You dont have javascript enabled! Please enable it!

এইসব বিষন্ন-মলিন মুখে
দিলীপ সেনগুপ্ত

আমরা অনেকে অনেক কিছু নিয়ে ভাবি, মানুষের কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, আরও অনেক কিছু। আর নিজেরা দুঃখিত এই। কিন্তু যখন স্বচক্ষে দেখি এই দুঃসহ গরমে একখানা অনতিবিশাল ঘরের মধ্যে বত্রিশ জন মানুষ বসন্তরােগে আক্রান্ত হয়ে, দমবন্ধ অবস্থায় নিজেদের প্রাণ-বিনাশের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে, তখন দুঃখ বা সহানুভূতি জানাতে লজ্জা হয়।
এঁরা আমাদের এই পশ্চিমবাঙলার নিঃস্ব অধিবাসী। সীমান্ত ডিঙিয়ে এপারে এসে ঠাই পেয়েছেন মাজদিয়া হাই স্কুলে। বর্ডারের অতি নিকটে। স্কুলের ক্যাম্পে ইন-চার্জ শ্ৰী চিন্ময় রায় চৌধুরী জানালেন, এখন পর্যন্ত তিন হাজার শরণার্থী এই ক্যাম্পের আশ্রয়ে রয়েছেন। আরও আসছেন, কিন্তু জায়গা বাড়ন্ত । ক্যাম্প ঘুরে বুঝলাম, চিন্ময় বাবু মিথ্যে বলেননি।
গত ২০ এপ্রিল থেকে এই ক্যাম্পের পত্তন। শুনলাম, স্থানীয় বাঙলা কংগ্রেস নেতা শ্রী মৃত্যুঞ্জয় রক্ষিত দিনরাত খাটছেন। তারই চেষ্টায় মাজদিয়ার বহু তরুণ-যুবক এইসব মানুষের যথাসাধ্য কষ্ট লাঘবের জন্যে জড়াে হয়েছেন।
ক্যাম্প অধ্যক্ষ শ্ৰী চিন্ময় রায় চৌধুরী বললেন, ‘অসম্ভব। সরকার সব ঢেলে দিলেও এ সংকট মেটানাে যাবে না।’
‘খেতে দিচ্ছেন কী?’ প্রশ্ন করলাম। ভাত, ডাল আর তরকারি, সপ্তাহে দুদিন খিচুড়ি। এই গরমে খিচুড়ি খেয়ে এন্তার পেট খারাপ হচ্ছে। কলেরাও হচ্ছে দু-একজনের। তবে বসন্তের মতাে কলেরাটা এপিডেমিক হতে পারেনি।’
‘মারা গেছে কেউ? ‘না—এমনিতেই কদিন আগে একটা বাচ্চা মারা গেছে আর জন্মেছে বেশ কটি।’ ‘এঁরা বাঙলাদেশের কোন অঞ্চল থেকে আসছেন? জানতে চাইলাম। ‘অনেক জায়গা থেকে। যেমন কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মারগঙ্গা, ঝিনাইদহ ইত্যাদি জায়গা থেকে।
‘আপনার এখানে এমন কেউ আছেন যার ঘর-বাড়ি পাক-সেনারা পুড়িয়ে দিয়েছে? পরিজনকে হত্যা করেছে?
হাসলেন চিন্ময়বাবু। বললেন, ‘কতজন চান? আমি আর কথা বাড়ালাম না। ‘কী বেসিসে এঁদের আপনারা ক্যাম্পে আশ্রয় দিচ্ছেন? ‘বর্ডার শ্লিপ দেখে। অনেক রাত হয়েছে। প্রায় দশটা।
আমাকে নিয়ে নিনেমা হলে এলেন তিনি। আলাপ করিয়ে দিলেন মৃত্যুঞ্জয় রক্ষিতের সঙ্গে। একটিও প্রশ্ন না করে মৃত্যুঞ্জয়বাবু আমাকে থাকার স্থান তাে দিলেনই, রাত্রে আহারের ব্যবস্থাও করলেন।
রাত্রে কথায় কথায় মৃত্যুঞ্জয়বাবু জানালেন, স্থানীয় লােকেরা এইসব শরণার্থীদের খুব ভালাে চোখে দেখছেন না। তাঁদের ভয়, এরা রােগ ছড়াবে, সম্পত্তি নষ্ট করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাপারটা দুঃখের হলেও পরবর্তী সময়ে একই কথা মনে হয়েছে আমার।
সকাল নটা নাগাদ মাজদিয়া থেকে টেম্পােয় চেপে বসলাম কৃষ্ণনগরকে লক্ষ্য করে। কৃষ্ণনগর থেকে শিকারপুরগামী বাসের সংখ্যা অত্যন্ত অল্প থাকায় বড় আদুলিয়া ক্যাম্পে পৌছতে দেরি হয়ে গেল অনেক।
বড় আদুলিয়া বেসিক ট্রেনিং সেন্টারের সব ঘর এখন শরণার্থীদের শিবিরে পরিণত হয়েছে। ক্যাম্প ইনচার্জ শ্রীপি এম ভৌমিক তখন ছিলেন না। তার স্থলে কাজ চালাচ্ছিলেন জ্ঞানরঞ্জন সাহা। তার কাছে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এ পর্যন্ত মােট ১৩৭৫ জনকে এখানে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সকালে পিএল ৪০-র দুধ, দুপুরে ডাল, ভাত তরকারি, বিকেলেও তাই অথবা খিচুড়ি। কোন রােগই এযাবৎ এখানে সংক্রামক হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ বােধ করি যথেষ্ট পরিসর ও আচ্ছাদন। প্রচুর ঘর, ছােট ও বড়, মােটামুটি ঢাকা বারান্দা, এক কথায়, কাউকে খােলা আকাশের নিচে বাস করতে হচ্ছে না। অবস্থা এ পর্যন্ত খারাপ না হলেও সাহাবাবুর মতে যে হারে লােক আসছে তাতে খারাপ হতে সময় বিশেষ লাগবে না। ওরা আমার কাছে একটি অভিযােগ করেছে, অশালীন হলেও তার উল্লেখ না করে পারছি না। সমস্ত শিবিরেই হিন্দু-মুসলিম-খৃষ্টান সব সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন। এই বড় আন্দুলিয়া শিবিরে খৃষ্টান শরণার্থীদেরই সাহায্য করছেন। ব্যাপারটা অনেকেরই ভালাে লাগছে না।
আর দেখলাম বিমলাবালা দাসকে। এসেছে কুষ্টিয়া থেকে। জামাই নিখোঁজ। দুটি জোয়ান ছেলেকে গুলিবিদ্ধ করছে পাক-সৈন্য। তারা কেউই বেঁচে নেই। বিমলার মেয়েকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করার মনস্থ করে কেঁদে ফেলল সে। সে তার স্বামীকে চায়।
মান্নান কাজী শিবিরের হেঁসেলে রান্নার তদারকিতে ব্যস্ত।
কাঁচা চামড়ার ব্যবসা করত মান্নান কাজী। এপ্রিলের ২৭ তারিখ হঠাৎ মেহেরপুর বাজারে বােমা পড়ল বেলা দশটা নাগাদ। মান্নান তখন ঘরে। দুই ভাই বাজারে। মােট চারজন বাজারেই মারা গেছে। তার মধ্যে দুজন ওরা ভাই। এই দুই ভাইয়ের মৃত্যু ওকে পাগল করে দিয়েছে। বলল, ‘দুই ভাই যখন গেছে—আমিও যাবাে, তবে যুদ্ধ করে যাবাে।’ | মান্নানের আরও একটা দুঃখ আছে। তা হলাে, ২৭ এপ্রিল কোন নেতাকে ও মেহেরপুরে খুঁজে পায়নি।
ভেগেছে। কোন খবর পর্যন্ত দেয়নি কাউকে। অথচ মান্নান ছিল সংগ্রামের সাথী। আওয়ামী লীগ বাইশ জন নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় যে স্কোয়াড তৈরি করেছিল মান্নান ছিল তারই একটির নেতা। এত সত্বেও শেষ সময় কিছু নির্দেশ ছিল না।

সূত্র: সপ্তাহ, ১১ জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!