নির্বাচনে জয় এবং মন্ত্রিত্ব গ্রহণ
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের প্রতীক ছিল যথারীতি নৌকা। ৩ শ আসনের মধ্যে আওয়াম লীগ ২৯৫টি আসনে জয় লাভ করে। তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকার কাপাসিয়া (১৯০ ঢাকা-২০) আসন থেকে বিপুল ভােটে নির্বাচিত হন। তিনি মােট ভােট পেয়েছিলেন ৬২৭৬২টি, তার প্রতিদ্বন্দ্বী জাসদের সুলতান উদ্দিন আহমদ পেয়েছিলেন ৩৮৬৪টি। নির্বাচনের আগে তাজউদ্দীনের আপন মামা, আওয়ামী লীগ নেতা ও সমাজকর্মী হেকিম মােল্লা নিহত হন দুষ্কৃতকারীদের হাতে নির্বাচনের সময় তাজউদ্দীন কাপাসিয়া ডাকবাংলােতে এক রাত যাপন করেন। তখন স্থানীয় এসপি তাকে জিজ্ঞেস করেন, তার কি কাউকে সন্দেহ হয়? জবাবে তাজউদ্দীন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “আমার মামাকেই শুধু নয়, আরও অনেককেই জীবন উৎসর্গ করতে হতে পারে। এ নির্বাচনে তাজউদ্দীনের মােট খরচ হয়েছিল ২৫০৯ টাকা। নির্বাচনের এক মাসের মধ্যে নির্বাচনী ব্যয় নির্বাচন কমিশনে দাখিল করেন তিনি। ‘৭৩ সালের ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ অর্থ ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন। ১৬ এপ্রিল আফ্রো-এশিয়া গণসংহতি পরিষদের সভাপতি অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভিয়েতনাম প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভিয়েতনাম থেকে এখনও সরে যাওয়ার সময় আছে, তারা যদি তা করে তাহলে তাদের পতন অনিবার্য। ২৭ এপ্রিল শেরেবাংলার দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে টিএসসিতে ফজলুল হক ছাত্র সংসদ কর্তৃক আয়ােজিত আলােচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তাজউদ্দীন। বক্তৃতায় তিনি বলেন, শেরেবাংলার আদর্শ বাস্তবায়নে আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটাতে হবে। শেরেবাংলা সারা জীবন বাঙালি হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন।
আমাদের জাতীয়তাবাদের যে আদর্শ শেরেবাংলা আজীবন সে আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন।১৩ ও ১৪ মে দুদিনব্যাপী সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়ােজিত জাতীয় সম্মেলনের শেষ দিন প্রধান অতিথির বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ১ লাখ ১৭ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের অধিকার কেউ আর খর্ব করতে পারবে না। তাজউদ্দীন ব্যাংক ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করেন। নিজে রাষ্ট্রীয়করণ অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়ন করেন। প্রাথমিক অবস্থায় প্রত্যেক থানায় তিনি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শাখা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেন। প্রত্যেক ইউনিয়নে ভ্রাম্যমাণ ব্যাংকিংয়ের সুযােগ সৃষ্টি করেন। তার উদ্যোগে ১৯৭৩ সালের মধ্যে পাকিস্তানি নােট বাজার থেকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার এবং তার পরিবর্তে বাংলাদেশের নতুন নােটের প্রচলন করা হয়। নিজে পছন্দ করে তাজউদ্দীন পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার লেখা ডায়েরিতে দেখা যায়, তিনি ছাত্র জীবনে পাটচাষি ও পাটের ন্যায্যমূল্য নিয়ে চিন্তা করতেন। তিনি মন্ত্রী হওয়ার পর পাটশিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পাটকল সংস্থা। “বিজেএমসি’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিজেএমসির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় পাটকলগুলাের উৎপাদন বাড়তে থাকে। পাট উৎপাদনের লক্ষ্যে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
বাজেট বক্তৃতা
তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী থাকাকালে সংসদে ১৯৭১-৭২, ১৯৭২-৭৩, ১৯৭৩-৭৪, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বাজেট পেশ করেন। তার অর্থনীতি ছিল আয় বৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করা। দেশের প্রথম নির্বাচিত সংসদের সামনে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দ্বিতীয় বাজেট পেশ করেন ১৯৭৩ সালের ১৪ জুন। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত অর্থ বিল নিয়ে ১৯৭৩ সালের ২৯ জুন শুক্রবার বিকেল ৪টা ৩৩ মিনিটে স্পিকার জনাব মুহম্মদল্লাহর সভাপতিত্বে আলােচনা শুরু হয়। প্রস্তাবিত অর্থ বিলে কাঁচা তামাক, সিমেন্ট, ঢেউটিন, ছাতার কাপড়, অতি মিহি কাপড় ইত্যাদির ওপর শুল্ক বাড়ানাে হয়। অন্যদিকে সুতি মােটা কাপড়ের ওপর শুল্ক কমানাে হয়। সংসদ সদস্য মাে. আবদুল্যা সরকার ও আবদুস সাত্তারসহ অনেকেই প্রস্তাবিত অর্থ বিলের শুল্ক বাড়ানাের বিষয়ে তীব্র সমালােচনা করেন। এই সমালােচনার পর অর্থ ও পাট বিভাগীয় মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার বক্তব্য দেন। জাতীয় সংসদের সরকারি বিবরণী থেকে বক্তব্যটি দেওয়া হলাে জনাব স্পিকার : জনাব অর্থমন্ত্রী সাহেব, আপনার বক্তব্য পেশ করুন।
জনাব নূরুল হক (নােয়াখালী) : জনাব স্পিকার সাহেব, জনাব আবদুস সাত্তার। সাহেব তার বক্তৃতায় পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিকানা ব্যক্তিমালিকানায় দেওয়ার কথা বলেছেন। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির এটা বিরােধী। পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যক্তিগত মালিকানায় ফেরত দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। জনাব মাে. আবদুস ছাত্তার : এই পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে যথেষ্ট টাকা পেতে পারবেন। বাজেটে যে অতিরিক্ত কর ধার্য করা হয়েছে আমি তার বিরােধিতা করছি। এবং তা প্রত্যাহার করার জন্য দাবি রেখে শেষ করছি। ধন্যবাদ। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ (অর্থ ও পাট বিভাগীয় মন্ত্রী) : জনাব স্পিকার, ফাইনান্স বিল এই সংসদের বিবেচনাৰ্থ প্রস্তাব গৃহীত হবার পর সর্বশেষে মাননীয় সদস্য জনাব আবদুস সাত্তারসহ আটজন সদস্য আলােচনায় অংশগ্রহণ করেছেন। এই ফাইনান্স বিলের উপর সংসদ এবং সংসদের বাইরেও আলােচনা হয়েছে, সুষ্ঠু সমালােচনা হয়েছে, প্রশংসা করা হয়েছে, নিন্দা করা হয়েছে। আমি সরকারের পক্ষ থেকে সেজন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই আলােচনা, সমালােচনা, প্রশংসা, নিন্দা, সব কিছু করা দরকার। এই সংসদের সদস্য আপনারা আছেন; দেশের আপামর জনসাধারণেরও মতামত ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। এই গণতান্ত্রিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের রয়েছে। এসব আলােচনায় আমরা অত্যন্ত উপকৃত হয়েছি। অবশিষ্ট আলােচনা অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে হয়েছে। আমি যখন আপনার সমালােচনার কথা বলছি তখন সংসদের ভিতর বাইরে সবাইকে ধরেই বলছি। আমরা আপনার সম্পূর্ণ আলােচনা অত্যন্ত গভীরভাবে সতর্কতার সঙ্গে অনুধাবন করার ও বিবেচনার চেষ্টা করেছি। জনাব স্পিকার স্যার, শুরুতে একটা কথা বলা দরকার যে, যে বাজেট সংসদে উপস্থাপিত করেছি তার মােটামুটি দুইটা দিক রয়েছে।
একটা দিক হচ্ছে সাধারণ প্রশাসন চালাবার জন্য ব্যয় এবং সেই ব্যয়সংকুলানের জন্য আয়ের ব্যবস্থা করা। আর একটা ব্যবস্থা রয়েছে, উন্নয়নের প্রয়ােজনীয় ব্যয় এবং তার জন্য প্রয়ােজনীয় সম্পদ আহরণ করা। একটা ধারণা এক Section লােকের মধ্যে রয়েছে বলে মনে হয়। এই যে বাজেট উপস্থাপিত করা হয়েছে (রাজস্ব বাজেট) যেটা মিলাবার জন্য কর আরােপ করা হয়েছে এবং কর আরােপ করে সেটা সংগ্রহ করা হয়েছে। সাধারণ গতানুগতিকভাবে নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্রের ব্যয়ভার বহনের জন্য অর্থের প্রয়ােজন, সেই অর্থের জন্য কোনাে কর আরােপ করা হয়নি, প্রয়ােজনও ছিল না। জনাব স্পিকার, এই সংসদে ব্যয় বরাদ্দ পেশ করা হয়েছে ২৯৫ কোটি ৩০ লাখ টাকার। আমাদের আয় যা ধরা হয়েছে কোনাে রকম কর আরােপ না করে। তাতে আমাদের ২৭৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা অনুমিত হয়েছে। তা থেকে ব্যয় বাদ দিলে ৭৯ কোটি ২ লাখ টাকা উদ্বৃত্ত থেকে যায়। জনাব স্পিকার স্যার, আজকে যে কোনাে গণতান্ত্রিক সরকারের দেশের সব। জটিল সমস্যার সমাধান দেওয়া দরকার। আজ থেকে কিছুদিন আগেই এইরূপ সময় দেওয়ার প্রয়ােজন হতাে না। কোনাে একটা ঔপনিবেশিক শাসকের অধীনে দেওয়া প্রয়ােজন হয়নি। কোনাে গণবিরােধী সরকারও মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে চায় না। তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের সম্পদ আহরণ করে ধনী ও বণিকশ্রেণির স্বার্থে নিয়ােজিত করে থাকে। ঔপনিবেশিক সরকার শাসক উপনিবেশ থেকে সম্পদ আহরণ করে তা শাসকদের দেশে নিয়ে যায় । কিন্তু আমাদের এটা একটা গণতান্ত্রিক সরকারই শুধু নয়—এই সরকার দেশের শােষণমুক্ত একটা সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুত সরকার। আওয়ামী লীগ শুধু আজকেই এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না—যুগ যুগ ধরে। এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সামনে। তাই তারা প্রথম সুযােগে ঐ প্রতিশ্রুতি-ঐ ওয়াদা পালনে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে বদ্ধপরিকর।
জনাব স্পিকার, যাতে দেশের সার্বিক উন্নতি হয় সেই ব্যবস্থা সরকারকে করতে হচ্ছে। তা না হলে আমাদের যে আয় ২১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা রয়েছে সেখানে রাজস্ব বাজেটে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা উদ্বৃত্ত রয়েছে। যদি ঔপনিবেশিক শাসকের মতাে পথ নিতে যেতাম তাহলে সাময়িকভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামাে পরিচালনার অর্থ থেকে কিছু মাফ করে দিয়ে, কিছু কর মাফ করে দিয়ে, প্রশাসনিক কাজ চালিয়ে জাকজমক সহকারে রাজত্ব করতে পারতাম । তা না করে আমরা চেয়েছি সবচেয়ে কম খরচ করে স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্র-কাঠামাে পরিচালনা করে কীভাবে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ কাজে তা ব্যবহার করা যায় । বাজেটের দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযােগ্য অংশ হচ্ছে এই রাষ্ট্রীয় । বাজেটে কোনাে কর আরােপ না করা। ৩০ জুনের অবস্থায় ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। উদ্বৃত্ত রেখেছি। সেটা উন্নয়ন কাজে লাগাতে পারব এবং লাগাবার ব্যবস্থা করছি। | আমাদের উন্নয়ন বাজেটে ৫২৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এই প্রয়ােজনের প্রাথমিক জোগান দিচ্ছে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। যেহেতু আবার বাজেটের ওপর সাধারণ আলােচনা চলবে সেহেতু আনীত বাজেটের আংশিক বরাদ্দ পাস করে নিয়েছি। যদি সুযােগ হয় তাহলে সামনে বক্তব্য রাখার চেষ্টা করব। বলে রাখতে চাই, জনাব স্পিকার, ৫২৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকার মধ্যে কোনাে কর আরােপ না করেই ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা দিতে পারব। সব মিলে ৩৫২ কোটি টাকা পাব বলে আমার বিশ্বাস। তাতে করে আমাদের মােট উন্নয়ন বাজেটের যে, প্রয়ােজন তার প্রায় ৭২ কোটি ২ লাখ টাকা বাকি থাকে। এই ৭২ কোটি টাকার মধ্যে আমরা কর হিসাবে অর্থাৎ আমাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে আমাদের নিজস্ব ত্যাগ দিয়ে আমাদের উন্নয়নে শরিক হতে চাই। এই ৭২ কোটি ২ লাখ টাকার মধ্যে আমরা কর আরােপের প্রস্তাব করেছি মাত্র ২৩ কোটি ৯২ লাখ টাকার। তাতে আমাদের মােট প্রয়ােজন এবং সরবরাহের মাঝে যে ফাক তার শতকরা ৩৩ ভাগ অর্থাৎ তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র আমরা আমাদের করের মাধ্যমে পূরণ করতে চাই।
