You dont have javascript enabled! Please enable it!

৩ রা নভেম্বর ৭৫ এর স্মৃতি

– ইকবাল রশিদ (সাবেক এয়ার ফোর্স অফিসার) (সাব-সেক্টর কমান্ডার সেক্টর -৬)

[৩ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখের পরিণতির কারণ ও পরবর্তি ফলাফলের একটি চিত্র নিম্নরূপ]

১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে জন্ম লাভ করে বাংলাদেশ নামের দেশটি। যে কয়েকটি মূলভিত্তির উপর নির্ভর করে দেশটির জন্ম হয়েছিল যা হল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র- এই সবগুলোর একটি মিশ্র সাম্যতা বজায় রাখা খুব কঠিন।কিন্তু মৌলিক নীতি হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্র। যদিও স্বাধীনতার পরে পরিস্থিতি খুব তিক্ত হয়ে ওঠে। ক্ষমতাসীন দল দুটি গ্রুপে ভেঙ্গে যায় এবং সেই সাথে ভঙ্গুর হয়ে যায় ভবিষ্যতের বাংলাদেশের মৌলিক ভিত্তি। ছাত্ররা দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে যায় এবং একে ওপরকে হত্যা করতে শুরু করে। এবং সকল ক্ষেত্রে সরকারের ব্যার্থতা মারাত্মক আর্থিক সংকটের সৃষ্টি করে। ( হয়ত এটা সদ্য স্বাধীন একটি দেশের জন্য স্বাভাবিক বিষয়।) এই পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সামরিক ও বেসামরিক ব্যাক্তিবর্গের মাঝে লুকিয়ে থাকা সুযোগসন্ধানীদের (স্লিপিং সেল) জেগে উঠতে সহায়তা করে। এদের মাঝে যারা পশ্চিমা শক্তির সমর্থক তারা একটি গ্রুপের সাথে যোগ দেয় ও তাদের সমর্থন দিতে শুরু করে।

হঠাৎ করে এক দলীয় শাসন চালু – যার সাথে মুক্তিযুদ্ধের মূল ধারা এবং স্বাধীনতার চেতনার বৈপরীত্য হওয়ায় স্বাধীন বাংলার জনক অজনপ্রিয় হতে থাকেন। এর ফলে স্বাধীনতাবাদী শক্তিগুলি জেগে ওঠে যাদের মাঝে ছিল এনএসএফ, যুদ্ধাপরাধি এবং সুপ্ত অশুভ শক্তিরা। একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে যখন একটি পরাজিত শক্তি একটি দেশ ছেড়ে চলে যায় তখন সে তার লগ স্টক এবং ব্যারেল  (অর্থাৎ তল্পিতল্পা সবকিছু) ছেড়ে যায় না। স্লিপার সেল বা সুযোগসন্ধানী শক্তিগুলোকে  ভবিষ্যতে ক্ষতি করার অভিপ্রায়ে পেছনে ফেলে রেখে যায়। পাকিস্তানও একই কাজ করেছে। এবং এরা বিহারী বা স্থানীয় বাহিনী নয়; এরা বেশিরভাগ ছিলেন বাঙালি – যাদের দীর্ঘ ২৫  বছর সময়কাল ধরে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরির কাজে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে, এবং এমনকি রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে তাদের পছন্দসই কাউকে সরকার গঠন করার জন্য কাজ করেছে। তারা তা করেছে সদ্য জন্ম লাভ করা একটি দেশ – বাংলাদেশে – যার অর্থণৈতিক অবস্থা ছিল বেপরোয়া। এই সুযোগসন্ধানী শক্তি (স্লিপার সেল) যে কেউ হতে পারে –  রাজনীতিবিদ, আমলা, এমনকি হতে পারে পাকিস্তানের প্রতি ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থার অনুগত সামরিক বাহিনীর কেউ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসার ও জওয়ান ছিলেন যারা স্বেচ্ছায় চাকরী থেকে চলে এসে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন, কিন্তু আরও অনেকেই ছিলেন যারা চাকরী ছেড়ে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে পারেনি বা যোগদান করেনি। মুক্তিযুদ্ধের পর এই দুই পক্ষ পরস্পরের বিরোধিতা করে এবং প্রশাসনিক ও দুর্বল নেতৃত্বের কারণে এই দূরত্ব আরও প্রশস্ত হতে থাকে। আমি উভয় পক্ষের কাউকে দোষ দেব না। সব মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে (আল্ট্রা প্রো লিবারেশন মাইন্ডেড)ধারণ করেনা এমনও হতে পারে আবার এমন কিছু মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক নিয়োগকৃত। আবার এমনও হতে পারে যারা অতোটা চেতনা ধারণ না করলেও একজন মুক্তপ্রান নিবেদিত যোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারতেন – এরকম শত শত দৃষ্টান্ত আছে। একারণেই খুব কম সংখ্যকই স্বাধীনতার বিরুদ্ধতা করেছে।

উদাহরণঃ একজন অফিসার মুক্তিযুদ্ধের সময় দিল্লীতে পোস্টেড ছিলেন। যখন সকল বাঙালি স্টাফ বাংলাদেশ সরকারের জন্য কাজ করছিল, তিনি পাকিস্তানিদের সর্বোত্তম সন্তুষ্টি লাভের জন্য কাজ করেন এবং তাকে সৌদি আরবে পদায়ন করা হয়। তুরস্কের বাঙ্গালী কর্মকর্তা একই অবস্থান গ্রহণ করেন, কিন্তু তাকে ফিরতি অফিসার হিসেবে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এবং ভেবে দেখুন যে, তাকে গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব দেয়া হয়, সম্ভবত এটা কি হতে পারেনা যে তিনি ঐ স্লিপিং সেল বা সুযোগসন্ধানীদের অন্যতম কেউ ছিলেন? হতে পারে এটা আপেক্ষিক বিষয়। পূর্ণ সুযোগসুবিধা নিয়ে অবসর গ্রহণের পরে তিনি অবসরপ্রাপ্ত সৈন্যদের নিয়ে দেশের প্রথম সিকিউরিটি কোম্পানি চালু করেন এবং এই কাজে তাকে এমন একজন জেনারেল সমর্থন করেছিল যিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিলেন। সেই সময়ে এই ধরনের সংস্থার অনুমতির পাওয়াটা ছিল একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ, যদি না আপনাকে আমলা, পুলিশ, গোয়েন্দা ইত্যাদির থেকে যথেষ্ট সমর্থন বা সহায়তা না করা হয়। তাহলে কল্পনা করুন কিভাবে এই সংগঠনটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে। এমন অনেক উদাহরণ আছে, শুধু কয়েকটি বলি।

১. ছুটি শেষে দুইজন অফিসারের একজন বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন এবং অন্যজন চাকরিতে ফিরে গিয়ে তার স্বাভাবিক কর্তব্য পালন শুরু করে। উভয়ই তাদের নিজস্ব পরিস্থিতিতে হয়ত সঠিক কাজ করেছেন। এটা আপেক্ষিক ব্যাপার। যা নির্ভর করে একজন কিভাবে সেটাকে দেখছেন। যিনি মুক্তিযুদ্ধে দিয়েছিলেন যদি দেশ স্বাধীন না হত তিনি হয় হতেন যুদ্ধাপরাধী। যাই হোক, এ সবই আপেক্ষিক !!

২. অনেকে ছুটিতে এসে আবার চাকরিতে ফিরে গেছেন। তারা অজুহাত দেখান, ‘আমি মুক্তিবাহিনীর কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি বা আমার বাবা-মা সমর্থন দেয় নাই – ইত্যাদি ইত্যাদি।

৩. সেই সময়ে এমন বাঙালি কর্মকর্তারাও ছিলেন যারা এমনকি বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে আলোচনাই করতে চাইতেন না। পরে এদের অনেকেই নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। কাকতালীয় বটে।

৪. বাংলার কর্মকর্তারা যারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ছিলেন তাদের সেই আনুগত্যের জন্য তাদের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এবং তারা বেইস ও ক্যাম্পে বাঙালিদের আঘাত করার জন্য অন্যদের চেয়ে দক্ষ ছিল।

৫. পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করা কর্মকর্তা ছিল যাদের দেশে ফেরত এনে সিনিয়র পোস্ট দেয়া হয়।

৬. পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে নিজেদের সমর্পনকারী বাঙালি পশ্চাদপসরণকারী কর্মকর্তারাদের দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরে তাদের পুরস্কৃত করা হয় এবং তারা পদোন্নতি পান এবং অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বহিষ্কার করা হয়। এবং অনেক কর্মকর্তা ও জোয়ান ঢাকায় কারাগারে বন্দী ছিলেন এবং পাকিস্তানি ডিজিএফআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের মাথাকে ধূমপানের ছাই ফেলার (এস ট্রে) জন্য ব্যবহার করা হত। কিভাবে আপনি তুলনা করবেন বিষয়টা?

৭. পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের সবচেয়ে সিনিয়র বাঙ্গালী অফিসারকে পূর্ণ সুবিধা দিয়ে অবসর দেয়া হয় এবং বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, যিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেননি বরং পাকিস্তানের সাথে নেগোশিয়েট করে চলেছেন। এটা স্লিপার সেল বা সুযোগসন্ধানীদের একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ যা স্বাধীনতার পরে আমরা দেখতে পাই। কারণ দুর্নীতি এবং রাজনীতি উভয় কারণেই এমনকি জেনারেল জিয়াও তাকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছিল।

৮. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কর্মচারি হিসেবে যারা ছিলেন তাদের বেশিরভাগ ছিলেন তারাই যারা ১৬ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করে অথবা পুনর্বাসিত হয়। এটা ঠিক যে তাদের মত কৌশলী বা চতুর মুক্তিযোদ্ধা কেউ ছিলোনা!! সেই সময়কার কোন কমান্ডার কি এর ব্যাখ্যা করতে পারেন !!

৯) সামরিক বাহিনীতে সহযোগী (কোলাবরেটর) যারা ছিলেন যারা এতটা সুস্পষ্ট ছিলেন যে সেনাবাহিনী তাদেরকে ফিরিয়ে নিচ্ছিল না; কিন্তু বেসামরিক পাকপন্থি সেই শক্তি এদের ডেকে নেয় এবং তাদের ব্যবসা গড়ে দেয়, এমনকি নিয়ম লঙ্ঘন করতেও সহায়তা করে। এদের মধ্যে কয়েকজন জেনারেল জিয়ার সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। এবং আমরা সবাই জানি যে তারা দেশের মৌলিক নীতিতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিল।

১০. অনেকগুলি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, একটির পর একটি …

১১. হ্যাঁ, শগাই ফোর্ট এবং অন্যান্য ক্যাম্পগুলি আরামদায়ক ছিল না। এমনকি কোন জঙ্গল, যুদ্ধ অথবা উদ্বাস্তু ক্যাম্পও নয়।

পশ্চাদপসরণকারী বাঙালি অফিসারদের সবাই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল না। বরং অনেকেই যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। তাদের অনুভূতি এবং অবদান কিছু উদাহরণ আমরা দিতে পারি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় জিপি ক্যাপ্টেন সাইয়েদ আহমেদের নাম –  যিনি তার সামর্থ্যের বাইরেও আরও বাঙালিদের নিয়োগের জন্য কাজ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি অফিসারদের ছুটির ব্যবস্থা করেন। কাবুল থেকে পালিয়ে পাকিস্তান এবং সেখান থেকে আসার চেষ্টা করা এক অফিসারের গল্প আমরা সবাই জানি। প্রো লিবারেশন অনুভূতিসম্পন্ন অনেক অফিসারের অনেকেই হয়ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের চাইতেই ভালো করতেন। আমি জেনারেল ওসমানীকে স্মরণ করছি – যিনি বলেছিলেন যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবে তারা স্বেচ্ছায় আসবে, তাদের কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করা বা বাধ্য করা হবেনা। এটা তাদের পছন্দের ব্যাপার এবং আপেক্ষিক।

যারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ  দিয়েছিলেন তারা চাকরিতে প্রত্যর্পণকারী অফিসার এবং জওয়ানদের বিরুদ্ধে ছিলেন, কিন্তু আমাদের কমান্ডাররা তাদের বন্ধুদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছিল এবং লোক দেখানো হিসেবে কয়েকজনকে বের করে দিয়েছিল।  এটি মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে এবং যারা বাংলাদেশ সৃষ্টির পক্ষে ছিলেন তাদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি করে। প্রত্যাবর্তনকারী কর্মীদের মধ্যে যারা পাকিস্তানীদের সহযোগিতা করেছে তাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে হতাশা ও রাগ সৃষ্টি করে যা উভয় দিক থেকেই বিপদজনক হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের মধ্যে কিছু মুক্তিযোদ্ধা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যাবহার করে এবং অবশ্যই তাদের মাঝে লুকিয়ে থাকা স্লিপার সেল এই সুযোগে তাদের উস্কানি দিয়ে ক্রোধের আগুন বাড়িয়ে দেয়। জেনারেল জিয়ার মন্ত্রিসভায় তিনজন প্রাক্তন আই.এস.আই সদস্য ছিলেন যারা বাংলা জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তিটি পাল্টে এমন সুন্দর করে ধর্মীয় অনুভূতির দিকে নিয়ে যায় যে তার বিরোধিতা কেউই করতে পারেনি।

আমাদের এই দূরত্ব অবশ্যই কমাতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা এবং ফিরে আসা অফিসারদের মধ্যের এই দূরত্ব। (তবে পাকিস্তানীদের সহযোগীদের প্রতি কখনোই ক্ষমা নয়।) যদি আমাদের জন্য নাও সম্ভব হয় – বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য আমাদের এটা করতেই হবে – তা কোন ব্যাক্তির জন্য নয় –  বরং দেশ ও জাতির জন্য।

আমরা ১৯৭২  সালের দিনগুলি থেকে সামনে এগিয়ে এসেছি।  আসুন আমরা সবাই এটাকে সাধুবাদ জানাই এবং এই অবস্থার জন্য যুদ্ধের সময়কার এবং যুদ্ধ পরবর্তি সকল অবদানের জন্য সাধারণ মানুষকে ধন্যবাদ জ্ঞ্যাপন করি।  আসুন আমরা তাদের সাথে যোগদান করি এবং আরও এক ধাপ এগিয়ে যাই। আমাদের মনে রাখতে হবে যে বর্তমান পাকিস্তানিরা এখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে না এবং তারা দাবি করে যে পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে থাকা গুটি কয়েক বিদ্রোহী (মুক্তি বাহিনী) এবং ভারতের চাপে বাঙালি স্বাধীনতা লাভে বাধ্য হয়েছে এবং তারা সামাজিক মাধ্যমে এই কথাই বলে বেড়াচ্ছে। আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে সত্য বলা উচিত এবং তা হতে হবে হুবহু যা ঘটেছে সেটাই। তাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে সবই জানা উচিত। তারা যদি অতীতের কথা না জানত তবে তারা কীভাবে এগিয়ে যাবে? স্বাধীনতার মূল্য শাশ্বত।

১৯৭২  থেকে ১৯৭৫  সালের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা ও বিধিমালা সন্তোষজনক ছিল না। যুদ্ধের পর নবজাতক দেশটিতে এটা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু নয়। ঢাকার অবস্থা মূলত বন্য পশ্চিমাদের মত হয়ে গিয়েছিল, প্রতি তিন জনের মধ্যে একজনের কাছে অস্ত্র ছিল। বেশিরভাগই অবশেষ ছিল। পুলিশ কর্মকর্তা এসপি মাহবুব এবং তার দলের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞ্যাপন করছি যে তিনি এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। হ্যাঁ, অনেকে তাদের মানবাধিকারের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলে, কিন্তু সেই অবস্থায় আপনি কি করতেন! বরং তাদের ধন্যবাদ দিন।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা এবং তার পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ আমার কাছে একটি আতঙ্ক ও বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে আবির্ভূত হয়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অনেকে এটি গ্রহণ করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর দুঃখজনক মৃত্যুতে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা খন্দকার মুস্তাক ও বেসামরিক সহযোগীরা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। এবং দেশ পাকিস্তানি ভাবধারার দিকে পরিচালিত হতে লাগল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তন হতে লাগল; পাকিস্তান স্টাইল বা বাঙালি মুসলিম (জাতীয়তাবাদ) ফিরে আসছে। নতুন সরকারকে সেইসব দেশ স্বীকৃতি দিল যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতা খন্দকার মোশতাক যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিপূর্ন চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। সুযোগসন্ধানী (অবসরপ্রাপ্ত) সামরিক কর্মকর্তা যাদের কয়েকজনের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে প্রাথমিকভাবে এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন) নামক ছাত্রফ্রন্ট এর সাথে ছিলেন (এটি আইউব খান / মোনেম খান কর্তৃক নির্মিত ছাত্র সংগঠন) – যারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বরখাস্ত এবং অসন্তুষ্ট কর্মকর্তা ছিলেন তারা বাংলাদেশ নামক নতুন এই দেশকে নতুন দিকে (মুসলিম বাংলাদেশ) নিয়ে আসতে থাকেন। আশ্চর্যজনকভাবে যদিও এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ হয়নি; যদিও পুরো জাতি বিস্মিত ছিল, এমনকি আওয়ামী লীগের বিপুল কর্মিবাহিনীও নিশ্চুপ ছিল – যেহেতু সকল নেতারা আত্মগোপনে গিয়েছিল এবং অনেকে মোস্তাকের সাথে যোগ দিয়েছিল।

ব্যতিক্রম ছিল কাদের সিদ্দিকি যিনি অবিলম্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। এই লোকটির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। যেমনটি আশা করা হয়েছিল মোশতাক তাই করা শুরু করলেন। অবিলম্বে পাকিস্তানপন্থী কর্মকর্তাদের দিয়ে সম্পূর্ণ প্রশাসন পরিবর্তন করলেন, যাদের অধিকাংশকেই বঙ্গবন্ধু ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। এমনকি যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫  আগস্ট পর্যন্ত পাক পররাষ্ট্র দফতরে চাকরি করতেন, তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হল ও পুনর্বহাল করা হল। এমনকি তাদের মধ্যে একজনকে পররাষ্ট্রসচিব ও পরবর্তিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। অতএব অনুমান করুন দেশের পররাষ্ট্রনীতির কী অবস্থা ছিল। জাতীয়তাবাদী সরকারকে এ ধরনের লোকদের কাছ থেকে এবং এদের মত অন্য আরও অনেকের থেকে সতর্ক থাকতে হবে যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অস্থিতিশীল করার জন্য কাজ করছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ হলেও পাকিস্তানি আদর্শবাদের সমাপ্তি হয়নি। পশ্চাদপসরণকারী সেনাবাহিনী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য ইউনিফর্মের ভেতরে ও বাইরে উভয় স্থানে কাজ করছে এবং সম্ভব হলে তাদের পছন্দ মত সরকার গঠন করছে।

আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি যে, সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার পরে আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউই পুলিশ কমপ্লেইন করতে এগিয়ে আসেনি। শুধুমাত্র পরবর্তিতে একজন সাধারণ ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য একটি মামলা দায়ের করে, যার অধীনে পুরো ট্রায়াল সিস্টেম চালু হয়। দুঃখের বিষয় এটি করতে ৩৪ বছর লেগেছিল। কি লজ্জা।

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫(বি এ এফ এর ভূমিকা)

জেনারেল খলিল এবং জেনারেল দস্তগীরের মতো অনেকেই মোস্তাক সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেননি, এবং এভিএম খন্দকারের  মতো মানুষ একেবারে বিভ্রান্ত ছিলেন। এয়ার কমোডোর এম কে বাশার অফিসারের মেসে বিএসএফ-এর সব কর্মকর্তাকে একত্রিত করে এবং এভিএম খোন্দকারের নির্দেশনার অপেক্ষা করে। কেউ নিশ্চিত ছিলো না কি হয়েছে বা মেজর শরিফুল হক (ডালিম) এর রেডিও ঘোষণার বিষয়টির সঠিকতা সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না। এ এম এম খন্দকার তখন ফ্লাইট লে ইকবাল রশিদকে ডাকলেন (কিন্তু কেন তাকে ডাকলেন তা আজ পর্যন্ত জানিনা, হয়ত আমার সাথে শেখ কামালের ঘনিষ্ঠতার কারণে, অথবা সেকারণে ঝুঁকি থাকার সম্ভবনার কারণে) এবং জানতে চাইলেন যা ঘোষণা দেয়া হয়েছে তা সঠিক ছিল কিনা। এরপর তিনি ফ্লাইট লে কাইয়ুম এবং ফ্ল্যাগ অফিসার জামান সহ ধানমণ্ডিতে ৩২ নম্বরে গিয়েছিলেন যেখানে বঙ্গবন্ধু রয়েছেন। প্রথমে তাদের ঘিরে থাকা সৈন্যবাহিনী প্রবেশ করার অনুমতি দেয়নি, তবে পরে তিনি অবসরপ্রাপ্ত মেজর (শাহরিয়ার) কে দেখতে পান যিনি মুক্তিযুদ্ধকালে সেক্টর ৬ এ তার সহকর্মী ছিলেন। তিনি পুরো বাড়িটির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তার কাছে অনুরোধ করেন এবং মেজর তাকে বাড়ীতে যেতে অনুমতি দেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর জন্য খুবই সাধারণ বাসস্থান ছিল এটি। তারা খুন ও হত্যার একটি বিধ্বংসী দৃশ্যের অবশিষ্টাংশ দেখেছিল; সমস্ত মৃতদেহ যেটা সেখানে ছিল সেখানেই পড়ে ছিল। সেগুলো তখনো সরানো হয়নি। বঙ্গবন্ধু  সিঁড়ির উপর পড়ে ছিলেন। সেই দৃশ্য তিনি তার জীবনে কোনোদিন ভুলতে পারেননি। এই মানুষগুলো কতটা নির্মম এবং নিষ্ঠুর হতে পারে? অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীরা সবকিছুর যে ছবি নিয়েছিল তাতে প্রমাণিত হয় এটা কয়েকজন মাস্টারমাইন্ডের পরিকল্পনা!

তারা ফিরে এসে জানাল তারা কি দেখেছিল। কিছুক্ষণ পরে তাদেরকে ঢাকা শহরের উপর চক্কর দিতে বলা হল। তাই একটি হেলিকপ্টার এবং দুটো মিগ স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলমের নেতৃত্বে উড়াল দিল এবং ঢাকায় চক্কর দিতে লাগল। এটা করা হচ্ছিল মোশতাকের কাজের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা দেখানোর প্রমাণস্বরূপ; এবং ধীরে ধীরে বিডিআর এবং অন্যান্যরা তা অনুসরণ করে।

[এখানে আমাদের বলতে হবে যে বঙ্গবন্ধু ইতিমধ্যেই বাঙালি জাতি ও জাতীয়তাবাদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন – দুই বাংলাতেই। বাঙালি জাতি সর্বদা তাদের সাথে অবহেলা অনুভব করেছিল; অর্থনৈতিক এবং সামাজিক – উভয়  ক্ষেত্রেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় সমস্ত মানুষ সমস্ত দিক থেকে তাকে দেবতার আসনে বসিয়েছিলেন। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টানরা তাদের নিজস্ব প্রার্থনা ঘরগুলিতে প্রার্থনা করেছিল। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, এটি অনেকেরই, এমনকি আমাদের মিত্ররাও স্বাগত জানায়নি। আশ্চর্যজনকভাবে স্বাধীনতার পর আমরা হঠাৎ আরও ইসলামি হয়ে উঠি এবং জাতির জাতীয়তাবাদ থেকে দেশকে দূরে সরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়। আমরা তার জাতীয়তাবাদী নীতিগুলির একটি স্মরণ করতে পারি “যত দূর ভালোবাসা তত দূর বাংলাদেশ।’

পদ্ধতিগতভাবে সমগ্র ধারণাকে একটি তথাকথিত ইসলামিক কাঠামোর মধ্যে পর্যালোচনা করা হয় এবং প্রশাসনের সমস্ত কাঠামো এমন লোকদের সাথে পূরণ করা হয়েছিল যাদের মতাদর্শ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ছিল। উদাহরণ: জেনারেল করিম এবং আইএসআই নিরাপত্তা কোম্পানি গঠন করে যা পরবর্তীতে তাহির কুদ্দুস দ্বারা পরিচালিত হয়। সিকিউরেক্স। এনএসএফ এবং জামাত পুনর্গঠিত হয়। মুসলিম দেশগুলো এদের অর্থায়ন শুরু করে যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। কাকতালীয়!

এই হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রের উৎসে যাওয়ার জন্য খুঁজতে হবে এতে লাভটা কার ছিল। পাকিস্তান তার জখমের প্রতিশোধ নেবার জন্য সেখানে ছিল। ভুলে গেলে চলবে না যে এশিয়াতে মোল্লাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম দেওবন্দ যা ভারতে অবস্থিত। নিয়োগের জন্য কতটুকু প্রচেষ্টা করা হয় … ..।  এরপর হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হতে পারে-  যা সকল উত্স থেকে হতে পারে, হত্যাকারীরা তো কেবলমাত্র হাতিয়ার বা দলীয় লোক। এই ধরণের সংগঠিত অভ্যুত্থানের পেছনে একটি খুব শক্তিশালী রাজনৈতিক সমর্থন থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর  সর্বশ্রেষ্ঠ শত্রু ছিল তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদের আকাঙ্ক্ষা, যেকারনে তিনি বহু প্রকাশ্য ও গোপন শত্রু বানিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা ভালভাবে অভিনয় করেছিলেন এবং বাঙালিরা যখন বাংলাদেশী হলেন তখন বাঙালিরা বিষয়টা খুব কমই ধরতে পেরেছিলেন। গাছ কেটে ফেললে – ফল পাবেনা। বঙ্গবন্ধুকে শেষ কর – জাতীয়তাবাদের মূলতপাটন সম্পন্ন কর।  তবে খুনিরা খুব কম আঁচ করতে পেরেছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে চেতনা বুনেছেন তা আবার জেগে উঠবে – জেগে উঠবে সকল ধর্ম, বংশ ও গোষ্ঠীগত চক্রান্তের চাইতে অনেক উপরে।  শুধু সময়টা একটু বেশী লাগবে যা তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত লাগত না। পাকিস্তানীদের জন্য এটা ছিল শুধু প্রতিশোধ, কিন্তু অন্যদের জন্য এটি অনেক বেশি কিছু। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সুবিধাভোগী কারা সেটা অনুসন্ধান করলেই চূড়ান্তভাবে ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে পাবেন।]

৩ রা  নভেম্বর ১৯৭৫: (বিএএফ এর ভূমিকা)

অল্প কয়েকজন অফিসার যাদের বেশিরভাগ বিএএফ এর ছিলেন তারা বঙ্গবন্ধু হত্যা মেনে নিতে পারেন নাই এবং বাংলাদেশের এই পরিবর্তন তারা স্বীকার করতে পারছিলেন না। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন এর বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেবেন এবং এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে এবং দেশটিতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে হবে এবং হত্যাকারীদেরকে শাস্তি প্রদান করার জন্যও সিদ্ধান্ত নেন। তাদের সেনাবাহিনীকে দরকার ছিল ও সেনাবাহিনীরও তাদের দরকার। কারণ সেনাবাহিনীর ভালো ল্যান্ড পাওয়ার থাকলেও তারা জানতো ট্যাংক ধ্বংস করতে এয়ার এটাকের তুলনা নেই। এয়ার ফোর্স ট্যাংক বাস্টার হিসেবে সুপরিচিত ছিল। তারা সমন্বয় শুরু করল। ৪৬ নং ব্রিগেডের কর্নেল শফাত নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সম্মত হন, যদি তার সিনিয়ররা নির্দেশ দেয়। তিনি খুব শৃঙ্খলাপূর্ন একজন মানুষ! তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, তাদের বিমান বাহিনীর সমর্থন লাগবেই কারণ ট্যাংকের বিরুদ্ধে এগুলোই সবচেয়ে কার্যকর। এবং অন্যদিকে ট্যাংক যে পদাতিক বাহিনীর হাতে তারা এই মুহুর্তে একটু ভীত সন্ত্রস্ত। বিএএফ ২৫ শে আগস্ট দিন হিসেবে ধার্য করে। সমস্ত পরিকল্পনা সম্পূর্ণ চূড়ান্ত ছিল, কিন্তু কোনও পদাতিক বাহিনী ছাড়া নড়া সম্ভব না কারণ বিমান উড্ডয়নের পরে সেটা একটা নিরাপদ স্থানে অবতরণের বিষয়টাও জড়িত। তাছাড়া কে এই অপারেশনে নেতৃত্ব দেবে সেটা নিয়েও অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হল।

