You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.05.16 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হোক | ভেজাল বিরোধী অভিযান | প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
১৬ই মে, বুধবার, ১৯৭৩, ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হোক

পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য জাতিসংঘের একজন পর্যবেক্ষককে পিন্ডিতে প্রেরণের বিষয়টি সেক্রেটারী জেনারেল মিঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম গভীরভাবে বিবেচনা করছেন বলে জানা গেছে। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ দূত জনাব এম.আর. সিদ্দিকীর সাথে আলোচনাকালে সেক্রেটারী জেনারেল একথা তাঁকে বলেছেন। জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের এই মানবিক বিবেচনা বর্তমান অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারবে কিনা জানিনা, তবে অন্ততঃ বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বিরাট ভরসা হিসেবে কাজ করবে—এ বিশ্বাস আমাদের আছে।
কেননা পাকিস্তানের ভুট্টো সরকার পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের জীবন নিয়ে আরেকটি নতুন খেলায় মেতে ‍উঠেছেন। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত খবরে জানা গেছে যে, ইসলামাবাদ, করাচী, লাহোরসহ পাকিস্তানের সর্বত্রই পদস্থ বাঙালী কর্মচারীদের গৃহে পাকিস্তানী পুলিশরা গভীররাতে হানা দিয়ে তাদের স্ত্রী-পুত্র পরিজনসহ সবাইকে গ্রেফতার করে পশুর মতো টেনে-হিঁচড়ে প্রথমতঃ ট্রাক ভর্তি করেছে এবং তারপরে গুজরানওয়ালা, ওয়ারশাক ও লান্ডীর বন্দীশিবিরে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, দস্যু দুর্বৃত্তদের মতো ভুট্টোর পুলিশ বাহিনী রাতের অন্ধকারে ঘরের দরজা ভেঙে বাঙালী অফিসারদের গৃহে প্রবেশ করে তাদের সর্বস্ব লুন্ঠন করতেও দ্বিধাবোধ করেনি।
এদিকে পাকিস্তানে আটক ১৫ হাজার বাঙালীকে ছেড়ে দেবার জন্য ভুট্টো সাহেব ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিকভাবে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সরকার সে ব্যাপারে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক রেডক্রসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে খোলা মন নিয়ে এগিয়ে গেলেও সে ব্যাপারে ভুট্টো সাহেবের এখন আর কোন কথা শোনা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার এখনো আশাবাদী মন নিয়ে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
ভুট্টো সরকারের আটক বাঙালীদের প্রশ্নে এহেন ছিনিমিনি খেলা আজ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি ‘ব্ল্যাকমেল’ বলেই স্বীকৃত হয়েছে। বৃটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলীয় সদস্য মিঃ পিটার শোর বলেছেন, পাকিস্তানী ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীর মধ্যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারসহ ভারত ও বাংলাদেশ যৌথভাবে যে ঘোষণা প্রকাশ করেছেন, তা এ উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথই প্রশস্ত করেছে। পাকিস্তান সেই ঘোষণায় নৈরাশ্যব্যঞ্জক সাড়া দিয়ে শান্তির পথই বিঘ্নিত করছে মাত্র। তিনি পাকিস্তানের এ ভূমিকার নিন্দা করেছেন।
একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামকালে বাংলাদেশের সর্বত্র ব্যাপক নরহত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন এবং বর্তমানে আটক বাঙালীদের ওপর চরম নির্যাতন ও বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠানের অপচেষ্টার মাধ্যমে পাকিস্তান এখন বিশ্বব্যাপী যে কলঙ্কের কালিমা ও ঘৃণা কুড়িয়েছে, তা থেকে কোনমতে আত্মরক্ষা করার জন্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধবন্দীদের প্রশ্নে মানবতাবাদী ভারতের বিরুদ্ধে এক মামলা দায়ের করছে। কিন্তু এ মামলার শুনানিকালে যে আরো কালিমাময় তথ্য উদ্ঘাটিত হয়ে পাকিস্তানের কলঙ্কিত মুখ আরো কলঙ্কের আবর্তে নিমজ্জিত হবে পাঞ্জাবী উপদেষ্টা এবং চীন-মার্কিন প্রভুত সম্ভবতঃ ভুট্টো সাহেবকে সেকথা বুঝতে দিতে চাইছেন না এবং সম্ভবতঃ ভুট্টো সাহেব নিজেও তা বুঝতে নারাজ।
এমতাবস্থায় জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল সকল রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের ঊর্ধ্বে মানবতাবাদী মন নিয়ে আটক বাঙালীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণে পিন্ডিতে যে পর্যবেক্ষক প্রেরণের চিন্তা করছেন, আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আমরা মনে করি যত শীঘ্রই এই উদ্যোগ নেয়া যায়, ততই ম্ঙ্গল।

ভেজাল বিরোধী অভিযান

বেসরকারী পর্যায়ে পরিচালিত এক জরিপ রিপোর্টে প্রকাশ যে, রাজধানী ঢাকা নগরীতে যত আহার্য সামগ্রী বিক্রি হয়, তার শতকরা ৮০ ভাগই ভেজাল। এই ভেজাল খাদ্য খেয়ে রাজধানীর প্রায় চার লক্ষ লোক বর্তমানে মারাত্মক আমাশয়, গ্যাস্ট্রিক, পাঁচড়া ও খুজলী প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ অভিমত পোষণ করেন।
এই অভিজ্ঞ মহলের মত হ’লো ভেজাল খাদ্যদ্রব্য প্রসূত পুষ্টিহীনতাই সাম্প্রতিককালের যাবতীয় ভয়াবহ ব্যাধি বিস্তারের মূল কারণ। বর্তমানে রাজধানীর প্রতি পাঁচজন লোকের মধ্যে এজন মারাত্মক আমাশয়, অম্লশূল এবং গ্যাস্ট্রিকের ব্যথায় ভুগছেন এবং অচিরেই সর্বস্তরের মানুষ এইসব রোগে আক্রান্ত হবেন এবং আয়ুক্ষয় করবেন বলেই তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
প্রকাশ থাকে যে, বেশ কিছুদিন থেকে প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকাতেই এই ভেজাল খাদ্যদ্রব্য সম্বন্ধে নানা রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের হার যেন পাল্লা দিয়ে অপ্রতিহত গতিতে বেড়ে চলেছে।
অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনা করে আশু তাগিদের ভিত্তিতে ভেজালবিরোধী অভিযান গড়ে তোলার দায়িত্ব ছিলো পৌরসভারই। কিন্তু তারা কতটা দায়িত্বের পরিচয় রেখেছে তা নিম্নোক্ত ঘটনার বিবরণই জানা যাবে।
পৌরসভার অধীনে মাত্র সতেরো জন স্যানিটারী ইন্সপেক্টর আছে, যা ঢাকার জনসংখ্যার ভিত্তিতে খুবই নগন্য। এই কয়টি ইন্সপেক্টর দিয়ে কুড়ি লক্ষ লোকের খাদ্যদ্রব্য সামগ্রীর ভালো-মন্দ আয়ত্তে রাখার পরিকল্পনা সত্যি হাস্যকর।
চাপে পড়ে এই ইন্সপেক্টররা বাজারেও আসে মাঝে মধ্যে এবং দু’একটা জিনিসের নমুনাও সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই! তারপর সব শেষ।
আবার মাঝে মধ্যে যে সমস্ত ভেজাল দ্রব্য বিক্রেতাদের শাস্তি দেওয়া হয়, তাদের শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগই হচ্ছে খুচরো বিক্রেতা। এরা পাইকারদের কাছ থেকে মাল আনে এবং বাজারে ছাড়ে। ভেজাল মেশানোর অপরাধে তাই এদের দায়ী করা যায় না।
ভেজাল মেশানোর ব্যাপারে প্রস্তুতকারী, পাইকার ও ডিস্ট্রিবিউটররাই বৃহৎ ভূমিকা পালন করে থাকে। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোন কার্যকরী পন্থাই গ্রহণ করে নাই।
অপরপক্ষে প্রচলিত আইনের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের একার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। কেননা আইনের বিধান অনুযায়ী কেউ ভেজাল দ্রব্য সম্পর্কে তথ্য দিতে গেলে নিজের পয়সায় ভেজাল দ্রব্যের নমুনা ক্রয় ও বিশ্লেষণের সমস্ত খরচ তাকেই বহন করতে হয়।
এই অবস্থার পটভূমিতে ভেজাল বিরোধী অভিযানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এবং জনগণও যেন সরকারের এই ভেজালবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিতে পারে সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন কোন চেষ্টায় নয়, পারস্পরিক চেষ্টায় ও যৌথ উদ্যোগে সামগ্রিক স্বার্থেই কাজ করার পরিবেশ গড়তে হবে।
অপরদিকে পৌরসভার এই সীমাহীন নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে ভেজাল দ্রব্যসামগ্রীর প্রস্তুতকারকদের মুলোৎপাটনে অতি দ্রুত তৎপর হতে হবে। এ ব্যাপারে কোন গাফিলতিই আর চলতে পারে না।

প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত

ঘটনাটা ছোট্ট হলেও তাৎপর্যপূর্ণ। অন্ততঃ বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তো বটেই। চোরাচালান, মুনাফাখোরী, মওজুতদারী আর সমাজবিরোধী তৎপরতায় সমাজ জীবন যেখানে ব্যাধিগ্রস্ত এমতাবস্থায় সততার দু’একটি ছিটে ফোঁটা দৃষ্টান্ত চোখে পড়লে উৎসাহিত ও উদ্দীপ্ত হতে হয়। অন্ততঃ সমাজ জীবনে একটা সুস্থ জীবন ধারা প্রবাহিত করার জন্য মানুষ এগিয়ে আসতে পারে।
গত সোমবার গণভবনে বরিশালের মূলাদী থানাধীন বড়পাড়ার চর গ্রামের জনাব আয়েজ উদ্দিন শেখ এসেছিলেন। বরিশাল থেকে তিনি এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে দু’হাজার টাকা ফেরত দিতে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পিতা হিসেবে এ টাকা তার নামে বরাদ্দ হয়েছিলো। প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য তহবিল থেকে তার কাছে এ টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু তার ছেলে মোহাম্মদ শেখ শহীদ হয়নি। রণাঙ্গন থেকে বিজয়ীর বেশেই সে ফিরে এসেছে। তাই এ টাকা নেওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না।
জনাব আয়েজ উদ্দিন শেখের সততায় বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হন। তাই বঙ্গবন্ধু টাকাটি তাকেই আবার দান করেন।
বাংলাদেশে জনাব আয়েজ উদ্দিন শেখের মতো মানুষের সংখ্যা কম এটা আমরা বিশ্বাস করিনা। সৎ ও মানবিক গুণাগুণসম্পন্ন মানুষ আছেন কিন্তু একদল সমাজবিরোধী মানুষের যাদের লক্ষ্যই হলো অর্থের পেছনে ছোটা, যেকোন উপায়ে অর্থ উপার্জন করা তারাই যেকোন কারণে হোক সামনে এগিয়ে এসেছে। তাদের অশুভ তৎপরতার ফলে সৎ গুণাগুণসম্পন্ন মানুষেরা সামনে এগিয়ে আসতে পারছেন না। পদে পদে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছেন। এই যে কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা একে অপসারিত করতেই হবে। সকলে সমবেতভাবে চেষ্টা করতে হবে যাতে আয়েজ উদ্দিন শেখের মতো সৎগুণাগুণ সম্পন্ন মানুষগুলো এগিয়ে আসতে পারে। দুর্নীতি ও সমাজবিরোধী তৎপরতার বেড়াজালকে অপসারিত করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সমাজ জীবনকে কলুষমুক্ত করতে পারে। স্মরণ রাখতে হবে একটি মহৎ দৃষ্টান্ত শত শত মহৎ দৃষ্টান্তেরই জন্ম দেয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন