You dont have javascript enabled! Please enable it! আবুল মাল আবদুল মুহিত (সিএসপি ১৯৫৬) | মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা - সংগ্রামের নোটবুক

আবুল মাল আবদুল মুহিত (সিএসপি ১৯৫৬)

মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা

পাকিস্তান বৈদেশিক মিশনে বা দূতাবাসগুলােয় কর্মরত পিএফএস কর্মকর্তাদের অসাধারণ ভূমিকার বাইরে সেসব স্থানে প্রেষণে নিয়োজিত সিএসপি কর্মকর্তাদের ভূমিকা  যদি নিবিষ্ট চিত্তে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পর্যালােচনা করা হয়, তবে দেখা যাবে যে, এ. এম. এ. আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভূমিকাই এঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রােজ্জ্বল। অবশ্য একথা বলার উদ্দেশ্য এ নয় যে, অন্য সিএসপিদের বা প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে যারা দূতাবাসে নিযুক্ত হতেন, তাদের ভূমিকা আদৌ গৌণ বা ছােটো করে দেখা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত আমেরিকার শিকাগো থেকে প্রকাশিত Bangladesh Newsletter নামক পত্রিকার ৫ই আগস্ট ১৯৭১ তারিখের ষষ্ঠ সংখ্যার “Economic Counsellor at the Pakistan Embassy Resigns’ শীর্ষক সংবাদে এ, এম, এ মুহিত সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল, তা এখানে উদ্ধৃত হলাে: Mr. A. M, A. Muhit a senior officer of the Civil Service of Pakistan and the Economic Counsellor at the Pakistan Embassy in Washington had formally resigned his post and severed all connections with the Government of Pakistan. In a letter to the President of Pakistan dated July 21, Mr. Muhit gave reasons for this resignation together with a total indictment of the Yahya regime. In his letter. Mr. Muhit questioned the legitimacy of the Yahya government, assailed it for its colonial ambition, savagery, and utter lack of humanitarian concern/ It may be recalled that Mr. Muhit was awarded a Tamgha (title) for his meritorious services to the Government of Pakistan. His last home post was Joint Secretary, Natural Resources Division, Government of Pakistan. We congratulated Mr. Muhit for his bold decision.”১৫

Bangladesh পত্রিকাটি এর ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের Vol.1: No. 14 সংখ্যার ‘Programs on Bangladesh’ শীর্ষক সংবাদে এ, এম, এ মুহিত-সহ বাঙালি কূটনীতিকদের বিভিন্ন তৎপরতা সম্পর্কে বলা হয়েছিল; “Bangladesh counselors S.A.M.S. Kibria, A M. A. Muhit and S.A.R. Matinuddin have been addressing students and faculty on various American (পৃষ্ঠাঃ ১৯০) campuses. They are also appearing on TV and radio interviews to seek support for the Bangladesh struggle.”১৬

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জানিয়েছেন: “এ. এম. এ মুহিত ও  হারুন অর-রশিদ আমার সঙ্গে নিউইয়র্কে পৌছানাের দিনই দেখা করতে আসেন। কিছু বলার আগেই তাদের বুকে বাংলাদেশের ব্যাজ দেখে আনন্দিত হই। তারা তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে কাজ করে  যাচ্ছেন। তারা যথাসময়ে অন্যান্য কূটনীতিবিদের সঙ্গে একযােগে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করবেন বলে জানালেন। অন্যান্য কূটনীতিবিদের সংগে এ নিয়ে আলােচনা হচ্ছে বলেও জানান। আমি বললাম যে, ঘােষণাটাই বড় নয়, কাজটাই বড়। এ, এম, এ মুহিত পাকিস্তান দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিষ্টার  ও হারুন- অর- রশিদ তখন ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসে কাজ করছিলেন। তাঁরা ৪ঠা আগষ্ট অন্যান্য কুটনীতিবিদসহ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে আনুগত্য ঘােষণা করেছিলেন।”১৭

তিনি অন্যত্র আরও লিখেছেন: “এই আগষ্ট মাসের প্রথম দিকেই ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালী অফিসার এ, এম, এ মুহিত, এস, এ. করিম, এনায়েত করিম। এম, এ কিবরিয়া, এ, আর চৌধুরী, আবু রুশদ মতিনউদ্দীন, এস, এম, আলী প্রমুখ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।”১৮

 এ. এম. এ. মুহিত প্রমুখের কৃতিত্বপ্রসঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী বলেন: “প্রতিনিধিদল নিউইয়র্কে আসার অনেক আগে থেকেই তিনি (প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সােবহান) এ, এম, এ, মুহিত, হারুন-অর রশীদ প্রমুখের সহযােগিতায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে সমস্যার কবলে ফেলতে খুবই চেষ্টা করছিলেন।”১৯

দূতাবাসের তৎকালীন রাজনৈতিক কাউন্সেলর শাহ এ এম এস কিবরিয়া তদীয় স্মৃতিকথায় লিখেছেন: “(ওয়াশিংটনস্থ) বাংলাদেশ মিশনের প্রধান দায়িত্ব ছিলাে জনসংযােগ ও প্রচার। প্রচারকার্য সুচারুরূপে করার জন্য আমরা একটা ইংরেজি সাপ্তাহিক কাগজ বাংলাদেশ বুলেটিন প্রকাশ করছিলাম। এই বুলেটিন প্রধান কংগ্রেসের সকল সদস্যের মধ্যে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ও সংবাদমাধ্যমে বিতরণ করা হতাে। মুজিবনগর থেকে যুদ্ধের খবরাখবর পাওয়ার সুবন্দোবস্ত করা হয়েছিলাে। এর ফলে আমাদের বুলেটিন ছিলাে মুক্তিযুদ্ধের প্রচার অভিযানের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এম, আর, সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আমরা পরিকল্পিতভাবে জনমত গঠনে আত্মনিয়ােগ করেছিলাম। স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যােগাযােগ আমিই রাখতাম। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে আমরা দায়িত্ব ভাগ করে কাজ করতাম। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এ আবুল মাল আবদুল মুহিত সক্রিয় ছিলেন। শিক্ষা কাউন্সিলর সুসাহিত্যিক আবু রুশদ মতিন উদ্দিন বুলেটিনের (পৃষ্ঠাঃ  ১৯১) সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে যােগ্যতা অনুসারে কাজ করেছেন। আমাদের মনােবল ছিলো অত্যন্ত দৃঢ় এবং মিশনের পরিবেশ ছিলাে সৌহার্দ্য ও সহযােগিতাপূর্ণ। বস্তুত আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে গণ্য করতাম এবং সেই স্পিরিট নিয়েই আমরা প্রতিটি কাজ করেছি।”২০

খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ রেহমান সােবহান আত্মকথনে উল্লেখ করেছেন (ডিসেম্বর ১৯৮৩ ): “..I proceeded from New York to Washington with Harun-ur-Rashid, a CSP officer who was tha(e)n working with the World Bank. In Washington I was received at the airport by A.M.A. Muhith who was then Economic Minister at the Pakistan Embassy. Whilst  the lobbying in Washington continued, the donors aid consortium to Pakistan still remained an important arena of influence… A.M.A. Muhith and myself put together a fresh document spelling out Pakistan’s circumstances and the case for remaining from any fresh relief to Pakistan just when the liberation war was reaching a critical stage/  Muhith and myself took on the task of tackling the different delegations from the Consortium countries who were attending the meeting, to place our literature to them and to talk with them. Our efforts inside were on one day assisted by Prof. Nurul Islam who flew in from Yale where he was based. Outside the hotel BIC (Bangladesh Information Centre) group had organized small demonstration. Amongst others Joan Dine, accompanied by her baby Amy, still in her pram, participated. On one occasion Muhith found himself linked with the demonstration outside the hotel and was evicted by the security guards from the premises of the Sheraton. Fortunately I was at a distance from these proceedings and managed to rescue the bundle of literature with Muhith to resume our lobbying efforts within the hotel.”২১

এবার স্বয়ং আবুল মাল আবদুল মুহিতের এসংক্রান্ত ভাষ্য উদ্ধার করব। বস্তুত নিজের লেখা বেশ কিছু উল্লেখযােগ্য ও তথ্যবহুল গ্রন্থে বিশেষ করে American Response to Bangladesh Liberation War এবং স্মৃতি অম্লান ১৯৭১-এ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসে ইকোনমিক কাউন্সেলর পদে থাকাকালীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে

আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে তার ব্যক্তিগত ও অন্যদের নানামুখী কর্মতৎপরতার কৌতূহলােদ্দীপক বর্ণনা পাওয়া যায়।

নিচে স্মৃতি অম্লান ১৯৭১ গ্রন্থ থেকেও এসম্পর্কে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে কিছু বিবরণ চয়িত হলাে, যেখানে জনাব মুহিত লিখেছেন: “.পাকিস্তানের সামরিক (পৃষ্ঠাঃ ১৯২) বাহিনী বস্তুতই বাংলার জনগণকে অক্রিমণ করেছে। কামান দাগিয়ে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তারা শুরু করেছে এক ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যালীলা, স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে এইভাবেই গুড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকার। এতেই রচিত হলাে সংযুক্ত পাকিস্তানের কবর এবং শুরু হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্।.. /  সাতাশে বিকেলে ওয়াশিংটনের বাঙালি সমাজ আমার বাসায় হাজির। যে খবর পেয়েছে সেই এসেছে। আমার মনে হলাে পরিবার পরিজন নিয়ে আমাদের সংখ্যা ছিল  প্রায় সত্তর। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবাই হাজির, পাকিস্তানী ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদ করতে হবে এবং একে প্রতিহত করার কথা ভাবতে হবে। ঢাকার হহত্যাযজ্ঞ এবং  দেশব্যাপী ধ্বংসলীলা পাকিস্তানের কবর রচনা করেছে, এখন বিবেচনার বিষয় একটি। কি করে কতাে দ্রুততার সংগে পাকিস্তানী সামরিকবাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে উৎপাটন করা যাবে। উদ্যোক্তা হিসেবে আমাকেই বলতে হলাে আমরা এখন আর পাকিস্তানী নই এবং পাকিস্তানী হায়েনাদের শায়েস্তা করা আমাদের কর্তব্য। প্রবাসে আমরা জনমত গড়ে তুলতে পারি। আমাদের দেশে ত্রাণকার্য এবং যুদ্ধ উদ্যোগে সাহায্য করতে পারি এবং পাকিস্তানকে সর্বতোভাবে অপদস্থ করতে পারি। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হলাে যে, মার্কিন ও আন্তজাতিক নেতাদের কাছে বার্তা পাঠাতে হবে। আরাে ঠিক হলাে যে, সোমবারে শােভাযাত্রা হবে-কংগ্রেসের সিঁড়িতে, বিশ্বব্যাংক ও মুদ্রা তহবিলের সামনে আর স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে।../ ২৯ তারিখের বিক্ষোভের জন্য কাজ ভাগ করে নেওয়া হলাে। প্রথম কর্তব্য ছিল আমেরিকার সর্বত্র খবর পৌছানাে। ঠিক হলাে যে, যার যেখানে যােগাযােগ আছে তিনিই সেখানে খবর দেবেন এবং দলে বলে র্যালিতে যােগ দিতে আহ্বান জানাবেন। উদ্যোক্তা ব্যক্তিরা তক্ষুণি টেলিফোনে ব্যস্ত হয়ে গেলেন এবং ফজলুল বারী এতে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। বাইরে থেকে যারা আসবেন তারা উদ্যোক্তা যে কোনাে ব্যক্তির বাসায় রাত্রিযাপন করতে পারবেন। তাই তাদের বিভিন্ন ঠিকানা বলে দেওয়া হলো। র্যালির জন্য পুলিশের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। এই দায়িত্ব নিলেন ফজলুল বারী এবং মাহবুব আলী। ফজলুল বারী সুনামগঞ্জের অভিবাসী। পড়তে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। ভিসার সুবিধার জন্য তখন দূতাবাসে তিনি একটি ছােটখাট চাকরি করেন। মার্কিন কৃষি বিভাগে একটি ছােট দফতর ছিল আন্তর্জাতিক তুলা কমিটির সচিবালয়। মাহবুব আলী সেখানে চাকরি করতেন। তিনিও সিলেটের অভিবাসী। এরা দুজনই ছিলেন অনেকটা বেপরােয়া। তৃতীয় কর্তব্য ছিল শ্লোগান, ফেস্টুন, পােস্টার ইত্যাদি লিখতে হবে। এই দায়িত্ব নিলেন এনায়েত রহিম। এনায়েত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উচ্চতর শিক্ষায় ওয়াশিংটনে আছেন।.. আর একটি কাজ ছিল দাবিনামা বা আপিল প্রস্তুত করা। এই দায়িত্ব নিলাম হারুন রশীদ আর আমি। পরের দিন নিউইয়র্ক থেকে এস এ করীম এসে (পৃষ্ঠাঃ ১৯৩) আমাদের ভার অনেকটা লাঘব করলেন।/ ২৮ মার্চ আমার প্রথম কাজ হলাে কয়েকটি তারবার্তা পাঠানাে। তারবার্তা বাংলাদেশ নাগরিকদের তরফ থেকে গেল প্রেসিডেন্ট  নিক্সন, সেক্রেটারি রজার্স, নিরাপত্তা সহকারী কিসিনজার এবং সিনেটে বৈদেশিক  বিষয়ের চেয়ারম্যান সিনেটর ফুব্রাইটের কাছে। একই সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব উথান্ট এবং নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে আবেদন পাঠানো হলো।”২২

যাই হােক, এসংক্রান্ত বিশদ বর্ণনা তার আলােচ্যগ্রন্থেই যেহেতু লভ্য, সেহেতু এখানে শুধু যে ব্যক্তিগত দোলাচল ও পারিবারিক অনিকেত পরিস্থিতিতে সেদিন এই সিএসপি কর্মকর্তা জীবনের সবচেয়ে দুঃসাহসী, ঝুঁকিপূর্ণ২৩  অথচ সময়ােচিত সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন সেসম্পর্কে তার ভাষায় আরেকটু বলে এপ্রসঙ্গ শেষ করব। তবে একে একটু না বলে নাতিদীর্ঘই বলতে হবে, কেননা তার এবর্ণনায় এমন আনুষঙ্গিক  তথ্যও পাওয়া যাবে যা থেকে প্রতীয়মান হবে- কার্যত অনেক সিভিল সার্ভিস অফিসারই (সিএসপি-পিএফএস) বা পুলিশ সার্ভিস অভ পাকিস্তান (পিএসপি) বাঙালির ইতিহাসের সেই মহা-যুগসন্ধিক্ষণে প্রয়ােজনীয় সিদ্ধান্তটি নিতে পারেননি বা নিতে চাননি; ২৪ ফলত যারা নিয়েছিলেন, তারাই তাে যুগস্রষ্টা, আজ আমাদের স্বীকত মহাবীর, জাতির চির-নমস্য। অন্যদের সামনে সুযােগ থাকলেও যুগের আহ্বানে সাড়া দিতে না-পারার দোদুল্যমানতা এবং অপারগতার কারণে সেই অনন্য কীর্তিগাথা থেকে তারা মাহরুম- বঞ্চিত হয়েছেন।

জনাব মুহিত জানাচ্ছেন: “সাতাশে মার্চ আমার বাড়িতে যখন ওয়াশিংটনের বাঙালি সমাজ সমবেত হন তখনই আমি ঘােষণা করি যে, পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে এবং আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা ছাড়া কোনাে উপায় নেই। কথাটি নিতান্তই হুজুগে বলিনি কিন্তু এর তাৎপর্য তখন যে একেবারে পরিষ্কার ছিল তা নয়। আমার ছেলেমেয়েরা তখন সবগুলােই বাচ্চা, কনিষ্ঠতম সন্তান টিভিতে বাংলাদেশের নাম শুনলে উত্তেজিত হয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাদের সংগে সলাপরামর্শের কোনাে সুযােগ নেই। মাসখানেক তাে দেশের সংগে কোনাে যােগাযােগ নেই। আমেরিকা বা অন্যত্র যারা পরিচিত তাদের সংগে অনবরত মতবিনিময় হচ্ছে। কিন্তু দূতাবাস ছেড়ে একটি অনিশ্চিত পথে পা বাড়ানাের বিষয়ে একমাত্র পরামর্শদানকারী তখন শুধু আমার স্ত্রী। এপ্রিল এক ট্রান্সের মধ্যে পেরিয়ে গেল। বাংলাদেশে তখনাে দখল সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে পাকিস্তানও খুব জারিজুরি করতে পারছে না। মেতে আসলাে ধীরেস্থিরে বিবেচনার সময় এবং একই সংগে মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতা। পাকিস্তান আমার স্বপ্নের দেশ ছিল। ছাত্রাবস্থায় নানা আন্দোলনে কখনাে নিজেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে হয়নি-যদিও বঞ্চনা ও শঠতা উপলব্ধি করতে হয়েছে।../ সাতাশে মার্চের পরে পাকিস্তান দূতাবাসে থাকলেও আমি কাজ করেছি একান্তই বাংলাদেশের জন্য (পৃষ্ঠাঃ ১৯৪) এবং বাঙালিদের জন্য। সরকারে অবস্থান কোনাে কোনাে ব্যাপারে বাঙালিদের কাজে লেগেছে। যেমন প্রশিক্ষণের মেয়াদ বাড়ানাে, মার্কিন সাহায্যে গম বা সার খরিদ বন্ধ রাখা, বিশ্বব্যাংকের নানা প্রকল্পে বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক সিদ্ধান্ত নেওয়া ইত্যাদি। তবে মে মাস থেকে দূতাবাসে কাজ করা খুব অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। ঔপনিবেশিক মাতৃভূমির ক্রীতদাস হিসেবে অথবা পাকিস্তানের দালাল হিসেবে পরিচিতি আমার অসহ্য মনে হয়। ইতিমধ্যে জনমত গঠনে যারা অবদান রাখতে পারেন তেমন অনেক মার্কিন নেতা বা কর্মীবৃন্দের সংগে হয়েছে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ। মার্কিন মুলুকের বাঙালি মহলের সংগেও আমার পরিচয় ও আনাগোনা ঘনিষ্ঠ। এমতাবস্থায় পাকিস্তান দূতাবাসের সংগে সম্পর্ক বজায় রাখা বস্তুতই একটি অসুবিধা বা বােঝা হয়ে দাঁড়ায়। রাজ্জাক খান ছিল আমার খুব ঘনিষ্ঠ।  তাকে যখন বরখাস্ত করা হলাে, সেদিনই আমার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেল।.. স্বীকার করতেই হবে যে, পরবর্তী মাসটি মােটেই সুখকর ছিল না। রােজগার নিয়ে ততাে সমস্যা ছিল না।../ আমাদের চিন্তা ছিল অন্য বিষয়ে, অন্য রকমের। প্রথমত: যদি মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হয় তাহলে আমরা হবাে দেশহীন।.. আর একটি বিষয় ছিল দেশে আত্মীয়স্বজনের অবস্থান।.. তার উপর রয়েছে আত্মীয়স্বজনের উপর পাকিস্তানী হামলার সম্ভাবনা। কেউ কেউ উপদেশ দিলেন আরাে কিছুদিন অপেক্ষা করতে, একটা যদি হিল্লে হয়ে যায়। আর এক উপদেশ হলাে ইসলামাবাদে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়া। এম এম আহমদ এবং মাহমুদ আলী দুজনাই এই উপদেশও দিয়েছিলেন। আর এক পরামর্শ হলাে যে দূতাবাস ছেড়ে দাও তবে কোনাে আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি নিয়ে চুপ করে সরে পড়াে, মুক্তিযুদ্ধ ভুলে যাও। এই রকম পরামর্শ দিয়েছিলেন ড: নুরুল ইসলাম, জাকারিয়া খান চৌধুরী এবং এক সময়ে মাহমুদ আলী। আমার স্ত্রীকে অনেক শুভানুধ্যায়ী এসে বুঝলেন যে আমি অল্পে উত্তেজিত হয়ে যাই। তাই তাকে শক্তহাতে আমাকে সুস্থির করতে হবে।/ আমার একান্ত নিজস্ব সিদ্ধান্ত প্রথমে জানালাম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে, নিউইয়র্কে ২৯ মে শনিবারে। পনেরাে জুনে আমি দূতাবাস ত্যাগ করবাে। চৌধুরী সাহেবের প্রতিক্রিয়া আগেই লিপিবদ্ধ করেছি। এফআর খানকেও সিদ্ধান্তটি সেদিনই জানাই। তবে পনেরাে জুনের তারিখ পরবর্তীতে আমি তিরিশে জুনে বদলাই এবং সে কথাও বিবৃত হয়েছে।../ তিরিশ জুনে আমি দূতাবাস থেকে বিদায় নিলাম.।”২৫

Reference:

১৫. তথ্য সংগ্রহীত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্রঃ, ষষ্ঠ খণ্ড, মুজিব নগরঃ গণ মাধ্যম, পৃষ্ঠা ৭৯৯।

১৬. তথ্য সংগৃহীত, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৮৮৩।

১৭. তদেব, পৃষ্ঠা ৪০-৪১।

১৮. প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, পৃষ্ঠা ৮৫।

১৯. তদেব, পৃষ্ঠা ১৭৩।

২০. পেছন ফিরে দেখা, পৃষ্ঠা ১০০।

২১. তথ্য সংগৃহীত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র, পঞ্চদশ খণ্ড, সাক্ষাৎকার, পৃষ্ঠা ৪০০-০১।

২২. স্মৃতি অম্লান  ১৯৭১, পৃষ্ঠা ৩৫-৭। তাঁর বক্তব্য জানার জন্য আরও দেখা যেতে পারে বাংলাদেশের  স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র, পঞ্চদশ খণ্ড, সাক্ষাৎকার, পৃষ্ঠা ১৭৬-৮৮।

২৩. ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সৎ, নির্লোভ ও প্রজ্ঞাবান এবং তৎকালীন সিভিল সার্ভিস অভ পাকিস্তানের ধীমান, কৃতী (১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত নিজব্যাচে সমগ্র পাকিস্তানে তার মেধাক্রম তৃতীয়) কর্মকর্তা আবুল মাল আবদুল মুহিত জীবনে এরকম ঝুকি পরবর্তীকালে ও নিয়েছেন। যেমন, ক্যাডার সার্ভিসে বা সরকারি চাকুরির সর্বোচ্চ পদে ( মন্ত্রণালয়ের সচিব) পৌছে যাবার পর এবং তখনও তার ১০ বছরেরও অধিক চাকুরিকাল (জন্ম ০১/০৬/১৯৩৪; চাকুরিতে অবসরের বয়স এসময় ৫৭ বছর ধরে) অবশিষ্ট থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৪৬ বছর বয়সে নীতি-আদর্শের সঙ্গে আপােষ (আপস) করতে না-পারায় চাকুরি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে অকালীন অবসর নিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ১৯৮১ সালে পঁচিশ বছর চাকরি করে আমি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেছি… চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে আমি কারাে পরামর্শ বিশেষ নিইনি। আমার আব্বা সহজেই আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন। চাকরি জীবনে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌছে গেছি কিন্তু টাকা পয়সার অভাবে খুবই কাবু। তাই অবসর গ্রহণে কোন খেদ নেই, নিরাশা নেই, বা অতৃপ্তিরও কোন সুযােগ নেই। (দেখুন তার, মহাপুরুষদের কথা কাছে থেকে দেখা, আবুল মাল আবদুল মুহিত, পৃষ্ঠা ১৩০)।

২৪. আগেই দেখিয়েছি, অনেক সিএসপি-ইপিসিএস কর্মকর্তা সেদিন এই সুযােগটির সদ্ব্যবহার করেননি বা করতে পারেননি। তবে এটা যে শুধু তারাই পারেননি তা নয়, অনেক পিএফএস কর্মকর্তাও পারেননি। যেমন, পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের ১৯৫৬ সাল-ব্যাচের ফারুক আহমেদ চৌধুরী (বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত)-র কথা বলা যায়। তাঁর আজীবনীসদৃশ জীবনের বালুকাবেলায় শীর্ষক গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, ১৯৬৯ সাল থেকে তিনি পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকুরিরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের এপ্রিলের মধ্যনাগাদ দেশে ফিরলেও দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত অবরুদ্ধ পূর্বপাকিস্তানেই অবস্থান এবং পাকিস্তান সরকারের চাকুরি করেন। তার ঢাকায় ফেরার অন্যতম কারণ ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ছােটবােনের স্বামীর শাহাদতবরণে বােনকে সান্ত্বনা দিতে আসা, বিধবা মাকে দেখভাল ইত্যাদি। তাঁর ভাষায়, ‘.. কিন্তু কে জানত যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে নরপিশাচত্রা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? পাকিস্তান ভেঙে হবে বাংলাদেশের অ্যুদয়? কে জানত যে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের চিরদিনের মতো  ইসলামাবাদ ছাড়তে হবে ব্যক্তিগত জীবনের বিয়োগান্ত এবং অনিশ্চিত একটি    পরিস্থিতিতে? ১৯৭১ সালের ২৭ জানুয়ারি সাভারে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আমার  বাবা মত্যুবরণ করেন। ঘটনাটি আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। ১৯৭১ সালে ২ এপ্রিল ইসলামাবাদে খবর পেলাম, ৩০ মার্চ যশাের ক্যান্টনমেন্টে মুক্তিযুদ্ধের  প্রারম্ভেই শাহাদত বরণ করেছেন আমার ছােট বােনের স্বামী লে. কর্নেল সৈয়দ  আবদুল হাই। ঢাকা থেকে ইসলামাবাদে আসা একজন লােকের হাতে ছোট ভাই ইনাম সংবাদটি পাঠিয়ে লিখেছে, মুষড়ে পােড়ো না। বিজয় আমাদের সুনিশ্চি। ‘ এত শােকেও ব্যক্ত দৃপ্ত আশাবাদ। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম যে ঢাকায় আমাদের ফিরে যেতেই হবে। ফিরে যেতে হবে আমার সদ্যবিধবা বোন নাসিম, তার তিনটি ছােট ছেলেমেয়ে আর আমার বিধবা মায়ের কাছে।.. যেহেতু ভারতের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ছিল, তাই আমাদের ঢাকা আসতে হলো করাচি আর লঙ্কা হয়ে, পরদিন অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল।” ( জীবনের বালুকাবেলায়, ফারুক চৌধুরী, পৃষ্ঠা ১৬৮-৯।) অন্যত্র লিখেছেন: “নভেম্বর ১৯৭১-  এর ঢাকা ছিল যুদ্ধকালীন রাজধানীর মতাে। অফিস-আদালত বসত, কিন্তু মন বসত না কাজে। রাস্তাঘাটে ছিল না গাড়ি-রিকশার ভিড়। সন্ধ্যায় নির্জন রাজপথ। থেকে থেকে বােমার শব্দ। কখনাে ব্ল্যাকআউট। কখনাে বা যুগপৎ দুটিই। তারপর খবর আর গুজব।” (তদেব, পৃষ্ঠা ১৮০)। লক্ষণীয়, ভায়ের পত্র মারফত ‘বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত জেনেও তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি বা নিতে পারেননি; কেন নেননি বা নিতে পারেননি সেটা তিনি জানেন। অন্যদিকে তার লেখনীবিত ছােটভাই ইনাম’ পুরােনাম ‘এনাম/ ইনাম আহমদ চৌধুরী ছিলেন সিভিল সার্ভিস অভ পাকিস্তানের ১৯৬০ সাল-ব্যাচের কর্মকর্তা। কাকতালীয় হলেও সত্য যে, তিনিও মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেননি বা করতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি পূর্বপাকিস্তান সরকারের বাণিজ্য ও শিল্প দপ্তরের যুগ্মসচিব ছিলেন এবং সেজন্য স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বরের দখলী সময়ে সামরিক সরকারের খেদমত করে খেতাব বা তমঘাপ্রাপ্ত যে ৫৩-জন সরকারি কর্মকর্তাকে অপসারিত করেছিল, তার ১৩ সংখ্যক ক্রমিকের নামটি ছিল– এনাম আহমদ চৌধুরী, জয়েন্ট সেক্রেটারী, শিল্প ও বাণিজ্য, বাংলাদেশ, ঢাকা’। (দেখুন, অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা, ৮ম বর্ষ, ৭৯শ সংখ্যা, তারিখ ০২/০২/১৯৭২)।

২৫. স্মৃতি অম্লান ১৯৭১, পৃষ্ঠা ১০৮-১৩।

মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা