You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.14 | নিউ ইয়র্ক টাইমস, এপ্রিল ১৪, ১৯৭১ হত্যাযজ্ঞের মধ্যে বাঙ্গালীদের মন্ত্রীসভা গঠন - সংগ্রামের নোটবুক

নিউ ইয়র্ক টাইমস, এপ্রিল ১৪, ১৯৭১
হত্যাযজ্ঞের মধ্যে বাঙ্গালীদের মন্ত্রীসভা গঠন

নিম্নলিখিত সংবাদটি আমাদের নিউ দিল্লীতে অবস্থানকারী সংবাদ দাতা প্রেরন করেছেন। যার পূর্বে তিনি ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে একটি চার দিনের সফর সম্পন্ন করেন।

সিডনি এইচ শ্যানবারগ
নিউ ইয়র্ক টাইমস বিশেষ প্রকাশনা

১৩ এপ্রিল, আগরতলা, ভারত- খবর অনুযায়ী, পূর্ব পাকিস্তানে গনহারে হত্যাকান্ড চলছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের বেশিরভাগকেই হত্যা করা হলেও, এই আন্দোলনের উচ্চ পর্যায়ের অনেক সদস্যই এখনও বেচে আছেন এবং তারা একটি মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন। এই মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের মধ্যে তাজউদ্দিন আহমেদকে, শেখ মুজিবর রহমানের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত দলনেতা হিসেবে অভিষিক্ত করা হয়। শেখ মুজিবর রহমান, যার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ স্বাধীনতার আন্দোলন করেছিল এবং যার ফলস্বরূপ আজ পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের উপর হামলা করেছে।

সংবাদদাতার পরিদর্শিত একটি সীমান্ত এলাকায়, যা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত, কমপক্ষে ৬ জন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা মিলিত হয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করে মিঃ আহমেদকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেন, যেই দেশের নাম তারা দিয়েছেন বাংলাদেশ, বা বাঙ্গালীর দেশ। তারা শেখ মুজিবকে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন, যদিও এই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাগন গোপনে স্বীকার করেন যে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে কারারুদ্ধ অবস্থায় আছেন।

যখন কেন্দ্রীয় সরকার, যা মুলত পশ্চিম পাকিস্তানীরাই নিয়ন্ত্রন করেন, ক্রমাগত বলছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন শান্ত আছে এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে, তখনই এমন একটি সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রমধর্মী দৃশ্যের অবতারনা হল।

প্রতিদিনই যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হবার খবর

বিভিন্ন আস্থাভাজন খবরসুত্র জানিয়েছে যে রোজই পূর্ব পাকিস্তানে সংঘর্ষ সঙ্ঘটিত হচ্ছে। দলে দলে পূর্ব পাকিস্তানিরা শহর থেকে পালিয়ে হয় শরণার্থী হচ্ছেন আর নয়তো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সেনাদলে যোগ দিচ্ছেন। আর হাজার হাজার শরণার্থী, বাক্স-পেটরা বা বস্তায় তাদের যতসামান্য জিনিসপত্র নিয়ে অস্থায়ী নিরাপদ আস্রয়ের খোজে সীমানা পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করছেন।

সংবাদদাতা পাকিস্তানী সৈন্যদের মুক্তিবাহিনীকে ধরিয়ে দেয়া বা তাদের আস্তানার খোজ দেয়াতে অস্বীকৃতি জানানোর অপরাধে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে দেখেছে। আগুনে পোড়া খর আর বাশের তৈরি কুড়েঘরের ধোয়ায় কুমিল্লা শহরতলীর আকাশ ভারী হয়ে উঠছিল, আর নিচে কুকুর বা শেয়ালের টেনে নিয়ে যাওয়া গ্রামবাসীদের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহের উপরে চক্কর দিচ্ছিল শকুন।

সাড়ে সাত কোটি পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে ঠিক কতজনকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছে তা জানার কোন উপায় নেই, কিন্তু বিভিন্ন নিরভরযোগ্য সুত্রের খবর অনুযায়ী তা কমপক্ষে দশ হাজার, কোন কোন প্রতিবেদন সংখ্যাটি এর চেয়েও বেশি বলে জানিয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সকল বিদেশী সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। পাকিস্তানিরা সেনাদের বার বার আক্রমনস্বত্বেও সবাধিনতাবাদীদের দখলে থাকা কিছু গ্রামীন এলাকায় তথ্য অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সকল নেতা ও তরুণদের হত্যা করেছে এবং তাদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিতে এ অঞ্চলের অর্থনীতির ভিত ধংশ করে দিয়েছে।

