শৈশব-কৈশাের ও শিক্ষা জীবন
শৈশব-কৈশােরে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন দায়িত্বশীল, শান্ত, সংযমী, মিতভাষী ও স্নেহপরায়ণ। মধুর স্বভাব ও চারিত্রিক গুণাবলির কারণে তিনি ছিলেন সবার নয়নের মণি। বাল্যকাল থেকেই গাছপালার পরিচর্যা খুব পছন্দ করতেন। গরু বাছুরেরও দেখাশােনা করতেন দায়িত্ব সহকারে। তার প্রিয় মিষ্টি ছিল গুড়। ব্রিটিশ আমলে হিন্দু-মুসলিম সবার মধ্যেই ধুতি পরার রেওয়াজ ছিল। তাজউদ্দীন বাল্যবয়সে ঘরে ধুতি পরতেন। তার বাবা স্কুল-কলেজের শিক্ষা অপছন্দ করতেন। তার ইচ্ছে ছিল পুত্রকে কোরানে হাফেজ বানাবেন। তাই তার তত্ত্বাবধানে নিজবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত মক্তবে তাজউদ্দীন আহমদ বাল্যবয়সেই এগারাে পারা কোরআন মুখস্থ করেন। পরে মুখস্থ করেন পুরাে কোরআন শরিফ। শুক্রবার লুঙ্গি ও শার্ট পরে মসজিদে জুমার নামাজে যেতেন। ছেলে ধর্মীয় ও সাধারণ সব শিক্ষায় পারদর্শিতা লাভ করুক—এটাই ছিল তার মায়ের ইচ্ছা। মায়ের প্রচণ্ড ইচ্ছা ও আগ্রহের কারণে তাজউদ্দীন স্কুলে ভর্তি হন বাড়ি থেকে দেড়মাইল দূরে হাফিজ বেপারির বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ভুলেশ্বর প্রাইমারি স্কুলে। বড়বােন শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি বেড়াতে এলে তাজউদ্দীন তার। পাঠ্যপুস্তক থেকে ছড়া, গল্প, ইত্যাদি আগ্রহভরে পড়ে শােনাতেন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে তাজউদ্দীন পড়তেন সচিত্র শিশুপাঠ। বইটির একটি কবিতা তার সঙ্গে তার বড়বােনও মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। তাজউদ্দীন যখন সুর করে কবিতাটি পড়তেন, তার বড়বােন যােগ দিতেন উৎসাহভরে। কবিতাটির কিছু অংশ উল্লেখ করা যেতে পারে— পথের ধারে পুকুর পাড়ে ভিখারিদের মেয়ে সারাটি দিন থাকত বসে পথের দিকে চেয়ে কেউ বা দিত পয়সা কড়ি। কেউ বা দিত চাল কেউ বা কেবল দেখে যেত। কেউ বা দিত গাল।
ধুলাে দিয়ে পালিয়ে যেত দুষ্ট ছেলের দল
নীরবে তার গালটি দিয়ে পড়ত চোখের জল ।
রাজার ছেলে সেই পথেতে যেতেন ঘােড়ায় চড়ে
একদিন তার ছুটল ঘােড়া তিনি গেলেন পড়ে।
হাঁ করে সব লােকগুলাে দেখল শুধু চেয়ে।
আহা বলে দৌড়ে এল ভিখারিদের মেয়ে।
কেঁদে বলে হায় কী হবে কপাল গেছে কেটে
নিজের কাপড় ছিড়ে মাথায় পট্টি দিল এটে।
আঁজলা ভরে পুকুর হতে জল দিল সে ঢেলে
রাজার ছেলে সুস্থ হলেন বসলেন আঁখি মেলে।
[সূত্র- তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা, শারমিন আহমদ) ভুলেশ্বরে পড়াকালীন প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন প্রথম স্থান লাভ করে। পুরস্কার হিসেবে পান ৯ পয়সার কলম ও দেড় পয়সার দোয়াত। দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হলেন। এবারে প্রথম পুরস্কার পান আল্লাহর ৯৯ নামের একটি বই এবং আলীবাবা ও চল্লিশ চোরের একটি বই। তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ প্রাইমারি স্কুলে। তাজউদ্দীনের সবচেয়ে বড় বােন সুফিয়া খাতুনের শ্বশুর আহম ফকিরের বাড়ি তরগাঁওয়ে দু-বছর থেকে কাপাসিয়া প্রাইমারি স্কুলে তিনি লেখাপড়া করেন। এই সময়ের একটি ঘটনা। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মফিজউদ্দীন আহমেদ। শারমিন আহমদের ‘তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা’ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, একদিন প্রধান শিক্ষক তাজউদ্দীনের ক্লাসে ঢুকলেন। দেখলেন তিনি কাঁদছেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন তিনি। তাজউদ্দীন বললেন, এবসেন্ট ছিলাম, তাই স্যার মেরেছে। সেই ক্লাসের শিক্ষক দেবেন্দ্রবাবু ছাত্রদের মারতেন। প্রধান শিক্ষক কমনরুমে দেবেন্দ্রবাবুকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন তাজউদ্দীনকে কেন মেরেছেন। তিনি উত্তর দিলেন, এবসেন্ট করেছে তাই মেরেছি। প্রধান শিক্ষক বললেন, এই সামান্য কারণে কেন মেরেছেন? এরপর মফিজউদ্দীন শিক্ষকদের বললেন, আপনারা তাজউদ্দীনকে মারবেন না। সে হলাে গ্রেট স্কলার। সে হলাে রত্ন।
