আফ্রো-এশিয়া নীরব কেন?
বাংলাদেশে রক্তের নদী বইছে। গণহত্যা চালাচ্ছে ইয়াহিয়ার সৈন্যদল। আফ্রো-এশীয় রাষ্ট্রগুলাে নীরব কেন? লক্ষ লক্ষ নরনারীর এবং শিশুর মৃত্যুগুলাে তাদের ঘুমন্ত বিবেক জেগে উঠছে না কেন? প্রশ্ন করছেন। ভারত এবং বাংলাদেশের জনসাধারণ। সােজা উত্তর পাওয়া মুস্কিল। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সঠিক সংবাদ এবং কারণ জানেন না পৃথিবীর অনেকেই। সরকারি মহল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বার্থের শিকার। সাধারণ মানুষের মধ্যে সঠিক সংবাদের প্রচার খুবই কম। বাইরের দুনিয়া সাধারণভাবে মনে করে, বাংলাদেশের সংগ্রাম বিচ্ছিন্নতাকামী সংগ্রাম। জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ যে সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাকামী সংগ্রাম চালাতে পারে না—একথা তাদের বুঝিয়ে দেবার লােকের অভাব। সংবাদপত্রগুলাে পশ্চিম ইউরােপ কিম্বা মার্কিন সংবাদ সংখ্যাগলাের পরিবেশিত সংবাদের উপর নির্ভরশীল। ওরা যেদিকে ঝুকবে জনমত সেদিকেই গড়ে উঠবে। প্রকৃতপক্ষে বংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে রােডেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এ দুটি রাষ্ট্রে মুষ্টিমেয় শ্বেতাঙ্গ ফ্যাসিস্ত শােষণ, শাসন এবং নির্যাদন চালাচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর। বাংলাদেশেও তেমনি জনাকয় পশ্চিমা সামরিক নেতা অত্যাচারের ষ্টীম রােলার চালাচ্ছে গােটা পাকিস্তানের জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশই পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতার অধিকারী। এই ন্যায্য অধিকার তারা পায় নি। সংখ্যালঘুরা তাদের শাসন এবং শােষণ করেছে গত তেইশ বছর। নির্যাতিত সংখ্যাগুরুর স্বাধীকারের সংগ্রামই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। ভারতের কাছে তত সহজ নয়। ঘটনাস্থল থেকে তারা বহু দূরে। বাংলাদেশের হয়ে কথা বলার লােকও ছিল না এতদিন। আফ্রো-এশিয়ার প্রগতিশীল রাষ্ট্রগুলাের উপর বাংলাদেশের প্রত্যাশা খুব বেশী। কিন্তু তারা হতাশ করেছে তাকে। তুরস্ক, ইরান এবং সৌদী আরব ঐশ্লামিক জোটের শরিক। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এই ধর্মীয় জোটকে সামরিক জোটে পরিণত করার তালে আছেন এ ক’টি রাষ্ট্রের সামরিক নায়কেরা। তুরস্কের গণতন্ত্র একটা প্রহসন। সৈন্যবাহিনীর নির্দেশে সেখানে মন্ত্রীসভা গজায় এবং তার পতন ঘটে। সেনানায়কদের হুকুম মানতে হয় আইনসভাকে। নইলে চলবে সামরিক শাসন। ইরানের শাহ স্বৈরাচারী এবং রক্ষণশীল। আমেরিকার মুখের দিকে চেয়ে কাজ করেন তিনি। সৌদী আরব মােল্লাতন্ত্রী রাষ্ট্র। সেখানে সমাজবাদ নিষিদ্ধ। সৌদী, ইরানী এবং পাকিস্তানি আঁতাত বাংলাদেশের ঘােরতর শত্রু। সিরিয়া এবং ইরাক নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। সেখানে রাজনৈতক উত্থান-পতন লেগেই আছে। এ দুটি রাষ্ট্রে একদিকে বইছে প্রগতিবাদী ধারা, অন্যদিকে তেমনি মােল্লাতন্ত্রী মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রভাবও একেবারে কম নয়। ওদের বৈপ্লবিক রণ হুঙ্কার প্রচণ্ড, কাজের বেলায় অষ্টরম্ভ। ১৯৬৭ সালে আরব-ইস্রাইল লড়াই সময়মত নাসেরের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি সিরিয়া। ইহুদী সৈন্যরা জর্ডানে করেছিল শুধু পয়িতারা। সঙ্কটকালে সৌদী আরব শুধুমাত্র হুঙ্কার দিয়ে কর্তব্য শেষ করেছিল। বাংলাদেশ বহু দূরে। কিন্তু ঘরের কাছ ইয়েমেন। তার গৃহযুদ্ধে গণতন্ত্রীদের সমর্থনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন নাসের। রাজতন্ত্রীদের পক্ষ নিয়েছিল সৌদী আরব। তাকে মদৎ দিয়েছিল বৃটেটন এবং পাকিস্তান। এদের বিরুদ্ধে একাই লড়েছিল মিশর। তাকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করে নি সিরিয়া কিম্বা ইরাক। অথচ এদের মুখে ফুটে গণতন্ত্রী বিপ্লবের খই। কিন্তু সংযুক্ত আরব রিপাবলিক?
বাংলাদেশ সম্পর্কে তার নীরবতা একটা বিরাট বিস্ময়। ম্লান হয়ে গেছে কি সেখানে গণতন্ত্রী আদর্শের ঐতিহ্য? কঙ্গোর গণতন্ত্রী সংগ্রামের আহ্বানে মার্কিন সাহায্য ছুড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন নাসের। তার সহকর্মী প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদত নির্বাক কেন? হয়ত তিনি নিজের সমস্যায় ককেবারে ডুবে আছেন। মিশরের বিস্তৃত ভূভাগ ইস্রাইলের দখলে। যে কোন সময় আবার একটা যুদ্ধ বাধতে পারে। তার আর্থিক চাহিদার খানিকটা মিটার সৌদী আরব। বছরে তিনি পান ন’ কোটি পাঁচ লক্ষষ পাউন্ড। ইস্রাইলের বিরুদ্ধে গোড়া ঐশ্লামিক জাহানের সমর্থন মিশরের দরকার। নানা দিক ভেবেই হয়ত তিনি বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের পক্ষে কোন কিছু বলতে চান না। কিন্তু আফ্রিকার প্রগতিবাদী রাষ্ট্রগুলাের কোন কৈফিয়ৎ নেই। রােডেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ ফ্যাসিস্ত নিপীড়নের নিন্দায় তারা পঞ্চমুখ। রাষ্ট্রসঙ্ে দিনের পর দিন চলে প্রচণ্ড আলােড়ন। ভারত তাদের একনিষ্ঠ সঙ্গী। বাংলাদেশও চলছে মুষ্টিমেয় ফ্যাসিস্তের গণহত্যা। এরা শ্বেতাঙ্গ নয়, বাদামী। অত্যাচারীর গায়ের বাদামী রং তীব্র নিন্দা থেকে রেহাই পাবার পাশপাের্ট নয়। আজ যদি আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলাে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার পাশে দাঁড়াবার সংসাহস না পায় তবে এঙ্গোলা, রােডেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে কথা বলার নৈতিক জোর তারা হারিয়ে ফেলবে। পক্ষপাতদৃষ্টির অভিযােগ আসবে তাদের উপর। আরব রাষ্ট্রগুলাে সম্পর্কেও একই কথা প্রযােজ্য। ইস্রাইল অধিকৃত আরবভূমিতে ইহুদী অত্যাচারের প্রতিবাদে তাদের বিবেক জেগে উঠবে, আর বাংলাদেশের বেলায় তা ঘুমিয়ে থাকবে—এ সুযােগসন্ধানী বিবেকে কারও আস্থা নেই। জর্ডানের আভ্যন্তরীন সমস্যা এই বাদশাহী অছিলা শুনে না কেউ। বাংলাদেশের বেলায় তাদের কথা—ওটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন সমস্যা। দুমুখাে নীতির কোন মূল্য নেই বিশ্বের বিবেকবান জনগণের কাছে। তারা যদি বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা না জেনে থাকে তবে তা জানার সুযােগ এসে পড়েছে। ইয়াহিয়া খান তাড়িয়ে দিয়েছেন বিদেশী সাংবাদিকদের। পাকিস্তান এখন বন্ধ কারাগার। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ খুলে দিয়েছেন মুক্ত বাংলার দ্বার। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন বিদেশী সাংবাদিক এবং কূটনৈতিকবিদদের। তারা যান মুক্ত অঞ্চলে। দেখে আসুন ইয়াহিয়ার মহাশ্মশান এবং তার পাশে গণতন্ত্রী বাংলার গৌরব অভ্যুত্থান। তারপর বলুন—সত্য এবং ন্যায়নীতি কোন পক্ষে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৬এপ্রিল ১৯৭১