুলঘরে প্রধানমন্ত্রী ও তার সঙ্গে আসা অতিথিদের দুপুরে খাবার পরিবেশন করা হলাে। হঠাৎ উইং কমান্ডার বাসারকে ডেকে তাজউদ্দীন জিজ্ঞেস করলেন, “আমাদের যােদ্ধারা খেয়েছে?’ উত্তর এলাে, ‘ওরা মাটির মধ্যে খেতে বসেছে। একটি মুহূর্ত মাত্র। প্রধানমন্ত্রী আস্তে করে উঠে। চলে গেলেন। বাইরে এসে একটি টিনের থালায় খাবার হাতে নিয়ে অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধার সঙ্গে বসে খেতে লাগলেন। তার দু-পাশে বসা দুজন মুক্তিযােদ্ধা সঙ্কোচ ও জড়তায় খাবার কথা ভুলে অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন নিজের থালা থেকে দুটি মাংসের টুকরাে তাদের পাতে তুলে দিয়ে তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘বাংলার সাড়ে সাত কোটি নরনারীর প্রত্যেকেই আজ মুক্তিযােদ্ধা, মুক্তি ও স্বাধীনতার এই যুদ্ধে আমি, তুমি, সে আর তিনি সবাই সমান। তারপর তিনি মুক্তাঞ্চলের একের পর এক গ্রাম ঘুরে বড়খাতা অঞ্চলের রণাঙ্গনে গেলেন। সমস্ত এলাকায় অসংখ্য বাংকার তৈরি করে অতন্দ্র প্রহরীর মতাে মেশিনগান ও রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযােদ্ধারা। সৈনিক বেশে সজ্জিত প্রধানমন্ত্রী তাদের কাছে গেলেন।
হঠাৎ দেখা গেল একদল গ্রামবাসী সারিবদ্ধভাবে বাশের সঙ্গে বড় বড় হাঁড়ি ঝুলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তােমরা কোথায় যাচ্ছ ভাই?’ তারা বলল, ‘আমাদের। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘ধন্য আমার প্রিয় দেশবাসী। তারপর তিনি বাঙ্কারের দিকে এগিয়ে গেলেন। আনন্দাশ্রু বিসর্জন করতে করতে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এক এক করে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের। হঠাৎ একটি বারাে-তেরাে বছরের কিশােরকে হাতে অটোমেটিক মেশিনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতবাক। ওর গালে ছােট্ট করে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন, এই খােকা, তােমার বয়স কত? ছেলেটি জবাব দিলাে, ‘স্যার, আঠারাে বছর।’ প্রধানমন্ত্রী বুঝলেন ছেলেটি সত্য বলছে না। ঠাট্টা করে তিনি বললেন, ‘তুমি ফিরে যাও, তােমার যুদ্ধের দরকার নেই।’ কিশােরটির দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আকুতি জানিয়ে বলল, ‘আমাকে বাদ দেবেন স্যার, এগিয়ে চলার পথে আমি পিছু হটতে শিখিনি। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘কেউ তােমায় বাদ দেবে না ভাই রণক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনির্ধারিত আগমনে সেনাবাহিনীর মধ্যে দেখা দিলাে এক অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্য।
হঠাৎ একসঙ্গে গর্জে উঠল বাংলা বাহিনীর কামান আর মর্টার। অব্যর্থ তাদের লক্ষ্য। চোখে দুরবিন লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রী সচক্ষে দেখলেন মাত্র চার শ গজ দূরে শুক্রবাঙ্কারে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হানাদারদের। ইতােমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আগমন বার্তা পৌঁছে গেলে মুক্তাঞ্চলের জনগণের কাছে। তাই ফেরার পথে শত শত নরনারী পথের পাশে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে অভিনন্দন জানালাে তাকে রাত আটটায় প্রধানমন্ত্রী পাটগ্রামে পৌছলেন। দূর থেকে ভেসে এলাে সহস্র জনতার কণ্ঠনিঃসৃত বলিষ্ঠ স্লোগান। পাটগ্রাম হাইস্কুল প্রাঙ্গণে ওরা সমবেত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা শুনতে। বীর জনতার সেই ডাক প্রধানমন্ত্রীর সব ক্লান্তি মুছে দিলাে। তিনি ছুটে গেলেন জনতার মাঝখানে  আবেগবিহবল কণ্ঠে বললেন, ‘ভায়েরা আমার, সুদীর্ঘ ২৪ বছর ধরে উপনিবেশবাদী। শাসক চক্রের হাতে শােষিত, লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত সাড়ে সাত কোটি বাঙালি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চেয়ছিল তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, আর তাই তারা বাংলাদেশের শতকরা সাড়ে ৯৮টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভােট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিল। তারা স্বপ্ন দেখেছিল একটি শােষণহীন সমাজব্যবস্থার। কিন্তু অত্যন্ত পৈশাচিকভাবে ইতিহাসের এই নজিরবিহীন গণরায়কে বানচাল করে দিয়ে বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হানাদার পশ্চিমা পশুর দল সারা বাংলাদেশব্যাপী এক অশ্রুতপূর্ব গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে বিগত ২৫ মার্চ থেকে একদিকে নিহত, লাঞ্ছিত ও লুণ্ঠিত মানবাত্মার আর্তনাদে বিমর্ষ বাংলা আর একদিকে আঘাতে প্রত্যাঘাত হেনে মাতৃভূমিকে শত্রু কবলমুক্ত করার দুর্জয় শপথে বলীয়ান বীর মুক্তিযােদ্ধাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার বেদিতটে মহান নেতার আদর্শে নবজন্ম লাভ করেছে বাঙালি জাতি । সারাদিন রণাঙ্গনে দেখে এলাম জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কিশাের, যুবক, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ নরনারী আজ অস্ত্র ধারণ করেছে হানাদার পশুদের মােকাবিলা করতে। এ যুদ্ধ আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার যুদ্ধ। জয় আমাদের হবেই। আপনারা মুক্তাঞ্চলের অধিবাসীরা জীবনের প্রতি পদক্ষেপে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করুন। মনে রাখবেন বাংলার প্রতিটি মানুষই আজ একজন মুক্তিযােদ্ধা।
মাতৃভূমি থেকে শেষ হানাদার শত্রুকে খতম অথবা বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এ যুদ্ধ আমাদের চালাতে হবে।’ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘বাংলার মানুষের নয়নমণি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে আমরা আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনবােই।’ বিক্ষুব্ধ গর্জনে সমগ্র এলাকাকে থরথর করে কাপিয়ে দিয়ে জনতা আওয়াজ তুলল, “জয় বঙ্গবন্ধু, জয় শেখ মুজিব। সভা শেষে আঞ্চলিক আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে ডেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থাকে জনগণের স্বার্থে গড়ে তােলার কাজে সহযােগিতা করতে। তারপর বুড়িমারি ক্যাম্পে ফিরলেন রাত প্রায় ১২টায়। পরদিন সকালে তেঁতুলিয়ার পথে রওনা হওয়ার কথা। কিন্তু ভােরবেলায় পাটগ্রাম থেকে খবর এলাে ওখানকার যুব সম্প্রদায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছে প্রধানমন্ত্রীর সফরকে অভিনন্দন জানাতে। তাই আবার রওনা হলেন পাটগ্রামে  পথের দু’ধারে মুক্তিযুদ্ধে দীক্ষিত হাজার হাজার নরনারী, চোখেমুখে তাদের প্রভাত সূর্যের আলােকরশ্মির স্বর্ণচ্ছটা, চিত্ত ওদের হর্ষোস্ফুল্ল আর কণ্ঠ ওদের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে সােচ্চার। একের পর এক পাটগ্রাম পােস্ট অফিস, থানা, বালিকা বিদ্যালয় ও আওয়ামী লীগ শাখা অফিস পরিদর্শন করে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান কক্ষে (পাটগ্রাম সদর দফতর) গেলেন। তারা গেয়ে উঠল জাতীয় সঙ্গীত তারপর পরিবেশন করল বাংলাদেশের গণহত্যা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর রচিত একটি নাটিকা। ওদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন মুক্তিযুদ্ধের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়ােজনীয়তার কথা।
এরপর গেলেন ভুরুঙ্গামারি ও ফুলবাড়ি রণক্ষেত্রে  পথে এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির সঙ্গে একটি জিপে চড়ে আসছিলেন চলচ্চিত্র ও স্টিল ক্যামেরাম্যান আসিফ ও আলম। হঠাৎ তাদের জিপটি রাস্তার ওপর থেকে স্কিড করে উল্টে গিয়ে খালের মধ্যে পড়ে গেল। গাড়ি থামিয়ে প্রধানমন্ত্রী ছুটে গেলেন খালের মধ্য থেকে ভেজা শরীরে বেরিয়ে এসে ফটোগ্রাফার আলম চিল্কার করে। বলে উঠলেন, “আমরা সবাই ভালাে আছি।  প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়ে আলম, আসিফ ও গাড়ির ড্রাইভারকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। দু-হাত তুলে খােদার দরবারে জানালেন অশেষ কৃতজ্ঞতা তাদেরকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আবার এগিয়ে চললেন। ভুরুঙ্গামারি অঞ্চলে পৌছলেন সন্ধ্যার কিছু আগে। শত সহস্র মুক্তিযােদ্ধা ও গ্রামবাসী প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানালাে। মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ডিফেন্স ক্যাম্প পরিদর্শনে বের হলেন। ডিফেন্স লাইন থেকে মাত্র দু-মাইল দূরে রণসজ্জায় হানাদাররা স্থানীয় নেতৃবর্গ ও সেনাপতিদের সকল অনুরােধ উপেক্ষা করেও বিপদ মাথায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে গেলেন। সামনে পড়ল একটি খরস্রোতা নদী। সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক প্রধান বললেন নদীর ওপারে আমাদের ডিফেন্স লাইন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘চলুন, আমি ওদেরকে দেখতে চাই।’ নদী পার হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিলাে। একটি মাত্র কলাগাছের তৈরি ভেলা ছাড়া সেই মুহূর্তে আর কিছুই ছিল না। প্রধানমন্ত্রী সােজা ভেলায় চড়ে বসলেন। অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন অন্যরা ভেলা ভেসে চলল। হঠাৎ মাঝ নদীতে গিয়ে স্রোতের কাছে পরাভূত হলাে ভেলার গতি কিছুতেই আর এগােনাে সম্ভব হচ্ছে না। ওপার থেকে দুজন বলিষ্ঠ মুক্তিসেনা তাদের হাতের স্টেনগান দুটি অন্য সাথীদের দিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন। স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তারা ভেলাটি টেনে ওপারে নিয়ে গেলেন। বাঙ্কারে বাঙ্কারে ঘুরে ঘুরে প্রতিটি সৈনিকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মিলিত হয়ে অনেক রাতে ফিরে এলেন প্রধানমন্ত্রী, কর্তব্য পালনের প্রশান্তি মুখে নিয়ে।