এয়ার ফোর্স ১৫ ই আগস্ট সকালকে নির্ধারিত সময় হিসেবে চিহ্নিত করে কিন্তু তারা এমন কোন নেতা পাচ্ছিল না যাকে বিশ্বাস করা যায়।একটি পুরোপুরি বিভ্রান্তি তৈরি হল, কেউ জানে না কি করে নেতৃত্ব দেয়া যেতে পারে। তাই আমরা জুনিয়র স্তর থেকে এগিয়ে যেতে সিদ্ধান্ত নিলাম।

সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে একদিন  স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত ফ্লাইট লে ইকবালের স্কোয়াড্রনে আসলেন এবং কী অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন।  ইকবাল দৃঢ়কণ্ঠে বললেন বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে। লিয়াকত একমত হলেন, কি পরিকল্পনা তা জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বলেন: কমান্ডের শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন করতে হবে, যে কোন উপায়ে হত্যাকারীদের অপসারণ করতে হবে। ইকবাল তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলো এয়ার ফোর্সের প্রধান কে হবে।  তিনি বলেন, তারা জিপি-ক্যাপটেন সাইফুল আজমকে চেয়েছিলেন। ইকবাল কথা দিতে পারেন নাই যেহেতু সে ছিল এয়ার কমোডোর বাশারের অনুগামী যে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। লিয়াকত বলেন, এভিএম বাশারকে রাষ্ট্রদূত বানানো হবে।

অতএব নতুন যুবকেরাই বি.এফ.এর নেতৃত্বে দেবে। ইকবাল খুব উত্তেজিত ছিলেন এবং বলছিলেন যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হতেই হবে। এটি তার চিন্তাধারার মতই ছিল। লিয়াকত আমাকে আরও জানায় যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এই পদক্ষেপের নেতা হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ইকবাল আমাকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে ২ টি এমআই ৮ সম্পূর্ণরূপে সশস্ত্র প্রস্তুত করার জন্য বলল।  ইকবাল একদিনের মধ্যে রেডি করতে অনুরোধ জানায়।

চেইন অব কমান্ড পুনরুদ্ধার করতে হবে। এটা আমি মনে করি।

যেহেতু এতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন, মনসুর আলীকে নেতৃত্বে আসতে সাহায্য করবে।

ইকবাল জেনারেল জিয়াকে তেমন ভাল করে জানেন না। একজন জুনিয়র অফিসার হিসেবে সেটা জানার কথাও না। তবে সে তার পরামর্শদাতা এভিএম বাশারের কাছে চলে যায় এবং এই ইস্যুটা তাকে জানায়। তিনি বলেন যে তিনি তাদের সাথে থাকবেন যদি জেনারেল জিয়া তাদের সাথে থাকে।

ইকবালকে স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত হেলিকপ্টারকে অস্ত্রশস্ত্র রেডি করতে বলেন এবং ক্যাপ্টেন জামালকে মিগের দায়িত্ব দেন।  এবং ফ্লাইট লে মিজানকে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। অস্ত্রাগারটি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হক এর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছিল। সময় মত সব কাজ শেষ হয় এবং বি এ এফ প্রস্তুত ছিল। শুধুমাত্র নির্দেশের অপেক্ষা। বিএএফ এর দিক থেকে সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় সব করা হয় কিন্তু সেনাবাহিনী আগাচ্ছিলনা। আগেই জানানো হয়েছে যে আমরা ২৫ আগস্টের মধ্যে বিএএফ প্রস্তুত ছিলাম।

সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে  ইকবাল জনাব মন্টুর সঙ্গে দেখা করার একটি সুযোগ পায় – তিনি ছিলেন একজন যুব আওয়ামী লীগ নেতা, যিনি সেনানিবাসের মেসের ভাড়ার দায়িত্বে ছিলেন এবং বাড়িওয়ালা ছিলেন।  তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে কিছু করা হচ্ছে কিনা। ইকবাল তাকে বললেন ধৈর্য্যধারণ করে থাকতে। এবং বললেন কিছু একটা হচ্ছে। আশা করি সে তার সেই মিটিংটা মনে করতে পারবে কারণ সেটা হয়েছিল ক্যান্টনমেন্ট হাউসে যা তার নিজের মালিকানাধীন ছিল। (হাউস নং ২১)। সেটাই ছিল ইকবালের সাথে আওয়ামী লীগের একমাত্র যোগাযোগ।

অক্টোবরের শেষে কোন এক সময়ে ইকবালকে হঠাৎ করে বলা হল টাঙাইলে উড়ে গিয়ে কাদের সিদ্দিকের কাছে যেতে তাকে ধরার জন্য। ইকবাল ও তার স্কোয়াড্রন কমান্ডার উইং কমান্ডার মঈন উল ইসলাম এমআই -৮ যোগে টাঙ্গাইল গিয়েছিলেন এবং সবচেয়ে দুর্বলভাবে সজ্জিত এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে গিয়েছিলেন যারা খুব শিহরিত এবং উত্তেজিত ছিলেন যে তারা মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকিকে আটক করতে যাচ্ছেন। যদিও পাইলট নিজে তেমন উত্তেজনা বোধ করছিলেন না। কারণ কাদের সিদ্দিকি ছিলেন আওয়ামী লীগের একমাত্র বিদ্রোহী যিনি জাতীয়তাবাদী হিসেবে সকল প্রশংসার দাবিদার। এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুসাইদ (সিলেট থেকে) যিনি পরে হয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার। আক্রমণটি অত্যন্ত খারাপভাবে পরিকল্পিত ও পরিচালিত ছিল। আমাদের সব রকম সামরিক কায়দার বাইরে পরিচালিত করা হয় – শুধুমাত্র কাদের সিদ্দিকীকে ধরতে, কারণ এতে একটি সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হবে। সাধারণ বিমানবাহিনী আক্রমণ / হামলার কায়দা হল লক্ষ্যমাত্রায় কেবলমাত্র একবার যাওয়া হবে। কারণ হেলিকপ্টারের শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যায় এবং তাই প্রথমবারের পরেই তারা আর সারপ্রাইজড হবেনা। এই কমান্ডার হেলিকপ্টার ব্যবহার করল মাছ ধরার নেটের মত। বারবার চারিদিকে ঘুরছেন এবং সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন কাদের সিদ্দিকি কোথায়। একদম বাজে পেশাদারিত্ব। এটি জানা যে কাদের সিদ্দিকি ছিল পেশাদার এবং হেলিকপ্টার তার জন্য ছিল সহায়ক। আগেই যেমন আলোচনা করা হয়েছে, যখন তারা নিচিন্তপুরের নিকটবর্তী একটি স্থানে এসে নামল, তখন তারা কাদের সিদ্দিকির দ্বারা খুব কাছ থেকে গোলাবর্ষনের স্বীকার হয়, কাদের সিদ্দিকি ছিলেন খুবই দক্ষ এবং একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন নিহত হয়। ইকবাল জানায় যে সে আত্মসমর্পণ করার মত লোক ছিলেন না, তাই সে ক্ষতিগ্রস্ত হেলিকপ্টার নিয়ে টাঙ্গাইল ফিরে আসে এবং অবতরণের পর হেলিকপ্টারে ২২ টি বুলেটের গর্ত খুঁজে পান। পরবর্তিতে ইকবাল ঢাকা জেলে কাদের সিদ্দিকির এক সহযোগীর সাথে পুরো বিষয়টা আলোচনা করেছিল। এই অধ্যায়টি বিস্তারিত আমাদের বর্তমান সেনাবাহিনীকে জানানো উচিৎ যা তাদের সামনে আগাতে সাহায্য করবে।

