You dont have javascript enabled! Please enable it! তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি - সংগ্রামের নোটবুক
তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি
উল্লেখিত আয়েরিগুলাে, সিমিন হােসেন রিমি সম্পাদিত, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি (প্রতিভাস। প্রকাশনা) হতে উল্লেখিত হলাে। বাংলায় অনূদিত ডায়েরির পাশে, তরুণ রাজনৈতিক কর্মী ও হাত্র আব্দুর স্বহস্তে ইংরেজিতে লেখা ডায়েরি উল্লেখ করা হলাে। ২৮ নভেম্বর ‘৪৭, শুক্রবার। ৬-১৫ মিনিটে উঠেছি। সকাল সােয়া ৭টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত পড়াশােনা করেছি। রাতে পড়াশােনা হলাে না। সকালে নাঈমউদ্দিন সাহেব এলেন। তিনি কামরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন। সাড়ে ১১টার দিকে শওকত সাহেব আমার কাছে এসে সাইকেলের দাম বাবদ নগদ ১০/- টাকা নিলেন।  বিকেল ৪টায় বলিয়াদি প্রেসে গিয়ে প্রুফ নিলাম। ৫টার দিকে কামরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। ওয়াদুদ সেখানে ছিল। শামসুল হুদা সন্ধ্যা পর্যন্ত এলেন না। আমি তার কাছে গেলাম এবং ৭টা নাগাদ তাকে নিয়ে এলাম।  কামরুদ্দিন সাহেব সরদার বাড়িতে গিয়ে কাদের সরদারকে আনলেন। আউয়াল ও সামসুজ্জোহাও তার সাথে এলেন একজন ভদ্রলােকসহ ক্যাপ্টেন শাহজাহানও এলেন। এতিম ছাত্র ও এতিমখানার জন্য সবকিছু শামসুল হুদাকে করতে হবে। কামরুদ্দিন সাহেব আউয়াল সাহেব ও সামসুজ্জোহাকে সঙ্গে নিয়ে তফাজ্জল আলীর কাছে গেলেন। আমি রাত সাড়ে ৮টার। দিকে ফিরলাম। আজ থেকে খুব ঠান্ডায় ভুগছি। শরীর খারাপ সত্ত্বেও রাত ১২টা পর্যন্ত প্রুফ দেখলাম। ১২টার দিকে বিছানায় গেলাম। আবহাওয়া কিছুটা খারাপ।
বি. দ্র. আমি মনে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। হয়তবা প্রচণ্ডতর একটি, যখন দেখলাম কামরুদ্দিন সাহেবসহ কেউই এতিমখানার ছাত্রদের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সামান্য একটু চেষ্টার পরিবর্তে ছেলেগুলােকে তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণীর প্রথম ও তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীর প্রথম, অষ্টম শ্রেণীর ফার্স্টবয় এবং সপ্তম শ্রেণীর মেধাবী এবং কুশলী কারিগরি ছাত্রগুলাে, তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে হারাবে। এসব দরিদ্র এতিম ছেলেদের জন্য কেউ এতিমখানার ক্ষমতাধর দ্রলােকদের সঙ্গে ঝগড়া করতে এগিয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে যদিও অতীতে এমন দেখা গেছে আমরা কালু, নূরুল হুদা ও আফতাবউদ্দিন ভূইয়া এবং অন্যদের জন্য গুরুত্বহীন বিষয়ে কত চেষ্টাই না করেছি। আমরা সংসদীয় রাজনীতির জন্য সময় দিতে পারি। কিন্তু যখন এসব ছেলেদের জন্য কিছু করতে চাই তখন সময়ের প্রশ্ন আসে। এ ক্ষেত্রে আমরা আমাদের বিবেক ও স্বার্থের সাথে প্রতারণা করছি। আমাদের সব ভালাে ভালাে কথা জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। নির্দোষ ছেলেরা ! আমরা ভালােভাবেই জানি তাদের জন্য কিছুই করতে পারব না। ২৯ জানুয়ারি ‘৪৮, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টায় ঘুম থেকে উঠেছি। সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পড়াশােনা করেছি। তারপর আর পড়াশােনা হলাে না। মখদুমী লাইব্রেরির হিসাব মেটানাের জন্যে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নাঈমউদ্দিন সাহেব এলেন তিনি কিছুক্ষণ পরে চলে গেলেন।  বিকেল সাড়ে ৩টায় নাজির লাইব্রেরিতে গিয়ে মহিউদ্দিনকে পেলাম না। সাড়ে ৫টা পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করলাম।
৬টায় বসিরউদ্দিনের কাছে গেলাম, তারপর টাইম হলাে। ঘড়ি তখনাে মেরামত হয়নি। শনিবার যেতে হবে। সন্ধ্যে ৭টায় পুনরায় নাজির লাইব্রেরিতে এলাম, কিন্তু মহিউদ্দিনকে পাওয়া গেল না। সাড়ে ৭টায় মেসে ফিরলাম। ৯টায় বিছানায় ঘুমাতে গেলাম। আবহাওয়া স্বাভাবিক। ৩০ জানুয়ারি, ৪৮, শুক্রবার সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে ১০টা পর্যন্ত পড়াশােনা করলাম। তারপর আর কোনাে পড়াশােনা হয়নি। ১টার সময়ে নাঈমউদ্দিন সাহেবের একটি স্লিপ পেলাম। তিনি ২০টি টাকা চেয়েছেন। তাঁর জন্য ২০ টাকার একটি চেক দিয়েছি। পৌনে পাঁচটায় ফজলুর রহমান এবং হাবিবুল্লাহকে সঙ্গে করে বের হলেন। লীগ অফিসে কিছুক্ষণ থেমেছি। মুজিব, শওকত, কালু, নুরুল হুদা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ৫-৩০ মিনিটে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম ফজলুর রহমান এবং হাবিবুল্লাহ চলে গেল। হজরত আলীকে সঙ্গে করে ডা, করিমের কাছে এলাম। সেখানে ৭টা পর্যন্ত ছিলাম। সেখান থেকে সন্ধ্যে ৭টা ১৯ মিনিটে বসিরউদ্দিনের কাছে গেলাম। তার কাছ থেকে লেখার কপি নিলাম না। সন্ধ্যা ৭-৪৫ মিনিটে কামরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে ক্যাপ্টেন শাহজাহান সাহেবের বাসায় এলাম। সেখানে জলিলকেও দেখলাম। আহা কি দুঃখের দিন। (শুক্রবার) : স্যাড নিউজ : বিষাদের বার্তা। ঠিক রাত ৮টার সময়ে জলিল আমায় বলল : গান্ধীজীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমি এ কথা কোনােভাবেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। কিন্তু শাহজাহান সাহেবও এই খবর ঠিক বলে বললেন। আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। প্রায় ৩ মিনিট আমার স্নায়ুগুলাে যেন বিবশ হয়ে রইল। খবরটা শুনে আমার কণ্ঠ থেকে কেবল একটা চীৎকার-ধ্বনি বেরিয়ে এল।
৮-২০ মিনিটে কামরুদ্দিন সাহেব নীচে নেমে এলেন। তিনি ভয়ানকভাবে বিমূঢ় হয়ে গেছেন।  রাত সাড়ে ৮টায় নূরজাহন বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এলাম। বেচারাম দেউরীতে রেডিওতে নিজের কানে সেই খবর শুনলাম। রাত ৯টায় ফজলুল হক হলে এলাম। সেখান থেকে ঢাকা হলে গেলাম। সেখানে ৯-৩০ মিনিট থেকে ১০টা পর্যন্ত রেডিওতে পণ্ডিত নেহেরু এবং সর্দার প্যাটেলের ভাষণ শুনলাম। বাসায় ফিরলাম রাত ১১টায় বিছানায় যখন গেলাম, তখন রাত ১২টা। আবহাওয়া স্বাভাবিক। মৃত্যু : আমি জীবনে এই প্রথম মৃত্যুর আঘাত পেলাম। মানুষের মৃত্যুর আঘাত। অথচ মানুষের মৃত্যুকে আমি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করি।  মহাত্মা গান্ধী। কাথিওয়ারের পােড় বন্দরে জনুগ্রহণ। অক্টোবরের ২ তারিখ : ১৮৬৯ সাল। মৃত্যু : বিরলা ভবন : নয়াদিল্লী। ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল। সময় ৫-৪০ মিনিট, অপরাহ (আই.এস.টি)। হত্যাকারীর বুলেট বর্ষণে মৃত্যু। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর ৩ মাস ২৮দিন।  গান্ধীজী অন্যান্য দিনের মতাে ৫-১০ মিনিটে (আই.এস.টি.) তাঁর প্রার্থনা মঞ্চের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। একটি লোেক উঠে দাঁড়াল। সে পিস্তলের ৩টা গুলি করল। একটা গুলি মহাত্মার বুক ভেদ করে গেল। আর দুটো তার তল পেটে বিদ্ধ হয়েছে। তাঁর নিদারুণ রক্তপাত ঘটেছে। ৩০ মিনিট পরেই মহাত্মা গান্ধী বিরলা ভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। হত্যাকারীকে জনতা সাথে সাথেই ধরে ফেলেছে। তার নাম নাথুরাম গডসে। সে বম্বের লােক। একজন মারাঠী। হিন্দু রাষ্ট্র’ পত্রিকার সম্পাদক। 
একথা স্মরণ করতে হয় যে, মাত্র ১০ দিন আগে ২০ জানুয়ারি একটা লােক গান্ধীজী যখন তাঁর সান্ধ্য প্রার্থনায় ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন তাকে লক্ষ্য করে গুলি করেছিল। কিন্তু সে লােকটা গুলি করেও পালিয়ে যেতে পেরেছিল। | আমার কাছে মৃত্যু একটা সাধারণ ব্যাপার, স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি কারুর মৃত্যুতে কোনােদিন শােক প্রকাশ করিনি। আমার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর কথা আমার এখনাে স্মরণ আছে। ১৯৪৪ সালে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর সময়ে আমি উপস্থিত ছিলাম না। কিন্তু তার মৃত্যুর জন্য আমার মনে কোনাে দুঃখবােধ জাগেনি তেমন দুঃখবােধের কোনাে কারণ আমি খুঁজে পাইনি।  আমার বাবার মৃত্যুর কথাও আমার মনে আছে মাত্র এক বছর আগে তার মৃত্যু হয়েছে। বছরটা শেষ হতে আর কয়েকটা দিন মাত্র বাকি। তাঁর মৃত্যুর সময়ে আমি কোলকাতায় ছিলামতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তার মৃত্যুতেও আমার মনের মধ্যে কোনাে দুঃখ জাগেনি। তার মৃত্যুতে কেবল কাঁধের উপর পারিবারিক বােঝার ভারটা যেন জীবনে প্রথমবারের জন্য বােধ করলাম। আমার মনে আছে, বাবার মৃত্যুর খবর শােনার মাত্র ১৫ মিনিট পরেই আমি ৪টা পরাটা  এবং এক বাটি মাংস খেয়েছিলাম। আমার তাে একথাও মনে আছে, তার পরের রাতে, যে বিছানাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন সেই বিছানাতে আমি গভীর দ্রিায় নিদ্রিত হয়েছিলাম।
৩১ জানুয়ারি ‘৪৮, শনিবার সকাল ৮টায় ঘুম থেকে উঠলাম। কোনাে পড়াশােনা হলাে না।  ইউনিভার্সিটি চত্বরে শােক সঞ্জয় গেলাম। ১৯৩০ মিনিটে ড, এম, হাসানের সভাপতিত্বে সভা শুরু হলাে। শেষ হলাে ২টা। যাঁরা বল করলেন তাদের মধ্যে ছিলেন : ড. এম. হােসেন, ড. এস, এম, হােসেন, কাজী মােতাহার হােসেন, প্রফেসর মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, বি, এ, সিদ্দিকী। এ ছাড়াও অন্যান্য বক্তা ছিলেন।  ২-৩০ মিনিটে রেল স্টেশনে গেলাম খবরের কাগজের জন্য। লােকে খবরের কাগজের জন্য এমনভাবে দৌড়াচ্ছে, ভিড় করছে যে, সে ভিড় ঢাকার সিনেমা হলের থার্ড ক্লাসের কাউন্টারের ভিড়কে। ছাড়িয়ে গেছে। মানুষের উপর মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। একজন আর একজনকে চেপে ধরছে। স্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। একের পায়ের নিচে অপরের চাপা পড়ছে। একজনকে মাড়িয়ে আর একজন চেষ্টা করছে খবরের কাগজের একটু টুকরাও পেতে পারে কিনা। সেখানে যদি পাওয়া যায় এই লােকটির খবর লােকটিকে এতদিন কি তারা এমনভাবে সত্যই ভালােবেসেছিল ? কোনাে কিছু পাওয়ার জন্য মানুষের এমন ভিড় আমি জীবনে আর দেখিনি। কী নিদারুণ চাহিদা কাগজের। আর কাগজের কী দাম! বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের দিনের সংবাদপত্রের চাহিদা আর মূল্যের স্মৃতি আমার আছে। যে কাগজে সে দিনের মর্মান্তিক খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল, তখন পয়সা দিয়ে তার একটা পুরাে কাগজ আমরা কিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু আজ পুরাে কাগজ নয়। একজন আর একজনের সঙ্গে ভাগ করে কিনেছে খবরের কাগজ। এমনি তার চাহিদা। এক ঘন্টার মধ্যে কাগজ সব শেষ হয়ে গেল। কোনাে কাগজ আর পাওয়া গেল না। তবু লােকের ভিড় কমল না। তারা অপেক্ষা। করতে লাগল যেন আবার ট্রেনে কাগজ আসবে। তারই জন্য অপেক্ষা। 
৩-৩০ মিনিটে নাজির লাইব্রেরিতে গেলাম।’অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রয়াত মহর্ষির শেষকৃত্যের ধারা। বিবরণী ৬-১৫ মিনিট পর্যন্ত শুনলাম। সাড়ে সাতটায় মেসে ফিরে এলাম। ১০টায় বিছানায় গেলাম। সমস্ত শহরে হরতাল হয়েছে। ঢাকার জন্য এ দৃশ্য অভাবিত। ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে শােক মিছিল বেরুল। ৫টায় শ্রীশ, চাটার্জীর সভাপতিত্বে করােনেশন পার্কে শােক সভা এবং মৌন প্রার্থনা হলাে। কোনাে বক্তৃত নয়। সূর্য অস্তমিত হলাে। এবং অস্তমিত হলাে মানবতার পথের দিশারী আলােকবর্তিকা। তাহলে কি অন্ধকার নেমে এল। আলাে এবং অন্ধকার। অন্ধকার এবং আলাে দিনের পরে তাে রাত্রির আগমন এবং দিনের আগমনে নিশার অপসারণ। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। তার পরে তাে সূর্যের কিরণ। ক্ষীণতনু নতুন চন্দ্র। কিন্তু তারপরো তাে আনন্দময় পূর্ণ চন্দ্রের আবির্ভাব হতাশার শেষ তাে আশাতে। সংকটময় মুহূর্ত শ্রে, তিরােহিত হয় বিস্মৃত অতীতে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাে বর্তমানের সৃষ্টিতে রূপায়িত হয়। জগৎ তাে থেমে থাকে না। অনিবার তার এই চক্র।  যে মানুষটির শােকে আজ আমরা মুহামান, সে লােকটি তাে অন্ধকারের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে আলােতে পেীছেছিলেন। তাকেও সে অন্ধকারে আলাের অন্বেষণে উদ্বিগ্ন হতে হয়েছে। অথচ কী বিস্ময়! তিনি নিজেই তাে ছিলেন একটি আলােকবর্তিকা আলােককে কি তুমি ধ্বংস করতে পার? আলাের কণিকা আমাদের কাছ থেকে বহু দূরে অবস্থিত হতে পারে। কিম তাতে কী ? ধ্রুবতারার দূরত্ব অকল্পনীয়। কিন্তু বিজন মেরুতে অভিযানকারীর সেইই তাে একমাত্র দিক নির্ধারক। যুগ থেকে যুগ। তার চোখের ক্ষুদ্র কল্পনাটিও আমাদের পথের দিশা প্রদান করে। তাহলে বেদনা কেন? বহু যুগের এই ধ্রুবতারার কাছ থেকে আমরা নির্দেশ গ্রহণ করব। তাঁর ফেলে যাওয়া পায়ের চিহ্ন ধরে আমরা অগ্রসর হয়। তিনি শান্তি লাভ করুন। আমিন।  ১১টা ৪৫ মিনিটে, সকালে (আই, এস, টি,) মহাত্মার মরদেহকে বিরলা ভবন থেকে শশাভাযাত্রা করে বহন করে আনা হলো। শবাধারটি বহন করেছে সামরিক বাহিনীর অধিনায়কবৃন্দ। কারণ ভারত মহাত্মার শেষকৃত্যকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বলে ঘােষণা করেছে।
৪-২০ মিনিটে শবাধার যমুনার তীরে রাজঘাটে এসে পৌছল। ৪-৩০-এ দেহটিকে চিতায় শায়িত করা হলাে। উত্তর দিকে রক্ষিত হলাে তার শিরদেশ। দেবদাস গান্ধী দেহটির ওপর চন্দন কাঠের একটি স্বপকে স্থাপন করলেন বিকেল ৪-৫৫ মিনিটে (আই.এস,টি,) রামদাস গান্ধী চিতায় অগ্নি সংযােগ করলেন। ৫টার মধ্যে মহাত্মার দেহ জন্মে রূপান্তরিত হয়ে গেল। মহাত্মার শিয়রে পণ্ডিত রামদাস শর্মা মন্ত্র পাঠ করলেন। মহাত্মার চিতায় ১৫ মণ চন্দন কাঠ, ৪ মণ ঘি, ২ মণ সুগন্ধী, ১ মণ নারকেল এবং ১৫ সের কপূরের সমাহার ঘটেছিল। আমার আর কিছু না থাক চুল আঁচড়াবার বিলাস আছে। তােক সামান্য। তবু তাে বিলাস। আজ কি সেটুকুও আর রইল না। আজ আর আমার গােসল হলাে না। ৪৮ ঘণ্টা ধরে আমার কেশবিন্যাসও ঘটল না। আমার মনে আছে, একবার ১০ মহররমে মুখে মাে মেখেছিলাম বলে, ওয়াসেফ সাহেব মুসলিম লীগ অফিসে আমাকে তিরস্কার করেছিলেন। সে দিন আমি জবাব দিয়ে বলেছিলাম ; দুঃখের এমন প্রকাশে আমি বিশ্বাসী নই। কিন্তু সেই আমিই গত দুদিন ধরে আমার কেশ বিন্যাসকে পরিত্যাগ করেছি। অন্তরের এক তাগিদে, বিস্মৃতির এক অপরিহার্যতায় ।
২১ মার্চ ‘৪৮, রবিবার সকাল সাড়ে ৭টায় ঘুম থেকে উঠেছি। পড়াশােনা হলাে না।  বিকেল সােয়া ৩টায় আসগর সাহেবের সঙ্গে বেরিয়ে এফ. এইচ. এম. হলে গেলাম সেখানে নাঈমউদ্দিন সাহবের সঙ্গে দেখা হলাে।  বিকেল সাড়ে ৪টায় রেসকোর্স ময়দানে কায়দে আযমের জনসভায় গেলাম। কায়দে আযম এলেন সােয়া ৫টায়। অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি হিসেবে নবাবের বক্তৃতার পর কায়দে আযম পৌনে ৬টায় তার বক্তৃতা শুরু করলেন। পৌনে ৭টা পর্যন্ত ১ ঘন্টা বক্তৃতা করলেন। তিনি মন্ত্রিসভা ও মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচার চালালেন এবং সাম্প্রতিক ভাষা আন্দোলনের নিন্দা করলেন। তিনি ঘােষণা করলেন যে, উর্দুই হবে রাষ্ট্র ভাষা। পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা বাংলা হবে কি না সে ব্যাপারে চূড়ান্তরূপে সিদ্ধান্ত নিতে বললেন। ছাত্রদেরকে সাবধান করে দিলেন এবং প্রায় সরাসরি তাদেরকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এফ, এইচ, এম, হলে ফিরে এলাম। তােয়াহা সাহেব অ্যাসেমরি হলের। সামনে ন্যাশনাল গার্ডদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করলেন। তারপর জনাব মােহাজের ও জহিরউদ্দিনও বক্তৃতা করলেন। রাত ৯টার দিকে মেসে ফিরে এলাম। ১১টায় ঘুমাতে গেলাম। আবহাওয়া স্বাভাবিক আজ সকাল থেকে ঠান্ডায় ভুগছি।
বি: দ্র: কায়দে আযমের ভাষণ এ প্রদেশের সবাইকে আহত করেছে। প্রত্যেকেই নিদারুণ বিরুক্ত- তিনি দলের ওপরে উঠবেন সবাই সে আশাই করেছিল। ২৪ মার্চ ‘৪৮, বুধবার। সকাল সাড়ে ৭টায় ঘুম থেকে উঠেছি পড়াশােনা হলাে না। ১০টার দিকে শওকত সাহেব এসে নারায়ণগঞ্জে দলের জনসভার কথা জানালেন। সাড়ে ১১টায় তােয়াহা সাহেব এলে তাকে নিয়ে কামরুদ্দিন সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি বেরিয়ে গেছেন। আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে ১২-৪৫ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ রওনা হয়ে সােয়া ১টায় সেখানে পৌছলাম। ২টায় কামরুদ্দিন সাহেব ছাড়া সবাই হাজির। তােয়াহা সাহেব সভা মুলতবির প্রস্তাব দিলে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলাে। সভা আগামীকাল সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। বিকেল সাড়ে ৩টায় আমরা ঢাকায় ফিরে কামরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। সেখানে কাসেম ও অলি আহাদ উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্র লীগের ব্যাপারে আলােচনার জন্য আব্দুর রহমান চৌধুরীকে সাথে নিয়ে তােয়াহা সাহেব বিকেল সাড়ে ৫টায় কায়দে আযমের সঙ্গে দেখা করলেন। শাহ আজিজের উপস্থিতিতে তাদের আলােচনা প্রায় ঘণ্টাধিককাল স্থায়ী হলাে। কায়দে আযম ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের ব্যাপারে একমত হলেন এবং একটা গঠনতন্ত্র তৈরি করে নতুন করে শুরু করতে। বললেন। তিনি অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্ট লীগকে বিলুপ্ত ঘােষণা করলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কায়েদে আযম রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটিকে একটা সাক্ষাৎকার দিলেন। আমরা তার সামনে একটা স্মারকলিপি দিলাম। কি কায়দে আযম আমাদের বক্তব্য উপস্থাপন। করতে দিলেন না। তিনি উর্দুর পক্ষে তাঁর নিজস্ব মতামত দিতে লাগলেন যা চরমভাবে যুক্তিহীন। তিনি আমাদেরকে বােঝাবার চেষ্টা করলেন যে, আমরা যেন উর্দুকে আমাদের মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করি। তিনি যা বললেন, “তােমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত উর্দু আমরা হয়ত কিছুটা হলেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানাতে পারতাম, যদি না শামসুল হক সাহেব তাঁকে উত্তেজিত করতেন। সােয়া সাতটা পর্যন্ত আলােচনা হলাে। কায়দে আযম অনেক ঘটনা অস্বীকার করলেন। হয় এসব ব্যাপারে তিনি জানেন না, না হয় ইচ্ছাকৃতভাবেই তিনি এটা করছিলেন। এফ, এইচ, হল হয়ে মেসে ফিরলাম। হলে প্রায় রাত ৯টা পর্যন্ত দেড়টা ধরে আলােচনা করলাম। ১১টায় ঘুমাতে গেলাম। আজ বেশ ভালাে লাগছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০, শুক্রবার সকাল ৭টায় উঠেছি। পড়শােনা হয়নি।
বেলা ১২টায় ডি,এফ,ওর অফিসে গেলাম। কিন্তু তিনি তার অফিস রুমে ছিলেন না। ছিলেন উপর তলায় বেলা সােয়া ১২টায় স্টেশনে ফজলুর সঙ্গে দেখা করলাম এবং আজিজ মিয়ার কাছে কিছু নির্দেশ পৌছে দেয়ার জন্য তাকে বললাম। জালালও বাড়ি যাচ্ছে। বেলা ১টা থেকে ৬টা পর্যন্ত নবাবপুর, সদরঘাট, পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর, দিগবাজার, ইংলিশ রােড, চক প্রভৃতি এলাকা ঘুরে বেড়ালাম। হিন্দুদের ওপর কিছু মুসলমানদের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে করতে। রাত কাটালাম কামরুদ্দিন সাহেবের বাসায়। আবহাওয়া : মধ্যদিন পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। দিনের তিন-চতুর্থাংশ সময় এক পশলা বৃষ্টি হলাে। রাত থেকে জোরে বাতাস বইছে। 
বি. দ্র. স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতাে ঢাকা আজ দুপুর ১২টা থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করল। গত তিন/চার দিন ধরে কোলকাতায় যে দাঙ্গা চলছিল এটা তারই ধারাবাহিকতার ফল। শরণার্থীরা বিশেষ করে বিহারিরা এই গােলযােগের জন্য দায়ী। স্থানীয় জনগণ যদিও এসবের বিপক্ষে নয়, তবে তারা উদাসীন। সন্ধ্যা পর্যন্ত অবিরাম লুট, হত্যা আর অগ্নিসংযোেগ চলল। পুলিশ এসব বন্ধ করার কোনাে চেষ্টাই করল না। অবাঙালি পুলিশেরা বরং উৎসাহ যােগাচ্ছিল। পুরাে প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল। সরকারের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভাের ৬টা পর্যন্ত কারফিউয়ের ঘােষণা দেয়া হলেও তা কার্যকর করা হলাে না। বর্তমান গােলযােগের উৎপত্তি নিহিত আছে ভারত ইউনিয়নের বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার প্রতিপক্ষদের মধ্যে মূলত গত সপ্তাহে কোলকাতায় মুসলমানদের উপর যা ঘটেছে এটা নিঃসন্দেহে তারই বহিঃপ্রকাশ। উদ্দেশ্যমূলক না হলেও পূর্ব বাংলা অ্যাসেমব্লির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এম, এল,এ দের একটি অবিবেচক পদক্ষেপ এই ঘটনাকে গুরুতর করে তােলে।
সংসদের কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত এবং পূর্ব-বাংলার সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন, এই প্রদেশের মুসলমানদের অসন্তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এম,এল,এ দের এই পদক্ষেপগুলাে যতই সরল বিশ্বাস ও বিদ্ধ নাগরিক অধিকার বােধ থেকেই উৎসারিত হােক না কেন এর বিরুদ্ধে অতি উদারপন্থীদের ঠিক সন্দেহ না হলেও অসন্তোষ ছিলই।  এছাড়াও সচিবালয়ের কেরানিদের আরাে একটি অপরিকল্পিত পদক্ষেপের ফলে বিস্ফোরণ উনখ এক বারুদের স্কুপে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়া হলাে। যখন কেরানিরা ভারতীয় দূতাবাসের সামনে মিছিল করে এসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব সি, এম, সেনের কাছে তাদের অনুভূতি বর্ণনা করে ভারত প্রজাতন্ত্রের কাছ থেকে প্রশংসিত হয়। সি, এম, সেন আমাদের মুখ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। শরণার্থীরা, বিশেষত বিহারিরা যারা প্রতিশােধ নেয়ার জন্য সুযােগের অপেক্ষায় ছিল, তারা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। বেচারা কেরানিদের সাংবিধানিকভাবে পদক্ষেপ নেয়ার আন্তরিক ইচ্ছা মারমুখী জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। এইজনতা কেরানিদের চারপাশে জড়াে হয়েছিল এবং যাদের অধিকাংশই ছিল শরণার্থী। দাঙ্গাকারীদের এই আক্রমণের ফলে প্রথমে আক্রান্ত হয় সংখ্যালঘুদের বিষয়-সম্পত্তি এবং তারপর ব্যক্তি। ক্রমবর্ধমানভাবে পূর্ণোদ্যমে হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকল।
দোকানপাট ইতােমধ্যেই লুষ্ঠিত হয়েছে। হিন্দুদের জীবনটাই দুষ্কৃতিকারীদের মনােযােগের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পরিবার সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাপকসংখ্যক বিচ্ছিন্ন সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে। চলন্ত ট্রেনের কামরায় নৃশংসভাবে হত্যার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। সরকার বিচ্ছিন্ন হিন্দু পরিবারগুলাের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছে। প্রধান প্রধান সড়কগুলাে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বিকেল ৫টা থেকে বাড়িয়ে সকাল ৮টা পর্যন্ত করা হয়েছে। এত কিছু সত্ত্বেও ডানে বামে চতুর্দিকে মানুষ নিধন চলছে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের পক্ষে এবং দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি করছে না। ১০ তারিখ থেকে জীবনের উপর হামলা চলছে দাঙ্গাকারী জনতার রােষ কমে এলে ঘটনা শান্ত হবার কোনাে চিহ্ন নেই। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০, শনিবার খুব ভােরে ঘুম থেকে উঠেছি। ৯টায় রায়েদের কাচারি ঘরে গিয়েছিলাম। সেখানে আসিরুদ্দিন মােল্লার সুপারিশ করা দরখাস্ত পেলাম। কাচারি ঘরে অনানুষ্ঠানিক মিটিং হলাে। স্থানীয় গণ্যমান্য মুসলিম ব্যক্তিবর্গ, আবিদ বেপারি, হাসেন মৃধা, নবাব পালান প্রমুখ প্রায় ৪০ জন হিন্দু ও মুসলিম ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। বর্তমানে গােলযােগ বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের অবস্থান এবং ঘটনার প্রকৃত অবস্থা ব্যাখ্যা করলাম। তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এখানে উপস্থিত সবাই সরকারের পাশে থাকা এবং গােলযােগ বন্ধের শপথ করল। বেলা আড়াইটায় বরামার উদ্দেশে রওনা হলাম।
বরামাতে হেডমাস্টার মফিজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। সেই সময় কাপাসিয়া থানার সেকেন্ড অফিসার একজন সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে সেখানে ঝেয়াদিতে ২টি ভৌমিক পরিবার। এবং ৩টি শুক্লাদাস পরিবারকে অশেষ দুর্গতির মধ্যে দেখলাম। বাড়ি ঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ব্রজেন্দ চন্দ্র ভৌমিক সেকেন্ড অফিসারের কাছে এজাহার দিলেন। স্থানীয় মুসলমানরা তাদেরকে রক্ষা করেছে। মীর মােহাম্মদ নামে একজন গুন্ডাদের কার্যকলাপের প্রতিবাদ করতে গেলে গুন্ডাদের হাতে আহত হন। ঠিক সন্ধ্যায় সেকেন্ড অফিসার ও আমি মীর মােহাম্মদের বাড়িতে গেলাম। এরপর সঞ্জীব রায়ের বাড়ি হয়ে বরামাতে ফিরে এলাম। সঞ্জীব রায়ের বাড়ির পাশে ৪টি অগ্নিদগ্ধ বাড়ি দেখলাম। সেখানে কোনাে বাসিন্দা ছিল না। আমরা রাত সাড়ে ৮টায় বরামাতে সভা করলাম। সভায় অনেক লােক জড়াে হয়েছিল। শাহেদ আলি বেপারি, হুসেইন আলি খাসহ আরাে অনেকে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দাঙ্গার কারণে সর্বস্তরে যে ক্ষতিকর কার্যকলাপ সংঘটিত হয়েছে আমি তার উপর জোর দিয়ে দীর্ঘসময় ধরে বক্তব্য রাখলাম এবং শান্তির জন্য আবেদন জানালাম। উপস্থিত সবাই সমস্বরে তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবেন বলে শপথ উচ্চারণ করলেন। স্কুলের হেডমাস্টার, ইউনিয়ন বাের্ডের প্রেসিডেন্ট এবং স্থানীয় মুসলমানরা বরামার হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকদের রক্ষা করেছে। রাতের খাবার শেষে পুলিশের সেকেন্ড অফিসার হুসেইন খানের বাড়িতে গেলেন এবং আমরা রাতে বরামাতে থেকে গেলাম। রাত প্রায় ১২টার দিকে ঘুমাতে গেলাম। আবহাওয়া : স্বাভাবিক। প্রায় শীতহীন রাত।
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২, বৃহস্পতিবার ভাের সাড়ে ৫টায় উঠেছি। সকালে আমি যখন পুকুরে গােসল করতে গিয়েছিলাম তখন রফিক আমার বিছানার বালিশের নিচ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। নাশ মিয়া, জয়তুনের বাপ প্রমুখের সহায়তায় ১৪৭ টাকা আট আনার মতাে তার কাছ থেকে উদ্ধার করা গেল এই ঝামেলার কারণে আমি সকালের ট্রেন ধরতে পারলাম না। বেলা ১২টা ১৪ মিনিটের ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। একই কামরায় আমার সহযাত্রী ছিলেন এফ করিম ও ডা, আহসানউদ্দিন। রাজেন্দ্রপুর থেকে উঠলেন হাসান মােড়ল। স্কুল সম্পর্কিত বিষয়াবলি, তার দায়িত্ব ও ২৪.০২.৫২ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য ম্যানেজিং কমিটির সভা নিয়ে আমি তার সঙ্গে কথাবার্তা বললাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ট্রেন থামতেই আমি এবং এফ করিম সেখানে নেমে গেলাম। পুরাে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশাল জনসমাবেশ। মেডিক্যাল কলেজ ও অ্যাসেমব্লি হলের কাছে এইমাত্র পুলিশের টিয়ার গ্যাস ছােড়ার বিষয়ে লােকজন বলাবলি করছিল।  বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রায় ২০ মিনিটের মতাে থেমে ডিপিআই অফিসে গেলাম। মুসলিম এডুকেশন ফান্ডের গ্রান্ট-ইন-এইডস সম্পর্কিত সহকারীর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে জানালেন এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি স্মারক পাঠিয়ে দেবেন। বেলা ৩টার দিকে আমি ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
ইডেন ভবনের দ্বিতীয় গেটের কাছে আকবর আলী বেপারির সঙ্গে রেনুকে পেলাম। তিনি। আমাকে বললেন, তারক সাহার বাড়ি ও বমি বাজারের দোকানটি তিনি কিনে নেবেন। এটি কিনতে টাকার জন্য তিনি জমি বিক্রি করবেন। তার সঙ্গে কথা বলে বাসে উঠলাম এবং বেলা সাড়ে ৩টায় এসডিও (উত্তর)-এর আদালতে উপস্থিত হলাম। এসডিওর সঙ্গে তার খাস কামরায় দেখা করলাম বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে। আমাদের স্কুল ও ২৪,২.৫২ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য ম্যানেজিং কমিটির সভা নিয়ে তার সঙ্গে আলােচনা করলাম। প্রধান শিক্ষকের বিষয়াবলি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনাটি কীভাবে সুরাহা করা যায় সে ব্যাপারে আমার পরামর্শের সঙ্গে তিনি একমত হলেন। তিনি আমাকে ৩,৩.৫২ তারিখে ম্যানেজিং কমিটির একটি সভা আয়ােজন করার জন্য বললেন। তখন তিনি শ্রীপুর থাকবেন। এরই মধ্যে তিনি আমার অনুরােধে শ্রীপুরের উদ্বাস্তু মিস্ত্রিদের ত্রাণের আবেদন অনুমােদন করলেন। তার চেম্বার ছাড়লাম বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে। আদালতের রেস্তোরাঁয় সিআইবির অ্যাসিস্ট্যান্ট মহিউদ্দিন ও আমাকে সাদির মােক্তার নাস্তা খাওয়ালেন। বিকেল পাঁচটার দিকে। আদালত ছেড়ে এলাম। কামরুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে দেখা করলাম এবং দেরি না করে তার সঙ্গে ৯৪ নবাবপুর এএমএল অফিসে এলাম। মিনিট পাঁচেকের জন্য সেখানে থেমে কেমব্রিজ ফার্মেসিতে গেলাম। জহির ভাই-এস এম জহিরউদ্দীনও আমাদের চা দিলেন।  ডা, করিম ও আমি মেডিক্যাল কলেজে গেলাম। পুলিশের গুলিতে আহত ও নিহতদের মৃতদেহ দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। ডা, করিম চলে গেলেন। আমি মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলে ইতস্তত ঘােরাফেরা করে রাত ১১টায় যােগীনগরে ফিরে গেলাম।
রাতের খাবারের পর ভাবির সঙ্গে কথা বললাম রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। বিছানায় গেলাম রাত ১টায়। আবহাওয়া : স্বাভাবিক। অপেক্ষাকৃত কম ঠান্ডা। বি. দ্র. আজ দুপুরে খেতে পারিনি। গভীর রাতে সাড়ে ৩টায় পুলিশ বাহিনী আমাদের বাড়ি ঘেরাও করল এবং যুবলীগের অফিসে তল্লাশি চালাল। তারা ক্ষতিকর বা অবৈধ কিছু খুঁজে পেল না। যুবলীগের অফিস লাগােয়া আমার শােবার ঘর, তাই আমি ঘর থেকে সরে পড়ায় তারা আমার উপস্থিতি টের পায়নি। ভাের ৪টায় তারা চলে গেল। এরপর আর ঘুমাইনি। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট চলছে। গতকাল থেকে এক মাসের জন্য সিআর, পিসি, ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আজ বিকেলে অ্যাসেমব্লি বসেছে। ধর্মঘট পালনকারী ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে অ্যাসেমব্লি হাউসের কাছে জড়ো হয়; যাতে তাদের কষ্ঠ অধিবেশনে উপস্থিত এমএলএরা শুনতে পান। প্রথমে শুরু হলাে গ্রেফতার করা। এরপর কাঁদননা গ্যাস ছােড়া হলাে। তারপর গুলি। চালানাে হলাে মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসে। গুলিতে চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হচ্ছে। আহত হলাে ৩০ জন। জানা যায় ৬২ জনকে জেলে পােরা হয়েছে। আরও শােনা যায় পুলিশ কয়েকটি মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। বেসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন। অক্টোবর ১৪, ১৯৭৪ সােমবার : দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক পূর্বদেশ খাদ্য সংকটকে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখতে হবে; নিরন্ন মানুষকে বাঁচাতে দলমত নির্বিশেষে এগিয়ে আসুন : অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বর্তমান জাতীয় দুর্যোগকালে উট পাখির মতাে বালিতে মাথা গুঁজে থাকলে চলবে না। বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। অবিলম্বে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষকে সাথে নিয়ে জাতীয়ভাবে খাদ্য সংকটের বাস্তব সমাধানের পথে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি গতকাল ঢাকা বিমানবন্দরে এই অভিমত ব্যক্ত করেন। | তিনি বলেন, সকল দল ও মতের নেতৃবৃন্দ এবং বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করে বর্তমান খাদ্য সংকট মােকাবেলায় সুনির্দিষ্ট ও কার্যকরী পন্থা গ্রহণের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুরােধ করবেন। তিনি তার বক্তব্য দ্বারা কোনাে সর্বদলীয় বা জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলছেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেছেন যে, সে প্রশ্নই ওঠে না, কারণ বর্তমান সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। কদিন আগের উপ-নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। তিনি বলেন, খাদ্য সমস্যাকে অবশ্যই রাজনীতির উর্ধ্বে রাখতে হবে।
এ কথা মনে রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র বক্তৃতা, বিবৃতি, স্লোগান দিয়ে সংকটের সমাধান হবে না। এই প্রসঙ্গে তিনি ১৯৫৬ সালের সর্বদলীয় খাদ্য কমিটির কথা উল্লেখ করেন।  অর্থমন্ত্রী আবেগরুদ্ধকণ্ঠে বলেন, মানুষ না খেয়ে মরছে- এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এর অবসান ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, মাটি আর মানুষ নিয়ে দেশ- বাংলাদেশ এখন সার্বভৌম, তার মাটি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কিন্তু মানুষ না থাকলে কাকে নিয়ে রাজনীতি, কার। জন্যই বা রাজনীতি। মানুষ যখন মরে যাচ্ছে তখন নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা যায় না। এ পরিস্থিতি মােকাবেলা করতে যারা ব্যর্থ হবে তাদের ব্যক্তি নির্বিশেষে ছাঁটাই করা দরকার। এমনকি আমি যদি হই আমাকেও বাদ দেয়া উচিত। মােটকথা যে কোনাে মূল্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতাে বর্তমান সঙ্কট মােকাবেলা করে মানুষ বাঁচাতে হবে।  জনৈক সাংবাদিক বর্তমান গণঐক্য জোটের পরিপ্রেক্ষিতে তার দলমত নির্বিশেষে খাদ্য সঙ্কট মােকাবেলার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দাবি করলে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি গণঐক্য জোটকে আরাে ব্যাপকভিত্তিক (ব্রড বেজড) করার কথা বলেছি। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি মনে করি। কিছুসংখ্যক (মাইক্রোস্কপিক মাইনরিটি-) লােক যারা বিদেশের এজেন্ট, তারা ছাড়া এ দেশের সকল মানুষ দেশপ্রেমিক।
তাছাড়া বিরােধী দল করলেই মানুষ অ-দেশ প্রেমিক হয় না। দুঃখ। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, কেউ অভিজাত বিপণী কেন্দ্রে মার্কেটিং করবে আর কেউ না খেয়ে রাস্তায় মরে পড়ে থাকবে এ অবস্থা চলতে দেয়া যেতে পারে না। তিনি। আরাে বলেন, যারা আজ না খেয়ে ধুকে ধুকে পথে-ঘাটে পড়ছে-মরছে, তারা আমাদের। মানবতাবােধের প্রতি বিদ্রুপ করে বিদায় নিচ্ছে। তিনি জানান যে, বিদেশ সফরকালে তিনি। বিদেশি সংবাদপত্রে বাংলাদেশে অনাহারে মৃত্যুর সচিত্র খবর পাঠ করে ব্যথিত হয়েছেন। লন্ডনে ব্রিটিশ টেলিভিশনে তিনি বাংলাদেশে অনাহারে মৃত্যু এবং এরই পাশাপাশি এক শ্রেণীর মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার দুই বিপরীত মর্মান্তিক ছবি দেখেছেন। তিনি দেখেছেন ঢাকার রাজপথে খেয়ে মরে যাওয়া মানুষের লাশ আর তারই পাশাপাশি নাইট ক্লাবে এক শ্রেণীর মানুষ বেআইনীভাবে আমদানিকৃত দামি বিদেশি মদ এবং আস্ত মুরগি খাচ্ছে। তিনি জানান যে, লন্ডনে বসে নিজ দেশের দুই বিপরীত ও অমানবিক দৃশ্য দেখে তিনি মর্মাহত ও লজ্জিত হয়েছেন। | তিনি দুঃখ করে বলেন, দেশের মানুষ যখন না খেতে পেয়ে মরছে, তখন কালাে টাকার মালিকরা তাদের সম্পদ আরাে বাড়ানাের জন্য অবৈধ প্রতিযােগিতায় মেতে উঠেছে। তিনি বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি সকল অধঃপতন ও দুর্নীতির মূল কারণ। আমরা স্থায়ীভাবে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হতে পারি না। আমাদের দেশে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। সেই সম্পদ। আহরণ করে গণ-মানুষের মধ্যে সুষম বন্টনের মাধ্যমে আমাদের সুষম জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তােলার কাজ করে যেতে হবে। যদিও অনেক আগে থেকেই আমাদের তা করা উচিত ছিল। অর্থমন্ত্রী দেশের বিত্তবান লােকদের কৃচ্ছুতা সাধনের জন্যেও আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, যাদের নাই তাদেরকে কৃচ্ছতা সাধনের কথা বলে মরতে বলতে পারি না। আমরা সবাই সহানুভূতিশীল হলে এ পরিস্থিতির বেদনা কিছুটা প্রশমিত হতাে।  জনাব তাজউদ্দীন আহমদ আরাে বলেন, সরকারি দলই হােক আর বিরােধী দলই হােক। কারাে হাতে অস্ত্র থাকা উচিত নয়। এতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়ােজিত সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও উপদলের মধ্যে অনাস্থার মনােভাব সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনারা কেন সরকারের ভালােমন্দ তুলে ধরছেন না? কেন বাস্তব। অবস্থা তুলে না ধরে জনগণকে শুধু আশার বাণীই শােনাচ্ছেন ? অমুক দেশ থেকে চাল আসছে, গম আসছে, সাহায্য পাওয়া যাবে- এইটুকু লিখলেই চলবে না। কীভাবে উৎপাদন বাড়ানাে যেতে পারে, কীভাবে সকল মানুষকে একত্রিত করে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে তার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’ পরিশেষে তিনি বলেন যে, একটি স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তােলার ব্যাপারে আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
 

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ- নেতা ও পিতা – শারমিন আহমদ