You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২১শে মে, বৃহস্পতিবার, ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

এলিসি প্রাসাদে গিসকার্ড

চূড়ান্ত সরকারি ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী মসিয়েঁ গিসকার্ডই অবশেষে এলিসি প্রাসাদে প্রবেশের ছাড়পত্র পেলেন। সর্বশেষ ভোট গণনার হিসেব অনুসারে তিনি পেয়েছেন ১ কোটি ৩৩ লক্ষ ১৪ হাজার ভোট আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রাঁসোয়া মিতেরাঁ পেয়েছেন ১ কোটি ২৮ লাখ ৪২ হাজার ভোট। ফ্রান্সের রাজনীতিতে এমন তীব্র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর হয়নি। সমাজতন্ত্রী নেতা ক্রাঁসোয়া মিতেরাঁ একবার দাঁড়িয়েছিলেন স্বয়ং দ্যগলেরই বিরুদ্ধে। তখন গলপন্থীদের ভীষণ প্রভাব। তবুও ভোট পড়েছিল অনেক মিতেরাঁর স্বপক্ষে! শতকরা চুয়াল্লিশ থেকে ছেচল্লিশে ভাগ। এবার তার জুটেছে ৪৯’৩ ভাগ ভোট। এবার বামপন্থীরা একজোট হয়ে নির্বাচনে লড়েছে। মিতেরাঁর সমাজতন্ত্রী দল ছাড়াও ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ছিল রেডিক্যাল বামপন্থীরা। ছিল সুদীর্ঘ ১৬ বৎসরের গলপন্থী শাসনের বিরুদ্ধে গঅসন্তোষ। তবুও মিতেরাঁ কুলিয়ে উঠতে পারলেন না। সন্দেহ এবং সংসার আকুল একটা বড় রকমের জনগোষ্ঠী গিসকার্ডের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।
যুক্তবামপন্থীদের প্রার্থী মিতেরাঁ জনসাধারণের সামনে রেখেছিলেন ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি। তাতে ছিল শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি, বাসস্থানের নির্মান পরিকল্পনা, ন’টি বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ এমনি আরো প্রগতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণের ওয়াদা। পক্ষান্তরে গিসকার্ড এর নিউ ট্রাস্টের স্লোগান। যে অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য অর্থমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার একজন প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে তাঁর দায়িত্ব কম ছিলনা সে সবকিছু ঝেড়ে মুছে ফেলে নতুন করে যাত্রা শুরুর আশ্বাস দিয়েছিলেন তার ভোটারদের কাছে। এছাড়া ছিল সমাজতন্ত্রী আর কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে নানা প্রকার কুৎসা প্রচার। এলিসি প্রাসাদে বসে এবার কিন্তু সত্যিই গিসকার্ডকে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হবে। পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলা তার পক্ষে খুব একটা সম্ভব হবেনা আর হলেও তা ফ্রান্সের জন্য ভাল ফল এনে দেবে না। মুদ্রাস্ফীতি, অবাধ পুঁজিবাদী শোষণ, নিম্ন মজুরি হার এবং ক্রমবর্ধমান সামাজিক অসন্তোষ মোকাবিলায় তাকে বাস্তব কর্মপন্থা খুঁজে বের করতে হবে। ভোটের ফলাফল যখন তারপর স্বপক্ষে ঘোষিত হয়েছিল তখন গিসকার্ড বলেছেন, ফ্রান্সের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে মিতেরাঁর একটা ভূমিকা রয়েছে। রাজনীতিক হিসেবে ফ্রান্সের রাজনীতিতে মিতেরাঁর ভূমিকা থাকবে এটা স্বাভাবিক কথা কিন্তু এমন একটা সময়ে গিয়ে বক্তব্য রেখেছেন, যার থেকে অনুমান করা হচ্ছে এলিসি প্রাসাদের ভবিষ্যৎ ’রাজদণ্ড’ বিরোধীদের একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনায় আগ্রহী নয়।
এছাড়া রয়েছে পার্লামেন্টে গলপন্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। গলপন্থীরা সে সুযোগ অবশ্যই গ্রহণ করবে। গিসকার্ডের মন্ত্রিসভায় তাই গলপন্থীদের একটা শক্তিশালী অবস্থান থাকবে। সবকিছু মিলিয়ে ট্রান্সলেট রাজনীতি আর পুরনো ধারায় বইবে বলে মনে হয় না। গলপন্থীদের যেমন তেমনি সমাজতন্ত্রী কমিউনিস্টদের সঙ্গে গিসকার্ডকে সমঝোতার মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে। আর সে প্রেক্ষিতে ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী শিবিরে ভাঙন ধরানোর একটা কূট-তৎপরতা চালানোর প্রচেষ্টা ও ডান-মধ্যপন্থীদের তরফ থেকে হতে পারে।
যাইহোক, ফ্রান্সের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিধারার দিকে শুধু ইউরোপেই নয় সমগ্র দুনিয়ার মানুষ কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকবে। আমরা ফ্রান্সের ভোটারদের মধ্যে আশা করব গিসকার্ড তার ওয়াদা অনুযায়ী নতুন করে যাত্রা শুরু করবেন। সেখানকার সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সুদুরপ্রসারী পদক্ষেপ গৃহীত হবে।

শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি

শিল্প মন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম গত পরশুদিন মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেছিলেন। সভায় ভাষণদানকালে শিল্পমন্ত্রী বলেছেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষিত জনশক্তি একটি পূর্ব শর্ত। সুতরাং বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে অবশ্যই দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। ক্যাডেটদের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয় বরং জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে জনগণের কল্যাণের জন্যই ক্যাডেটদের কাজ করতে হবে।
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে ইতি পূর্বে বহু কথা বলা হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজাতে হবে-একথা নেতৃবৃন্দ হরহামেশাই বলে থাকেন। কিন্তু আজ অবধি শিক্ষাব্যবস্থার সত্যিকারের রুপরেখা কি হওয়া উচিত এখন পর্যন্ত স্থিরীকৃত হয় নি। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ পাবে শীঘ্র বলে জানা গেছে। শিল্পমন্ত্রী তার ভাষণে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার প্রয়োজনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তা দেশের শিক্ষিত সমাজ বহুকাল পূর্ব থেকেই উপলব্ধি করেছে। এমনকি স্বাধীনতার পূর্বকালেও এ নিয়ে অনেক দাবি-দাওয়াও পেশ করা হয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা সেদিনের কর্তৃপক্ষরাও বহুবার বলেছেন। কিন্তু মূলতঃ তাদের সে সকল কথা ছিল দায় সারারই নামান্তর। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট তৈরীর জন্য গত বাহাত্তর সালের সেপ্টেম্বর মাসে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। প্রায় দেড় বছর সময় লেগেছিল রিপোর্ট প্রস্তুত করতে। এরপর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সরকারের নিকট রিপোর্টটি প্রেরন করা হয়। কিন্তু আজও তা অনুমোদন লাভ করেনি। স্বাধীনতার পর ২৯ মাস অতিবাহিত হতে চলেছে। অথচ এ পর্যন্ত শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের বাণী অবিরাম বর্ষিত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো সিদ্ধান্ত জনগণ জানতে পারছে না। এহেন দুরস্থার অবসান দ্রুত ঘটুক এটাই মানুষের কামনা। জাতীয় অর্থনীতির মেরুদন্ড শক্ত করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস পূর্ব শর্ত। এই সত্য কথাটা যদি সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন তাহলে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। সে কারণে প্রথমে যে কাজটি সম্পন্ন হওয়া দরকার তাহলো-শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবর্তন শিক্ষার্থীদের মৌলিক দাবি। এ দাবি বাস্তবায়ন কমিশনের রিপোর্টে রয়েছে বলে সবার বিশ্বাস। এছাড়া অন্যান্য কারিগরি পদ্ধতির পরিপূর্ণ বিকাশ ও ঘটবে কমিশনের রিপোর্টে। দেশের কৃষি, শিল্প ও অন্যান্য সেক্টরের উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকেও উপযোগি বা সম্পূরক হিসেবে তৈরি করতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে জ্ঞানার্জন আজ আর অতীত দিনের মত শুধু কবি-সাহিত্যিকবা কেরানি কুল হওয়ার জন্য নয়, বরং জ্ঞানার্জন আজ কৃষি, শিল্প ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বাস্তব অবদান রেখে যাবার নিমিত্তে। আমাদের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে বাস্তব চেতনার সংযোজন হয়েছে বলেই আমাদের বিশ্বাস। যত দ্রুত রিপোর্ট প্রকাশ পাবে ততোই শিক্ষাঙ্গনের হতাশা ক্রমান্বয়ে দূরীভূত হবে বলেও আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!