খাওয়াদাওয়া সেরে তার সঙ্গীরা ঘুমাতে গেলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থেকে স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মাধ্যক্ষ, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও গ্রামবাসীর সাথে অভাব, অভিযােগ ও প্রয়ােজনীয়তা নিয়ে আলাপ-আলােচনা করলেন। ২১ অক্টোবর ভােরে উঠেই সদলবলে তেঁতুলিয়ার পথে রওনা হলেন। সারাদিন পথ চলে তেঁতুলিয়ার মুক্তাঞ্চলে দিয়ে পৌছলেন বিকেল সাড়ে তিনটায় নেতার আগমনে আনন্দে উৎফুল্ল মুক্তিযােদ্ধারা চতুর্দিক থেকে ছুটে এসে যুদ্ধক্ষেত্রেই নেতাকে দিলাে সামরিক গার্ড অব অনার। ওদেরকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘ভায়েরা আমার, আগেরবার আমি যখন এসেছিলাম তখন আপনারা। অনেক পেছনে ছিলেন। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তেঁতুলিয়া, ভজনপুর ও কোটগাছিসহ প্রায় সাড়ে ছয় শত বর্গমাইল এলাকা মুক্ত করে দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতাে আপনাদের দাড়িয়ে থাকতে দেখে আনন্দে আমার বুক ভরে উঠেছে। আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর কোনাে শক্তিই আর আমাদের এই অগ্রযাত্রাকে রােধ করতে পারবে না। প্রতিটি শক্রসেনাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আমাদের বহু সাধের ধর্মনিরপেক্ষ ও শােষণহীন সমাজ আমরা গড়ে তুলতে পারবােই এই বিশ্বাস আমার আছে কঠিন আত্মবিশ্বাস নিয়ে আপনারা এগিয়ে চলুন জয় আমাদের হবেই। বক্তৃতা শেষে সৈনিকরা তাদের বাঙ্কারে ফিরে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন। একটি গ্রাম্য দুর্গম স্থানের মাঝখানে তাদের প্রধান বাঙ্কার। বর্ষার জলে বাঙ্কার ভরে গেছে। আর তার মধ্যে কোমার জলে দাড়িয়ে প্রহরারত বীর মুক্তিযােদ্ধারা। পরদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী একটি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিদর্শন করলেন। সেখানে প্রায় তিন সহস্রাধিক মুক্তিসেনা শিক্ষা গ্রহণ করছে। তাদেরকে শেখানাে হচ্ছে অটোমেটিক মেশিনগান ও রাইফেল চালনা, মর্টার শেলিং, গ্রেনেড চার্জ ও ডিনামাইট বিস্ফোরণের আধুনিকতম পদ্ধতি ও গেরিলা কার্যক্রম প্রায়।
দু-ঘণ্টাব্যাপী তাদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী দেখলেন কত ধৈর্য সহকারে ও মনােযােগ দিয়ে তারা শিখছেন। টার্গেট করে মেশিনগানের ৫টি করে গুলি চালালেন ২০ শিক্ষার্থী। প্রত্যেকেরই পাঁচটির মধ্যে চারটি গুলিই টার্গেটে আঘাত করল। তারা মাত্র এক সপ্তাহ আগে মেশিনগান হাতে নিয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রত্যেকেই তের থেকে উনিশ বছর বয়স্ক কিশাের অথবা যুবক । সবাইকে সমবেত করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী বললেন, “তােমরা আজ সকলেই দেশমাতৃকার আজাদী রক্ষার যে মহান সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছ তার জন্যে তােমরা আমার অভিনন্দন গ্রহণ করাে। সকল প্রকার রাজনৈতিক স্বার্থ বা আদর্শের উর্ধ্বে তােমরা আজ একেকজন দেশপ্রেমিক মুক্তিসেনা। আজ থেকে তােমাদের আদর্শ মাত্র। একটি, মহান নেতা শেখ মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর একটি শপথ, বিদেশি শক্র কবলমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার প্রশ্নে আত্মােৎসর্গ করা তােমরাই আমার দেশের ভবিষ্যৎ বিকেলে সদলবলে প্রধানমন্ত্রী গেলেন মুক্তিযুদ্ধে আহত সৈনিকদের একটি হাসপাতাল পরিদর্শনে সারা বিকেল ধরে এক এক করে প্রতিটি আহত সৈনিককে বুকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসজল চোখে প্রধানমন্ত্রী শােনালেন তাদের সান্ত্বনার বাণী তাদের ঘরবাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে লিয়াজো অফিসারকে বললেন যােগাযােগ করতে, নির্দেশ দিলেন তাদের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করতে। প্রধানমন্ত্রীর চোখ অশ্রুসিক্ত কিন্তু আহত মুক্তিসেনাদের চোখেমুখে বারুদের বিস্ফোরণের প্রতিজ্ঞা হাসপাতালের ডাক্তাররা অভিযােগ করলেন তারা চিকিৎসাগ্রহণে কালক্ষেপণ করতে চায় না, যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে যেতে চায় তারা। হাসপাতালের বিছানায় বসে অপলক চোখে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন এক সৈনিক  হানাদারদের একটি মর্টার শেল তার দুটি হাতকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বলাে তুমি কী চাও?’ ধীর শান্ত অথচ ইস্পাত কঠিন কণ্ঠে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘পারবেন আমি যা চাই তা আমাকে দিতে?’ প্রধানমন্ত্রী নির্বাক। সৈনিক বলেন, ‘স্যার, হৃদয়ের জ্বালা আমার থামেনি, আমি আবার যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চাই। প্লাস্টিক সার্জারি করে আমার হাত দুটিকে ভালাে করে দিন।’ তার কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী ও তার সঙ্গীরা স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। হাসপাতালের বিছানায় দুটি চেনামুখ দেখে প্রধানমন্ত্রী চমকে উঠলেন। ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তােমাদেরকে তাে আমি গত পরশুদিন বড়খাতা রণাঙ্গনে দেখে এলাম, কিন্তু আজ তােমরা এখানে এলে কেমন করে? তারা হাসিমাখা মুখে বললেন, এখানে কেমন করে এসেছি তা আমাদের মনে নেই। কিন্তু এ কথা স্পষ্ট মনে আছে যে সেদিন আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে যে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলাম তারই ভিত্তিতে সেদিন রাতে আমরা অগ্রসর হই। সারারাত যুদ্ধ করে হানাদারদের ২৪/২৫ জনকে খতম করে আমরা আরাে ৪/৫ বর্গমাইল এলাকা দখল করে ওদেরকে বিতাড়িত করেছিলাম । আমাদের একজন বীর সঙ্গী বুলেটবিদ্ধ। হয়ে মারা যায়। আর আমরা দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন আমাদের জ্ঞান ফেরে, তখন আমরা এই হাসপাতালে। তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ১৯৭১ সালে মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের পর থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। আওয়ামী লীগের একটি প্রভাবশালী অংশ তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবে না। তারা খােন্দকার মােশতাক আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করতে চায়। এএইচএম কামরুজ্জামানও প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী খােন্দকার মােশতাক আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর পদ তারই প্রাপ্য অন্যদিকে কামরুজ্জামান। ছিলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, অতএব তিনিই প্রধানমন্ত্রীর পদের একমাত্র দাবিদার। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর ভাগিনা বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেবেন।
এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন অবিচল ও অচঞ্চল। ১৯৭১-এর ৫-৬ জুলাই পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়িতে আওয়ামী লীগের দলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মিজানুর রহমান চৌধুরী এমএনএ তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগ দাবি করেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করায় বিরােধীরা পিছু হটে। সভায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটিই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে থাকবে। এই সিদ্ধান্তের পর কামারুজ্জামান। তার দাবি থেকে সরে দাঁড়ান এবং আন্তরিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। কিন্তু খােন্দকার মােশতাক ও শেখ ফজলুল হক মণি মনেপ্রাণে তাজউদ্দীনকে মেনে নেননি। শেখ মণির ক্ষমতার উৎস ছিল ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’। ‘র’-এর প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান ও তােফায়েল আহমেদ মুজিববাহিনী গঠন করেন। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি না নিয়ে মুজিববাহিনী সৃষ্টি হয়। মুজিববাহিনী বাংলাদেশ সরকার ও সেক্টর কমান্ডারদের নির্দেশ মানত না। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলাে জেনারেল  ওসমানী মন্ত্রিসভায় মুজিববাহিনী প্রশ্নটি তুললেন কিন্তু মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও মুজিববাহিনী সরকারের নিয়ন্ত্রণে এলাে না। প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত সরকারের কাছ থেকে কোনাে সহযােগিতা পাননি। এই সম্পর্কে এইচটি ইমাম লিখেছেন, “আমার উপস্থিতিতেই কর্নেল ওসমানী কয়েকবার অব্যাহতি চেয়েছেন মুজিববাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায়  অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অনেক বুঝিয়ে তাকে শান্ত করেন। আরেকটি ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী ।