তার মাঝে আমি বিরাট ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষায় তিনি ঢাকা জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভর্তি হন কালীগঞ্জ থানার নাগরীর সেন্ট নিকোলাস ইন্সটিটিউশনে। খ্রিস্টান মিশনারিগণ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। সেন্ট নিকোলাস স্কুলে তার মেধা দেখে শিক্ষকরা প্রশংসা করতেন। তিনি ক্লাসে প্রথম হতেন। শিক্ষকগণ তাকে ঢাকায় ভালাে স্কুলে ভর্তি হতে পরামর্শ দেন। ক্লাস এইটের মাঝামাঝিতে এসে ভর্তি হন ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাই স্কুলে। থাকতেন ডাফরিন মুসলিম হােস্টেলে। তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র মহম্মদ ওয়াহিদুজ্জামানের সঙ্গে একই কক্ষে থাকতেন। হােস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন অম্বর আলী। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবদুর রহমান এবং অঙ্ক শিক্ষক ছিলেন শাহাবুদ্দিন। ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষার আগে মুসলিম বয়েজ হাইস্কুল ত্যাগ করে ঢাকার প্রাচীনতম বিদ্যালয় সেন্ট গ্রেগরীজ হাই ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হন। ভর্তি পরীক্ষায় তিনি ইংরেজিতে ৮০ নম্বর পেয়েছিলেন। এ-স্কুলের ইংরেজির বিখ্যাত শিক্ষক ছিলেন এস দাশগুপ্ত। ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগের দিন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বক্তৃতা শুনতে যান তাজউদ্দীন। সেই সময় বাংলা প্রদেশে মাত্র একটাই বাের্ড-কলকাতা বাের্ড। এই বাের্ড থেকে তাজউদ্দীন পরীক্ষায় ১২তম স্থান লাভ করেন। তার এই কৃতিত্বে ঢাকা শহরে আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল সেই সময়। সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে মুসলিম ছাত্র খুবই কম ছিল। তার মধ্যে তাজউদ্দীনের কৃতিত্ব এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল।
ম্যাট্রিক পাসের পর এক বছর তিনি লেখাপড়া করেননি। ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে শিক্ষা বর্জন করে সকল প্রগতিশীল ছাত্র। কারণ ‘৪২ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়। ব্রিটিশ সরকার সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং চালু করে। তাজউদ্দীন আহমদ সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং গ্রহণ করেন। এসময় তিনি ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে পালন করেন নিরাপত্তার দায়িত্ব। এই কাজের জন্য প্রত্যেক রাতে সম্মানী পেতেন ৮ আনা। এই সিদ্ধান্তে তার মা খুব মর্মাহত হয়ে তাকে খুব বকাঝকা। করেছিলেন। পড়ালেখা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তে মা এতই মর্মাহত হয়েছিলেন যে ছেলেকে তিনি বলেছিলেন, ‘তাজউদ্দীন, তুই পড়বি নাকি আমি দা দিয়ে কোপ দিয়ে নিজে মরে যাব? তাজউদ্দীন তার প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন, পাশাপাশি মায়ের মনও রক্ষা করেছিলেন। এরপর ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন তাজউদ্দীন ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তিনি সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৪ সালে ‘ঢাকা মুসলিম লীগ সম্মেলন, কৃষ্ণনগর ছাত্রলীগ সম্মেলন, ১৯৪৬ সালের নির্বাচন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ—এসব ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকায় তার পক্ষে নিয়মিত ক্লাস করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৬ সালে তার আইএ পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। কিন্তু তা দেওয়া হলাে না। তিনি ঢাকা কলেজে নন-কলেজিয়েট হলেন। লেখাপড়ার প্রতি তার অমনােযােগিতা। দেখে শিক্ষকরা বলতেন, “তুমি তাে পরীক্ষায় ভালাে করবে না।’ উত্তরে তিনি বলতেন, ভালাে করার প্রয়ােজন নেই।
রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে ঢাকা কলেজের ক্লাসগুলােতে তাজউদ্দীন নিয়মিত উপস্থিত থাকতে পারেননি। ঢাকা কলেজ যেহেতু সরকারি কলেজ ছিল এবং অন্যান্য সরকারি কলেজের মতােই উপস্থিতির ব্যাপারে এই কলেজের নিয়মকানুন ছিল কড়া সেহেতু বেসরকারি সলিমুল্লাহ কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বাের্ডে চতুর্থ স্থান লাভ করেন। কিন্তু পরে তিনি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে বিএ (অনার্স) পাস করেন তাজউদ্দীন। যুক্তফ্রন্ট ইলেকশন ওই বছরের ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের ইলেকশনে জেতার পর ফজলুল হক হলের ছাত্ররা তাকে বিশাল সংবর্ধনা দেয়। হলের ভেতরের দিকে এক সুন্দর বাগান ছিল, সেখানেই তারা তাকে মাথায় তুলে আনন্দ প্রকাশ করে। রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়ার পর এমএ পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯৫৪ সালে এমএলএ থাকাবস্থায় তিনি নিয়মিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ক্লাস করতেন। সাফল্যের সঙ্গে আইনের সমাপ্ত পেপার শেষ হলেও একটি পেপার রাজনৈতিক কারণে পরীক্ষা দেওয়া যায়নি। পরে জেলে থাকাবস্থায় শেষ পরীক্ষা দিয়ে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন।
ছাত্রজীবনে মানুষের কাছে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তাজউদ্দীন চিন্তাশীল, সমাজসচেতন ও রাজনীতিসচেতন ছিলেন এবং সমাজকল্যাণমূলক কাজে সক্রিয় ছিলেন। সারা জীবনই অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি ইত্যাদি বিষয়ের বই ও পত্রপত্রিকা পড়তেন এবং জ্ঞানকে সর্বজনীন কল্যাণে কাজে লাগাবার কথা ভাবতেন। ভালাে ছাত্রেরা সাধারণত আত্মেদরসর্বস্ব হয়ে থাকে, তাজউদ্দীনের মধ্যে সেরকম প্রবণতা ছিল না। ১৯৪৩-এর মন্বন্তর তার মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। আজীবন তিনি অনাহারক্লিষ্ট, নিপীড়িত মানুষদের কল্যাণে চিন্তা ও কাজ করেছেন। ১৯৫০-এর দশকের কথা। তার এলাকার এক দফাদারের পুত্র, ১৫ বছরের কিশাের, ঘটনাক্রমে বন্দুকের গুলিতে আহত হয়। তাজউদ্দীন ঢাকার হাসপাতালে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং নিজের দেহ থেকে তার জন্য রক্ত দেন; যদিও ছেলেটি বাঁচল না। এই মৃত্যুও তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল।
আরেকটি ঘটনা । তার গ্রামের এক বিধবা মহিলার দুই পায়ে মারাত্মক ঘা ছিল, যা ছিল ছোঁয়াচে রােগ। তার কাছে কেউ যেত না। তার পুত্র কাশেমও মায়ের কাছে। ঘেঁষত না। তাজউদ্দীন এই নারীকে সেবা-শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তুললেন। তাজউদ্দীনের কৈশােরে, গ্রামে প্রাইমারি স্কুলে হেঁটে যাওয়ার পথে ছয়টি খাল পড়ত। সহপাঠীদের নিয়ে গজারি কাঠ দিয়ে সেগুলােতে সঁকো তৈরি করলেন তাজউদ্দীন। সেই সময় গ্রামে প্রতিবছর বসন্ত রােগ হতাে। তিনি অক্লান্তভাবে রােগীদের সেবা করতেন। অনেককে চিকিৎসার জন্য ঢাকাতেও পাঠিয়েছেন। দরদরিয়া গ্রামের তাহের আলী ভিক্ষুককে সমাজকর্তৃক একঘরে অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন তিনি গ্রামের মহিম নাপিতকে শ্রদ্ধা করতেন। কারণ মহিম আঁতুড়ঘরে তার চুল কেটেছিল। আজীবন গ্রামের সঙ্গে তার যােগাযােগ ছিল। গ্রামের বয়ােজ্যেষ্ঠরা তাকে ‘স্যার’ বা ‘সাহেব’ বললে তিনি রাগ করতেন। তুই বা তুমি সম্বােধন আশা করতেন তিনি এমনই তার বিনয় বড় হতে হলে মানুষকে বুঝতে হয়, মানুষের কাছে যেতে হয়। বস্তুত স্কুল-কলেজে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পাঠশালা থেকে তিনি বাস্তব শিক্ষা গ্রহণ করেন, যাতে ভবিষ্যতে বড় কিছু করতে পারেন। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা করেছেন। গরিব-অসহায় মানুষের প্রতি নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন। ‘৪৭ সালের ১ অক্টোবর সলিমুল্লাহ এতিমখানায় ছাত্র-ছাীদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। কাপাসিয়া থানায় ছিল বিস্তৃত গজারি বন, এখনাে আছে। রাজেন্দ্রপুর বনবিভাগের অধীনে কাপাসিয়া বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এলাকার লােকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে নির্যাতন করত। বনবিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তিনি বন বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করতেন।
অনেক সময় এলাকার লােকজন নির্যাতন থেকে মুক্তি পেত। এই কারণে কাপাসিয়া অঞ্চলে ছাত্র অবস্থাতেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বন কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছিল। তার পক্ষে উকিল ছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ, আতাউর রহমান খান। অন্যান্য আসামিসহ তাজউদ্দীন মামলায় জামিন পেলেন। কিন্তু ১৯৫০ সালের ৭ জুলাই মহকুমা হাকিম তাদের জামিন বাতিল করে কারাগারে প্রেরণ করেন। তাজউদ্দীন নিজ প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠা ও সংস্কার করেন। সেখানে তিনি একাডেমিক শিক্ষা এবং এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিক্ষক ও ছাত্রদের সঙ্গে আলােচনা করতেন। এমনিভাবেই তিনি নানা অভিজ্ঞতা লাভ করছিলেন। এসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার ভবিষ্যৎ জীবনের পাথেয় ছিল। হিংসা, বিদ্বেষ, দুর্নীতি, মিথ্যা ভাষণ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ঢাকায় পড়াশােনার সময় তাজউদ্দীন পড়াশােনার পাশাপাশি রাজনীতিও করতেন। কলতাবাজারে মুসলিম লীগের অফিস ছিল। নিয়মিত তিনি মুসলিম লীগ অফিসে যেতেন। কোর্টে যেতে পছন্দ করতেন এবং কোর্টে উকিল ও জজদের মধ্যে আলােচনা শুনতেন। বন্ধুরা তার কোর্টে যাতায়াত দেখে জিজ্ঞেস করতেন, ‘তুমি কি উকিল হবে?’ তাজউদ্দীন বলতেন তিনি উকিল হবেন। ক্লাস নাইন থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। লেখাপড়া করতেন কম। কিন্তু ছাত্র হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তার মেধাশক্তি দেখে ঢাকার শিক্ষকরাও তার প্রশংসা করতেন। সহপাঠীরা বলতেন, এরকম মেধাবী ছাত্র তারা আর দেখেনি। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ দেখেছেন তাজউদ্দীন। দেখেছেন কীভাবে মানুষ কুকুর-বিড়ালের মতাে মরে পথে-ঘাটে পড়ে থাকে। দুর্ভিক্ষের হাহাকার তার অন্তরকে দারুণভাবে আঘাত করে। তিনি মনে করতেন দেশ স্বাধীন হলে, দেশ শাসনের অধিকার পেলে দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ করা সম্ভব হবে। ‘৪৪ সালে চালের মণ ১০ টাকায় ওঠে।
তাজউদ্দীন গ্রামের গরিব লােকদের খাদ্যাভাব দেখে বন্ধুদের। নিয়ে ‘ধর্মগােলা’ নামে খাদ্যভাণ্ডার গঠন করেছিলেন। ফসল ওঠার সময় ধনী। কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করে ধর্মগােলায় জমা করা হতাে এবং আশ্বিন-কার্তিক মাসে দুর্ভিক্ষের সময় তা থেকে অনাহার-অর্ধাহারক্লিষ্ট মানুষদের। চাল দেওয়া হতাে। কৈশােরকাল থেকেই সর্বজনীন কল্যাণ ও উন্নত সমাজ গড়ে তােলার প্রতি তার ছিল অদম্য স্পৃহা। গ্রামে পড়ার সময় তিনি ছিলেন গ্রাম অঞ্চলের মানুষদের একান্ত আপনজন। তাদের সুখে-দুঃখে তিনি পাশে দাঁড়াতেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। দরদরিয়া গ্রামের আবদুল মজিদ, তাজউদ্দীনসহ অনেকে বাঘ শিকারী মনিরউদ্দিন বেপারির সঙ্গে জঙ্গলে যেতেন। একদিনের কথা শিকারি গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে বাঘ তাদের দিকে। দৌড়াচ্ছে, প্রাণের ভয়ে সবাই দৌড়ে পালাচ্ছে, কিন্তু তাজউদ্দীন দৌড়ালেন না । মজিদকেও দৌড়াতে দিলেন না। বললেন, ‘ভয় পেয়াে না, বাঘের বিরুদ্ধে লাঠি নিয়ে দাঁড়াও। নদীতে সেই সময় কুমিরের উপদ্রব ছিল, অথচ তাজউদ্দীন নদীতেই গােসল করতেন।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ – স্বকৃত নোমান – উৎস প্রকাশন, ৩ নভেস্বর ২০১৫