বাকশাল নিয়ে মুজিব-তাজউদ্দীন অভিমান
বাকশাল সম্পর্কে তাজউদ্দীন ভাই বলতেন যে, এটা সঠিক পদক্ষেপ নয়, গণতন্ত্রের জন্য বঙ্গবন্ধু এতকাল যুদ্ধ করে এসেছেন এবং সংসদীয় গণতন্ত্রই হচ্ছে আমাদের দাবি—সেই ‘৫৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত। হঠাৎ করে এই দিক পরিবর্তন করাটা ঠিক হচ্ছে না, এতে কোন প্রয়ােজন মেটানাে যাবে না। একটা কথা আমার মনে আছে, সেটা ১৯৭৪ সাল, বঙ্গবন্ধু তার ইজি চেয়ারে বসে আছেন। সেখানে তাজউদ্দীন সাহেব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব, সেরনিয়াবাত সাহেব, শেখ মণি, তাহের উদ্দিন ঠাকুর এবং আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেই সময় কথা বলতে বলতে হঠাৎ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি যে প্রেসিডেনশিয়াল ফর্মের কথা বলছি তােমরা এটাকে কী মনে কর?’ এর আগে কেউ এরকম আলােচনা শােনেনি। হঠাৎ একটা পিনপতন নীরবতার সৃষ্টি হয়। তখন আমি এই কথাটা বলে ফেললাম যে, “দেখেন, প্রেসিডেনশিয়াল এবং পার্লামেন্টারি সিস্টেমের পক্ষে এবং বিপক্ষে অনেক তাত্ত্বিক আলােচনা আছে। আমি সেগুলাের ভেতর যেতে চাই না। আমি একটা সহজ হিসেবের কথা বলি যে, পৃথিবীতে যত ক্যু হচ্ছে এবং এটা যত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে হয়েছে তার সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সংখ্যা খুবই নগণ্য।’ আমার কথার পর তাজউদ্দীন সাহেব একটা সামগ্রিক বিশ্লেষণ দিলেন যে, রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতির কুফল কী । তারপর তাজউদ্দীন ভাই যখন একটা কনভিন্সিং আরগুমেন্ট করলেন তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘না, না, আমি এ রকম কিছু ভাবছি না। তবে তােমাদেরকে বললাম আর কি।’ এই বলে কথাটার পাশ কাটিয়ে গেলেন। এরও প্রায় ৫/৬ মাস পর গণভবনে আলােচনা হচ্ছিল বাকশাল করা নিয়ে। তখন বেশির ভাগ এমপি এর বিপক্ষে বক্তৃতা করেছিলেন। দুই দিন ধরে ১২৮ জন এমপি এর বিপক্ষে বললেন। বঙ্গবন্ধু তখন আলােচনা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, ‘আমি তােমাদের সব কথা বলতে পারব না, ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে, ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াত শুরু হয়েছে; তারা যখন আসবে তখন আমাকে স্যালুট দেবে, কিন্তু তাদের হাতে স্টেনগান থাকবে এবং তােমাদের কারাে মাথা থাকবে না।
আমি তােমাদের বলছি, তােমরা আমার কথার কোনদিন অবাধ্য হওনি, এবারও হবে না। আমি বলছি যে, তােমরা আগামীকাল এই বিল পাস করবে।’ এই কথা সংক্ষেপে বলে বক্তব্য শেষ করলেন। তারপর বের হয়ে এসে ‘তাজউদ্দীন সাহেবের হাত ধরে তাকে তিনি বাগানে নিয়ে গেলেন। আমি কিছু এমপি-র সাথে লেকের ধারে চলে গিয়েছিলাম, সেখানে কিছু নারকেলের চারা রােপণ হয়েছে। এমন সময় তিনি সেখানে এসে দলবলসহ আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী দেখছ?’ আমি বললাম, আমি নারকেলের চারা দেখছি।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, আমার এই নারকেলের চারাগুলাে কত সুন্দর হয়েছে!” আমি বললাম, “হ্যা, তা তাে ঠিক। কিন্তু আপনি আজকে যে চারাগাছ পুঁতলেন, এই চারা যে কী বিষফল জন্ম দেবে তা বুঝতে পারছি না।’ তিনি বললেন যে, তােমার মাথায় এটা ভূত ?’ এভাবে তিনি পরের দিন বিল পাস করালেন। মঈনুল হােসেন সাহেব এবং জেনারেল
ওসমানী এঁরা দু’জন ভােট দিলেন না। তাঁরা পার্লামেন্টেও গেলেন না, আমরা সবাই গেলাম। হাত তুলে বিল পাস করিয়ে এলাম ৪/৫ মিনিটের ভেতরে। এটা পড়ে দেখারও সুযােগ আমাদের হয়নি। আমার যেটা মনে হয়, আমি কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ চাচ্ছিল সেই সময় থেকে, এবং এটা বােধ হয় বঙ্গবন্ধুর কাছে কোন না কোনভাবে প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধু হয়ত ভেবেছিলেন যে, আর্মিকে রিপ্লেস করবার এটা একটা পদ্ধতি হবে যে তাদেরকেও আমি সাথে নিয়ে নেব বাকশালের ভেতরে। এতে আর্মি, আমলাতন্ত্র এবং অন্যান্য দলের লােকজন সবাই থাকবে। যে কোন পলিসি হােক সবাই মিলে করা হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের ব্যাপারে আমাদের প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি, কামাল হােসেন, আসাদুজ্জামান খান এই তিনজন যুক্তি করি যে, বঙ্গবন্ধুকে আমরা তিনজন গিয়ে বলব তিনি যাতে ওইদিকে পা না বাড়ান। যেদিন বিল পাস হবে সেদিন পর্যন্ত আমরা লবি করলাম। শেষ পর্যন্ত তার ঘরে গেলাম, পার্লামেন্ট ভবনের অফিসে। সেখানে আমরা বােঝানাের চেষ্টা করলাম যে, এমন কোন্ ক্ষমতা তার প্রয়ােজন, কারণ সব ক্ষমতাই তাঁর আছে। Criminal Procedure Code এবং Bangladesh Penal Code-এর সব পাওয়ারই তার আছে। এমন কোন কাজ যেখানে তিনি ঠেকে গেছেন, সেটা যদি আমাদেরকে বলেন তাহলে আমরা এর সমাধান খুঁজতে পারি। এজন্য সংবিধান বদলানাে ঠিক হবে না। কারণ তিনি সবচেয়ে বেশি নিবর্তনমূলক আইনের শিকার হয়েছেন। তাই নিবর্তনমূলক আইন পাস করানাের কোন ব্যবস্থা যেন তিনি না নেন। অনেক কথা এবং আলােচনার পর তিনি বললেন যে, “দেখ, তােমার বিলেত থেকে পাস করে এসেছ, তােমরা পশ্চিমের গণতন্ত্র দেখেছ—এইগুলাে আমাদের দেশে চলবে না। আমি আমার দেশের লােককে জানি ভাল।’ তখন আসাদুজ্জামান খান সাহেব নরম হয়ে গেলেন। তিনি ধরে ফেললেন যে, আমরা বিলেতি চিন্তার লােক আর তিনি দেশি চিন্তার লােক। তখন আসাদুজ্জামান খান সাহেব বললেন যে, ‘বঙ্গবন্ধু দেশের নেতা, প্রধানমন্ত্রী, তিনি যখন বলছেন, তখন আমাদের আর কি বলার আছে।’ তখন আমি আর কামাল হােসেন সাহেব চলে এলাম। আমি তাকে না বলে পার্লামেন্ট ছেড়ে চলে আসি, আর কামাল হােসেন সাহেব তার অনুমতি নিয়ে চলে যান। তাজউদ্দীন সাহেব তখন পার্লামেন্টে। তিনি এই ব্যাপারে আর না বলতে পারেননি। আমি ভােট দেইনি, কামাল হােসেন সাহেবও ভােট দেননি।তাজউদ্দীন সাহেব যে কষ্টটা মনে নিয়ে মারা গেলেন সেটা হল, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নয় মাসে কী হল, কীভাবে দেশটা স্বাধীন হল, কীভাবে এই মুক্তিযুদ্ধটা হল, কার কী ভূমিকা—এই ব্যাপারটা বঙ্গবন্ধু কোন দিন তাকে জিজ্ঞাসাও করেননি। এবং তাজউদ্দীন সাহেব এই নয় মাসের ভূমিকা রিপাের্ট করারও কোন সুযােগ পাননি। এটা তার সবচেয়ে বেশি কষ্ট ছিল যে, এই নয়টি মাস যেন ইতিহাসের পাতায় নেই। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতিটুকুও বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তিনি পাননি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাজউদ্দীন সাহেবের বড় দুর্বলতা ছিল, বঙ্গবন্ধুকে তিন্থি এমনভাবে ভালবাসতেন যে তিনি তার উপর অভিমান করতেন—হয়ত দেখাই করতেন না, বাড়িতে থেকে হয়ত টেলিফোনের জবাব দিতেন না—কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সামনে এলে আবার সবকিছু ভুলে যেতেন। তিনি একথা বলতেন যে, ‘দেশকে আমি ভালবাসি, দেশকে ভালবাসতে গিয়েই বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসেছি এবং দেখেছি যে, দেশের এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বঙ্গবন্ধুর মত একজন নেতা দরকার।’ এই কথাগুলাে তাজউদ্দীন সাহেব ‘৭২-‘৭৪-এর দিকে বলতেন। আবার সেই সময়ের অনেক কিছুই তাজউদ্দীন সাহেব মেনে নিতে পারছিলেন না।
কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব খুব অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে সংগঠন বঙ্গবন্ধু করেছেন সেই সংগঠনেই নিজেকে নিবেদিত করবেন। নিজের প্রচেষ্টাতে আর একটা সংগঠন করবেন—এমন মানসিকতা তাঁর মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যে কাজটি করতে হয়েছে সেই কাজটি তিনি করেছেন সুচারুরূপে। কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে তিনি খুব ব্যথিত বােধ করতেন যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু নেই, ঝামেলাটা তাকে পােহাতে হচ্ছে। কারণ রাজনীতিতে যে কতকগুলাে খুচরাে ঝামেলা থাকে, এই খুচরাে ঝামেলা করতে তিনি মানসিকভাবে কোনদিনই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি নিষ্ঠাবান, চরিত্রবান মানুষ; সে কারণেই হােক বা যে কোন কারণেই হােক, রাজনীতির যে বাড়তি কাজগুলাে থাকে, সে বাড়তি কাজগুলাে করতে তিনি খুব রাজি ছিলেন না। যেমন, পিঠে চাপড় দিয়ে কথা বলা, মাথায় হাত দিয়ে একটু আদর করে দেয়া, পকেট থেকে পাঁচশ’টি টাকা বের করে দেয়া যে, তুমি এই টাকাটা রাখ—এ ধরনের কাজে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। সে কারণে রাজনীতির এই বাড়তি কাজগুলাে তার ঠিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ছিল না। তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার শেষ কথা হয় ১৫ অগাস্ট। ১৫ অগাস্ট আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম এবং অন্য এক বাসায় গিয়ে তাজউদ্দীন সাহেবকে ফোন করলাম। তিনি বলেছিলেন যে, আমি তাে ক্যাবিনেটে ছিলাম না—’ বা এরকম একটা কথা, কিন্তু হঠাৎ লাইনটা কেটে গেল। তারপর ফোন করে আর পেলাম না। ততক্ষণে বােধ হয় তাঁর টেলিফোন কেটে দিয়েছে। তাজউদ্দীন সাহেব পদত্যাগের পর পরিষ্কার করে কিছু বলতেন না, পাশ কাটিয়ে যেতেন অনেক কিছু। তিনি বােধ হয় তখন ভাবতেন যে, দেশটি যেভাবে চলছে এতে পতন অনিবার্য। একে ঠেকাবার উপায় নাই। যখন ত্রিদলীয় ঐক্যজোট হল তখন থেকেই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি খুব শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তার ধারণা ছিল আওয়ামী লীগের বিপক্ষে একটা শক্তিশালী বিরােধী দল থাকলে আমরা একটা ভারসাম্যের ভেতর দিয়ে চলতে পারব। বিরােধী দল আমাদের কাজের সমালােচনা করবে; তার ফলে আমরা সৎভাবে, ভালভাবে এগিয়ে চলব—এবং শক্তিশালী বিরােধী দল গড়ে উঠুক এটা তিনি চাচ্ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন ত্রিদলীয় ঐক্যজোট করলেন তখন দেখলেন যে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের সম্ভাবনা প্রায় লুপ্ত হতে চলেছে। ওই সময় মণি সিংকে আমার সামনেই বলেছেন যে, ‘দাদা, আপনারা ত্রিশূল হয়ে আসলেন। এর এক শূল দিয়ে আপনারা মারবেন বঙ্গবন্ধুকে, আর এক শূল দিয়ে আমাদেরকে, আর এক শুল দিয়ে বাংলাদেশকে।’
– আমীর-উল ইসলাম
– তাজউদ্দীন আহমদ – আলোকের অনন্তধারা