You dont have javascript enabled! Please enable it! সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের বংশাবলি ও পারিবারিক ইতিহাস - সংগ্রামের নোটবুক
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের বংশাবলি ও পারিবারিক ইতিহাস
আম্মার পিতৃকুল সম্বন্ধে তথ্য নানা বেঁচে থাকতে ওনার কাছ থেকে শুনে লিপিবদ্ধ করি। নানার সব ভাইয়ের ও একমাত্র বােনের পুরা নাম ও বাড়ির ঠিকানা নানার কনিষ্ঠ ভাইয়ের পুত্র সৈয়দ আনওয়ার হােসেনের কাছ থেকে সংগ্রহ করি। নানার পুরা নাম সৈয়দ সেরাজুল হক। জন্ম ইংরেজি ১৮৯৩ সাল, বাংলার বৈশাখ (মে-জুন) মাসে। জন্মস্থান : কুমিল্লা (বর্তমান চাদপুর)। ঠিকানা : সৈয়দ বাড়ি; গ্রাম : আজাগড়া; পােস্ট অফিস : ওয়ারুক; থানা : হাজীগঞ্জ (বর্তমান : শাহারাস্তি)। নানা কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ আরবিতে বিএ অনার্স পাস করেন। জ্ঞানের সাধক নানা ইংরেজি ও ফারসি ভাষা এবং সাহিত্যেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। বিএ পাস করার পর তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ক্লাসে ভর্তি হন এবং কিছুদিন ইসলামিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা কলেজ থেকে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। নানার সবচাইতে বড় ভাইয়ের নাম সৈয়দ আবদুল হক। খুব সম্ভবত ওনার পরেই এক বােন জন্মগ্রহণ করেন। নাম সৈয়দা রাবেয়া খাতুন। উনি অত্যন্ত পরহেজগার ছিলেন এবং তরুণ বয়সে। মৃত্যুবরণ করেন। নানা তৃতীয় সন্তান, ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। তৃতীয় ভাই সৈয়দ ফজলুল হক। চতুর্থ ভাই সৈয়দ তাহেরুল হক। পঞ্চম ভাই সৈয়দ শামসুল হক (শামু), এবং যষ্ঠ ভাই সৈয়দ মাহফুজুল হক (মাফু)। আমাদের শামু নানা সৈয়দ শামসুল হক ওনার এলাকায় ব্রিটিশবিরােধী প্রতিরােধ আন্দোলনের একজন অগ্রণী নেতা ছিলেন। ব্রিটিশবিরােধী তৎপরতার জন্য তাঁকে। বহুদিন পলাতক জীবন যাপন করতে হয়। যত দূর মনে পড়ে, ওনার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৭০ সালে। উনি নানাকে দেখতে আমাদের সাতমসজিদ রােডের বাসায় এসেছিলেন। নানার মতােই উনি ৬ফিট লম্বা ছিলেন। ওনার মেদহীন পেটানাে শরীর, বাবরি চুল, ও তারুণ্যের দীপ্তিময় চোখ দেখে মনেই হতাে না উনি একজন বর্ষীয়ান মানুষ।
আমার প্রপিতামহ, নানার পিতার নাম সৈয়দ মওলানা আব্দুল মজিদ। ওনার ভাইয়ের নাম হাফেজ সৈয়দ মহম্মদ। ওনাদের পিতার নাম : হাজি সৈয়দ মওলানা জালালউদ্দীন। প্রপিতামহ : হাজি সৈয়দ মওলানা ফোরকান। প্র-প্রপিতামহ : হাজি সৈয়দ মওলানা আব্দুল করিম। উনি তৎকালীন কুমিল্লা জেলার ডিস্ট্রিক্ট জজ ছিলেন। প্রবাদ আছে যে চালের একটি দানার মধ্যে তিনি সুরা ইখলাসের আয়াত লিখতে পারতেন। মওলানা আব্দুল করিমের (ওনার পিতা ও পিতামহর নাম জানা যায়নি), প্রপিতামহের