সম্পূর্ণ পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়ে গঠিত এই সেনাবাহিনী নির্বিচারে হত্যা করছে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক বা নেতৃত্ব দিতে সক্ষম এমন যেকাউকেই, তার এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সম্পৃক্ততা থাকুক বা না থাকুক।

২৫শে মার্চে শুরু হওয়া এই সেনা আক্রমনের পূর্বে যেসব পূর্ব পাকিস্তানি আর্মি অফিসার ও সিপাহিরা পালিয়ে যেতে পারেনি বা গেরিলা বাহিনীতে যোগদান করেনি, কেন্দ্রীয় সরকারের লেলিয়ে দেয়া বাহিনী হয় তাদের হামলা করে হত্যা করেছে আর নয়ত মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করেছে। বেশিরভাগ অফিসারদের পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করা হয়, তাদের মধ্যে সামান্য কয়েকজনই পালাতে পেরেছেন।

আকাশ বা নৌপথে খাদ্য মজুদ, চা কারখানা, পাটকল বা প্রাকৃতিক গ্যাস খনিগুলোতে গোলাবর্ষণ করার সুযোগ পেয়ে আর্মিরা পূর্ব পাকিস্তানের গোটা অর্থনৈতিক ভিতকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। সেদেশের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় অবস্থিত একটি চা বাগানের ম্যানেজার ভারতে পালিয়ে এসেছেন। জাতিতে স্কটিশ এই ব্যক্তি মন্তব্য করেন, “এই দেশ অন্তত ২৫ বছর পিছিয়ে গেছে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের ঠেকাতে রেললাইন বা রাস্তাগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে। যদি একসময় তারা স্বাধীন হয়ও, তাদেরকে একদম গোড়া থেকে শুরু করতে হবে সবকিছু”। মন্তব্যকারী এই ভদ্রলোক এবং তার সাথে পালিয়ে আসা আরো দুইজন এস্টেট ম্যানেজার তাদের পরিচয় গোপন রাখতে অনুরোধ জানিয়েছেন এই আশংকায় যে এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থানকারী ব্রিটিশ পরিবারগুলোর উপর অভিযান চালানো হতে পারে।

“শুন্য” ট্রাকের উপর হামলা

তিনজন শরণার্থী জানান যে পাকিস্তানি রেডিওগুলোতে ভারত থেকে আসা গোলাবারুদ ও অস্ত্রসংবলিত নয়টি ট্রাক পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ধ্বংস করার যে খবর প্রচারিত হয়েছে, সেই ট্রাকগুলোতে আসলে কোন অস্ত্র ছিলনা। মুলত সেগুলো ছিল পরিতক্ত্য এবং শুন্য ট্রাক। একটি চাবাগানের গোলাঘরে সেগুলো ফেলে রাখা হয়েছিল।

নিরভরযোগ্য সুত্রে পাওয়া খবরে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম বা কুমিল্লা শহরগুলোতে মোট জনসংখ্যার কেবল ২০ থেকে ২৫ শতাংশই এখনও সেখানে অবস্থান করছে, ছোট শহরগুলো থেকেই মানুষ পালিয়েছে সবচাইতে বেশি। ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ লক্ষের মতন, চট্টগ্রামে ৪ থেকে ৫ লক্ষ মানুষ ছিল আর কুমিল্লার জনসংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষের মত।

আর্টিলারি ফায়ারের গর্জনে দেশটির পূর্বাঞ্চল কেপে উঠছে রোজই, আর তা অনুভূতও হচ্ছে সর্বত্রই। প্রতিটি গেরিলা আক্রমন, কিংবা সংখ্যায় ও অস্ত্রবলে অত্যন্ত দুর্বল মুক্তিবাহিনির হাতে কোন ধরনের হয়রানীর সম্মুখীন হলেই পাকিস্তানি আর্মিরা সেখানকার সাধারন জনগণের উপর হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে।

বাঙ্গালীদের নিঃশেষ করে দেয়ার আগেই কুমিল্লার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা এক তরুন বাঙ্গালী লেফটেন্যান্ট বলেন, “এরা সব কাপুরুষের দলে, আমরা তাদের গুলি করার জন্য বুক পেতে দিয়েছি, সেনাবাহিনির ইউনিফরম পরে আছি, আর তারা হামলা করে নিরস্ত্র সাধারন মানুষের উপর”। মুক্তিবাহিনীর ভিতরে দক্ষ প্রশিক্ষনদাতা অফিসার, অস্ত্র, গোলাবারুদ, যানবাহন ও সাধারন রসদসামগ্রীর প্রচন্ড সংকট চলছে। কিছু সেনার পায়ে জুতো পর্যন্ত নেই। তাদের অস্ত্রসামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে ভারী অস্ত্রি তিন ইঞ্চি মরটার, যদিও তারা কিছু শক্তিশালী বন্দুক কব্জা করতে পেরেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনারা ব্যবহার করছে জেট-ফাইটার বম্বার প্লেন, ভারী আর্টিলারি এবং গানবোট যার সিংহভাগেরি যোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন আর গনচীন।
এদিকে পাকিস্তানের অভিযোগ অনুযায়ী ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কোন অস্ত্রসস্ত্র বা সৈন্যদল পাঠানোর মত কার্যক্রম সংবাদদাতার গোচরে আসেনি। পূর্ব পাকিস্তানের কোন ভারতীয় সেনা পাঠানো হয়নি।

এই বিপর্যয় ঘটার আগেই পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ২৫,০০০ সৈন্য আনা হয়েছিল।, এ দুটি অঙ্গরাজ্যর মধ্যে প্রায় ১০০০ মাইলের ভারত ভূখণ্ড তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে, ফলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রচুর সৈন্য সেসময় নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয়।

কেউ কেউ ধারনা করছেন যে এ মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৬০,০০০ থেকে ৮০,০০০ সৈন্য অবস্থান করছে, যাদের বেশিরভাগই হয় পাঞ্জাবি আর নাহয় পাঠান। এই দুই জাতির বেশিরভাগই মুসলিম হলেও পাঞ্জাবিরা সবসময়ই বাঙ্গালীদের হেয় প্রতিপন্ন করে এসেছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কোন শক্ত অবস্থান নেয়নি, তা জানতে পেরে বাঙ্গালীরা ক্ষুব্ধ, বেশিরভাগ স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাই পশ্চিমা ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং তারা ওয়াশিংটনের সমর্থন পাবে বলে ধারনা করেছিল। তারা আরো ক্ষুব্ধ এই কারনে যে আমেরিকার পাঠানো অস্ত্রই তাদের উপর চালানো হচ্ছে।
আমরা সাহায্য আসা করেছিলাম
‘তুমি কি জানো, তারা আমাদের হত্যা করতে তোমাদের প্লেন, তোমাদের রকেট আর ট্যাঙ্ক ব্যবহার করছে’?- উত্তেজিত কন্ঠে এবং সরু চোখে তাকিয়ে একজন বাঙালি যোদ্ধা এ প্রশ্নটি আমাদের সংবাদদাতাকে করছিলেন। ‘আমরা তাদের কাছে সাহায্য আসা করেছিলাম, এমন আচরন নয়’। বাকিরাও এমন মন্তব্যই করেছিলেন।

পাকিস্তানিরা চৈনিক অস্ত্র ব্যবহার করাতে বাঙ্গালীরা অবাক হয়নি, কেননা তারা এটাই ধরে নিয়েছিলেন যে পিকিং পাকিস্তান সরকারের পাশে থাকবে। কোন কোন বাঙালি অফিসার এও দাবী করেন যে এই সেনা হামলার পরিকল্পনাতে চীন ও সম্পৃক্ত ছিল। পিকিং এর সম্পূর্ণ সমর্থন ছাড়া পাকিস্তানিরা কখনই এধরনের অভিযানে নামার সাহস করতো না।

এমনকি এই সঙ্ঘাতের পূর্বেও বাঙ্গালিরা তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে কোন সমর্থন পায়নি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে এবং এটিও তাদের বেশ হতবাক করেছে। এখন তাদের মোহভঙ্গ হয়েছে।

“এখানে গনহত্যা চলছে, কিন্তু সবাই শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে” একজন বাঙালি ছাত্র মন্তব্যটি করেন। কেউ কথা বলছেনা, পৃথিবীর কোথাও কি বিবেক নেই?

এই তিক্ত মনোভাবের মধ্যে ভারত অন্তর্ভুক্ত নয়। তারা পাকিস্তানের এই সেনা হামলার প্রতিবাদ করেছে এবং অন্যান্য সরকারকেও একি কাজ করতে আহবান জানাচ্ছে। ভারতের জনগন এবং কর্তৃপক্ষ শরণার্থী ও অন্যদের খেয়াল রাখছে, কিন্তু সংবাদ দাতা কোন ধরনের অস্ত্র সাহায্য দিতে দেখেনি। যদিও এ অভিযোগ পাকিস্তান বারবারই করে এসেছে এবং দিল্লী তা বার বার অস্বীকার করে এসেছে।