নভেম্বর মাসে জানানো হয় যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন, যেহেতু জিয়া তখন আক্রমণে রাজি ছিলেন না।  পরে জনগণ বুঝতে পারলো কেন জিয়া অস্বাভাবিক আচরণ করেছেন। [আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে যখন যে মন্ত্রীসভা গঠন করল তখন দেখা গেল তার বেশিরভাগ মন্ত্রী ছিলেন প্রাক্তন – আই.এস.আই., এম.আই. অফিসার যাদেরকে তিনি বাংলাদেশকে রূপান্তরের দায়িত্ব দেন …]।

ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমাদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিলেন না, যেহেতু তার যোগাযোগ ছিল এলিট বেসামরিকদের সাথে যাদের অনেকেই তথাকথিত বামপন্থী। এটি  আমাদের মধ্যে তার ব্যাপারে সমালোচনার সৃষ্টি করেছিল। উদাহরণ স্বরূপ তার মেলামেশার লোকদের একজন ছিল  হলিডে এর এনায়েতুল্লাহ। ১৫ আগস্ট তার জড়িত থাকার বিষয়ে বি এ এফ সন্দিহান ছিল। কারণ সে ছিল সিজিএস। সে অনেক কিছুই করতে পারত। সে যাই হোক, আমরা জানি তার ক্যারিশমা ছিল এবং সে দারুণভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতৃত্ব দিয়েছিল। তাছাড়া কর্নেল শফাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের কাউকে দরকার ছিল।আমরা খুবই আকুল ছিলাম। একদিন মেজর ডালিম মেজর হাফিজ, স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত এবং ফ্লাইট লেফটেনেন্ট ইকবালের মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়। যদিও তারা এটাকে সেনাবাহিনীর একটি সামাজিক সমাবেশের অজুহাতে হাল্কা হিসেবে দেখতে পারেন। কিন্তু এটা আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিল যে মোশতাকের সরকার আমাদের সম্পর্কে সজাগ ছিল !!

২ নভেম্বর ১৯৭৫ এর মাঝরাতের দিকে স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত ইকবালের বাড়ীতে এসে জানায় আজ সকালে অপারেশন। তিনি তার ঘর ত্যাগ করেন এবং ক্রুদেরকে জড়ো করেন এবং বিমানটিকে সকাল সাড়ে ৪ টায় প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। বিএএফ এর ৩ টি হেলিকপ্টার এবং ৩টি এমআইজি প্রস্তুত এবং সশস্ত্র ছিল।

৩ ই নভেম্বর মেজর ইকবাল তার পদাতিক বাহিনী নিয়ে রাষ্ট্রপতি হাউস থেকে বেরিয়ে যান।

আমরা প্রথমেই বিমান পেয়েছিলাম। বিএএফ এর ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য সম্পূর্ণরূপে সশস্ত্র হেলিকপ্টার চালান স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম, এবং ফ্লাইট লেফটেনেন্ট ইকবাল রশিদ। ফ্লাইট লেফটেনেন্ট কাইয়ুম, পাইলট অফিসার ডিদার ও অন্য কিছু জুনিয়র অফিসারদের সাথে ব্যাক আপ হিসেবে ছিল; সশস্ত্র মিগ-এর চালাতেন ফ্লাইট লে জামাল ও সালাউদ্দিন।

৩ নভেম্বরের প্রধান কার্যক্রম নিম্নরূপ:

স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত আলী খান বি.এফ. এর প্রধান পরিকল্পনাকারী এবং সেনাবাহিনীর সাথে এবং ৪৬ ব্রিগেডের বিএম মেজর হাফিজের সাথে সমন্বয়কারী ছিলেন।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশীদ বিএএফ এবং পরিকল্পনা বিভিন্ন প্রযুক্তিগত বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এবং হেলিকপ্টারের যাবতীয় দেখাশোনা এবং ক্রু প্রস্তুতের দায়িত্বে ছিলেন।

ফ্লাইট লে জামালউদ্দীন আহমেদ বিএএফ এর বিভিন্ন প্রযুক্তিগত বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এবং হেলিকপ্টার প্রয়োজনীয়তা এবং ক্রু প্রস্তুতের সমন্বয়কারী ছিলেন।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ওয়ালী খন্দকার জি.সি.র ফ্লাইট এবং এম ও ডি সি (বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা) এর দায়িত্বে ছিলেন।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মিজান বি এ এফ এর সাথে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ উভয়ই যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্বে ছিল।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হক  অস্ত্রাগার থেকে রকেট সরবরাহ করেন।

পরিবহন স্কোয়াড্রন স্ট্যান্ডবাই ছিল। এটি পরিচালিত হয় স্কোয়াড্রন লিডার শাখাওয়াত(মরহুম) এর নেতৃত্বে।

এটিসি নিয়ন্ত্রণ করেন অফিসার আখতার (মরহুম)। ক্যাপ্ট কামাল মাহমুদ বিমানের গাড়ির দায়িত্বে ছিলেন।

হেলিকপ্টার এবং মিগ রাষ্ট্রপতির বাড়ির চারপাশ দিয়ে ঘুরছিল যেখানে পাহারায় শুধু একটি ট্যাংক ছিল। এর মধ্যে সেনারা সোনারগাঁও হোটেল এরিয়ায় চলে আসে। রাষ্ট্রপতির বাসভবন আমাদের নিয়ন্ত্রণে এবং রেডিও স্টেশন , রেস কোর্স এবং ট্যাঙ্কগুলো আমাদের আক্রমণসীমানার আয়ত্তে। প্রতিটা এয়ারক্র্যাফটে আছে ৬৪ টি করে রকেট। একটি সুইচের চাপেই এগুলো সব উড়িয়ে দেয়া সম্ভব। পাইলট গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থেকে কমান্ডে থাকা স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতের কাছ থেকে গুলি চালানোর অনুমতি চাইল। পাইলটদের বিস্মিত হয়েছিল যে রেসকোর্স এবং বঙ্গভবনের ট্যাংকগুলিতে আক্রমণ চালানোর অনুমতি তাদের দেওয়া হয়নি; যে কোনো সময় তারা আক্রমণ সীমানার মধ্যে থাকায় ট্যাংকগুলি উপর আক্রমণ করতে পারে। পরে তারা জানতে পেরেছিল যে ব্রিগেডিয়ার খালিদ এবং ১৫ ই আগস্টের অন্যতম পরিকল্পনাকারী জেনারেল ওসমানীর মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি/আপোষের চেষ্টা চলছে – কোনো রক্তক্ষরণ এড়াতে !!! তিনি ১৫ আগস্ট গ্রুপের আত্মসমর্পণের শর্তে একটি চুক্তি সম্পাদনে সমর্থ হলেন; এবং বিএএফ বিমান অবতরণ করল এবং স্ট্যান্ডবাই থাকল।

ক্যাপ্টেন ইকবাল পরবর্তিতে জাতীয় পার্টির মন্ত্রী ছিলেন। তিনি কমোডোর বাশারকে গৃহবন্দী রেখেছিলেন; তিনি বেশিরভাগ  বি.এ.এফ  স্টাফকে সমস্যায় ফেলেছিলেন এবং বিশেষ করে ফ্লাইট লে ইকবালকে; যে তার সেক্টর কমান্ডার ছিল।

সবচেয়ে খারাপ অংশটি ছিল গুজব ছড়ানো যে, ফ্লাইট লে ইকবাল তাকে ঘরে আটক রেখেছিল; যা একেবারে মিথ্যা ছিল। ফ্লাইট লে  ইকবাল তখন ফ্লাইটের প্রস্তুতির জন্য ব্যস্ত ছিলেন, বিশেষ করে হেলিকপ্টারের অস্ত্রশস্ত্র দেয়া নিয়ে। কারণ এই প্রথম বারের মত অস্ত্রশস্ত্র সহ অনুশীলন করতে হচ্ছিল। (পরবর্তীতে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ভুলটি হয়েছিল নামের সাদৃশ্যের কারণে।)

প্রায় ৯ টার দিকে ফ্লাইট লে ইকবালকে স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত আদেশ দেন এসিএম তাওয়াব কে গ্রেফতার করার জন্য। যে ছিল আইএসআই এজেন্ট এবং ১৫ ই আগস্টের হত্যাকারীদের দ্বারা নিয়জিত এন্টি-বাংলাদেশ অফিসারদের মধ্যে অন্যতম।

তারা জানত না সে কোথায় লুকিয়ে আছে। একজন সিনয়র কলিগকে ধন্যবাদ। সে জানায় যে সে ডি জি এফ আই প্রধান আমিনুল ইসলামের (যিনি কিনা সন্দেহের তালিকায় থাকা আরও একজন) বাড়িতে লুকিয়ে আছে। স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত, ফ্লাইট  লে জামাল এবং ফ্লাইট লে ইকবাল বেঙ্গল রেজিমেন্টের আরও কিছু সৈন্য সহ এভিএম আমিনুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে সেখানে তাওয়াবকে লুকানো অবস্থায় ধরে ফেলে। সেখান থেকে তারা তাকে তুলে আনে। উইং কমান্ডার সুলতানকে ধন্যবাদ তাওয়াবের সম্পর্কে তাত্পর্যপূর্ণ তথ্য দেয়ার জন্য। তারা তাকে ৪র্থ বেঙ্গলে নিয়ে যায় যেটা ছিল ওপিএস হেডকোয়ার্টার।  এভিএম তাওয়াব এমন এক লোক যে ছিল পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সেইসব কর্মকর্তাদের একজন যে ছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানান। এবং তাকে পরে হত্যাকারীরা বি.এ এফ এর প্রধান বানায়।  [এখানে একটি কথা উল্লেখ্য যে  এ.ভি.এম. তাওয়াবকে যখন ৪র্থ বেঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন সে ইকবালের হাত ধরে বলে তাকে যেন রাষ্ট্রদূত করা হয়। ইকবাল তাকে বলেন তিনি কিভাবে সেটা করবেন – তিনি তো কেউ না।কতটা ধুর্ত।]

৪র্থ বেঙ্গলে তারা দেখেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ এ জি ব্রিগেডিয়ার মঈনের সাথে তর্কবিতর্ক করছেন নৌবাহিনীর প্রধান। দীর্ঘ বারান্দার এক কোণে কর্নেল হুদা, লে কর্নেল কর্নেল হায়দার, লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাফর ইমামকে অত্যন্ত হতাশ দেখাচ্ছে এবং কর্নেল হুদা ফ্লাইট লে ইকবালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবং ইকবাল বলেন, “কিছুই হবেনা।’

যখন তারা ৪র্থ বেঙ্গলে এ.ভি.এম তাওয়াবকে পাহারা দিয়ে নিয়ে গেল তখন তারা আশ্চর্য হয়ে গেল যখন দেখল ব্রিগেডিয়ার খালিদ মোশাররফ তাঁকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান এবং বলেন, “স্যার, আপনি কোথায় ছিলেন, আমরা বিমান বাহিনীর প্রধানের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কোরাম পূর্ণ করতে, আমাদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।” সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় এ.ভি.এম. তাওয়াব ইকবালকে একটি ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমা দিয়েছিলেন, যেহেতু তাকে বন্দুকের মুখে করে নিয়ে আসা হয়েছে। সেই ঘৃণাপূর্ন চেহারা ইকবাল কখনও ভুলবে না, এবং সেই সাথে ইকবালের বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন শেষ হল; তিনি সেই জায়গা ছেড়ে চলে যান এবং সরাসরি তার বাড়িতে চলে যান এবং ঘুমাতে গেলেন – তার স্ত্রী এই আচরণে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তার জন্য ৩ নভেম্বর এভাবেই শেষ হল। এভিএম তাওয়াব পরে এই বি.এ.এফ অফিসারদের উপর তার প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিলেন; ৭ নভেম্বরের পরিবর্তনের পর।

তখন পর্যন্ত বিএএফ জেলের দুঃখজনক এবং নিষ্ঠুর এই হত্যা সম্পর্কে কিছুই জানত না। তারা সন্ধ্যায় এটি সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। সেই সাথে সব আশা শেষ হল। এবং আমরা শুধু এটিকে আল বদর কর্তৃক বুদ্ধিজীবিদের হত্যার সঙ্গে তুলনা করতে পারি।

