You dont have javascript enabled! Please enable it! তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে কানভারী কে করেছে? কীভাবে করেছে? - সংগ্রামের নোটবুক

তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে কানভারী কে করেছে? কীভাবে করেছে?

December 28, 1971: The first press conference of the government of Mujibnagar Independent Bangladesh in Governor House, now known as Bangabhaban, in Dhaka, Bangladesh. From left: Khondakar Mostaq, Prime Minister Tajuddin Ahmed, Acting President Syed Najrul Islam, Captain Mansur Ali, Kamruzzaman and Sheikh Abdul Aziz.

প্রধানমন্ত্রী থাকার লােভে তাজুদ্দিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাচ্ছেন; পাকিস্তানের সংগে আলাপআলােচনা চাচ্ছেন না। মােশতাক গ্রুপের এই প্রচারণায় শেখ পরিবারের কেউ কেউ তখন প্রভাবিত হন । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেগম মুজিবকেও কথাটা জানানাে হয়। শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবের কানে কথাটা এইভাবে তােলা হয় যে পাকিস্তানের জেলে তার মৃত্যু ঘটিয়ে তাজুদ্দিন বাংলাদেশের ভাগ্যবিধাতা হতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এই অপপ্রচার বিশ্বাস করেছিলেন কিনা, তা আমার জানা নেই। মুজিব নগরে মােশতাক ছিলেন মন্ত্রী। ‘৭১ সালে পূর্ণাংগ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার  প্রাক্কালে জাতিসংঘের লবীতে বাংলাদেশের বক্তব্য পেশ করার জন্য তার নিউইয়র্কে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই মাহবুব আলম চাষী (তখন ফরেন সেক্রেটারী) কর্তৃক ওয়াশিংটনে প্রেরীত একটি গােপন বার্তা ধরা পড়ে গেল। তাতে পাকিস্তানের সংগে যুদ্ধ বন্ধ করা হবে এবং তার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সংগে মার্কিন সরকারের মাধ্যমে আলােচনা শুরু করার জন্য। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তাজুদ্দিন সংগে সংগে মাহবুব আলম চাষীকে বরখাস্ত করলেন। মােশতাকের নিউইয়র্ক যাত্রা বাতিল করা হয়। তার বদলে বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীকে জাতিসংঘ লবীতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার নির্দেশ দেয়া হল। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর মােশতাক গ্রুপের টিজনের চার্জে বিচার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাজুদ্দিন তাকে ক্ষমা করেন। তবে বিদেশমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে তাকে আইনমন্ত্রী করেন। মুজিব নগরে মােশতাক আরেকটি কাণ্ড করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব নগর থেকে অনেকগুলাে পত্রিকা বের হয়। আওয়ামী লীগের দলীয় মুখপত্র ছিল ‘জয়। বাংলা’। আওয়ামী লীগের যুৰ অংশের ছিল বাংলার বাণী।’ মুজাফফর ন্যাপ ও সিপিবিরও দুটি পত্রিকা ছিল। আওয়ামী লীগের নিজস্ব দলীয় পত্রিকা থাকা সত্ত্বেও মােশতাক নিজের একটি কাগজ বের করেন। নাম ‘অভিযান’। এখানে উল্লেখযােগ্য যে মােশতাক তার নিজের ঢাকার বাড়িতে বহুবছর একটি প্রেস চালিয়েছেন। তার নাম ‘অভিযান প্রিন্টিং প্রেস’। অভিযান পত্রিকায় বেছে বেছে ভাসানী ন্যাপ ও তৎকালীন জাফর-মেনন গ্রুপের কিছু সমর্থক ও কর্মীকে সাংবাদিক ও কর্মী হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। পত্রিকাটিতে অতি কৌশলে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা ও তাজুদ্দিন-বিরােধী প্রচারণা শুরু করা হয়। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব দেশে ফিরে প্রথম যে কাজটি করেন, তাহলে মােশতাক ও তার সাংগপাংগদের বিচার থেকে রেহাই দেয়া এবং তাদের ক্ষমা করা। ১৯৫৫ সাল থেকে একবার নয়, বার বার মুজিব ক্ষমা করেছেন মােশতাককে, ভুলে গেছেন তার বিশ্বাসঘাতকতা। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর মন্ত্রীসভা পুনর্গঠনের সময় মুজিব যখন মােশতাকের হাতে বাণিজ্য মন্ত্রীর ভারও তুলে দেন, তখনও আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এর কারণ কি? এই কারণ জানতে অবশ্য বেশি দিন দেরি হয়নি। বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে মােশতাকের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দুর্নীতির হিসেব দিতে গেলে একটা মহাভারত লিখতে হবে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস এই যে, মুজিব-হত্যার পর মােশতাক ক্ষমতায় গিয়েই তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীদের দুর্নীতির অভিযােগে গ্রেফতার করান। শেখ মুজিবের মায়ের মৃত্যুতে যিনি কেঁদে চোখ ফুলিয়েছিলেন, মাত্র এক বছরের  ব্যবধানে সেই মুজিবের এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্র পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে উল্লাস প্রকাশ করে হত্যাকারীদের খেতাব দিলেন ‘সূর্য-সন্তান এবং এই বর্বরতাকে আখ্যা দিলেন ‘হিস্টোরিকাল নেসেসিটি’ বা ঐতিহাসিক প্রয়ােজনীয়তা। 

– ইতিহাসের রক্তপলাশঃ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর (১ম পর্ব)

আব্দুল গাফফার চৌধুরী