নাম মওলানা হাজি সৈয়দ আহমেদ তানুরী। ওনার জন্ম ও আদি বাসস্থান বাগদাদে। হজরত বড় পীর সাহেব, সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) বংশধর। নানার কাছ থেকে উপরােক্ত তথ্য সংগ্রহ করার পর বাকি তথ্য ছােট মামা সৈয়দ গােলাম মওলার কাছ থেকে সগ্রহ করি। ওনার পূর্বপুরুষ সম্বন্ধে ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের কাটিং উনি ফাইল করে রেখেছিলেন। সেখান থেকে আমি হাতে কপি করি। ছােট মামার সূত্রমতে নােয়াখালির কাঞ্চনপুরে ওনাদের পূর্বপুরুষ সুফি সাধক সৈয়দ আহমেদ তানুরীর মাজার রয়েছে। উনি দিল্লির সুলতান ফিরােজ শাহ্র আমলে ইরাক থেকে ভারত উপমহাদেশে আসেন। সাধারণের মধ্যে তিনি মীরান শাহ নামে পরিচিত ছিলেন। ইত্তেফাক পত্রিকার খবরে (তারিখবিহীন) প্রকাশিত হয়েছিল যে নােয়াখালি জেলার রামগঞ্জ থানাধীন কাঞ্চনপুরের মাজার শরিফে হজরত শাহ সৈয়দ আহমদ তনুরীর (সামান্য ভিন্ন বানান) এবং তদীয় ভগ্নি সৈয়দা সালেহা মধুমা খাতুনের ওরশ মােবারক আগামী ১১ অগ্রহায়ণে অনুষ্ঠিত হবে। আম্মার মাতৃকুল সম্বন্ধে প্রায় সব তথ্য ও ইতিহাস আম্মার মামাতাে বোেন সৈয়দা রােকেয়া বেগমের কাছ থেকে সংগ্রহ করি আশির দশকের প্রথমার্ধে।
পরবর্তী সময়ে আম্মা ও পরিবারের অন্যান্যরা আরও কিছু তথ্য যােগ করেন। আম্মার মামাতাে ভাই সৈয়দ আবু তাহেরের পুত্র সৈয়দ মাসহুদ বাদশাহ, ও মামাতাে বােন সৈয়দা রােকেয়া বেগমের পুত্র সৈয়দ আবু সালেহ মহম্মদ মুজতবা (রনি), আম্মার খালাতাে বােন মােসাম্মাৎ তালে আফরােজের (পেয়ারা) পুত্র কাজী ওবায়দুল কবীর (ম), আমার ছােট বােন সিমিন হােসেন রিমি এবং ছােট মামা সৈয়দ গােলাম মাওলার জ্যেষ্ঠা ও কনিষ্ঠা কন্যা রােকসানা ওয়াদুদ (মুন্নী) ও সৈয়দা রেজওয়ানা হকের (সীমা) কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আমার নানি সৈয়দা ফাতেমা খাতুন ছিলেন পিতামাতার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। জন্ম ১৯০৪। (পরিবারের ইতিহাস লেখার সময় যাদের জন্মসাল জানা গিয়েছে বা কাছাকাছি অনুমান করা গিয়েছে শুধু তাদেরটাই তাদের নামের পর উল্লেখ করা হলাে।) জন্মস্থান : ফুলবাড়ি, দিনাজপুর। নানির পিতা সৈয়দ গােলাম মােস্তফার জন্ম আনুমানিক ১৮৬২ সালে, হুগলির ইমামবাড়ার জমিদার পরিবারে। তিনি ছিলেন সে যুগের প্রথম বাঙালি মুসলিম MBBs ডাক্তারদের একজন। কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে তিনি ডাক্তারি পাস করেন। এই উপমহাদেশে সেকালে হাতেগােনা যে কজন ডাক্তার সার্জারিতে স্পেশালিস্ট ছিলেন তিনি তার মধ্যে একজন। শুধু চিকিৎসক হিসেবেই তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন না, শিক্ষানুরাগী ও দানশীল হিসেবেও তিনি জনসমাজের শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা অর্জন করেন। উনি ২০০ বিঘার ওপরে জমি স্কুলের জন্য দান করেন। দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত এস. জি. মােস্তফা স্কুল (১৯২০) এখনাে তার স্মৃতি বহন করছে। | ওনার ছােট আরও দুই ভাই ছিলেন। মধ্যম ভাই লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি (Bar-at-Law) ডিগ্রি অর্জন করে রংপুরের মুন্সি পাড়ায় স্থায়ী হন। কনিষ্ঠ ভাই ব্যারিস্টার হয়ে লন্ডনে স্থায়ী হন, দেশে আর ফেরেননি। সৈয়দ গােলাম মােস্তফার প্রথম বিয়ে হয় রংপুরে কামারকাছনার জমিদার কন্যার সাথে।
বিয়ের পর একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে এবং স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। কন্যার নাম ছিল সৈয়দা খাতুন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন সম্রান্ত পরিবারের কন্যা বদরুননেসাকে। এই ঘরে তাদের প্রথম পুত্র জন্মগ্রহণ করেন, নাম সৈয়দ আবদুর রব (১৮৯০) দ্বিতীয় পুত্র সৈয়দ আব্দুর রউফ (১৮৯১) তৃতীয় পুত্র সৈয়দ আব্দুল লতিফ চতুর্থ পুত্র সৈয়দ আব্দুল সামাদ
পঞ্চম পুত্র সৈয়দ আব্দুল কাশেম
ষষ্ঠ সন্তান কন্যা সৈয়দা রাবেয়া খাতুন (১৯০২)
সপ্তম ও কনিষ্ঠ কন্যা সৈয়দা ফাতেমা খাতুন (১৯০৪)
আমার নানি ছিলেন সকলের নয়নের মণি। সবচেয়ে ছােট বলে বাবা, মা, বড় ভাই ও বােনেরা অত্যন্ত আদর ও আহ্লাদ করতেন। আদর করে সকলে তাকে ফাতু বলে ডাকতেন। ওনার বড় দুই ভাই সৈয়দ আব্দুর রব ও রউফ পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায় দুই বােনকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর আব্দুর রব সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করে বিহারে চলে যান। বহু যুগ পর তিনি সংসারে প্রত্যাবর্তন করেন এবং জীবনের শেষ সাত বছর নানির কাছে অবস্থান করেন। ওনার ঘরে ফিরে আসার নেপথ্য কাহিনি হলাে যে তিনি ৩৭ বছর স্রষ্টার উপাসনা ও ধ্যানে মগ্ন থাকার পর গায়েবি আওয়াজ আসে, ‘তুমি পেছনে কী ফেলে এসেছ?’ উনি স্ত্রী ও মা’কে পেছনে ফেলে এসেছিলেন। গায়েবি প্রশ্নটির কারণে তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রবাদ আছে যে তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। প্রবাদগুলাে এমন তিনি বাঘের পিঠে করে ফুলবাড়িতে ফিরে আসেন। ঝড় তুফানের সময় নদীর ওপর জায়নামাজ বিছিয়ে মানুষজনের পারাপারের ব্যবস্থা করেন। নানি ওনার আরও কিছু অলৌকিক ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করেন কিন্তু উনি কারাে কাছে বলতে মানা করায় উনি বেঁচে থাকা পর্যন্ত নানি কারাে কাছে প্রকাশ করেননি। আব্দুর রব প্রয়ােজন না হলে কথা বলতেন না। অধিকাংশ সময় ইশারায় ভাবের আদান-প্রদান করতেন। নানির হাতের সুজির হালুয়া ও চা ওনার প্রিয় খাবার ছিল। নানির দ্বিতীয় ভাইয়ের নাম সৈয়দ আব্দুর রউফ। ওনার পুত্রের নাম সৈয়দ আবু তাহের (১৯১৫)। পুত্রবধূ (পঞ্চম ভাইয়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা) সৈয়দা জাহানারা বেগম।
তৃতীয় ভাই সৈয়দ আব্দুল লতিফের একমাত্র পুত্রের নাম সৈয়দ আব্দুল মােত্তালিব। পুত্রবধূ সৈয়দা রােকেয়া বেগম (পঞ্চম ভাইয়ের তৃতীয় কন্যা)। আব্দুল মােত্তালিব শিশু অবস্থায় মাতৃহারা হন। আমার নানি ওনাকে স্তন্য পান করান এবং নিজ সন্তানের ন্যায় লালন-পালন করেন। আব্দুল মােত্তালিব কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তিনি District Controller of Food পদে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। নানির চতুর্থ ভাইয়ের নাম সৈয়দ আব্দুস সামাদ। উনি দিনাজপুরে বিয়ে করেন। ওনার একমাত্র পুত্রের নাম সৈয়দ শাহ আলম। পঞ্চম ভাই সৈয়দ আব্দুল কাশেম বিয়ে করেন গাইবান্ধার মেয়ে আকলিমা খাতুনকে। ঐ ঘরে ছয় সন্তান জন্মগ্রহণ করে। জ্যৈষ্ঠ পুত্রের নাম সৈয়দ আবু তালেব (জন্ম : ১৯১৭) দ্বিতীয় সন্তান জ্যেষ্ঠ কন্যা সৈয়দা জাহানারা বেগম (জন্ম : ১৯১৯)। তৃতীয় সন্তান মেজ কন্যা সৈয়দা হােসনে আরা বেগম (জন্ম : ১৯২২) চতুর্থ সন্তান তৃতীয় কন্যা সৈয়দা রােকেয়া বেগম (জন্ম: ১৯২৬) পঞ্চম সন্তান চতুর্থ কন্যা সৈয়দা দেলওয়ারা বেগম (জন্ম : ১৯৩৬) ষষ্ঠ সন্তান কনিষ্ঠ কন্যা সৈয়দা রওশন আরা বেগম (রুশু) (জন্ম: ১৯৩৮) প্রথম আবুল কাশেম দ্বিতীয় বিয়ে করেন বারকনা ফুলবাড়ি, দিনাজপুরে। স্ত্রীর নাম ঘােষ। এই ঘরে তিন সন্তান জন্মগ্রহণ করে :
পুত্র সৈয়দ গিয়াসুদ্দীন আবু কালাম (বাবু) সৈয়দ জালালউদ্দীন আবু জামাল (সেলিম) ও সর্বকনিষ্ঠ সন্তান কন্যা সৈয়দা আঞ্জুমান আরা (রেবা)। নানির বড় বােন সৈয়দা রাবেয়া খাতুনের বিয়ে হয় বগুড়ায় মুন্সেফ সৈয়দ আব্দুল লতিফের সাথে।
ওনাদের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম সৈয়দ আব্দুল মােজাফর; দ্বিতীয় পুত্র সৈয়দ আবদুর রাজ্জাক। ও সর্বকনিষ্ঠ কন্যা সৈয়দা মােসাম্মৎ তালে আফরােজ (পেয়ারা ১৯১৮)। ওনার স্বামীর নাম কাজী মজিদুন নবী (১৯১০)। নানি সৈয়দা ফাতেমা খাতুন ও নানা সৈয়দ সেরাজুল হকের পাঁচ সন্তান জন্মগ্রহণ করে। জ্যেষ্ঠ পুত্র সৈয়দ গােলাম কিবরিয়া (২০ এপ্রিল ১৯২০)। উনি ব্রিটিশ সরকারের Kings Commission থেকে Captain পদ লাভ করেন। কবি, লেখক ও নাট্যকার হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। চট্টগ্রাম বেতারে উনি ছােটদের আসর পরিচালনা করতেন এবং বেতারে শিল্পকলা ও সাহিত্য আসরেও যােগ দিতেন। দ্বিতীয় সন্তান জ্যেষ্ঠ কন্যা সৈয়দা হাসিনা খাতুন, গৃহবধূ (১৯২২)।