আর বাকি তিন ভাগের দুই ভাগ আমরা বিভিন্নভাবে আরাে সম্পদ আহরণ করে করব, যেমন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প এবং অন্যান্য সংস্থা থেকে আরাে ভালাে প্রশাসন চালিয়ে আরাে মিতব্যয়িতা আরােপ করে বাকি টাকা আমরা আদায় করব। তা করতে যেয়েও আমরা দেখেছি যে ১৮ কোটি ৬০ লাখ টাকার চাহিদা থেকে যায়, যেটা আমরা পূরণ করতে পারি না। আমি আমার বাজেট বক্তৃতায় বলছি যে, ১৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা আমাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে আহরণ করতে চেষ্টা করব। যদি অগত্যা সেটা সম্ভব না হয় তাহলে পরে যে পর্যন্ত বাকি থাকবে সেটা বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সাময়িক ঋণ হিসাবে নেব, এই প্রস্তাব আমরা করেছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সম্পূর্ণ চাহিদার দাবিগুলাের কথা চিন্তা করা দরকার। কাজেই আজ একটা কথা উঠেছে যে সরকার কর আরােপ করে উদ্বৃত্ত বাজেট দিয়েছে। জনাব স্পিকার, এ কথাটা ঠিক নয়। কর আরােপ না করেই আমরা উদ্বৃত্ত বাজেট দিয়েছিলাম। কর আরােপ করেছি রাজস্ব বাজেটের জন্য নয়, কর আরােপ করেছি উন্নয়ন বাজেটের জন্য। আজ এ কথাগুলাে সামনে রেখে আমরা যদি সামনের দিকে তাকাই তাহলেই জিনিসটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। বাইরে এবং ভিতরেও যে আলােচনা সমালােচনা হয়েছে, যারা সমালােচনা করেছেন তারা কতগুলাে বস্তুর নাম করেছেন যে, যেগুলাের উপর কর আরােপ করলে সাধারণ মানুষের অসুবিধা হবে। কিন্তু সরকার সব সময় লক্ষ্য রেখেছেন যে, আমরা যে কর প্রস্তাব করব সেই কর আরােপের ফলে অর্থের নিশ্চয়ই সংস্থান করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে এই করের বােঝা যাতে সাধারণ মানুষের ওপর না পড়ে; সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা কর আরােপ করেছি। জনাব স্পিকার, আমার বাজেট বক্তৃতার শেষ দিকে যে সমস্ত জিনিসের ওপর অতিরিক্ত করের প্রস্তাব করা হয়েছে তার প্রতি দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে যে গরিবের ওপর আঘাত হানা হয় এমন কোনাে জিনিসের উপর কর আরােপ করা হয় নাই।
জনাব স্পিকার আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করব আমার বাজেট বক্তৃতার ২১ পৃষ্ঠার প্রতি আমদানি শুল্ক আমরা কিছুটা বাড়াবার প্রস্তাব করেছি। আমাদের কথা বলা হয়েছে, এমন একটা ধারণা দেওয়া হচ্ছে যে তাদের কথায় আমার দেশের মানুষ প্রভাবান্বিত হতে চলেছে। এই সংসদ থেকে বলা হচ্ছে যে গরিবের ওপর। ট্যাক্স ধরা হয়েছে। তামাক গরিব লােকে খায়। জনাৰ স্পিকার, পরিষ্কার ভাষায়। বলা হয়েছে যে, সিগারেটের তামাক যেটা বিদেশ থেকে আমদানি হয়ে আসে তার। ওপর ট্যাক্স ধরা হয়েছে। আমার দেশের মানুষ সাধারণত কৃষক। তাদের কথা সরকার সবসময় মনে রেখেছেন। আমরা জানি, জনাব স্পিকার, অন্নবস্ত্রের কষ্ট মানুষের আছে কিন্তু হুক্কায় যদি এক ছিলিম তামাক ভরে একটা টান না দিতে পারে তাহলে অত্যন্ত কষ্ট পাবে সেজন্য আমরা সেই হুক্কায় খাওয়ার তামাকের ওপর এবং দেশে যে তামাক উৎপাদিত হয় তার ওপর কর আরােপ করিনি। কর আরােপ করা হয়েছে বাইরে থেকে যে তামাক আসবে এবং যে তামাকে সিগারেট তৈরি করা হবে তার ওপর। এখন সিগারেট অত্যাবশ্যকীয় কি না সে বিতর্কে আমি আসতে চাই না—তবে অনেক নেশাখােরকে দেখা গেছে যে খাবার জন্য পাঁচ টাকা দিলে যত খুশি না হয়। দুই টাকা নেশা করার জন্য দিলে তার চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হয়, কারণ সেটা তার কাছে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য। মাননীয় সদস্য আবদুল্যা সরকারের সঙ্গে আমি একমত।
আমার মনে হয় তিনিও সিগারেট পান করেন না। আমিও তামাক সিগারেট খাই না। সিগারেটের ওপর ট্যাক্স ধরলে তার বা আমার কোনাে ক্ষতি হচ্ছে না। এ রকম আরাে দুই একজন মাননীয় সদস্য থাকতে পারেন যারা ধূমপান। করেন না। কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ মানুষ ধূমপান করে। তারা মুখ দিয়ে সিগারেট টান দিয়ে নাক দিয়ে ধোয়া হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়ে পয়সা নষ্ট করছে। যে পয়সাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছে তার থেকে কিছু পয়সা আমরা চাচ্ছি দেশের উন্নয়ন কাজে লাগাতে । জনাব স্পিকার, আমি সিগারেটের দাম জানি না, রােজই শুনছি ৮০ পয়সার সিগারেট দুই টাকা, আড়াই টাকার সিগারেট তিন টাকায় বিক্রি হয়। এই হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছাকে যদি দমন না করতে পারে তাহলে ৮০ পয়সার উপরের যে পয়সা তা থেকে মাত্র ১৫ পয়সা দেন সেটা ব্যয় করে। বাংলার রাস্তা গড়ি, বাংলার কৃষির উন্নয়ন করি, যেটার ফল চিরকাল ভােগ করবেন এইটুকু শুধু আপনাদের কাছে চাই। জনাব স্পিকার, আমি বেশি সময় নেব না, পরে বাজেট আলােচনার সময় উত্তর দেব। পশমি বস্ত্রের ওপর ১২৫% কর ধার্য ছিল, তার ওপর ৫০ ভাগ বেশি ধারে ১৭৫% করা হয়েছে। আমার দেশের সাধারণ মানুষ, কোনাে গরিব লােক নিশ্চয়ই এটা পরে না। মাননীয় সদস্যরা আলােচনা করেছেন, বাইরেও আলােচনা হয়েছে। এ সম্পর্কে। যাদের পয়সা আছে তারাই ব্যবহার করেন। তাদের পয়সার কিছুটা ভাগ আমরা চাই।
করের প্রস্তাবে দেখা যায় যে, সম্পদ কর বৃদ্ধি করেছি দ্বিগুণ বা দ্বিগুণেরও বেশি। তেমনিভাবে অন্যান্য করও যা ধনীর ওপর পড়ে তা বাড়ানাে হয়েছে। যে জিনিসের ওপর কর ধরলে গরিবের ওপর করের বােঝা পড়বে। সেগুলাের ওপর আমরা কর বাড়াইনি। আর যে দ্রব্য সম্পর্কে বেশি আলােচনা হয়েছে সেটা হলাে সিমেন্ট। জনাব স্পিকার সাহেব, আমরা জানি পল্লীগ্রামের। জনসাধারণ সিমেন্ট ব্যবহার করে না। সিমেন্ট দিয়ে তারা কী করবে। তাদের কাঁচা ভিটায় পাটখড়ি বা নলখাগড়া দিয়ে যদি ঘরবাড়ি করতে পারে সেটাকেই তারা ভাগ্যবান মনে করে। সিমেন্টের মতাে মূল্যবান দ্রব্য দিয়ে তারা কী করবে। তারা যে ঘর তৈরি করে কোনাে উন্নত দেশে এটাকে বাড়ি বলবে কিনা আমরা জানি না জনাব স্পিকার। এই সিমেন্টের উন্নতির জন্য আমরা সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়েছি। যারা একটু ভালাে অবস্থায় আছে তাদের কিছুটা পয়সা আমরা নিতে চাই। জনাব স্পিকার, সিমেন্টের কথা বলা হয়েছে। স্বীকার করি, সিমেন্ট আজ থেকে দশ বছর আগে আসাম বেঙ্গল ছাতকের সিমেন্ট ছিল। আমাদের নিজস্ব সিমেন্ট ছিল। আজ সিমেন্টের যে দাম যেগুলাে প্রায় ১৫/২০ বছর আগে পাঁচ টাকা করে আমরা কিনেছি। আমরা এখন আমাদের সন্তান-সন্ততিদের কাছে আজকে সিমেন্টের দাম বলব অথবা তারা বইপুস্তকে পড়বে, এটা তাদের কাছে। আকাশকুসুম মনে হবে বাস্তবে পাওয়া যাবে না। জনাব স্পিকার, বিশ বস্তায় এক টন হয়, এর প্রতি বস্তা সিমেন্টের ওপর এক টাকা কর আগে থেকেই আরােপ করা আছে; গত বাজেটেই ছিল। তার ওপর ১ টাকা ২০ পয়সা sales tax ছিল। তাতে আমাদের Chittagong-এ। ex-godown TCB বিক্রি করে ১৫ টাকা ২৫ পয়সায়। আমরা যে আরাে এক। টাকা কর আরােপ করেছি তাতে সরাসরি sales taxসহ দাম হবে ১৬ টাকা ৫৫ পয়সা। আজ ঢাকার খােলাবাজারে এই সিমেন্ট বিক্রয় হয় ২১ টাকা ৩৫ পয়সায়। কাজেই এক টাকা কর বাড়িয়ে দিলে দাম তেমন কিছু বাড়বে না। কাজেই যাদের অবস্থা ভালাে তারা এখন ২০ টাকা বা ২১ টাকা দিতে পারবে।
আমি আশা করি। তারা আরাে বেশি কষ্ট সহ্য করতে সমর্থ এবং তাদের সেই শক্তি আছে। কাজেই সিমেন্টের ওপর এক টাকা বেশি ট্যাক্স গরিবের ওপর আসবে বলে আমি মনে করি তাছাড়া এই কর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপকারেই ব্যয় হবে। ভবিষ্যতেও আমরা ঠিক ততক্ষণ বিদেশ থেকে কাপড় আমদানি করব যতক্ষণ আমরা নিজেদের চাহিদা নিজের উৎপাদন দ্বারা পূরণ করতে না পারছি। একটা কথা এখানে স্পষ্ট করে বলা দরকার আমাদের শাড়ি মার্কিনেও হয় এবং লুঙ্গিও হয়, শাড়িও হয়। আমাদের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে আমরা সাধারণত লুঙ্গি পরি এবং আমাদের মেয়েরা সাধারণত যে শাড়ি পরে সেই লুঙ্গি ও শাড়ি ছাড়া দুনিয়ার অন্য কোনাে দেশে পরে না বিধায় তারা আগে থেকে কোনাে শাড়িও তৈরি করে রাখে না। আমাদের স্বাধীনতার পর আমরা একটা শূন্যতায় পড়ে গিয়েছি। আমাদের ৯ মাস স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস আপনি জানেন। সে সময় আমাদের এক কোটি ভাইবােন এদেশ ছেড়ে বন্ধু-রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। আর বাকিরা এখানে থেকে গিয়েছিল। তাদের কারও জন্য ঐ নয় মাসের ভিতর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কোনাে কাপড় আমদানি করে নাই। তার ফলে এ ক্ষেত্রে একটা বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তার জন্য বিতর্ক হয়; অবাক হয়ে যাই । তারা যদি একটু চিন্তা করে সে সময় বাংলাদেশের মানুষের কী অবস্থা ছিল। জানের নিরাপত্তা ছিল না। রাতে যখন খবর পেয়েছে বর্বর পাকিস্তান বাহিনী রাজাকার ও আলবদরের সহযােগিতায় তাদের আক্রমণ করতে আসছে। এই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাসী, মা-বােনের হাত ধরে ঝােপে-ঝাড়ে, জঙ্গলে মাঠে, পানিতে, পাটক্ষেতে, খালে আশ্রয় নিতে পালিয়ে যেত। standard of living বলতে যা বােঝায়—আমি খেলাম কি না, কয় দিনে একবার খেয়েছি সেটা কেউ চিন্তা করে। নিই। এ রকম অবস্থায় খাদ্যের চিন্তা, কাপড়ের চিন্তা কেউ করতে পারে না।
পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী গ্রাম আক্রমণ করেছে, নিজের সব রেখে মানুষ চলে গিয়েছে। তারা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে, এক কাপড়ে বের হয়ে চলে গিয়েছে আমাদের বাংলার মা-বােনেরা। তারপর দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ হয়েছে; পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় কাপড়ের প্রয়ােজন বােধ করে নাই; কারণ চিন্তা করার সময় ছিল না। আজকে শত্রু যখন। চলে গিয়েছে, আমরা আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছি, সব সমস্যা একযােগে দেখা দিতে শুরু করছে। এই যে শূন্যতা একসঙ্গে পূরণ করার মতাে ক্ষমতা এদেশের নেই। কারণ ৭৫ কোটি গজ কাপড়ের সরবরাহ হয় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য। যদি ১০ গজ করে কাপড় মাথাপিছু দেওয়া যায়। ১০ গজ মানে এটা কিছুই নয়। আমার মা-বােনের দুটা শাড়ি, ১০ গজ হলে দুটা পায়জামা দুটা পাঞ্জাবি হয়ে যায়; আর গামছা তােয়ালের কোনাে প্রশ্ন ওঠে না। যারা লুঙ্গি-শার্ট পরেন তাদের ১০ গজ হলে দুটা শার্ট, দুটা লুঙ্গি হয়ে যায়। এভাবে যেখানে ৭৫ কোটি গজ কাপড়ের দরকার হয়, পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের যে কলকারখানা ছিল তাতে মাত্র ৬ কোটি গজ কাপড় হতাে; যদিও তারা বলত ৮ কোটি গজ কিন্তু তারা কখনাে ৮ কোটি গজ করে নাই। আমার এদেশে তাঁতি ভাইয়েরা ছিল। তাদেরকে পূর্ণ জোগান দিলে চাহিদার অর্ধেকের বেশি পূরণ করতে পারত। কিন্তু তা দেওয়া হয় নাই, পর্যাপ্ত পরিমাণ সুতা সরবরাহের ব্যবস্থা হয় নাই। তারা তখন পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তান) কলকারখানা গড়ে তুলেছিল।
সুতা তৈরি কারখানা, কাপড় তৈরির কারখানা এবং অন্যান্য হস্তশিল্পকে সেখানে Protection দেওয়া হয়; কিন্তু আমাদের এখানে বাঙালি তাতিকে Protection দেওয়া হয় নাই। তারা আরাে Protection দিয়েছিল মিলওয়ালাদের । নিচের কাউন্ট পর্যন্ত তারা Protection দিয়েছিল এবং উপরের কাউন্টেও দিয়েছিল। কিন্তু মাঝখানে তারা Protection দেয় নাই। মিলওয়ালারা অবাধে সেটা তৈরি করতে পারত। আমরা দেখেছি করি,’ ‘ভালিকা’ এরা লুঙ্গির বাজারে প্রতিযােগিতা করত এবং আমাদের দেশের তাতি ভাইয়েরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এটা তারা করত কারণ এখানে তাদের ঔপনিবেশিক শাসন ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের মূল লক্ষ্য হলাে তারা শাসিত অঞ্চলকে শােষণ করবে এবং সেখানকার সম্পদ স্বদেশে নিয়ে যাবে। যার শাসিত অঞ্চলের মানুষকে শুধু এতটুকু সুযােগ সুবিধা দেবে যাতে তারা কোনােরকম বেঁচে থেকে তাদের রসদ জোগাতে পারে; তার বেশি নয়। আজকে আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আপস-মীমাংসা করে ১৯৪৭ সালে ইংরেজের হাত থেকে এই উপমহাদেশ যেমন করে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, আমরা তা করিনি। আমরা যুদ্ধ করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। পাকিস্তান আমাদেরকে যে কাপড় সরবরাহ করত সেটা তাদের ব্যবসায়ীদের স্বার্থে করত। আমরাও শাসিত হিসেবে অন্য উপায় ছিল না বলে সেটা পেতাম। এখন সেই পাকিস্তান চলে গেল। শাড়ি এবং লুঙ্গি ভারতবর্ষ ছাড়া অন্য কোথায়ও পাওয়া যায় না। অন্য কোনাে দেশে শাড়ি-লুঙ্গি পরে না।
তাদের খােলাবাজারে শাড়ি-লুঙ্গি কিনতে পাওয়া যায় না । এই জন্য প্রাণান্তকর অবস্থা হয়ে গিয়েছে। এমনকি ৬০ কাউন্টের fine শাড়িও জাপানে পাবেন না; তাদেরকে order দিতে হবে। বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি লােক শতকরা ৪৮ জন ভােটার হয়েছে। মা-বােনদের জন্য শাড়ি আনতে হবে। ৩ কোটি মানুষের জন্য যদি শাড়ি আনতে হয় তাহলে order দিতে হবে। কোনাে দেশ হঠাৎ দিতে পারবে না। এ জিনিস কোনাে দেশে তৈরি হয় না। কত কাউন্টের সুতা হবে, কেমন design হবে এসব সময়সাপেক্ষ। কোনাে দেশকে order দিলে তারা দেখবে এই বাজার কতদিন থাকবে, কতদিনে বাজার নষ্ট হয়ে যাবে। যদি তারা। দেখে যে বাজার দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম তাহলে তারা অনিচ্ছা প্রকাশ করবে। আমরা পৃথিবীর বাজার থেকে বেশি পরিমাণ সুতা আনার যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের চাহিদা হচ্ছে শাড়ি এবং লুঙ্গির। তা দুনিয়ার কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ভারতবর্ষের পক্ষেও তাদের ৫৫ কোটি লােকের চাহিদা মিটিয়ে আমাদের সাড়ে সাত কোটি লােকের চাহিদা মেটানাে সম্ভব না। যখনই আমাদের প্রয়ােজন হয়েছে আমরা বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে ভারতবর্ষের কাছ থেকে এনেছি। অবশ্য এর জন্যে তাদের ভাগ্যে জুটেছে বদনাম। বদনাম আমাদের হতে পারে বিতরণের ক্রটির জন্য। সরকার পরিচালনা করছি, সুনাম নিতে চাই। সুনাম দুর্নাম নিয়েই সরকার পরিচালনা করতে হবে।
একটি মাত্র বন্ধুরাষ্ট্র ভারত, তারা আমাদের জন্য যা করেছেন সবাই জানেন। যা আমাদের প্রয়ােজন তারা আমাদের। তাই দেন। তাদের কাছ থেকে কাপড় আনি, প্রয়ােজনে ব্যবহারে লাগাই । পরদিন ভারতের বিরুদ্ধে কুৎসা যে তারা খারাপ কাপড় দিয়েছে। ৯ হাত কাপড় দিয়েছে। গ্রামের বাচ্চা মেয়েদের বয়স ৮-৯-১০ বছর গেলে Frock পরে না। ৯ হাত শাড়ি পরবার জন্য বাংলাদেশে লাখ লাখ লােক আছে। ১১ হাত শাড়ির দরকার; ভারত ৯ হাত শাড়ি সরবরাহ করেছেন, এ দোষ ভারতের নয় আমরা চেষ্টা করেছি। ২১ থেকে ৩৫ কাউন্টের নিচে পর্যন্ত চলতি বাজেটে হার ছিল শতকরা ৫০, এটা কমিয়ে ২৫ করা হয়েছে। এই কাউন্টের কাপড় তৈরি করা যায় নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং কম আয়ের লােকে পরবে। ২১ কাউন্টের নিচের সবসময় পাওয়া সম্ভব হবে না। এই কাউন্টের কাপড় পরতে হবে। এবং করের বৃদ্ধি শতকরা ৫০ থেকে কমিয়ে ২৫% করায় আমাদের ৭ কোটি টাকা লােকসান দিতে তারা প্রস্তুত।
নিম্ন আয়ের লােকের কথা আমরা চিন্তা করিনি, তা ঠিক নয়। আমাদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যতটুকু সম্ভব তা করেছি, কাজেই জনাব স্পিকার সাহেব, আমরা কাপড়ের ওপর যে কর ধার্য করেছি সেটা অতিরিক্ত করিনি। ২১ কাউন্টের নিচে পর্যন্ত সুতার ওপর কর মওকুফ করে দিয়েছি। ২১ কাউন্টের প্রচুর জিনিস আসছে, আসবে। ২১ থেকে ৩৫ কাউন্টের নিচে করের হার শতকরা ৫০ ছিল। সেটা কমিয়ে ২৫ করা হয়েছে তাতে সরকারের ৭ কোটি টাকা লােকসান হয়েছে। ৩৫ থেকে ৪৮ কাউন্ট পর্যন্ত করের হার শতকরা ৫০ ছিল, সেটাই রেখেছি, বাড়াইনি। ৪৮ কাউন্টের ওপর যত আছে শতকরা ১০০ করা হয়েছে, আগে ৫০ ছিল। যারা। এগুলাে কিনবে তারা সমাজে আয়ের দিক থেকে উচ্চমানের লোেক; তারা একটু ত্যাগ স্বীকার করবে এই আশায় ৫০ থেকে ১০০ করেছি। কাজেই, জনাব স্পিকার সাহেব, করের প্রস্তাব বিবেচনা করলে দেখা যাবে, গরিবের কষ্ট হতে পারে, তাদের ওপর করের প্রভাব পড়তে পারে, এসব বিষয়ের। প্রতি লক্ষ্য রেখেই কর আরােপ করেছি।
জনাব স্পিকার সাহেব, motor spirit, petroleum products-এর ওপর কর। আরােপ করেছি যেগুলাে বড় লােকেরা কেনে অথবা বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হয়। আর লাল কেরােসিন বা সাদা কেরােসিনের ওপর কোনাে ট্যাক্স বসাইনি। আমরা ডিজেলের ওপর ট্যাক্স বসাইনি যদিও যারা ডিজেল দিয়ে মােটরলঞ্চ চালায়, বাস চালায়, ট্রাক চালায় তারা অনেক পয়সা রােজগার করে। ডিজেলের ওপর কর। আরােপ করিনি এ জন্য যে সব কৃষক ভাই ক্ষেতে নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অধিক। ফসল ফলাতে চায়। তাদের Power Pump, Tube-well চালাবার জন্য ডিজেল দরকার।
সে জন্য ডিজেলের ওপর কর আরােপ করিনি। একটা কথা উঠেছে কর আরােপ না করলে দাম কী করে বাড়ছে। Black marketing ছাড়াও দাম বাড়তে পারে। Crude oil বিভিন্ন জায়গা থেকে আনতে হয়। আগে crude oil এক ব্যারেলের দাম ছিল ১ ডলার ৭২ সেন্ট, এখন দাম হয়েছে ২ ডলার ৫০ সেন্ট, ভবিষ্যতে আরাে বাড়তে পারে। তারপর Freight কীভাবে বাড়ছে আপনারা সকলে তা জানেন। যদি crude oil-এর দাম বেশি বাড়ে, পরিবহন charge বেশি বাড়ে, তাহলে petroleum জাত দ্রব্য তৈরি করবে যে দামে তা বিক্রি করবে কী দামে? যদি লােকসানে বিক্রি করতে থাকে শিল্পকারখানা রসাতলে যাবে। এটা। আন্তর্জাতিক সমস্যা—এ সময়ে শুধু একটা উদাহরণ দেব। মাস আড়াই আগে প্রেসিডেন্ট নিক্সন full message দিয়েছিলেন। তাতে তাদের দেশের কথা তুলে। ধরেছিলেন। ১৯৮৫ সালে মার্কিন জ্বালানি দ্রব্যে অসুবিধায় পড়ে যাবে। জ্বালানির একই অবস্থা দুনিয়ায়। জ্বালানি পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য আমাদের দেশে নেই। তবে ডক্টর মাফিজ চৌধুরীর প্রচেষ্টায় যদি এই সমস্যার সমাধান হয়। সৌদি আরব ধমক দিয়েছে, নিক্সনকে বলেছে তােমাকে তেল দেব না। কাজেই এখানে ধমক দেওয়ার একটা সুযােগ হয়েছিল, একটি গাড়ি hijack করার চেষ্টা করলে সেই সময় এই ধমক দিয়েছিল।
আজকে সারা দুনিয়ায় তেলের এমন অভাব দেখা দিয়েছে যার ফলে শিল্পোন্নয়ন ব্যাহত হবে। পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে যারা সারা দুনিয়ার অর্থনীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তারাও এই বিষয়ে চিন্তা করতে শুরু করেছে। আমি এর ওপর। আর বেশি বলতে চাই না। জনাব স্পিকার সাহেব, পেট্রোলিয়ামজাত জিনিসের দাম বেড়েছে কারণ এর আমদানি দাম বেশি পড়ে যাচ্ছে। Eastern Refinery সাদা কেরােসিন, লাল কেরােসিন ও ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে। এতে উচ্চবাচ্য করা যাবে না। তারা পরিষ্কার ঘােষণা করেছে, gayette notification করেছে, শিল্প মন্ত্রণালয়কে তা যথাসময় জানিয়েছে। জনাব স্পিকার সাহেব, কয়েকজন মাননীয় সদস্য আইনগত দিক থেকে কিছু আলােচনা করেছেন ও কিছু প্রস্তাবও দিয়েছেন। তার মধ্যে জনাব আসাদুজ্জামান খান, জনাব আমীরুল ইসলাম ও জনাব সিরাজুল হক সাহেবের দুই একটি কথার। জবাব দেব। এই মুহূর্তে আমি মাননীয় সকল সদস্যের কথার জবাব দিলে অনেক। সময় লাগবে বিধায় সে সম্বন্ধে কিছু বলছি না। আমার বাজেট আলােচনার সমাপ্তিকালে সে সম্বন্ধে বক্তব্য রাখব।
দক্ষতার সঙ্গে অর্থনীতি পুনর্গঠন
তাজউদ্দীন আহমদ শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও একজন সাহসী যােদ্ধার পরিচয় দেন। মূলত তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ছিল সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত। সরকারি কোষাগার খালি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্য। যুদ্ধকালে ভারত সরকার বাংলাদেশকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দেয় এবং তা তাদের বােম্বের রিজার্ভ ব্যাংকে জমা ছিল। পাকিস্তান সরকার রপ্তানি আয়ের সম্পূর্ণ অংশ পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। বেশিরভাগ শিল্প-বাণিজ্যের মালিক পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। কাঁচামালের অভাব। ব্যবস্থাপনার অভাবে ব্যাংক, বীমা, শিল্পখাত অচল তাজউদ্দীন আহমদ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বলতেন সমাজতন্ত্র চীন বা রাশিয়ার মতাে হবে না। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শােষণহীন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা ছিল তার লক্ষ্য। অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করার জন্য তিনি পরনির্ভরশীল হতে চাননি। তাই তিনি আমেরিকা বা অন্যান্য দেশের শর্তযুক্ত ঋণ গ্রহণ করতে চাননি। এ কারণে অনেকে সমালােচনা করেন যে, তাজউদ্দীন মার্কিনবিরােধী ছিলেন। পূর্ব বাংলার ১০টি ব্যাংকের মধ্যে ৮টির মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা নিয়ােগ করার জন্য নামের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানাে হলাে। সুপারিশকৃতদের মধ্যে ছিল পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট নূরুল আমিনের পুত্র আনােয়ারুল আমিন। বঙ্গবন্ধু তাকে বাদ দিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলে উদার মনের মানুষ। তার কাছে অফিসারদের পরিচয় ছিল তাদের যােগ্যতা ও সততা তিনি মুজিবনগর ও ভেতরের অফিসারদের মধ্যে কোনাে বিভাজন করেননি। তার অর্থ সচিব ছিলেন সাবেক সিএসপি মতিউল ইসলাম। মতিউল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
তাজউদ্দীন তাকে খুব পছন্দ করতেন। এই দক্ষ অফিসারদের সঙ্গে তিনি কখনাে দ্বিমত পােষণ করেননি। পাকবাহিনীর নিয়ােগকৃত গভর্নর ড. এম এ মালেকের ব্যাংকের টাকা উন্মুক্ত করতে আপত্তি করেন। তার মামলা পরিচালনার জন্য অর্থ ছাড় করেছেন। তাজউদ্দীনের মানবিক মূল্যবােধ ছিল অসীম। তার মধ্যে প্রতিহিংসা ছিল না। আইনের প্রতি তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক, শিল্প ঋণ সংস্থা পুনর্গঠনের তাজউদ্দীন অপূর্ব মেধার পরিচয় দেন। বাংলাদেশের মুদ্রা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করেন তিনি। যুদ্ধকালে পাক সরকার হঠাৎ পাঁচ শ টাকার নােট অচল ঘােষণা করে সরকারকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল। যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের নিজস্ব মুদ্রা ছিল স্বাধীনতার পর তাজউদ্দীন বিভিন্ন মানের মুদ্রা ও নােট ছাপানাের ব্যবস্থা করেন। তার হাতের লেখা ছিল সুন্দর। তিনি মুদ্রা ও নােটের ডিজাইন সংশােধন করতেন। মুদ্রায় ‘টা’ শব্দটি তার অঙ্কিত। মুদ্রা ছাপা নিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার চলে। যুদ্ধকালে ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে এক টাকার নােট ছাপতে দেওয়া হয় এবং তা স্বাধীনতার পর বাজারে ছাড়া হয়। গুজব ছড়ানাে হলাে। যে, ভারত অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপিয়ে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাচার করছে। পরে। এক টাকার নােট বাজার থেকে প্রত্যাহার করা হয়। দেখা গেল, যে টাকা ছাড়া। হয়েছে তার চেয়ে কম জমা পড়েছে। তাজউদ্দীন বাজার থেকে পাকিস্তানি মুদ্রা ও কাগজের নােট প্রত্যাহার করেন। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের মুদ্রার মান বৃদ্ধি পায়। ১৯৭২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তাজউদ্দীন যুক্তরাজ্যে জনতা ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি নির্বাচিত সুধীমণ্ডলির সম্মানে ভাষণ দেন। অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের জন্য যে কাজ করেছে সে জন্য তিনি যুক্তরাজ্যকে ধন্যবাদ জানান। ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রী সম্মেলনে ভাষণ দেন। ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় ভাষণ দেন। তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পশ্চিমা দেশগুলাের কাছে তাজউদ্দীন মস্কোপন্থী ও আমেরিকা বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা। তাজউদ্দীন তাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। ম্যাকনামারা বাংলাদেশে এলে তাজউদ্দীন তাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে যাননি। আর একবার দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ম্যাকনামারার পাশাপাশি বসলেও তাজউদ্দীন তার সঙ্গে কথা বলেননি।
এমনি পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীনের নির্দেশে অর্থসচিব বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেন। আবেদনের নিয়ম হলাে। প্রথমে আইএমএফের সদস্য হতে হয় এবং তার পর বিশ্বব্যাংকের তাজউদ্দীনের মেধা ও অর্থনীতিতে পাণ্ডিত্যের কাছে পাশ্চাত্য দেশগুলাে হার মানে। বাংলাদেশ ‘৭২-এ ১৩ জুন আইএমএফের সদস্যপদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নূরুল ইসলামকে বিশ্বব্যাংকের গভর্নর এবং তাজউদ্দীনকে আইএমএফের গভর্নরের জন্য সুপারিশ করেন। ‘৭২ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হয়। তাজউদ্দীন আহমদ এটির গভর্নর নির্বাচিত হন। ‘৭২-এর ২৩ জুন তাজউদ্দীন মিরপুর চিড়িয়াখানা ও বােটানিক্যাল গার্ডেন উদ্বোধন করেন। ৮ আগস্ট বাগদাদের উদ্দেশে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। ১২ আগস্ট জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের সম্মেলনে যােগদান করেন। তিনি কয়েকবার আরব দেশ পরিদর্শন করেন। ‘৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাজউদ্দীন বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় ওয়াশিংটন যান। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারার সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর চমক্কার এবং সফল আলােচনা হয়। অর্থমন্ত্রী যে বিদেশি সাহায্য নিতে চান না ম্যাকনামারার এ ধারণা দূর হয়। তিনি তাজউদ্দীনে ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাজউদ্দীনের সঙ্গে আলােচনার পর বিশ্বব্যাংকসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বাংলাদেশকে ২০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়। ফলে ‘৭২-এর সেপ্টেম্বরের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। ‘৭৪-এর জুন মাসে বিশ্বব্যাংকের বিশেষ কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে তাজউদ্দীন গেলেন ওয়াশিংটনে। আলােচনা শেষে তিনি আমেরিকা সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের খাদ্য সাহায্য নিয়ে আলােচনা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তিনি খাদ্য সাহায্যের জন্য রাখেন জোরালাে প্রস্তাব। তাজউদ্দীন কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলন এবং দ্বিতীয়বার ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সভায় যােগ দেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশ-বিদেশের দাতাগােষ্ঠীর সঙ্গে বহু সভা করেন। তখন দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে, আমদানি-রপ্তানির অবস্থা খুবই খারাপ। ওয়াশিংটনের পথে তাজউদ্দীন সােভিয়েত রাশিয়া সফর করে আসেন ম্যাকনামারার চেষ্টা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক প্রয়ােজনীয় অর্থ ও খাদ্য যােগাতে ব্যর্থ হয়। এ সময় তাজউদ্দীনকে বিমর্ষ দেখা যেত। দেশে দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে ছিল তার সার্বক্ষণিক চিন্তা।
‘৭৪-এর ১৩ অক্টোবর দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিক সম্মেলনে তাজউদ্দীন বলেন, খাদ্য সংকটকে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখতে হবে। নিরন্ন মানুষকে বাঁচাতে দলমত নির্বিশেষে এগিয়ে আসুন। বর্তমান জাতীয় দুর্যোগকালে উট পাখির মতাে বালিতে মাথা গুজে থাকলে চলবে না। বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। অবিলম্বে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষকে সাথে নিয়ে জাতীয়ভাবে খাদ্য সঙ্কটের বাস্তব সমাধানের পথে এগিয়ে আসতে হবে। সকল দল ও মতের নেতৃবৃন্দ এবং বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করে বর্তমান খাদ্য সংকট মােকাবিলায় সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পন্থা গ্রহণের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে অনুরােধ করেন। তার বক্তব্যের মাধ্যমে কোনাে সর্বদলীয় বা জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলছেন কিনা এই প্রশ্ন উঠলে তিনি বলেন, সে প্রশ্নই ওঠে না। কারণ বর্তমান সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। তিনি বললেন, খাদ্য সমস্যাকে অবশ্যই রাজনীতির উর্ধ্বে রাখতে হবে। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র বক্তৃতা, বিবৃতি, শ্লোগান দিয়ে সঙ্কটের সমাধান হবে না। তিনি বলেন, মানুষ না খেয়ে মরছে। এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। এর অবসান ঘটাতে হবে। মাটি আর মানুষ নিয়ে দেশ-বাংলাদেশ এখন সার্বভৌম, তার মাটি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কিন্তু মানুষ না থাকলে কাকে নিয়ে রাজনীতি, কার জন্যই রাজনীতি? মানুষ যখন মরে যাচ্ছে তখন নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা যায় না। এ পরিস্থিতি মােকাবেলা করতে যারা ব্যর্থ হবে তাদের ব্যক্তি নির্বিশেষে ছাটাই করা দরকার।
এমনকি আমি যদি হই আমাকেও বাদ দেওয়া উচিত। একজন সাংবাদিক বর্তমান গণঐক্য জোটের পরিপ্রেক্ষিতে তার দলমত নির্বিশেষে খাদ্য সঙ্কট মােকাবেলার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দাবি করলে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি গণঐক্য জোটকে আরাে ব্যাপকভিত্তিক করার কথা বলেছি। আমি মনে করি কিছুসংখ্যক (মাইক্রোস্কপিক মাইনরিটি) লােক যারা বিদেশের এজেন্ট, তারা ছাড়া এ দেশের সকল মানুষ দেশপ্রেমিক। তাছাড়া বিরােধী দল করলেই মানুষ অ-দেশপ্রেমিক হয় না। তিনি আরাে বলেন, কেউ অভিজাত বিপণি কেন্দ্রে মার্কেটিং করবে আর কেউ না খেয়ে রাস্তায় মরে পড়ে থাকবে, এই অবস্থা চলতে দেওয়া যেতে পারে না। যা আজ না খেয়ে ধুকে ধুকে পথেঘাটে মরছে তারা আমাদের মানবতাবােধের প্রতি বিদ্রুপ করে বিদায় নিচ্ছে। তিনি দেশের বিত্তবান লােকদের কৃচ্ছ সাধনের জন্যও আহ্বান জানান। তিনি। বলেন, যাদের নাই তাদেরকে কৃচ্ছ সাধনের কথা বলে মরতে বলতে পারি না।
আমরা সবাই সহানুভূতিশীল হলে এ পরিস্থিতির বেদনা কিছুটা প্রশমিত হতাে। তিনি আরাে বলেন, সরকারি দলই হােক আর বিরােধী দলই হােক, কারাে হাতে অস্ত্র থাকা উচিত নয়। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়ােজিত সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও উপদলের মধ্যে অনাস্থার মনােভাব সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনারা কেন সরকারের ভালােমন্দ তুলে ধরছেন না? কেন বাস্তব অবস্থা তুলে না ধরে জনগণকে শুধু আশার বাণীই শােনাচ্ছেন? অমুক দেশ থেকে চাল আসছে, গম আসছে, সাহায্য পাওয়া। যাবে—এইটুকু লিখলেই চলবে না। কীভাবে উৎপাদন বাড়ানাে যেতে পারে, কীভাবে সকল মানুষকে একত্রিত করে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে তার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তিনি বলেন, একটি স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তােলার ব্যাপারে আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও দায়িত্ব পালন করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। একবারের কথা। এডিবির বার্ষিক সম্মেলন হবে ম্যানিলায়। অর্থমন্ত্রী সঙ্গীদের নিয়ে বিমানে ম্যানিলা যাবেন। হঠাৎ খবর এলাে ঢাকা থেকে থাই ফ্লাইট বাতিল। তখন তাদের বলা হলাে দিল্লি-ব্যাঙ্কক হয়ে ম্যানিলায় যাওয়া যাবে। তাজউদ্দীন দুই কর্মকর্তাকে নিয়ে বিকেলে দিল্লি পৌছেন। ডিপি ধর তাদের অভ্যর্থনা জানান। পরের দিন পাঁচটায় প্যানঅ্যাম বিমানের ফ্লাইট। তারা ভিআইপি রুমে বসে আছেন। ভারতীয় প্রটোকল অফিসার জানায় যে, সময় হলে তিনি জানাবেন। কিন্তু যখন জানাল তখন প্লেনের কাছাকাছি গিয়ে দেখা গেল প্লেনের সিড়িটা উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে প্রটোকল অফিসার বললেন, না, ও কিছু না। প্লেন চলছে দেখে অফিসারের মাথায় হাত। তখন গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে প্যানঅ্যামের অফিসারের কাছে গিয়ে বলল, প্লেন কীভাবে যাচ্ছে? ভিআইপি যাত্রীরা রয়ে গেছে। প্যানঅ্যাম অফিসার বলল, ভিআইপিদের অনেকবার ডাকা হয়েছে, কেউ আসেনি তাই প্লেন চলে যাচ্ছে। অফিসার কন্ট্রোল টাওয়ারে ফোন করে প্লেন থামাতে বলে। মালগাড়ির। সিড়ি দিয়ে মন্ত্রী ও তার সহযাত্রীরা উঠলেন কিন্তু দরজা বন্ধ । প্লেন থেকে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। টোকা দেওয়ায় দরজা খুলে যায়। তারা ভেতরে ঢুকে পড়লেন। প্রটোকল অফিসারের দায়িত্বহীনতার ফলে অর্থমন্ত্রীর জীবনহানির আশঙ্কা ছিল।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ – স্বকৃত নোমান – উৎস প্রকাশন, ৩ নভেস্বর ২০১৫