You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.03.10 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | | মর্মান্তিক দুর্ঘটনা | মানসিক রোগীদের চিকিৎসা | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১০ই মার্চ, রবিবার, ১৯৭৪, ২৬শে ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

সূতা বন্টনের পদ্ধতি পরিবর্তন প্রসঙ্গে

সূতা নিয়ে দুর্নীতি ও কেলেংকারী সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সূতা বন্টন পদ্ধতির পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে গতকাল স্থানীয় একটি দৈনিকে।
প্রকাশ, পরিবর্তিত পদ্ধতি অনুসারে বিসিক ও সমবায় কর্তৃপক্ষের স্থলে ভোগ্যপণ্য কর্পোরেশনের মাধ্যমে সূতা বন্টন করা হবে। ভোগ্যপণ্য কর্পোরেশন তাঁত জরিপ রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রদত্ত বিশেষ কার্ডের মাধ্যমে সূতা বন্টন করবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত সূতা নিয়ে যে দুর্নীতি ও কেলেংকারী চলেছে তার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। ভুয়া তাঁতের দৌরাত্ম্যে আসল তাঁতীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। আর তারই ফলশ্রুতিতে একদিকে যেমন তাঁতীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তেমনি কাপড়ের দামও তিনগুণ চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, সাধারণ একটা গামছার দামও দশ টাকার নিচে নয়। অথচ এমন তো হওয়ার কথা নয়। আসল তাঁতীরা যদি ঠিকমতো সূতা পেতো তাহলে এতটা দাম বৃদ্ধি পেতো না।
চট্টগ্রামে সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালিয়ে ৭৮টি ভুয়া তাঁতের সন্ধান পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জে পাওয়া গেছে ভুয়া হোসিয়ারীর ঠিকানা। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও যে ভুয়া তাঁত নেই এমনটি জোর দিয়ে বলা যাবে না।
স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে যে, দেশের সর্বত্রই একদল ভুয়া তাঁতী সংঘবদ্ধভাবে সূতার কালোবাজারী চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং ওদের উচ্ছেদ করতে না পারলে মূল সমস্যার সমাধান হবে না—কাপড়ের দামও কমবে না।
সূতা বন্টনের ক্ষেত্রে সরকার যে পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন সে সম্পর্কে আমাদের বলার কিছু নেই। তবে এ প্রসঙ্গে দু’টো বিষয়ের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই আমরা। পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত অনুসারে ভোগ্যপণ্য কর্পোরেশন সূতা বন্টন করবেন এবং তা করবেন জরিপের মাধ্যমে। ভোগ্যপণ্য কর্পোরেশন জন্মের পর থেকে খুব একটা সুনাম অর্জন করতে পারেননি। তাছাড়া জরিপ করার সময় কোনো কারচুপি যাতে না হয় সে দায়িত্ব ভোগ্যপণ্য কর্পোরেশন নিতে পারবেন কি? যদি পারেন ভালো কথা। আমরাও চাই, ভোগ্যপণ্য কর্পোরেশন নতুন দায়িত্বটি সুষ্ঠুভাবে পালন করুন। দেশের সূতা সংকট ও বস্ত্র সংকটের একটা সুরাহা হোক।

মর্মান্তিক দুর্ঘটনা

আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারী বুমেদিন গত শুক্রবার এক স্বল্পকালীন সফরে ঢাকা এসেছিলেন। তাঁর সম্মানে ঢাকায় প্রাণঢালা সম্বর্ধনাও আয়োজিত হয়েছিল। চীন, উত্তর কোরিয়া এবং উত্তর ভিয়েতনাম সফর করে প্রেসিডেন্ট বুমেদিন ঢাকা এসেছিলেন। প্রেসিডেন্ট বুমেদিন হ্যানয় থেকে শুক্রবার ঢাকা এসে আবার শুক্রবার দিনই ঢাকা থেকে সরাসরি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনাকালে প্রেসিডেন্ট বুমেদিন আশা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশ ও আলজিরিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দিন দিন আরো জোরদার হবে।
আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিনকে আমরা বাংলাদেশে স্বাগতম জানিয়েছি। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পরেই যে আমাদের একটা অনভিপ্রেত মর্মান্তিক খবরের মুখোমুখি হতে হবে তা আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।
প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের দূরপ্রাচ্য সফরোপলক্ষে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাংবাদিক প্রতিনিধি দল সঙ্গে ছিলেন। গতকাল আলজিয়ার্স থেকে প্রাপ্ত এক খবরে জানা গেলো যে, গত শুক্রবার আলজিরিয়ায় সাংবাদিকদের বহনকারী বিমানটি হ্যানয় সামরিক বিমান বন্দরে অবতরণকালে দুর্ঘটনায় পতিত হয় এবং ঐ দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের সঙ্গে সফররত পনেরো জন সাংবাদিকেরই মর্মান্তিক প্রাণবিয়োগ ঘটে। উত্তর ভিয়েতনাম সরকারের প্রদত্ত ধার করা ‘আশুনভ’ বিমানে আলজিরিয়ার সাংবাদিক দলটি সফর করছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি আমরা এহেন মর্মান্তিক এবং দুঃখজনক দুর্ঘটনার জন্যে আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। আলজিরিয়ার সাংবাদিকরা কেমন করে দুর্ঘটনার শিকার হলেন তা প্রাথমিক সংবাদে বিস্তারিতভাবে জানা না গেলেও খবরটি যে আমাদের জন্যে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত তা না বলাই ভালো। এমনি দুর্ঘটনার ফলে আমরা আমাদের কতিপয় বাঘা বাঘা সাংবাদিককে কায়রোর বিমান দুর্ঘটনায় চিরতরে হারিয়েছিলাম। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো এই যে, প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের সঙ্গে আলজিরিয়ার যে সব সাংবাদিক সফরে এসেছিলেন তারা নিশ্চয়ই সেদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক। এইসব স্বনামধন্য সাংবাদিকদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ফলে আলজিরিয়ার সংবাদপত্র জগতে একটা শূন্যতা দেখা দেয়াই স্বাভাবিক। আমাদের বন্ধু দেশের এই সব লোকান্তরিত সাংবাদিকদের প্রতি আমরা আন্তরিক সমবেদনা প্রকাশ করছি। কর্তব্য পালন করতে এসে যারা আজ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে জীবনকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিলেন, তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতিও রইলো আমাদের ঐকান্তিক সহানুভূতি।

মানসিক রোগীদের চিকিৎসা

প্রয়োজনীয় বিচার বুদ্ধি খাটিয়ে সুস্থ, স্বাভাবিক ও সামাজিক জীবন-যাপন করতে প্রত্যেক মানুষেরই একটা ন্যূনতম মানসিক শক্তি বা ভারসাম্যের অধিকারী হওয়া লাগে। যতক্ষণ এ ভারসাম্যের কোনো ব্যতিক্রম না ঘটে, ততক্ষণ কোনো বিশেষ ব্যক্তি সুস্থ আছেন বলেই ধরে নেয়া যেতে পারে। আর কোনো লোক যখন তার এই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ব্যতিক্রম ধরনে বা অস্বাভাবিকভাবে কোনো গতিবিধি প্রকাশ করে, তখনি সাধারণভাবে তাকে মানসিক রোগী বলা যেতে পারে। চলতি কথায় এ ধরনের মানসিক রোগীকে পাগলও বলা হয়।
মানসিক রোগের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, অনেক বা একাধিক কারণেই মানুষ মানসিক রোগের শিকারে পরিণত হয়। যেমন, প্রিয়জনদের একটানা মৃত্যু দেখলে, বিশেষ প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটলে, কোনো কঠিন রোগ হলে, কোনো সড়ক বা অন্যকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে, কোনো অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ পেলে, হঠাৎ ধন সম্পত্তি হারালে ও আরো অনেক কারণে মানুষ মানসিক রোগের শিকার হতে পারে। অনেক সময়ে প্রেমে ব্যর্থতা বা অশেষ কষ্ট সহিষ্ণুতার কারণেও এ মানসিক রোগ হতে পারে।
এভাবে হিসাব করে মানুষের এ মানসিক রোগের কারণকে সামাজিক কারণে, অর্থনৈতিক কারণে, ব্যক্তিগত কারণে, পারিবারিক কারণে ও আকস্মিক কারণে বলেও পর্যায়ভুক্ত করা যেতে পারে।
গত শুক্রবার ঢাকায় বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের তৃতীয় জাতীয় সম্মেলনে আয়োজিত এক সেমিনারে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ হেদায়েতুল ইসলাম যে তথ্য প্রকাশ করেন, তাতে জানা যায় যে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৮ লক্ষ লোক গুরুতর মানসিক রোগে ভুগছে।
এছাড়া, সাধারণ মানসিক রোগীগুলো কোনো না কোনো কারণে পাগল হয়ে থাকে, বাংলাদেশে সাধারণ মানসিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ লক্ষ। মানসিক বৈকল্যের কারণে আত্মহত্যার হারও উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তার বিরচিত ‘এ কেস অব সাইকোলজিক্যাল মেডিসিন’ শীর্ষক প্রবন্ধের মতো, আমাদের দেশে নাকি মানসিক রোগীর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে যেহেতু ভারতের সঙ্গে আমাদের অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাদৃশ্য আছে সেজন্য তাদের পরিসংখ্যান থেকে এবং অন্যান্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপের ভিত্তিতে এ কথা ধারণা করা যায় যে, আমাদের দেশের প্রায় ৮ লক্ষ লোক এ রোগে ভুগছে, অথচ এ রোগের চিকিৎসার জন্যে আমাদের আপাততঃ যে ব্যবস্থা আছে তা’ নাকি খুবই অপ্রতুল। দেশে মানসিক রোগীর জন্যে শয্যা আছে মাত্র ৪৫০টি। তার মধ্যে ৪০০ শয্যা পাবনা মানসিক হাসপাতালে আছে। এ সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় এতো কম যে, পাবনার সন্নিহিত এলাকার রোগীদের দিয়েই হাসপাতাল সচরাচর ভর্তি থাকে এবং ফলে দূরাঞ্চলের রোগীদের ভর্তি করা সম্ভব হয় না। এজন্যে ডাঃ হেদায়েত শয্যার সংখ্যা দু’হাজার পর্যন্ত উন্নীত করার জন্য এক সুপারিশ দিয়েছেন।
আমাদের মনে হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত এবং উল্লেখিত সংখ্যার যথার্থতা বিচার করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এজন্য, পাবনা মানসিক হাসপাতালকে কেন্দ্র করে বা অন্য কোনো উপযুক্ত স্থানে মানসিক রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দানের জন্যে একটি ইন্সটিটিউট স্থাপনও যথেষ্ট উপযোগী হবে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। কারণ, মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষের উপযুক্ত চিকিৎসায় কোনো রকমের কার্পণ্য করলে আমরা আগামী সুস্থ বুদ্ধির কাছে শুধু অপরাধীই সাব্যস্ত হবো না, আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নানা ধরনের অসুবিধাও সৃষ্টি হবে। যার জের পোহানো খুব একটা সহজসাধ্য কাজ হবে বলা চলেনা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন