নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৬ এপ্রিল, ১৯৭১
শকুন ও বুনো কুকুর
প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রায় দু’সপ্তাহের বেশি সময় ধরে প্রতীক্ষার এর কৌতূহলী খেলায় রত ছিলো। তারা দৃঢ়ভাবে তাদের দ্বিখণ্ডিত দেশের বিদ্রোহী পূর্বভাগের শক্তিশালী ক্যান্টনমেন্ট গুলোতে অবস্থান করেছে এবং তারা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গড়ে তোলা ‘মুক্তিবাহিনী’ কে অবজ্ঞা করেছে। কিন্তু গত সপ্তাহে হঠাৎ তাদের ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠেই পাঞ্জাবী সৈন্যদল একসাথে কঠোর পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে থাকে এবং অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের সমস্তটা জুড়ে এক ডজনেরও বেশি বিধ্বংসী আক্রমণ চালায়। আর যখন তাদের এই প্রবল ঝটিকা আক্রমণ গুলো শেষ হয় তখন এটা পরিষ্কার বুঝা যায় যে এক মাসেরও কম বয়সী বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র (বাঙালী জাতি) এ আঘাতে অচেতন হয়ে পড়েছে।
এ গৃহযুদ্ধে ইতিমধ্যে বর্বরতা লক্ষণীয়, পাকসেনাদের বজ্রাঘাতগুলো শুধুমাত্রই পশুত্বের চিহ্ন। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালী কয়েদিদেরকে ট্রাকের সামনে তুলে তাদের স্বাধীনতার স্লোগান ”জয় বাংলা” বলতে বাধ্য করছে। যখন বাঙ্গালি তাদের লুকোনো গোপন জায়গা থেকে বের হয়ে এসেছে, তখন পাকিস্তানি সেনারা তাদের সয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা সরাসরি তাদের গুলি করছে। . পূর্ব সীমান্তের শহর সিলেট ও কুমিল্লাতে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সমর্থকদের ও বহু কৃষক কে নির্মম ভাবে হত্যা করে তাদের মৃতদেহ ফেলে যায় যেগুলি পরে বুড়ো শকুন ও শিকারী কুকুর ছিন্নভিন্ন করে।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের উগ্রতম সামরিক অভিযান গুলো দেখলেই বোঝা যায় যে, সাধারণ সামরিক যুদ্ধ হতেও তাদের উদ্দেশ্য অনেক বেশি ভয়ংকর, লোকালয়ের পর লোকালোয়। আসলে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনিতিকে তারা ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে যাতে স্বাধীনতা সংগ্রাম কে পিষে ফেলা যায়। ইসলামাবাদের হাই কমান্ডের নির্দেশেই পাক সেনারা কৌশলে ছাত্র, প্রকৌশলী, ডাক্তার সহ এমন যে কোনো কেউ যার নেতৃত্ব দেবার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের হত্যা করছে ; তারা স্বাধীনতাবাদী হোক আর না-ই-হোক। একজন বাঙালী সৈন্যের মতে, ”ওরা আমাদের আবার সেই আঠারো শতকে ঠেলে দিতে চাইছে, যেনো আবার দুর্ভিক্ষ হয়, আর আমরা বাঁচার তাগিদে ঘাস খেতে বাধ্য হই। তারা এটাই নিশ্চিত হতে চায় যে, তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কখনো রুখে দাঁড়াতে পারবে না”। .
সব বিধ্বংসী আক্রমণের বিরুদ্ধে বাঙালীরা তেমন প্রতিরোধ করতে পারেনি। মুজিবের আওয়ামীলীগ সহকর্মীরা বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন মন্ত্রী সভা গঠন করেছে ও ঘোষনা করেছে, ‘ বাংলার আকাশে যতক্ষন সূর্য থাকবে ততক্ষণ যুদ্ধ চলবে।’ বিদ্রোহীরা আশা করেছে, আসছে বর্ষার শুরুতেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিন্ন হবে। বাঙালিদের পক্ষের একজন বিশ্লেষক বলেন, ‘ সরবরাহ পথ হল ইয়াহিয়া খানের একিলিস হিল। আমাদের হিসাব মতে পাকসেনারা বর্ষায় কোনো সাপ্লাই পাবে না। কমান্ডাররা এতে সন্তুষ্ট থাকবে না। .
বন্দী
পশ্চিমা নেতারা খুশি হোক কিংবা বেজার, পর্যবেক্ষকদের মতে তাদের আত্মবিশ্বাসের ভালো কারণ রয়েছে। পশ্চিমারা মুজিবকে বন্দী করতে বলেছে এবং দেশদ্রোহের অভিযোগে আদালতে তার বিচার হতে যাচ্ছে। অপরদিকে এই শক্তিশালী ৫১ বছর বয়সী নেতা যিনি সংগ্রামের প্রতীক তিনি বন্দি থাকায় নতুন সরকারের কার্যক্রম একটু ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। আর রণক্ষেত্রে ২৫০০০ এর বেশি সাথীকে হারিয়ে বাঙালীরা টলটলায়মান অবস্থায় রয়েছে।
তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাঙালীদের যুদ্ধ বিন্যাস পদ্ধতি সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ। গত সপ্তাহে মিলান জে. কিউবিক পূর্ব পাকিস্তান ঘুরে এক তারবার্তায় জানান, ‘আমি বর্ধমানে শরণার্থীদের ধারাবাহিক স্রোত দেখলাম, যারা মাথায় করে বড় বড় পুটুলি এবং ছোট ছোট ঝাঁকে ঝাঁকে হাড় জিড়জিড়ে ছাগল ও বাছুর চড়িয়ে এগুচ্ছেন’। ‘কিন্তু আমি মাত্র একটাই টয়োটা জিপ দেখলাম যা ‘মুক্তিফৌজ’ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সৈন্যদের। গাড়িটির নিরস্ত্র ড্রাইভার যার বাড়ি ঝিকরগাছা -রাস্তার উপরে থাকা শত্রুদের নিয়ে সে একটা পরিকল্পনা করল, কিন্তু সে কিংবা তার সাথের অন্য দুজনের কিভাবে তাঁদের মোকাবিল করবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ‘আমরা কি দিয়ে লড়াই করবো? আমাদের কিছু নাই।
প্রতিবেশী
গা ছাড়া মনোভাব মনোভাব এবং একই সাথে কেন্দ্রীয় নেতাদের কার্যকরী ভূমিকার অনুপস্থিতির প্রভাব বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য খুব ভালো হবে না। কিন্তু একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন রয়ে যায় : শক্তিশালী প্রতিবেশী চীন ও ভারতের প্রতিক্রিয়া। পশ্চিমাদের অভিযোগ মতে দুষ্টু প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত দ্বন্দ্বের প্রায় শুরু হতেই পূর্ব পাকিস্তানিদের বিপক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। গত সপ্তাহে ইসলামাবাদ জানায় তারা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দু’টো কোম্পানীকে পুর্ব অঞ্চল থেকে হটিয়ে দিয়েছে।
পূর্ব প্রদেশের পক্ষে কাজের অভিযোগ ভারত সরাসরি অস্বীকার করে। তবে বেশিরভাগ পর্যবেক্ষকই তাদেরকে সমর্থন করেছেন। তার উপর দেখা গেছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার দেশে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছেন – যদিও অনেকের তা নিয়ে সন্দেহ আছে ।কারণ তারা পুর্ব অঞ্চলের পুরো মাত্রায় হত্যাযজ্ঞের খবর জানেন। তবে এটাও সত্য যে নয়া দিল্লি বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়েছে ইসলামাবাদকে চড় দেবার জন্য। সমস্ত সপ্তাহ ধরে ভারতীয় পত্রিকাগুলি পাকিস্তানের ব্যাপক নৃশংসতার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। এবং ভারতীয় মন্ত্রীসভায় বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে জনগণের মাঝে প্রচারণা চালিয়েছেন এবং গোপন আলোচনা করেছেন।
চৌ’ এর টেলিগ্রাফ
পিকিং পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষে আশাতীত সমর্থন দিয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গত মাসেই তারা পরিষ্কার বিবৃতি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই ইয়াহিয়া কে একটি টেলিগ্রামে বলেন ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের’ ধ্বংস করতে এবং তাদের দেশের সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে চাইনিজরা পাকিস্তানিদের সাহায্যের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ’। গত সপ্তাহে সমগ্র এশিয়ায় গুজব ছড়িয়েছিলো যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বেইজিংয়ের সাথে আলোচনা করেই মিলিটারি ক্র্যাক ডাউন করেছিল। বাকি সব অশুভ লক্ষণ ও ষড়যন্ত্র মুকাবিলা দেখে উপমহাদেশীয় বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন যে, এসব বাগাড়ম্বর পূর্ণ উক্তি ধাপে ধাপে বাস্তব কাজে রূপ নেবে, যদিও তা নিকট ভবিষ্যতে অন্তত নয়। চিন-ইসলামাবাদ মিত্রতা ভারতের কাছে অনেকটা ধরেই নেয়া। অন্যদিকে ভারতীয়রা বর্তমানে তাঁদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় আচ্ছন্ন। তবুও ইয়াহিয়া খানের মনোভাব ও ভারতের আবেগপূর্ণ প্রতিক্রিয়া রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের নিয়ামক হতে পারে। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন যদি যুদ্ধ ও রক্তক্ষয় চলতে থাকে তাহলে সামান্য একটি স্ফুলিঙ্গ সমস্ত এলাকায় আগুণ ধরিয়ে দিতে পারে – এবং সমস্ত পাকিস্তান, ভারত এমনকি চীন ও তাতে ধ্বংস হতে পারে।