বিকেলে কোণ এক সময় আমরা শুনেছি যে কর্নেল শফাত রাষ্ট্রপতির বাসভবনে গিয়েছিলেন এবং খন্দকার মোস্তাকের সঙ্গে কথাবার্তা বিনিময় করেছিলেন এবং জাতির পিতার হত্যাকারী হিসেবে তাকে সম্বোধন করেছিলেন। মোস্তাকের পুরো মন্ত্রণালয় সেখানে ছিল, যারা বিষয়টি মেটানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেখানে লে কর্নেল জাফর ইমাম ছিলেন যিনি রংপুর থেকে তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসেছিলেন, এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ তিনি উত্তেজিত হয়ে গেলেন এবং চিৎকার করে বললেন, ‘কেন আমরা জাতির পিতার এই হত্যাকারীদের সাথে বসে সময় নষ্ট করছি। এখনি ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।’ মন্ত্রীরা এতোটাই  ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে তাদের কেউ কেউ টেবিলের আর চেয়ারের  পিছনে লুকানো শুরু করেছিল। তখন মোশতাক বুঝে গেলেন যে তার সময় শেষ। তিনি চেয়ার ছাড়লেন। তাকে গ্রেফতার করা হল।

পরে বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। (সম্ভবত সেই সময়ে রাষ্ট্রপতির বাসভবনের দৃশ্যপটটি ক্যাপ্টেন আজিজ ভালো বলতে পারবেন – যিনি পরে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে অবসর নেন। আমাদের ধারণা তিনি সেই সময়ে এ ডি সি ছিলেন। তিনি সেই দিনের সকালের নেগোসিয়েশন সম্পর্কেও বলতে পারবেন যা হচ্ছিল জেনারেল ওসমানী ও অন্যান্যদের সাথে। তিনি খুব ভাল কর্মকর্তা এবং ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।)

খালেদ মোশাররফ, এভিএম তাওয়াব ও এভিএম আমিনুল ইসলাম (ডিজিএফআই) খুনিদের রাতের অন্ধকারে একটি ফকার বিমানে ব্যাংকক পালিয়ে যেতে দেন। অনুমান করুন যে পাইলটরা ভলান্টিয়ার ছিল সাত্তার ও আকরাম এবং পরবর্তিতে এটা খুব হতাশার বিষয় ছিল কর্নেল হুদা, হায়দার ও আমাদের জন্য। খালেদ মোশাররফ বিষয়টাকে একটা বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তিতে পরিণত করেছেন এবং আমাদের কাছ থেকে চলে গিয়ে ইসলামিক গ্রুপ তাওয়াব ও আমিনুল ইসলামের সাথে চলে গেছেন, যাদেরকে তিনি আমাদের তুলনায় আরো সুবিধাজনক মনে করেছেন। অনুমান করুন উপদেষ্টা হিসেবে তার পাশে কে ছিল? ক্ষমতা এবং লোভ একসঙ্গে যায়।

এ ভি এম তাওয়াব এবং আমিনুল ইসলাম অবিলম্বে খালেদকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করার পরামর্শ দেয়(ন্যায়সঙ্গত তাই)।

৩ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ৭ ই নভেম্বরের মধ্যে যা ঘটেছে তা জানতে আপনাকে সেনা কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করতে হবে যারা ক্ষমতার কাছাকাছি ছিলেন।

আমাদের এবং জেনারেল খালেদের মধ্যে এই বিভ্রান্তি এবং তর্ক-বিতর্কের সুযোগে তাওয়াব ও আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা একত্রিত হয়ে জেএসডি-র সাথে যোগ দেয়। কর্নেল তাহের ও জেএসডি সুবিধা গ্রহণ করেন এবং সিপাহি বিপ্লব করেন, এবং সাম্প্রতিক বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মতো হত্যাকাণ্ড ঘটান। এভিএম তাওয়াব ও এভিএম আমিনুল ইসলাম এই সুযোগ গ্রহণ করে এবং ৩ নভেম্বর বিমান বাহিনীর সকল কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে, বিচার করে এবং বিমান বাহিনীর বাইরে আমাদের একটি রাজনৈতিক টার্গেট ও ভিক্টিম হিসেবে আখ্যায়িত করে। এবিএম তাওয়াব এবং আমিনুল ইসলাম উইং কমোডোর তাহের কুদ্দুসসহ [যে ১৯৭১ সালে দিল্লিতে পাকিস্তানি মিলিটারি এটাচি ছিল এবং যাকে তার বিশ্বস্ততার জন্য সৌদি আরবের কাছে পাঠানো হয়েছিল]। ডি এ আই, বি এ এফ , তাদের বিশ্বাসঘাতক হিসাবে ফাঁসির দণ্ড দেয় – যাদের বেশিরভাগ ছিল মুক্তিযোদ্ধা – মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি।

৩ নভেম্বরে এয়ার ফোর্সের সাতজন অফিসারকে যথেষ্ট ভর্সৎসোনা করা হয়েছিল এবং অনেক কষ্টের মুখোমুখি করা হয়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে সেনাবাহিনীর কাউকে কোণ রকম ভর্সৎসোনা করা হয়নি এবং সবাই সম্পূর্ন সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন। বি এ এফ এর কোন বন্ধু ছিল না, যারা তাদের পক্ষ হয়ে দাঁড়াবে। সমগ্র পরিস্থিতি ছিল ভিতকর। তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। যাবজ্জীবন থেকে শুরু করে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়া হয়। তারা হয়ে যায় বেসামরিক লোক এবং শূন্য থেকে একটি নতুন জীবন শুরু করে। ৩ নভেম্বর ব্যর্থতার জন্য, কেন্দ্রীয় কারাগারের নেতাদের হত্যার জন্যে এবং কর্নেল হুদা ও হায়দারের মৃত্যুতে একমাত্র জেনারেল খালেদ মোশাররফকেই দোষী সাব্যস্ত করা যায় তার অদক্ষতা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যার্থতা এবং এ ভি এম তাওয়াব, আমিনুল ইসলাম এবং স্লিপার সেলের লোকজনের পরামর্শ গ্রহণ করে কাজ করার কারণে। এইসব কর্মকর্তারা কারাগার থেকে মুক্তি পান যেদিন এ.ভি.এম. তাওয়াবকে  জেনারেল জিয়া দেশের বাইরে পাঠান এবং এভিএম বাশার সি ও এ এস হিসেবে দায়িত্ব নেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত এভিএম বাশার একটি ডেমো ফ্লাইটে দুর্ঘটনায় মারা যান। ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা রাস্তার মানুষ হয়ে যান আর অমুক্তিযোদ্ধারা বি এ এফ এর দায়িত্ব নেয়।

তাদের বেশিরভাগই পাইলট হওয়ায় নতুন জীবন শুরু করতে তাদের সুবিধা হয়। তারা বাংলাদেশ ত্যাগ করে এবং বিভিন্ন দেশে কাজ শুরু করে। অবশেষে তারা স্থিত অবস্থায় আসে।

বাণিজ্যিক হেলিকপ্টার পাইলট হিসাবে তারা বিভিন্ন দেশে চাকরি করার সুযোগ পায় এবং নানান পরিবেশে কাজ করার সুযোগ পায়। তারা বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির সাথে মেশার সুযোগ হয়। তাদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়।

Facebook ID: https://www.facebook.com/poonam.sikder?hc_ref=ARQrMk-9keLeLohrOoMEHprs5JaNVko6MuMyw0NBm5OkP5rkdw8Pr7kSb8Z1AxAgsFU&fref=nf

Translated by – Dr Md Razibul Bari

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!