সেটা অক্টোবর মাসে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পূর্ব রণাঙ্গন পরিদর্শনে গিয়ে আগরতলা সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন। শেখ মণি এবং তার কয়েকজন সহযােগী অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে থাকেন সকলেই বেশ অবাক হয়েছিলাম সেদিন। যৌথ কমান্ড গঠনের চিন্তা-ভাবনা শুরু হতেই এই বিশৃঙ্খলা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। সেটা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকেই। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মি, ডিপি ধরকে নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান নিয়ােগের পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থার মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাপারে সমন্বয় অনেক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্ভবত ‘র’ তখন থেকে মুজিববাহিনীর রাশ টেনে ধরে। এরপর কর্নেল ওসমানীর জন্য, বিশেষ করে মুক্তিবাহিনীর চেইন অব কমান্ড বজায় রাখতে বড় কোনাে অসুবিধা হয়েছে। বলে আমার জানা নেই।” মঈদুল হাসান মূলধারা ‘৭১ গ্রন্থে লিখেছেন, মে মাসে এমনিতেই প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগ মহলে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা শুরু হয়েছে। মন্ত্রিসভার অবশিষ্ট তিনজন সদস্য প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ নিয়ে স্ব স্ব দাবির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যায় কম বেশি তৎপর। মন্ত্রিসভার বাইরেও তাজউদ্দীনবিরােধী প্রচারণায় উৎসমুখ একাধিক  শেখ মুজিবের গ্রেপ্তার হওয়ার কারণ থেকে শুরু করে স্বীকৃতিদানে ভারত সরকারের বিলম্ব পর্যন্ত অনেক অঘটনের জন্য সরাসরি তাজউদ্দীনকে দায়ী করে এক প্রবল প্রচার-আন্দোলন চলতে থাকে আওয়ামী যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে।
অপরদিকে, ভারত-সােভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থীরা ভারতের দক্ষিণপন্থী ও আমেরিকার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তারা মুক্তিযুদ্ধে সর্বদলীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বাধার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিণত করলে রাশিয়া ব্লকের সমর্থন পাওয়া যেত চীন-আমেরিকা পাকিস্তানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সেই পাকিস্তানের সঙ্গে মােশতাক-কিসিঞ্জার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য সর্বদলীয় সমর্থন প্রয়ােজন ছিল এটা যেমন তাজউদ্দীন আহমদ উপলব্ধি করেন এবং সেই কারণে তিনি জাতীয় ঐকমত্য সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। এই ছিল তাজউদ্দীন আহমদের কূটনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তার বিরাট বিজয়। তিনি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন। সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হলে আওয়ামী লীগের ভেতরে তাজউদ্দীনবিরােধী গ্রুপ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। উপদলীয় কোন্দলের নেতা খােন্দকার মােশতাক আহমদকে তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষমতাহীন করে রাখেন। মােশতাক নামে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন্তু তাকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে কোনাে কাজ করার সুযােগ দেওয়া হয়নি। খােন্দকার মােশতাক আহমদ, মাহবুবুল আলম চাষী প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রথম থেকে ষড়যন্ত্র শুরু করে। প্রথমে মাহবুবুল আলম চাষী যুব শিবিরের দায়িত্ব পালন করতেন। অন্তর্কলহ নিরসনের লক্ষ্যে ইন্দিরা গান্ধী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড. ত্রিগুণা সেনকে পাঠান।
মাহবুবুল আলম চাষীর তিন মাসে তিন হাজার মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণের কর্মসূচির সঙ্গে সংস্থাপন সচিব নূরুল কাদের দ্বিমত পােষণ করেন। নুরুল কাদের খান বিষয়টি তাজউদ্দীন আহমদকে অবহিত করেন। প্রধানমন্ত্রী মাহবুবুল আলম চাষীকে সরিয়ে অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে যুব ক্যাম্প পরিচালনার জন্য চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন এবং সচিব হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন নূরুল কাদের। সংস্থাপন সচিবের অফিস ছিল রাষ্ট্রদূত হােসেন আলীর অফিসের একটি কক্ষে । প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গােপনে সচিব নূরুল কাদেরকে নিয়ে দিল্লি যান এবং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। আলােচনায় ইন্দিরা গান্ধীকে সহায়তা করেন ড. ত্রিগুণা সেন এবং তাজউদ্দীনকে সহায়তা করেন নূরুল কাদের। অপরদিকে, ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হত্যা, লুণ্ঠন ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার তথাকথিত অপরাধে আওয়ামী লীগের ৭৯ জন এমএনএ ও ১৭৯ এমপির সদস্যপদ বাতিল করে। তাদের অবর্তমানে সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচার করে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়। তাদের শূন্য আসনে জামায়াত, মুসলিম লীগ ও পিডিপির নেতাদের নির্বাচিত ঘােষণা করে। ঢাকা-৫ আসনে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের এমএনএ পদ বাতিল এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে শাস্তি প্রদান করে। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ, ১৩ জুন ১৯৭১ ১৯৭১ সালের ১৩ জুন জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দেন। বাংলাদেশ বেতার থেকে ভাষণটি প্রচারিত হয়। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এই ভাষণটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আমার প্রিয় দেশবাসী ভাইবােনেরা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একাদশ সপ্তাহ শেষ হয়েছে। এই সংগ্রামের মাধ্যমে। আমাদের বীর নরনারী অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতা লাভের দুর্জয় সঙ্কল্প প্রকাশ করেছেন। নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর বিশ্বাসঘাতকতামূলক আক্রমণ চালিয়ে দ্রুত জয়লাভের ভরসা করেছিল শক্ররা, কিন্তু বীর মুক্তিসংগ্রামীরা তাদের সে কল্পনাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। বিপুল সংখ্যক শত্রু সৈন্য হতাহত হওয়ায় আমাদের প্রতিরক্ষামূলক অভিযানের সাফল্য যেমনি প্রমাণিত হয়েছে তেমনি প্রমাণিত হয়েছে ইসলামাবাদের শাসকচক্রের মারাত্মক হিসেবের ভুল। তারা ভেবেছিল যে সর্বাত্মক ভীতি প্রদর্শন ও নির্বিচারে হত্যা করে বাংলাদেশকে পদানত রাখা যাবে স্বাধীনতা লাভে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জাতির সঙ্কল্প বিনাশের এসব পরিকল্পনা কাজে লাগেনি। দখলদারী শক্ররা এক নিদারুণ অবস্থায় পড়েছে। তাদেরকে লােক ও রসদ আনতে হয় বিমানপথে কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে। আমাদের মুক্তিফৌজ আবার প্রত্যহ আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর সরবরাহ ও যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুতর বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। সৈন্য ও অস্ত্রবলে শক্ররা কয়েকটি জেলা শহর ও ছাউনি এলাকা পুনর্দখল করেছে বটে কিন্তু এ ধরনের যুদ্ধে একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি নয় শত্রুর যা লাভ হয়েছে তা আবার ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জনসাধারণের ক্রমাগত অসহযােগিতার ফলে। হানাদারদের ভীতি প্রদর্শন ও প্রলােভন সত্ত্বেও কোথাও কোনাে বেসামরিক শাসন ব্যবস্থার লক্ষণ নেই। কল-কারখানার চাকাও ঘােরেনি। সর্বস্তরের মানুষের সামগ্রিক অসহযােগিতার ফলে হানাদারগণ যে চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে তার থেকে উদ্ধার পাওয়া বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া তাদের পক্ষে অসম্ভব।
কিন্তু তাদের সাহায্যের আবেদন কোনাে দেশে সাড়া জাগাতে পারেনি। তারা এখন বাজার থেকে উঠিয়ে নেবার নামে বিনিময় মূল্য না দিয়েই এক শ ও পাঁচ শ টাকার নােট জমা দিতে জনসাধারণকে বাধ্য করছেন। এতে তাদের অর্থনৈতিক দেউয়ালিয়াপনার স্বীকৃতি যে শুধু মিলছে তা নয়, সাধারণ মানুষকে লুট করে ইসলামাবাদের শূন্য তহবিল পূরণের জঘন্য কারসাজিও প্রকাশ পাচ্ছে। কায়িক ও নৈতিক শক্তির তুলনায় শত্রুপক্ষ নিজেকে খুব বেশি জড়িয়ে ফেলেছে। এটা নিঃসন্দেহে তার ধ্বংসের কারণ হবে। পশ্চিম থেকে পুবে এসে এই বিদেশি সৈন্য যা দখল করেছে তা তারা আয়ত্তে রাখতে পারবে না। সুপরিকল্পিত হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের নীতি গ্রহণ করে তারা নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছে মানুষের শক্র ও সভ্যতার শত্রু রূপে। তাদের আর জনসাধারণের মাঝে রয়েছে ঘৃণার সমুদ্রের ব্যবধান। এই কারণেই আমাদের গৃহীত গেরিলা পদ্ধতির আক্রমণে শত্রুপক্ষের এত ক্ষতি হচ্ছে। শত্রুরা যেখানে যাচ্ছে সেখানেই তারা মারাত্মক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছে। এর একটা কারণ এই যে, শত্রুর মনে ভয় ঢুকেছে তারা ভয় পেয়েছে কারণ তারা জানে যে তারা হারছে। ইসলামাবাদের ঔপনিবেশিক সৈন্যবাহিনীকে বীরত্বের সঙ্গে বাধা দেবার জন্য বাংলাদেশের জনসাধারণকে আমি অভিনন্দন জানাই। তাদের সাহস ও আত্মত্যাগ পৃথিবীর সকল দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে এবং তাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। শত্রুপক্ষের সৈন্যবাহিনী সংখ্যায় বিপুল এবং উন্নত ধরনের অস্ত্রশস্ত্রে আদ্যোপান্ত সজ্জিত। এ সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী তাদেরকে শাস্তি দিতে সক্ষম হয়েছে। সংগ্রামের নতুন স্তরে মুক্তিযােদ্ধারা আরও সুসংগঠিত হয়েছে এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রত্যহ বহুসংখ্যক তরুণ সামরিক শিক্ষা এগিয়ে আসছে। এরা একটা আদর্শের জন্য লড়াই করছে। নিজের দেশ শাসন করার অনস্বীকার্য অধিকার ও সম্মানের সঙ্গে নিজের বাসভূমে বেঁচে থাকার জন্য এরা লড়াই করছে, এরা লড়ছে। দেশের মাটির জন্য, লড়ছে নিরপরাধ জনসাধারণকে হত্যার প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য। লড়ছে মা, বােনদের বেইজ্জতির প্রতিকারের জন্য। আর পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধ করছে ঔপনিবেশিক সুবিধা রক্ষার জন্য। একদিকে লুণ্ঠনের পাশবিক রূপ, অন্যদিকে একটি জাতির স্বাধীনতা লাভের সর্বাত্মক আকাক্ষা  এই যুদ্ধে জয় যে আমাদের হবে তাতে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই। গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনায় সারা পৃথিবীর মর্মাহত মানুষের কাছে বাংলাদেশের জনসাধারণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মারাত্মক ষড়যন্ত্রের পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে ব্যাপক গণহত্যার মাধ্যমে একটি জাতিকে ধ্বংস করা। সুপরিকল্পিতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি, ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে ও পােড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে বিপুলসংখ্যক বাঙালিকে ভারতে ঠেলে দেওয়া ও দুনিয়ার কাছে তাদেরকে অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দেওয়া। বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। বর্তমান অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথরােধ করা। এসবের উদ্দেশ্য হলাে একটি, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক প্রভু ও পুঁজিপতিদের কাছে বাঙালিদেরকে সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাসে পরিণত করা। উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য যেসব পন্থা তারা গ্রহণ করেছে তাকে বর্বরতা বললে যথেষ্ট বলা হয় না। পাশবিক বললেও পশুদের প্রতি অন্যায় করা হয়। তবে এসব উদ্দেশ্য ও পন্থা থেকে আমাদের শত্রুর প্রকৃতি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বােঝা যায়। পৃথিবীর মানুষ বুঝুন অন্য কোনাে কারণে নয়, বর্বর একনায়কত্বের বিরুদ্ধে আমরা গণতন্ত্রের জন্য সগ্রাম করছি।
মানব জাতির একটি বিরাট অংশ এ দেশের এক ন্যায্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করেছে। আমরা সেই দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য সগ্রাম করছি। পাকিস্তান বলতে যা বােঝাত সেখানে সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র ও বড় ব্যবসায়ীদের একটি ক্ষুদ্র গােষ্ঠী যারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি, এতকাল দেশের সংখ্যাগুরু পূর্বাঞ্চলকে শাসন করে এসেছে এক ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ সর্বসম্মতভাবে যে রায় দিয়েছে তাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তারা তেইশ বছরের এই ঔপনিবেশিক দাসত্বের অবসান। ঘটানাের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সংখ্যালঘু শাসকচক্রের প্রতিনিধি ইয়াহিয়া ও ভুট্টো গত ডিসেম্বরে এই নির্বাচনী রায় মেনে নিতে কার্যত অস্বীকার করেন। আমাদের শাসনতান্ত্রিক দাবির জবাবে তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতারণামূলক আলােচনা চালাবার পরে সে আলােচনার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি বা ব্যর্থতা ঘােষণার আগেই পঁচিশে মার্চ রাতে বাংলাদেশের নিদ্রিত মানুষের ওপর ট্যাঙ্কের আক্রমণ চালালেন। এর পরবর্তী ঘটনা ইতিহাসের অন্তর্গত। এখন আমরা জানি চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ বােঝাই সৈন্য আমদানি করার জন্য যত দিন সময়ের প্রয়ােজন ছিল শুধু ততদিনই আলােচনা চলেছে। বাংলাদেশের চির নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণকে হত্যা করার অনেককাল পরে এই অত্যাচারের কৈফিয়ত হিসেবে বাঙালির হাতে অবাঙালি নিধনের উদ্ভাবন করা হয়। ইয়াহিয়ার ক্রমাগত অসংলগ্ন ও পরস্পরবিরােধী মিথ্যা ভাষণের একটি হলাে  শেখ মুজিব তাকে ঢাকায় গ্রেফতার করতে চেয়েছিলেন। অথচ ঢাকায় তিনি সর্বক্ষণ তার জেনারেলদের নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে বাস করছিলেন। পঁচিশ মার্চ রাতে সামরিক বাহিনীর কাপুরুষােচিত আক্রমণে ছাত্র, শিক্ষক, বস্তিবাসী, শ্রমিক, রিকশাওয়ালা এবং বাঙালি সৈন্য, পুলিশ, সীমান্ত রক্ষীদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হয়। এখন বলা হচ্ছে শেখ মুজিবের লােকেরা ছাব্বিশ মার্চ সকালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম দখল করার পরিকল্পনা করেছিল। সে পরিকল্পনায় বাধা দেবার জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
কিন্তু সমগ্র দেশবাসীর বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া যে সামরিক তৎপরতা চালিয়েছেন তাকে আগাম ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করা চলে না। এসব। মিথ্যা এতই অপটু যে তা দিয়ে পৃথিবীর কাছে প্রকৃত সত্য গােপন করা যায়নি, আর সে সত্য হচ্ছে এই যে, দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের আত্মশাসনের অধিকার অস্বীকার করাই হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের প্ররােচনাহীন সামরিক তৎপরতার কারণে বাংলাদেশে আজ অশুভ শক্তির যে তাণ্ডব চলছে তাতে বৃহৎ শক্তিবর্গের দায়িত্ব অনস্বীকার্য। পকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে এবং তার ব্যবহারের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তা তারা পাকিস্তানের একনায়কত্ববাদী শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং পুঁজিবাদী হামলাতান্ত্রিক সামরিক চক্রের অভ্যুত্থানের সহায়তা করেছেন। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অধিকার ক্ষুন্ন করে তারা এই চক্রের পত্তন ও ফ্যাসিবাদী। সামরিক শক্তির বিকাশ ঘটিয়েছেন। তাদেরকে আগে উপলব্ধি করতে হবে যে, ইয়াহিয়া খানের হাতে আজ যে রক্ত লেগেছে তার দাগ তাদের হাতকেও স্পর্শ করেছে। আমেরিকার জনসাধারণও আজ বুঝতে পেরেছেন যে, তাদের দেওয়া অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যের ফলেই বাংলাদেশে এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হতে পেরেছে।
বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের নামে আমার আবেদন, গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে তারা যেন রক্তপিপাসু সামরিক অধিনায়কত্ববাদকে আর শক্তিশালী না করে তােলেন তাদের কাছে আমার আবেদন, বাংলাদেশ থেকে দখলদার সামরিক বাহিনী তুলে না নেওয়া পর্যন্ত তারা যেন প্রত্যক্ষভাবে অথবা বিশ্বব্যাংক বিশ্ব অর্থ তহবিলের মাধ্যমে ইসলামাবাদ সরকারের বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক কাঠামাে সারিয়ে তােলার চেষ্টা না করেন। এ কথায় কারাে যেন সন্দেহ না থাকে। যে, ইসলামাবাদকে কোনােরকম সাহায্য দেওয়ার অর্থ পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা এবং সে শক্তি বাংলাদেশের মানুষকে দমন করার কাজেই শুধু ব্যবহৃত হবে। সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা চালিয়ে ও পােড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশকে জনশূন্য করার যে চক্রান্ত করেছে পাকিস্তান তার কয়েকটি দিক আছে বাঙালি অবাঙালি বিরােধ সৃষ্টি করে তারা যে উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিল এখন ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করে তারা। তাই সিদ্ধি করতে চাচ্ছে। কিন্তু দেশবাসী জানেন যে, আমাদের সংগ্রাম জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল মানুষের সংগ্রাম এবং আজ যারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেশের পরিবেশ কলুষিত করার চেষ্টা করছে তারা শত্রুর চর ছাড়া আর কিছু নয়। শক্রর এসব চরকে আমরা ক্ষমা করব না। সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় যেসব সমাজবিরােধী লুটতরাজ ও অত্যাচার-উৎপীড়ন চালাচ্ছে, তাদেরকে সমুচিত শাস্তি দেওয়া হবে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুকে ভারতের কাধে চাপিয়ে দিয়ে তার অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পাকিস্তান সক্ষম হয়েছে যে বিপুলসংখ্যক যুদ্ধপীড়িত নির্মূল নরনারী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে তাদের ভরণপােষণের জন্য ভারত যা করছে তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের বিবৃতিতে বাংলাদেশের গণহত্যা ও পাশবিকত্বের প্রচণ্ড পরােক্ষ স্বীকৃতি রয়েছে দুঃখের বিষয় এই বিলম্বিত আবেদন সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ অপ্রতুল, এর ওপর বর্ষাকাল আগত।
মহামারীতে অবর্ণনীয় দুর্দশা হচ্ছে মানুষের। ভারত একাই এই সমস্যার ভার বহন করছে। অবশ্য বিশ্ব বিবেক যে নাড়া খেয়েছে তার পরিচয় সম্প্রতি পাওয়া যাচ্ছে। অত্যাচারিত হয়ে। যারা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছে এবং দেশের অভ্যন্তরে যারা দুর্ভিক্ষে পীড়িত হচ্ছে তাদের জন্য আমরা সকল দেশের মানুষের কাছে সকল প্রকার সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি। তবে এই সাহায্য সামগ্রী যাতে হানাদার সরকারের। হাতে না পড়ে সে ব্যবস্থা তাদেরকে করতে হবে। নইলে এই সাহায্য সামগ্রী ব্যবহৃত হবে নিরপরাধ মানুষ হত্যার কাজে। আমি এ কথা সবাইকে জানাতে চাই যে, বাংলাদেশের শরণার্থীরা দেশে ফিরে আসতে উদগ্রীব। তাদের প্রত্যাবর্তনের সময় ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের তরুণেরা বিপুলসংখ্যায় মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিচ্ছে। তারা জানে যে, স্বজনের দেশে ফিরিয়ে আনার এটাই একমাত্র উপায়। বর্বর শক্তির জোরে যারা তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। তাদের মর্জির ওপর নির্ভর করে নয়। বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পঁচিশ মার্চ থেকে বাংলাদেশের যে সকল নাগরিককে তাদের ঘরবাড়ি, জমি-জমা ও বিষয় সম্পত্তি থেকে বেআইনিভাবে উত্থাত করা হয়েছে, মুক্ত স্বদেশে তার সবই তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের স্বীকৃতি দেবার জন্য আমরা পৃথিবীর সকল। রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানাচ্ছি জনসাধারণের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত এই সরকারই দেশের একমাত্র প্রতিনিধি। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন।
সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে আমাদের জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। আমাদের জনসাধারণ যে নির্যাতন ভােগ করছে, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি নেই। কিন্তু শুধু সে জন্য নয়, আমাদের প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্রের জন্যই আমরা স্বীকৃতি দাবি করছি। আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে যে সমস্ত সরকার এখনও কোনাে স্থির মনােভাব গ্রহণ করেননি, যারা মাত্র মুখে এর প্রতি সমর্থন দিয়েছেন এবং যারা এর বিরােধিতা করছেন তাদের সবাইকে আমি জানাতে চাই যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছাশক্তিতে সে স্থান তার স্থায়ী হবে। মানব জাতির বৃহৎ এই অংশকে স্বীকৃতি না দেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত? অথবা এসব রাষ্ট্রের স্বার্থে অনুকূল? বাংলাদেশের মুক্তি সগ্রামের জন্য পৃথিবীর সকল দেশের কাছে আবার আমি অস্ত্র সাহায্যের জন্য আবেদন জানাচ্ছি। যেসব মুসলিম ও আরব ভাইয়েরা এখনও বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা করে উঠতে পারেননি, তাদের কাছে আমার একটি বিশেষ নিবেদন আছে। ইয়াহিয়ার সৈন্যরা বাংলাদেশে ইসলামি ন্যায়নীতির জন্য যুদ্ধ করছে এরকম ধারণা তাদের পক্ষে এক দুর্ভাগ্যজনক ভ্রান্তি। জনসাধারণের ইচছা ও মানব অধিকারকে বর্বরােচিতভাবে দমন করে তিনি ইসলামের দোহাই দিচ্ছেন। যে সংহতি নিজে ভেঙেছেন শকুন দিয়ে মুসলমানদের লাশ খাইয়ে, এখন তিনি ইসলামের নামে সেই সংহতি বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে। আমাদের সগ্রাম সম্পর্কে নীরবতার অর্থ ঔপনিবেশিকতাবাদ ও বর্বরতার নিন্দা থেকে বিরত থাকা। আরবরা স্মরণ করে দেখুন, কীভাবে মুসলিম তুর্কীদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তারা মুক্তি সংগ্রাম করেছিলেন। পশ্চিম-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই তারই অনুরূপ যে পর্যন্ত না শত্রু শেষ হয় বা তারা দেশের মাটি থেকে সরে যায় ততদিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে। বাংলাদেশের মানুষ বদ্ধপরিকর। ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন। আমেরিকার দেশসমূহের সগ্রামকে আমরা যেভাবে সমর্থন করেছি আমাদের সংগ্রামকেও সেভাবে সমর্থন করার জন্য আমরা তাদের কাছে আবেদন জানাই। বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে আমাদের আবেদন দূরদৃষ্টির হিসাব ফেলে ন্যায় ও গণতন্ত্রের পক্ষ সমর্থন করুন।

দশ লক্ষ লােকের হত্যা ও পঞ্চাশ লক্ষ লােকের বিতাড়ন কোনাে সরকারের ঘরােয়া আমােদ বলে বিবেচিত হতে পারে না। আপনাদের দেওয়া সাহায্য যেন আর বাংলাদেশের শান্তিকামী স্বাধীনতাপ্রিয় ও গণতন্ত্রী মানুষের প্রতি কৃত অন্যায়কে আরও বাড়িয়ে না তােলে  বরং ইসলামাবাদের উন্মাদ শাসক চক্রের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার চেষ্টায় আপনাদের। প্রভাব প্রয়ােগ করুন। বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা বিধান ও মুক্তি সাধনের ব্যবস্থা অবলম্বন করুন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই সংগ্রাম দেশের পুষ্পপত্রের মতাে মাটি থেকে উদ্ভূত। যে অসহনীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করছিল সেই সম্পর্কের অবসান ঘটাবার জন্য জনসাধারণের ইচ্ছা থেকেই এর উৎপত্তি। একে। ভারতের প্ররােচনা বলে পাকিস্তান যে প্রচারণা চালাচ্ছে তা তার সুপরিচিত। কৌশল। বাংলাদেশের সকল দাবি সম্পর্কেই এরকম প্রচারণা হয়েছে, এতে আর কেউ কান দিচ্ছে না। এটা বলা দরকার যে, জাতিগত প্রয়ােজনের ভিত্তিতে আমাদের আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কোনাে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত গােষ্ঠীর। বিরুদ্ধেও এই আন্দোলন নয়। বাংলাদেশের যেসব নাগরিকের ভাষা বাংলা নয়, তাদের কাছে আশা করবাে যে, তারা যেন শত্রুর সঙ্গে হাত না মেলান অথবা নিজেদেরকে যেন হানাদার শাসক গােষ্ঠীর সগােত্র বিবেচনা না করেন। আমরা জানি অনেক পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যকে বিশেষ করে সিন্ধি, বালুচি ও পাঠান সৈন্যকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক লজ্জাজনক ও নিষ্ঠুর কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমি তাদের কাছে আবেদন জানাই তারা যেন এরকম অমানবিক কাজ করতে অস্বীকার করে সৈনিকের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখেন এবং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমাদের পাশে এসে দাড়ান।

আমাদের মুক্তিফৌজ এখন শক্রর মৃত্যুর ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে বাংলাদেশের জলায়, জঙ্গলে, নদীতে, পথে প্রান্তরে। রক্ত দিয়ে তারা আমাদের জাতিগত পরিচয়ের চিহ্ন অঙ্কন করছে। যে নতুন রাষ্ট্রে আমাদের ভবিষ্যৎ নিহিত তার জন্য সংগ্রাম করছে তারা তাদের সাহস, আত্মােৎসর্গ ও কষ্ট স্বীকারের ক্ষমতা সকল মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আদর্শস্বরূপ হয়ে রইবে। তাদের সাফল্য আসলে তাদের। আত্মিক বলের জয় । এত কম উপকরণ নিয়ে এত নিষ্ঠুর শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে আর সংগ্রাম হয়নি। আমি তাদেরকে জানাতে চাই যে, সারা জাতির চিত্তে তারা বিরাজ করছে এবং প্রতিটি মানুষ তাদের সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করছে। বীর দেশবাসী, এই সংগ্রামে আপনারা দুঃখ বরণ করেছেন, গৌরবও অনুভব করেছেন। এই দ্বৈত ধারায় আপনাদের বল বেড়েছে, শক্রর শক্তি কমেছে। তার নৈতিক ও আর্থিক শক্তি বিনষ্ট  তার উপস্থিতি বিকৃত  আমাদের কষ্টের কাল সংক্ষেপ করার জন্য একযােগে সকল ক্ষেত্রে শত্রুকে আক্রমণ করতে হবে রপ্তানি দ্রব্য, পণ্য যেন শত্রুর হাতে না পড়ে আপনাদেরকে তা দেখতে হবে। যেসব বিশ্বাসঘাতক শক্রর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে। যে মুক্তিফৌজ দেশের বাতাসকে কলুষমুক্ত করছে তর সঙ্গে একাত্মতা রক্ষা করতে হবে। আমার আপনার এ সংগ্রামে সংগ্রামী সাথীদেরকে সাহায্য করুন সাম্প্রদায়িক ও দলীয় সম্প্রীতির বিনাশে শক্রর কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্ক হােন এবং নিজেদের ন্যায্য লক্ষ্য ও অবশ্যম্ভাবী বিজয় সম্পর্কে আস্থা রাখুন। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় বাংলা।
জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ, ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিম্নোক্ত ভাষণটি ‘৭১-এর ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় । প্রিয় দেশবাসী ও সংগ্রামী সাথীবর্গ, আপনাদের উদ্দেশ্যে গতবার আমার বক্তব্য পেশ করার পরে পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটে গেছে। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হলাে এই যে, সামরিক শাসকচক্রের পশ্চিম পাকিস্তানি ক্ষমতা ভিত্তিতে ভাঙন ধরেছে এবং বাংলাদেশ তাদের মুষ্টিমেয় নিরাপদ এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে এসেছে। তাদের অর্থনীতিকে বানচাল করার জন্য আমাদের দৃঢ়নীতি, জলে-স্থলে আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের উজ্জ্বল সাফল্য এবং আমাদের প্রতিরােধের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও গভীরতা—শত্রুর সম্পূর্ণ পরাজয়ের দিনটিকে নিশ্চিতরূপে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। এ সত্ত্বেও ধৈর্য ও সাহসের প্রয়ােজনীয়তার ওপরে আমি জোর দিতে চাই। শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এবং এই নিষ্ঠুর যুদ্ধের অবসানে দেশের পুনর্গঠনের জন্য এই গুণ দুটি অর্জন করা আজ আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে সম্প্রতি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। এই ভারসাম্যের উপর ভরসা করে শত্রুপক্ষ যা লাভ করতে চেয়েছিল, তাতে তারা সফল হতে পারেনি। এর নবমত প্রমাণ ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি। বর্তমান। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি যে বিস্ময়কর পরিচয়ে আমরা লাভ করেছি, নিঃসন্দেহে আমরা তারই উপর নির্ভর করি। তবে যেসব মহলে আগে শুধু সতর্কতার মনােভাব দেখা দিয়েছিল, সেখান থেকে যখন সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তখন আমাদের সন্তোষের কারণ ঘটে বৈকি  কোনাে কোনো দেশের সরকার এখন অবশ্য নীতিবিবর্জিত ভূমিকা পালন করছে, যদিও সেসব দেশের জনসাধারণ আমাদের প্রতি দ্বিধাহীন সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। আমরা শুধু আশা করব যে, এই সব দেশের জনসাধারণ ও তাদের প্রতিনিধিদের আচরণের এই অসঙ্গতি শিগগিরই দূর হবে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য যে বাংলাদেশের জনগণের ধ্বংসসাধন, সে বিষয়ে আর কোনাে সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং তারা যে জনগণকে ত্রাণসামগ্রী ঠিকমতাে পৌঁছে দেবে, সে কথা বিশ্বাস করার মতাে লােক পৃথিবীতে বেশি নেই। তবু বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যে সাহায্য দিয়েছেন, পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমে তা দখলীকৃত এলাকায় বিলি করার ব্যবস্থা সঙ্গত বিবেচনা করেছেন জাতিসংঘ।
বিগত ঘূর্ণিঝড়ের পরে রিলিফের জন্য যেসব হেলিকপ্টার, জলযান ও অন্যান্য যানবাহন এসেছিল, পাকিস্তান সরকার। নির্বিকারচিত্তে সেসব ব্যবহার করেছে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধেই। দুর্গত মানুষের জন্য নির্দিষ্ট বহু সামগ্রী দখলদার সৈন্যদের প্রয়ােজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতিসংঘের সেবাদলে একদল যােগাযােগ বিশেষজ্ঞ এসেছেন উন্নত ধরনের। যন্ত্রপাতি নিয়ে, এতে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী রণকৌশলে যে সাহায্য হবে, তাতে সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় ত্রাণকার্যের মানবতাবাদী উদ্দেশ্য বিপর্যস্ত হবার ঘােরতর আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল যদি পৃথিবীর এই অংশে বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে চান তাহলে তাকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ত্রাণকার্যের নামে নিষ্ঠুর প্রহসন অনুষ্ঠিত না হয়। ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের প্রকাশ্য বর্বরতার পরিচয় আমরা পেয়েছি। মাঝে মাঝে আপসের কতগুলাে প্রস্তাবের মাধ্যমে তার গােপন ছলনার। পরিচয়ও আমরা পাচ্ছি। এইসব প্রস্তাব চালু করার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে বিভ্রান্ত। করা ও এবং আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের আপসহীন সঙ্কল্পকে দুর্বল করে দেওয়া। শত্রুপক্ষ আপস চাইতে পারে দুটি কারণে—হয় সে দুর্বল, না হয় সে। আমাদের জন্য ফাদ পেতেছে, যে ফাদ সম্পর্কে আমাদের হুশিয়ার থাকতে হবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আসন্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক জান্তার কৌশল হলাে বাংলাদেশের বেসামরিক শাসন প্রবর্তনের ভান করা। ঘৃণ্য টিক্কা খানের আসনে বেসামরিক ক্রীড়নক বসানাে এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কয়েকজন ধিকৃত বাঙালিকে জাতিসংঘে প্রতিনিধিরূপে পাঠানাে—এসবই তার ছদ্ম-আবরণ। সে মিথ্যা আশা করে যে, এতে অব্যাহত সামরিক শাসন এবং বাংলাদেশের গণহত্যা ও জনমত দলনের নিষ্ঠুর সত্যকে ঢাকা দেওয়া যাবে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের কিছুসংখ্যক প্রতিনিধির আসন বাতিল করে আর কিছুসংখ্যকের আসন বজায় রেখে ইয়াহিয়া কাকে ধোকা দিতে চাইছেন? তিনি এমনতর ভান করছেন যে, যাদের আসন বাতিল হয়নি, তারা বুঝি তার চক্রান্তের সমর্থক। জনসাধারণের সুস্পষ্ট অভিপ্রায়ই জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধির ক্ষমতার উৎস।
তারা কোনাে ক্ষমতা দখলকারীর আজ্ঞাবাহী নন এবং তার উদ্ভাবিত ফন্দি-ফিকিরে তাদের কোনাে সম্পর্ক নেই। গত জুলাই মাসের সম্মেলনে এমএনএ ও এমপি এরা বাংলাদেশের পুর্ণ স্বাধীনতার জন্য অবিরাম সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা পুনরায় ঘােষণা করেন। জনপ্রতিনিধিদেরকে বিচার করার হাস্যকর প্রচেষ্টা কিংবা তাদের বিষয়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রয়াস তাদের প্রতিজ্ঞা টলাতে পারবে না। বাংলাদেশের গণহত্যায় যে বিশ্ববাসী শিউরে উঠেছে, তারাই এখন লক্ষ্য করছে যে, জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করে সামরিক আদালতে গােপন বিচারের আয়ােজন হয়েছে এবং তার পক্ষ সমর্থনের জন্য খলনায়ক ইয়াহিয়া সন্দেহজনকভাবে আইনজ্ঞ চাপিয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীর মানুষ তাই আবার ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানি শাসক চক্রের মিথ্যা ভাষণে এবং তাদের কলঙ্ক মােচনের কলাকৌশলে কেউ প্রতারিত হবে না। বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রসঙ্গে আমি পৃথিবীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালােবাসা মেখে তাদের সুখের স্বপ্ন যিনি দেখেছিলেন দস্যুদের কবলে পড়ায় তিনি আজ বন্দি জীবন যাপন করছেন। তার বিচারের প্রহসনের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশের সরকার ও জনগণ এবং আইন বিশেষজ্ঞসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সক্রিয় করে তােলার সর্বপ্রকার চেষ্টাই করেছে বাংলাদেশের সরকার ও জনসাধারণ। কিন্তু বর্বর চক্রের অন্ধ ঔদ্ধত্যের উপর এর তেমন। প্রতিক্রিয়া ঘটেনি। তবে দেশবাসীকে আমি প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে, বিচারের নামে যারা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করছে, পরিণামে শাস্তি পেতে হবে তাদেরকেই। আর ইসলামাবাদের ওপর যেসব সরকারের কিছুমাত্র প্রভাব আছে, শেখ সাহেবের মুক্তি সাধনের জন্য তাদের কাছে আমি আবার আবেদন জানাই।
পাকিস্তান সরকারের কর্মরত কূটনীতিবিদেরা সম্প্রতি দলে দলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করছেন। এতে আমাদের শক্তির প্রমাণ ঘটেছে এবং অন্যান্য দেশের সরকারে পক্ষে আমাদেরকে স্বীকৃতি দানের আরেকটি কারণ যুক্ত হয়েছে। আসলে স্বীকৃতি লাভ হলাে মুক্তিযুদ্ধের দ্রুত ও সফল পরিসমাপ্তির স্বরূপ সােপান। বর্বর শক্তির দ্বারা যারা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ আজ অস্ত্র ধারণ করেছে। আমাদের। জনসাধারণ যেভাবে অত্যাচারিত হয়েছে, বােধহয় আর কোনাে জাতির ভাগ্যে এমন ঘটেনি। সুতরাং যারা গণতন্ত্রের অনুসারী এবং আমাদের প্রতি মানবিক সহানুভূতিসম্পন্ন, তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক প্রত্যাশা করি।  পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক চক্রের নিষ্পেষণের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি আমাদের জীবনে আবার এক নিষ্ঠুর আঘাত এনেছে। তা হলাে সাম্প্রতিক বন্যার তাণ্ডবলীলা। বাৎসরিক দুঃখের বন্যায় বাংলাদেশের বহু অঞ্চল আজ প্লাবিত। এই প্লাবন পশ্চিম পাকিস্তানের মানবতাবিরােধী শােষণনীতির প্রতি এক সুস্পষ্ট অভিযােগ। কেননা, এই শাসক গােষ্ঠীই বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণর ব্যবস্থা করেনি। এ কথা আজ পরিষ্কার যে, বাঙালিরা নিজেদের নিয়তির ভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের সমস্যা সমাধান হবে না। বাঙালির দুঃখের ব্যাপকতা ও গভীরতা আজ মানবীয় পরিমাপ শক্তি বাইরে। তবু আমি বাংলার অজেয় প্রাণশক্তিতে বিশ্বাসী। তাই আমার দৃঢ় প্রত্যয় ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও যুদ্ধের সর্বনাশের উপরে বাংলার এই প্রাণশক্তির জয় অবশ্যম্ভাবী।
পরিশেষে, যাদের সাহস আত্মোৎসর্গ ও সাফল্য সারা জাতিকে গেীরবে পূর্ণ করেছে এবং মহান ভবিষ্যতের আশায় উজ্জীবিত করেছে, সেই মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য কামনা করি সকল শক্তি। বর্তমান সগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনসাধারণ। নিজেদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করেছে। এই ঐক্যই যেন আমাদের শক্তির চিরকালীন উৎস হয়।
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বাণী
৭১-এর ১৮ নভেম্বর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশবাসীর প্রতি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই বাণীটি দেন। এটি বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হয়—
“আমাদের দেশে এবার ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলকৃত এলাকায় শত্রু সৈন্যের তাণ্ডব চলছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন। মুক্ত এলাকায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম করছে। এবার ঈদের আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে। আছে শুধু স্বজন হারানাের শােক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সঙ্কল্প। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও আমার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধা ও জনসাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের যে আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি তা আমাদের জীবনে পুনপ্রতিষ্ঠিত হবে সেদিনই, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করবাে। আমি আপনাদেরকে আশ্বাস। দিচ্ছি যে, যথাসর্বস্ব পণ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা আজ লিপ্ত, তার চূড়ান্ত সাফল্যের দিনটি নিকটতর হয়ে এসেছে। সেই মুহূর্তটিকে এগিয়ে আনার সংগ্রামে আমরা সকলে যেন নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়ােগ করতে পারি, এই ঈদে তাই হােক আমাদের প্রার্থনা।”
জয় আমাদের কব্জায়
‘৭১-এর ২৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের এই ভাষণটি বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হয় দেশবাসী সংগ্রামী ভাইবােনেরা, গত সেপ্টেম্বর মাসে আপনাদের কাছে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের পর্যালােচনা করেছিলাম। তারপর আড়াই মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে আমাদের সাফল্য এসেছে নানা দিক থেকে। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহীন আক্রমণ যে সর্বক্ষেত্রে তীব্রতর হয়েছে, সে কথা শক্ৰমিত্র নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করেছেন। মুক্তিবাহিনী এখন যে কোনাে সময়ে যে কোনাে জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে, এমনকি শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে জলে-স্থলে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে মুক্তিবাহিনীর। নদীপথে হানাদাররা বিপর্যস্ত, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় অকেজো, বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল শক্রমুক্ত। ক্রমেই অধিকতর এলাকায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর প্রশাসন চালু হচ্ছে। আর সৈন্য, সামগ্রী ও মনােবল হারিয়ে শত্রুপক্ষ হতাশায় ততই উন্মাদ হয়ে উঠেছে একদিকে রণক্ষেত্রে শত্রুর বিপর্যয় ঘটছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ইসলামাবাদের দুষ্কৃতকারীরা আজ দিশেহারা ও কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংশয় ও ভীতির উদ্রেক হয়েছে তাদের মনে। বাংলাদেশের জনগণের অপরিমেয় দুর্দশা ঘটাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা পশ্চিম পাকিস্তানকেও টেনে নিয়ে গেছে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করতে। তারা আশা করে যে, এমন একটি যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যত্র নিবদ্ধ হবে, মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের গ্লানি গােপন করা যাবে।
এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যাতে তাদের পৃষ্ঠপােষকরা হস্তক্ষেপ করার সুযােগ পাবে। কিন্তু আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে না বরং এতে তাদের ভ্রান্তি, অপরাধ ও আত্মঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। এবং পরিণামে তাদের আত্মবিকাশ সুনিশ্চিত হবে। সামরিক শাসকচক্র আত্মহত্যার যে ব্যবস্থাই করে থাকুক না কেন আর এই উপমহাদেশের জন্য যে ব্যবস্থাই বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রের মনঃপূত হােক না কেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা একটিই, আর তা হলাে পূর্ণ স্বাধীনতা। ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রতিদিনই প্রমাণিত হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সংকল্প আর সে স্বাধীনতা রক্ষার শক্তি দখলদার সৈন্যবাহিনীর বিনাশ অথবা সম্পূর্ণ অপসারণের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। ইতিহাস মানুষকে অন্তত এই শিক্ষা দিয়েছে যে, জনসাধারণের ইচ্ছাশক্তির পরাজয় নেই, এমনকি, এক বিশ্ব শক্তির সমর সম্ভার দিয়ে জনগণের মুক্তিসংগ্রাম দমন করা যায় না।  এশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে কোনাে কোনাে পাশ্চাত্য দেশের নিরাসক্তি লক্ষ করার মতাে মনে হয় মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদার চাইতে এখানে তারা সরকারের স্থিতিশীলতার গুরুত্ব দেন বেশি। এটা শােচনীয়, কিন্তু ভারতকে অর্থ সাহায্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদেরকে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রস্তাব যখন কোনাে রাষ্ট্র উত্থাপন করেন তখন আমরা শিউরে না উঠে। পারি না। এই প্রস্তাবে গণহত্যা ও তার ফলাফলকে নীরবে মেনে নেওয়া হয়েছে, পর্বতসমান অবিচার ও অন্যায়কে বিনা বাক্যে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে গণহত্যা ও ব্যাপক বাস্তুত্যাগের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে।
