ঐতিহাসিক ছয় দফা, কারাবরণ, গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তি
মুক্তি পেয়ে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম শুরু করেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলােকে পুনরুজ্জীবিত না করে ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য আলােচনার করতে হবে। ১৯৬২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর লাহাের নেতাদের সঙ্গে আলােচনা করে এনডিএফ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ‘৬২-এর ৪ অক্টোবর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে সােহরাওয়ার্দীকে আহ্বায়ক করে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান এনডিএফ-এর আহ্বায়ক হলেন নূরুল আমিন। এই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি এনডিএফের প্রাদেশিক কমিটির প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান তিনি। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র বিশ্বাস করতেন না তিনি সামরিক স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ‘৬২ সালে তাজউদ্দীন আহমদ সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং কারারুদ্ধ হন। ‘৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ‘৬৬ সালে তিনি লাহােরে অনুষ্ঠিত বিরােধী দলীয় সম্মেলনে যােগ দেন শেখ মুজিবুর রহমান এই সম্মেলনেই ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি ঘােষণা করেন। সেখানে তা সমর্থন পায়নি। ছয় দফা প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাজউদ্দীনের। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারাও ছয় দফা সমর্থন করেননি। ঐ বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফা গৃহীত হয়। সেখানে প্রতিকূলতার মােকাবেলা করে ছয় দফা পাস করাতে উদ্যোগী ও সচেষ্ট ছিলেন তাজউদ্দীন, তার সহযােগী এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছয় দফা আন্দোলনের গােটা প্রক্রিয়ায় তাজউদ্দীন ছিলেন শেখ মুজিবের।
ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী। পরে আওয়ামী লীগের ঐ কাউন্সিল অধিবেশনেই যেদিন শেখ মুজিব পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হন, সেদিনই তাজউদ্দীন সাধারণ সম্পাদক হন। শেখ মুজিব সভাপতি হওয়ার আগে ছিলেন সাধারণ সম্পাদক এবং তাজউদ্দীন সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক। ছয় দফা আন্দোলনের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতা কারারুদ্ধ হন। ‘৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনের সর্ববৃহৎ জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ। শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ নেতৃবৃন্দ সভায় ভাষণ দেন। সভা রাত ৮টা পর্যন্ত চলে। শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন ঢাকায়। পৌছলেন। সেদিন গভীর রাতে পুলিশ শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যায়। একই রাতে আরাে অনেকের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদও গ্রেপ্তার হন। তাজউদ্দীন গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তার কন্যা সিমিন হােসেন রিমি লিখেছেন, জুন মাস ১৯৬৬ সালের এক গভীর রাতে আম্মা অথবা আপার ডাকে ঘুম থেকে উঠি তাকিয়ে দেখি ঘরে বাতি জ্বলছে। আব্দু বাইরে যাবার জন্য কাপড় পরে তৈরি। সবার চেহারা থমথমে। ঘুম ঘুম চোখে আব্বুকে বিদায় জানাতে সবার সাথে বাইরে বের হয়ে দেখি রাইফেল হাতে পুলিশ সমস্ত বাড়ি ঘিরে রেখেছে আব্বুকে একটা জীপে তুলে নিয়ে পুলিশের দল চলে গেল। আব্বু মানুষের দুঃখ কষ্ট দূর করতে চান, সবাইকে ভালাে থাকতে দিতে চান, এই কারণে কাজ না করতে পারেন তাই তাকে আটক রাখতে ওরা ধরে নিয়ে গেছে, আমি এটুকু খুব বুঝলাম।’ তাজউদ্দীন আহমদকে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে সরকার দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
কারণ স্বৈরাচারী সরকার তাজউদ্দীনকে ভয় পেত। তাজউদ্দীন তার প্রখর বুদ্ধি, কৌশল প্রয়ােগ করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সরকারবিরােধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করবে, তাদের ধারণা। তাই তাকে ঢাকা জেল থেকে ময়মনসিংহ জেলে স্থানান্তর করা হয়। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে প্রায় লড়ছেন। পরে সুস্থ হয়ে আবার বাসায় ফিরে আসেন। এই সময় তাজউদ্দীন। আহমদের মেয়েরা খুবই ছােট। তাজউদ্দীনের বােনের মেয়ে আনার বাসায়। থাকেন। জোহরা তাজউদ্দীনের অবর্তমানে আনার সংসারের দায়িত্ব পালন করেন। ময়মনসিংহ কারাগারে তাজউদ্দীনকে দেখতে মাসে দু-বার তার স্ত্রী ও শিশু কন্যারা যেতেন। সিমিন হােসেন রিমি শিশুকালে ময়মনসিংহ যাওয়ার স্মৃতিচারণ করে
লিখেছেন
“আব্বুকে ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। সত্যিকার অর্থে আব্দুর সাথে আমার পরিচয় এই কারাগারে। সেই ভাের অন্ধকার থাকতে আমাদের ছুটতে হতাে তখনকার সেই ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনের দিকে। মাসে দু-বার আব্দুর সাথে ময়মনসিংহ কারাগারে গিয়ে দেখা করার সুযােগ ছিল। আব্বু কারাগার থেকে মাসে একবার হলেও চিঠি লিখতেন। রিতি সবসময় উত্তর দিত। আমি তখনাে ভালাে করে লিখতে জানি না। তাই বানান করে পড়েই আনন্দ পেতাম। আমরা কারাগারে আন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলে ময়মনসিংহে আব্বুর এক বন্ধুর বাড়িতে উঠতাম। দোতলা বাড়ির সামনে বড় রাস্তার ওপারে দেখা যেত ব্রহ্মপুত্র নদী। আব্বুর সাথে দেখা করার নির্ধারিত সময় থাকত বিকেলের দিকটাতেই তাই অনেক সময় সন্ধ্যায় ঢাকায় ফেরার ট্রেন ধরা যেত না। রাতে আমরা এখানে থেকে যেতাম। ময়মনসিংহ কারাগারে একবার অবাক করা এক মজার ঘটনা হলাে। আব্দুর সাথে দেখা করতে গেছি। প্রতিবারের মতাে জেলার সাহেব রিতি আর আমাকে ডেকে কথা বলেন। তারপর আব্দু ভেতর থেকে এলে আব্দুর অনুমতি নিয়ে। আমাদের দুই বােনকে নিয়ে দুজন সেপাইসহ ভিতরের দিকে রওনা হলেন। কারাগারের ভেতরে ঢোকার মূল ফটকের তালা খুলে দেওয়া হলাে। অজানা বিস্ময় নিয়ে আমরা দুই বােন ভেতরে ঢুকলাম। ঝকঝকে তকতকে সাজানাে চারদিক বড় বড় গাছ কিন্তু মাটিতে একটা পাতাও নেই। বাইরে থেকে দেখা উঁচু প্রাচীরের ভেতরের দিকটা একেবারেই অন্যরকম অনেকটা পথ হেঁটে আমরা এসে দাঁড়ালাম একটা বড় লম্বা টিনের চালের ঘরের সামনে। ঘরের ভেতরে হাসপাতালের ওয়ার্ডের মতাে দুই দিকে অনেকগুলাে লােহার খাট পেতে রাখা। লােহার গরাদের দরজার বাঁ পাশের প্রথম খাটটি আব্বুর ঘরের মাঝখানে ধবধবে সাদা লাল ঝুটির একটি কাকাতুয়া পাখি বসে চা চ্যা করছে। আমাদের দুজনের সমস্ত নজর পাখিটার দিকে। কেউ একজন বললেন পাখিটা সম্ভবত কারাগারের ভেতরে পাওয়া গেছে। আমাদের দুজনকে দেখতে চারদিকে লােক জমে গেছে। এর কাছ থেকে ওর কাছে, সেখান থেকে আর একজনের কোলে। এইভাবে ফুলে ফুলে ভরা এক বাগানের সামনে এসে দাড়ালাম। জানলাম আব্দুর নিজ হাতে তৈরি। এ বাগান ১৯ আগস্ট আমার জন্মদিনের তারিখ ।
১৯৬৮ সালের এই দিনের তিনদিন পর। আমার আমরা আন্ধুর সাথে দেখা করতে গেছি। ওয়েটিং রুমের মােটা লােহার গরাদ ধরে রিতি আর আমি দাঁড়িয়ে আছি। দেখি আব্বুর হাতে টিনের কোটায় ছােট একটি গাছ । ওয়েটিং রুমে ঢুকে আমার সামনে গাছটি দিয়ে বললেন, ‘আমার রিমির জন্মদিনের জন্য এটা আব্দুর দেওয়া উপহার।’ এটি একটি ডালিম গাছ। আমি কত যত্ন করে সাবধানে গাছটি ঢাকায় নিয়ে এলাম। ‘৬৯ সালের শেষ দিকে সরকারি আদেশে আব্বকে ময়মনসিংহ কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত করা হলাে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাথে এই আমার প্রথম পরিচয়। এই বছরেরই অক্টোবর মাসে আমার নানির শরীরের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। আম্মা নানিকে মগবাজার থেকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আম্মার আবেদনের জবাবে জানানাে হলাে আল্লু নানিকে দেখতে প্যারােলে মুক্ত হয়ে এক ঘণ্টার জন্য বাসায় আসতে পারবেন। বিকেল থেকেই বাসায় লােক আসতে শুরু করল। ঢাকায় উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন এসে অপেক্ষা করতে থাকলেন। আব্বু আসার আগে পুরাে বাড়িটা পুলিশ ঘিরে ফেলল। নানিকে দেখার পাশাপাশি আব্দু দলীয় লােকজনদের সাথে কথা বলে নিলেন। তারপর ফিরে গেলেন। নানির অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানাে হলাে। নভেম্বর মাসের ৪ তারিখ দুপুরে নানি মারা গেলেন।” তাজউদ্দীন ও অন্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা চলতে থাকে। তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া ও দৈনিক ইত্তেফাক আওয়ামী লীগের ৬ দফা সমর্থনে এগিয়ে আসে। ১০ মে মানিক মিয়া। দৈনিক ইত্তেফাকে ‘মােসাফির’ নামে রাজনৈতিক মঞ্চ কলামে ৬ দফার সমর্থনে ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কলাম লেখেন। পরবর্তী সময়ে পূর্বপাকিস্তানে রাজনৈতিক নিপীড়ন চরম আকার ধারণ করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করা ও আনুষঙ্গিক ঘটনাবলি এদেশের মানুষের কাছে রাজনৈতিক নিপীড়নের চরম দৃষ্টান্ত রূপে অনুভূত হয়।
‘৬৮ সালের নভেম্বরে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শহর এবং গ্রামের শ্রমিক-কৃষক ও নিম্ন-আয়ের পেশাজীবীসহ বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে অন্তত একটি সাধারণ দাবি আইয়ুবের পতনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পাকিস্তানের সকল অংশের মানুষ একযােগে পথে নামেন। তবে শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক এবং সাধারণভাবে নিম্ন ও মধ্য আয়ের পেশাজীবীদের মধ্যে। আন্দোলন ক্রমাগতভাবে শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামােয় পূর্ববাংলার জাতিগত নিপীড়ন ও বঞ্চনা এবং তার বিপরীতে ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামসহ পরবর্তী বিভিন্ন পর্যায়ে গড়ে ওঠা স্বকীয় সত্তার বােধ উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ প্রভাব রেখেছিল। বস্তুত, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা-পরবর্তীকালের সর্ববৃহৎ গণজাগরণ। আটষট্টির ছাত্র অসন্তোষ গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘােষিত গভর্নর হাউস ঘেরাও ও পরবর্তী দিনগুলাের কর্মসূচির মাধ্যমে। ৬ ডিসেম্বর জুলুম প্রতিরােধ দিবস’ পালনের জন্য মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), তােয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন এবং আবদুল হকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি যৌথ কর্মসূচির অংশ হিসেবে পল্টন ময়দানে এক জনসভার আয়ােজন করে। জনসভার পর একটি বিরাট মিছিল গভর্নর হাউস ঘেরাও করে। সেখানে জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সূত্র ধরে মওলানা ভাসানী পরদিন ঢাকা শহরে হরতাল আহবান করেন। ৮ ডিসেম্বর ভাসানী ও মােজাফফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন দুই ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, পিপল্স পার্টি, নেজামে ইসলামসহ প্রধান বিরােধী দলসমূহের ডাকে সমগ্র পূর্ববাংলায় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। ১০ ডিসেম্বর ছয় দফাপন্থি আওয়ামী লীগ আহুত ‘নির্যাতন প্রতিরােধ দিবস’ জোরেসােরে পালিত হয়।
১৪ ডিসেম্বরে ভাসানী ন্যাপের পক্ষ থেকে ঘােষণা করা হয় ঘেরাও আন্দোলনের কর্মসূচি। সেই অনুযায়ী ২৯ ডিসেম্বর পাবনার ডিসির বাড়ি ঘেরাও করার মাধ্যমে ঘেরাও আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ‘৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ), পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ)-এর নেতৃবৃন্দ ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে এবং তাদের ১১ দফা কর্মসূচি ঘােষণা করে। ১১ দফার মধ্যে ‘৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ৬ দফার সাথে ছাত্র সমস্যাকেন্দ্রিক দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থ সংক্রান্ত দাবিসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বস্তুত ১১ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্র নেতৃবৃন্দ যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা ছিল অত্যন্ত সময়ােপযােগী এবং এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই গুরুত্বপূর্ণ বিরােধী দলগুলাের মধ্যে একটি আন্দোলনগত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া এসময় থেকেই শেখ মুজিবের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি প্রাধান্য পেতে শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-সহ ছাত্র সংগ্রাম কমিটির পূর্ব বাংলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উনসত্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । ১১ দফা কর্মসূচি ঘােষিত হওয়ার পরপরই ৮ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও মােজাফফর ন্যাপসহ আটটি রাজনৈতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ডেমােক্রাটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক)। তারা ফেডারেল পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার, প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালী খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দাবি করে এবং দাবিগুলাে বাস্তবায়নের পক্ষে গণআন্দোলন জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ‘ডাক’ভুক্ত উগ্র ডানপন্থী কয়েকটি সংগঠন ছাত্র সংগ্রাম কমিটির দেওয়া ১১ দফা কর্মসূচিকে সমর্থন করতে অস্বীকার করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দোলন ক্রমশ দানা বেঁধে ওঠে এবং ১১ দফার চেতনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
এমনকি সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠন এনএসএফ-এর। একটি অংশও তাদের সংগ্রামী ২২ দফা কর্মসূচি নিয়ে প্রকাশ্যে সরকারবিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সরকারি নিপীড়নের প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসভা ও প্রতিবাদ মিছিলের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। এ মিছিলে পুলিশের গুলিতে মেনন গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম নেতা আসাদউজ্জামান নিহত হলে গণজাগরণ রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। ২৪ জানুয়ারি গুলিতে নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর এবং ছুরিকাঘাতে রুস্তম নিহত হলে ঢাকার পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শহরের নিয়ন্ত্রণভার সেনাবাহিনীর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয় এবং অনির্দিষ্ট কালের জন্য সান্ধ্য আইন বলবৎ করা হয়। পরদিন সেনাবাহিনী ও ইপিআর-এর বেপরােয়া গুলিতে ঢাকার নাখালপাড়ায় আনােয়ারা বেগম ঘরের ভেতর বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানাের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলে তার প্রতিক্রিয়া হয় তীব্র । ‘৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। পড়ন্ত বিকেলে তাজউদ্দীনের আহমদের বাড়ির সামনের পাের্চের নিচে একটি বেবিট্যাক্সি এসে থামল বেবিট্যাক্সি থেকে নামলেন তাজউদ্দীন। দীর্ঘ কারাবাসের পর তিনি ঘরে ফিরলেন। বাড়িটি আবার সরগরম হয়ে উঠল। ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক বন্দি অবস্থায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গুলিতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যু সংবাদে পরিস্থিতি এমন উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠে যে, বিকেলে মওলানা ভাসানী লক্ষাধিক লােকের জনসভায় দু-মাসের মধ্যে ১১ দফার বাস্তবায়ন এবং সকল রাজবন্দির মুক্তি দেওয়া না হলে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার ঘােষণা দেন। তিনি আরও বলেন, প্রয়ােজন হলে ফরাসি বিপ্লবের মতাে জেলখানা ভেঙে শেখ মুজিবকে ছিনিয়ে আনা হবে।
সভাশেষে জনতা মন্ত্রীদের ঘরে অগ্নিসংযােগ শুরু করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা নিহত হলে ক্রুদ্ধ ও ভাবাবেগে আপ্লুত হাজার হাজার ছাত্র-জনতা সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে। উনসত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার বিরােধিতায় নতুন মাত্রা যােগ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে অধ্যাপক আবদুল হাইয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করা হয়। গণঅভ্যুত্থানের প্রবল চাপে আইয়ুব খান ঘােষণা করেন। যে, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। একই দিন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তগণ এবং নিরাপত্তা আইনে আটক ৩৪ জন নেতা মুক্তি পান। গণতন্ত্রের দাবিতে স্বৈরশাসন বিরােধী এ সংগ্রামে গ্রাম-গঞ্জের খেটে খাওয়া মানুষ তখন শুধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারণ করেই থেমে থাকেনি, বরং নিজ নিজ ক্ষমতা বলয়ে অধিষ্ঠিত শােষক শ্রেণি বা তাদের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও সােচ্চার হয়ে ওঠে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, বহু স্থানে কৃষকেরা ছাত্রদের সহযােগিতায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বহু স্থানে ছাত্ররা কৃষকদের সহযােগিতায় নায়েব, তহশিলদার, পুলিশ, দারােগা, সার্কেল অফিসারদের বিচার করে গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘুরিয়েছে। ঘুষ হিসাব করে ফেরত নিয়েছে, জরিমানা করেছে, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের পদত্যাগ করিয়েছে, বেশ্যাবাড়ি তুলে দিয়েছে, মদ-গাঁজার। দোকান ভেঙ্গে দিয়েছে, চোর-ডাকাতদের শায়েস্তা করেছে।
এছাড়া শহরাঞ্চলে ক্ষমতা অপব্যবহারকারী সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রকাশ শারীরিক আক্রমণ বা নথিপত্রাদি তছনছ এবং অফিসে অগ্নিসংযােগও করে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের পেশাজীবীরা তাদের দীর্ঘদিনের অপূর্ণ দাবি-দাওয়া উত্থাপন করেছেন এবং রাজপথে নেমে মিছিলে উচ্চকিত হয়েছেন, হাজার হাজার শ্রমিক তাদের ন্যূনতম অধিকার আদায় করার লক্ষ্যে ঘেরাও আন্দোলনকে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার ৬ দিন পরেই, ১৮ ফেব্রুয়ারি, রওনা দিলেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডির পথে, সেখানে অনুষ্ঠিত আসন্ন গােলটেবিল বৈঠকের প্রস্তুতি কমিটির সভায় যােগ দিতে গােলটেবিল বৈঠকে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা ভবিষ্যৎ নির্বাচনের পরিকল্পনা ও শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নিয়ে আলােচনা করবেন। রাওয়ালপিন্ডি রওনা দেওয়ার আগে তিনি ঢাকায় কুর্মিটোলার সেনানিবাসে কারাবন্দি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি প্রস্তুতি কমিটির সভায় যােগ দিতে যাচ্ছেন শেখ মুজিবের ইচ্ছানুযায়ী ও তার প্রতিনিধি হয়ে। এই সভায় যােগদানের নেপথ্য ইতিহাস হলাে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যখন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কারাগারে সাক্ষাৎ হয়, তখন আমীর-উল ইসলাম বলেছিলেন যে নিঃশর্তে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিলে গােলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগ যােগ দেবে না—এই প্রস্তাবটি প্রস্তুতি . কমিটিতে উত্থাপন করা যায়। পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট ও গােলটেবিল বৈঠকের সমন্বয়কারী নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানও বলেছেন, ঐ প্রস্তাব কমিটিতে আনতে বাধা নেই। কথাটি শুনে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, যে দলের প্রেসিডেন্ট ও জেনারেল সেক্রেটারি দুজনেই জেলে, তাদেরকে বাদ দিয়ে কী করে। গােলটেবিল হতে পারে? তিনি এই প্রশ্নটি উত্থাপন ও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব বাদে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের গােলটেবিলে যােগদানের অযৌক্তিকতা ও অসারতা যুক্তি ও প্রজ্ঞার সঙ্গে তুলে ধরার জন্য একজন প্রতিনিধি পাঠাবার কথা বললেন। তারপর একটু চিন্তা করে বললেন, দলের মধ্যে একজনই রয়েছে যে রাওয়ালপিণ্ডিতে দলের সুযােগ্য প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে।
সে হলাে তাজউদ্দীন যদি তাজউদ্দীন জেল থেকে ছাড়া পায়, সেই এই কাজটি করতে পারবে।’ আমীর-উল ইসলাম লক্ষ করলেন তাজউদ্দীনের মেধা, যােগ্যতা ও বিশ্বস্ততার প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের রয়েছে পরম আস্থা তারপর শেখ মুজিবের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি পাকিস্তানের পথে রওনা দিলেন। আমীর-উল ইসলাম তাকে শেখ মুজিবের মেসেজটি পৌছে দিলেন। প্রস্তুতি কমিটির মিটিংয়ে তাজউদ্দীন তার দল ও শেখ মুজিবের প্রতিনিধিত্ব করলেন তিনি প্রশ্ন তুললেন আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া গােলটেবিল বৈঠকের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে তিনি নিঃশর্তে তার মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি উত্থাপন করলেন শেখ মুজিবুর রহমান অবশেষে, তাজউদ্দীন আহমদের কারামুক্তির দশদিন পর, ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি লাভ করলেন। শেখ মুজিবুর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে আইয়ুব খান আহুত গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের কথা ঘােষণা করেন এবং শান্তি বজায় রাখার আহবান জানান অন্যদিকে মওলানা ভাসানী গােলটেবিল বৈঠককে প্রত্যাখ্যান করেন এবং উনসত্তরের গণজাগরণকে ‘জালেম’ ও ‘মজলুম’-এর মধ্যকার সংঘাত হিসেবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে prophet of violence হিসেবে পরিচিতি পান। গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারের মুখে টিকতে না পেরে শেষপর্যন্ত ২৫ মার্চ পাকিস্তানের।
“লৌহ মানব’ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সারা দেশে নতুন করে জারি হয় সামরিক শাসন, তবে প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন এবং অচিরে দেশে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা চালু করার দাবি স্বীকৃত হয়। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণের ফলে আমলা, পুলিশ ও মিলিটারি সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে আগে যে ভীতি ছিল তা বহুলাংশে হ্রাস পায়, তাদের মর্যাদা ও গুরুত্ব জনচেতনায় হ্রাস পায়। এ ছাড়া গ্রাম ও শহরাঞ্চলে শ্রেণি চেতনার উন্মেষ এবং শ্রেণি সংগ্রামের আংশিক বিকাশ সাধিত হয়। পাশাপাশি উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করার মতাে পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে এই সময়টিতে তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে ঘনঘন যেতেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দীনের সঙ্গে আলাপ-পরামর্শ করেই তিনি দলীয় প্রধান হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘােষণা করতেন। তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ওপর শেখ মুজিবের ছিল গভীর আস্থা। জোহরা তাজউদ্দীনকে ছােট বােনের মতােই তিনি স্নেহভরে লিলি (জোহরার ডাকনাম) বলে সম্মােধন করতেন। তাজউদ্দীন ঘুমাতেন খুব কম এবং প্রায়ই রাত জেগে দলীয় বিবৃতি এবং সূক্ষ্ম রাজনৈতিক পরিকল্পনাগুলাে প্রণয়ন করে প্রাঞ্জল ভাষায় ঢেলে সাজাতেন। তার খাটুনির মাত্রা বেশি হলেই শেখ মুজিব গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লিলিকে বলতেন, ‘লিলি, তাজউদ্দীনের দিকে খেয়াল রেখাে, ওকে ছাড়া কিন্তু সব অচল।’
শেখ মুজিব যখন তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন তাজউদ্দীনের মেয়ে শারমিন ও সিমিন ‘মুজিব কাকু’ বলে দৌড়ে তার কাছে ছুটে যেতেন। তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদ তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব আমাদের সঙ্গে টুকিটাকি কথা বলতেন এমন উষ্ণ স্বরে যে তাকে ভালাে না, বেসে পারা যেত না। নিজ দলের নেতা ও কর্মীরা ছাড়াও তাজউদ্দীনের বাড়িতে অন্যান্য দলের নেতা ও কর্মীদের সমাগম হতাে জোহরা তাজউদ্দীন ট্রেতে চা-নাশতা সাজিয়ে দিতেন আর সিমিন ও শারমিন উৎসাহভরে সেগুলাে পরিবেশন করতেন কাজের লােকের বদলে প্রায় সময়ই এ দায়িত্বটি জোহরা তার দুই মেয়ের ওপরই তুলে দিতেন।
মায়ের মৃত্যু
‘৭৯ সালের ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়ি দরদরিয়া থেকে সংবাদবাহক বয়ে আনলাে এক মর্মান্তিক সংবাদ, তাজউদ্দীনের মা মেহেরুননেসা খানম মৃত্যুবরণ করেছেন। সারা বাড়িতে নেমে এলাে শােকের ছায়া তাজউদ্দীন সেদিন ঢাকার বাইরে রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঢাকায় ফিরে দরদরিয়া যাওয়ার জন্য রেলস্টেশনের পথে রওনা হলেন। গভীর রাতে শ্রীপুর রেলস্টেশনে নামলেন। তখন প্রচণ্ড ঝড় চলছিল রিকশা বা গরুর গাড়ি কিছুই পাওয়া গেল না। যানবাহনের জন্য ভােররাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কিন্তু তাজউদ্দীন এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে নারাজ সিদ্ধান্ত নিলেন পাঁচ মাইল হেঁটেই পাড়ি দেবেন পায়ে হেঁটে ভােরে বাড়ি পৌছলেন। দক্ষিণ কোঠাবাড়ির ঘরে মায়ের শেষ শয্যা। এই ঘরটিতেই ডাকাতরা যখন তার বাবার মাথা লক্ষ করে কুড়ালের কোপ বসাতে যায় তখন তার মা হাত বাড়িয়ে কুড়ালটি ধরে ফেলেছিলেন। এর ফলে তার হাতের মাঝখানের আঙুলটি টুকরাে হয়ে পড়ে যায় স্বামী প্রাণে বেঁচে গেলেন। মাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা ছেলের মতাে কাদছিলেন তাজউদ্দীন তবু তিনি কর্তব্যপালনে সজাগ থাকলেন। মায়ের জন্য কবর খোড়া, তার জানাযা থেকে শুরু করে কবর দেওয়া পর্যন্ত সব কাজেই তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন আমবাগানে ছাওয়া বৃষ্টিস্নাত দূর্বাঘাসের আচ্ছাদনে ঢাকা পারিবারিক গােরস্তানে বাবা মৌলবি মুহাম্মদ ইয়াসিন খানের কবরের পাশেই মায়ের শেষ শয্যা পাতা হলাে। মাকে কবর দেওয়ার পর মায়ের ঘরটির সামনে বসে অঝাের ধারায় কাঁদলেন তিনি।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ – স্বকৃত নোমান – উৎস প্রকাশন, ৩ নভেস্বর ২০১৫