পাকিস্তানি সন্ত্রাসের ফলে যারা ছিন্নমূল হয়েছেন, তারা অস্থাবর সম্পত্তি নন যে, অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে হাতবদল করা হবে। সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ বাসভূমে ফেরার জন্মগত অধিকার তাদের আছে এবং তারা সেখানে সেভাবেই ফিরে আসবেন। আর আমি বলছি যে, তার খুব বেশি দেরি নেই। ঠিক এই সময়ে এই উপমহাদেশের তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল। পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কী উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? তার দেশের কূটনীতিবিদ। ও আইন সভার সদস্যরা অবগত নন এমন কী নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছক? দশ লক্ষ বাঙালিকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানুষকে বাস্তুত্যাগে বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা করেননি। এখন তথ্য সংগ্রাহক পাঠিয়ে কী ফল তারা লাভ করতে চান জানি না। তবে এতে আমাদের সঙ্কল্পের কোনাে ব্যত্যয় হবে না। সে সঙ্কল্প হলাে দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।  অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়েছি, সে স্বাধীনতা লাভের দিনটি নিকটতর হয়েছে। কিন্তু তার জন্য আরও আত্মত্যাগ, কষ্ট স্বীকার ও জীবন দানের প্রয়ােজন হবে। স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থগত স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এর জন্য আমরা কী মূল্য দিই এবং শান্তির সময়ে। এর কী ব্যবহার করি, তার উপরে। শক্ৰসংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাই শহীদের রক্তের উপযুক্ত সমাজ গঠনের প্রতিজ্ঞাও আমাদেরকে নতুন করে নিতে হবে।
বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশি দখলদারদের বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং অসাম্য ও সুবিধাভােগের অবসান ঘটানাের সংগ্রাম। আমাদের আজকের সংগ্রাম সে দিনই সার্থক হবে, যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। তখন বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করবেন সেখানে সকল সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ। করবেন। বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও পাকিস্তানের সামরিক চক্রের হাতে বন্দি হয়ে রয়েছেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের। নিমণের সকল পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। তা করবার শক্তি আমাদের আছে এবং আমরা তাই করতে যাচ্ছি। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে আমরা চরম আঘাত হানবাে আর। তখনই জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্রুর সত্যের মুখােমুখি হবেন।
বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমার আহ্বান, মুক্তি সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়কে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে চলুন। যেসব সরকারি কর্মচারী, রাজাকার, পুলিশ বা অন্যান্য ব্যক্তি বিবেকের নির্দেশের বিরুদ্ধে হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তারা সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযােগ গ্রহণ করুন। শত্রুপক্ষের সঙ্গে যারা স্বেচ্ছায় হাত মিলিয়েছেন, তাদেরকে আমি শেষবারের মতাে বলতে চাই : বিশ্বাসঘাতকতার পথ পরিহার করুন। অনুতাপহীন বিশ্বাসঘাতকদের আর তাদের বিদেশি প্রভুদের পরিণতি একই হবে—আর তা হলাে গ্লানিকর মৃত্যু। হাজার হাজার মুক্তিসেনা আজ শত্রুকে ঘিরে রেখেছে, তার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। সকলে প্রস্তুত থাকুন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে চরম মুহূর্তে যেন। সর্বশক্তি দিয়ে শক্রকে একযােগে চরম আঘাত করতে পারেন। বাংলাদেশের মুক্তি সগ্রামকে যারা সাফল্যের বর্তমান স্তরে নিয়ে এসেছেন, সেই। বীর শহীদ, অকুতােভয় যােদ্ধা ও সংগ্রামী জনগণকে আমি সালাম জানাই।
জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
ঢাকায় পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করার পরদিন অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বেতারে এই ভাষণ প্রদান করেন দেশবাসী সংগ্রামী ভাই বােনেরা, বাংলাদেশে দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রাম আজ সাফল্যের তােরণে উপনীত হয়েছে । গতকাল বিকেল পাঁচটা এক মিনিটে সম্মিলিত ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর নিযুক্ত খ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক হিসেবে এবং নিজের ক্ষমতাবলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী তার অধীনস্থ পাকিস্তানি স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী, আধা সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীসহ বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছেন। পঁচিশ মার্চ বাংলাদেশের জনসাধারণের যে দুঃস্বপ্নের রাত শুরু হয়েছিল, এতদিনে তার অবসান হলাে। বাংলাদেশে আমাদের নিজেদের কর্তৃত্ব পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হলাে  এত অল্প সময়ে বােধহয় আর কোনাে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হয়নি, স্বাধীনতার জন্য এত মূল্য বােধহয় আর কেনাে জাতি দেয়নি। আজকের বিজয় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বিজয়, সত্য, ন্যায় ও গণতন্ত্রের বিজয়।
আমরা যারা আজ স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছি, আসুন, শ্রদ্ধাবনত হৃদয়ে, কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি সেই বীর মুক্তিযােদ্ধাদের যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন সকলের মঙ্গলের জন্য। পাকিস্তানের সামরিক চক্র চেয়েছিল বর্বর শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে দমন করে রাখতে হানাদারেরা দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, পঙ্গু করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, আমাদের জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে এই দুঃসময়ে আমাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ভারত। আর তাই পাকিস্তানি সমরনায়কদের আক্রোশ গিয়ে পড়ে ভারতের উপর। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তারা রূপান্তরিত করে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিহত করেছেন। আর পূর্ণ রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিতভাবে সংগ্রাম করে তারা মাত্র বারােদিনের যুদ্ধে দখলদার সেনাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিপর্যয় এত দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হতে পারলাে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধ্যক্ষ জেনারেল মানেক শ’র নেতৃত্ব এবং সম্মিলিত বাহিনীর অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার নিপুণ রণকৌশলে। এই দুই সেনাপতির কাছে এবং ভারতের স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর কাছে আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আমাদের সাফল্যের এই মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে। তিনি যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও নেতাদের কাছে আমাদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং যেভাবে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, ইতিহাসে তার নজির নেই। আমাদের সংগ্রামের ফলে ভারতের। জনসাধারণকে যে বিপুল ভার বহন করতে হয়েছে, সে বিষয়েও আমরা সচেতন তাদের এই কষ্ট স্বীকার সার্থক হয়েছে। শরণার্থীরা এখন মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যেকে নিজের ঘরে ফিরে আসবেন।
আমাদের সংগ্রামের প্রতি দৃঢ়তাপূর্ণ সমর্থন দানের জন্য বাংলাদেশের মানুষ সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। পােল্যান্ড এবং অন্য যেসব দেশ আমাদের ন্যায় সগ্রামকে সমর্থন করেছে, তাদের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা এ কথাও ভুলিনি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগণ, সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের সাংবাদিকরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য আমাদের সংগ্রামকে যথার্থরূপে তুলে ধরে এই সংগ্রাম সফল করতে সাহায্য করেছেন। দেশবাসী ভাই বােনেরা, বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখনাে শত্রুর কারাগারে পাকিস্তানি শাসকদেরকে আমি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা শেষ মুহূর্তে অন্তত শুভবুদ্ধির পরিচয় দিন, বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করুন। এই দাবি মেনে নেওয়ার সুফল সম্পর্কে পাকিস্তানকে অবহিত করাও তার বন্ধুদের কর্তব্য বলে আমি মনে করি। বন্ধুগণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এলাে এক রক্তাপুত ভূমিতে এবং ধ্বংসস্তুপের মধ্যে জনগণের আশা ও আকাক্ষা অনুযায়ী এই দেশকে নতুন করে গড়ে তােলার দায়িত্ব এখন আমাদের সামনে দেশের দ্রুত পুনর্গঠনের কাজে আমরা ভারতের সহযােগিতা ও সাহায্য কামনা করব। শুধু পুনর্নিমাণ নয়—নতুন সমাজ গঠনের দায়িত্ব আমরা নিয়েছি সংগ্রামের কালে সমগ্র জাতির যে ঐক্য ও আত্মত্যাগের। পরিচয় আমরা দিয়েছি, সেই ঐক্য ত্যাগের মনােভাব অটুট রাখতে হবে। তবেই নতুন গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি দৃঢ় হবে। সেই নতুন আলাের পথে আজ আমরা যাত্রা করলাম।
জয়বাংলা।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ – স্বকৃত নোমান – উৎস প্রকাশন, ৩ নভেস্বর ২০১৫