তৃতীয় সন্তান দ্বিতীয় পুত্র সৈয়দ গােলাম মর্তুজা (১৯২৪)। ব্যবসায়ী। ইনিও সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন ও নিভৃতে কাব্যচর্চা করতেন। চতুর্থ সন্তান তৃতীয় পুত্র সৈয়দ গােলাম মাওলা (১ অক্টোবর ১৯২৯)। ব্যবসায়ী। সাহিত্য অনুরাগী এবং চিত্রাঙ্কনে পটু ছিলেন। ছােট মামা সৈয়দ গােলাম মাওলার সাথে ছােট মামি (বরিশালের উলানিয়া জমিদার পরিবারের কন্যা) সৈয়দা কামরুন নেসার বিয়ে হয় ১৯৫৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। বিয়ের সময় ছােট মামুর বয়স ২৪ বছর এবং সদ্য চাকরিতে যােগ দিয়েছেন। পঞ্চম সন্তান, সর্বকনিষ্ঠ কন্যা আমার আম্মা সৈয়দা জোহরা খাতুন (২৪ ডিসেম্বর ১৯৩২, জন্মস্থান : পুরাতন ঢাকা)। মহিলা পরিষদের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট, জাতীয় নেতৃত্বের চরম সংকটের সময় তিনি আহ্বায়িকা (এপ্রিল, ১৯৭৭) হিসেবে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন এবং এই দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন। আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য। আব্বু ও আম্মার বিয়ে ১৯৯২ সালে আম্মা যখন যুক্তরাষ্ট্রে আমার কাছে বেড়াতে আসেন তখন আমি আম্মার সাক্ষাৎকারের (১০ নভেম্বর ১৯৯২ বেলা ৩-৩০ ঘটিকা) মাধ্যমে আলু-আম্মার বিয়ের কাহিনি লিপিবদ্ধ করি। এই লেখাতে প্রায় দুই যুগ আগে লিপিবদ্ধ করা আম্মার বিশদ সাক্ষাৎকার থেকে আল্লু ও আম্মার প্রথম পরিচয়ের দিন এবং বিয়ের দিনটি সম্পর্কে কিছু তথ্য সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করা হলাে। আমার জন্ম হবার দিনটি ঘিরে আম্মা যে স্মৃতিচারণা করেছিলেন তা-ও সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলাে। আম্মার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনু খালা ও ওনার স্বামী ইসলাম সাহেব ছিলেন আল্লু ও আম্মার বিয়ের ঘটক। ১১ এপ্রিল অনু খালা আম্মার একটি খোঁপা করা সাইড থেকে তােলা ছবি আন্ধুকে দেখিয়েছিলেন। আম্মার সাথে আব্দুর প্রথম দেখা ১৯৫৯ সালের ১৪ এপ্রিল। ১ বৈশাখ, বাংলার নববর্ষের দিনটিতে। সাক্ষাতের স্থান, বংশালে অনু খালা ও ইসলাম সাহেবের বাসায়। আম্মা যখন ঐ বাড়িতে প্রবেশ করেন, আন্ধু তখন বাইরের উঠানে চেয়ারে বসে ইসলাম সাহেবের সাথে টেবিলে রাখা ভাত ও ড়ামাছের চচ্চড়ি খাচ্ছিলেন। আব্দুর পরনে ছিল হাওয়াই শার্ট। আম্মা হাতে কাজ করা একটি থ্রিকোয়ার্টার ব্লাউজের সাথে সাদা সুতির শাড়ি পরেছিলেন। আব্বু ও আম্মার যখন বিয়ের কথা চলছে তখন বড় মামু আব্দুর গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে আব্দুর সম্বন্ধে খোঁজ করেন। সেই ব্যক্তি আব্দুর স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে ভূয়সী প্রশংসা করেন। পরে জানা যায় যে সেই ব্যক্তি ছিলেন আব্দুর বিরােধী দলের। আব্বর সাথে তার সম্পর্কও ভালাে ছিল না। তা সত্ত্বেও ঐ ব্যক্তি তার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরােধকে পাশে হটিয়ে আব্দু সম্বন্ধে সত্য বলতে দ্বিধা করেননি।
২৬ এপ্রিল, রােববার, রাত ৮টায় আলু ও আম্মার বিয়ে পড়ানাে হয়। আম্মার ইচ্ছা অনুযায়ী আম্মার জন্য একরাশ বেলী ফুলের গয়না আব্দু বিয়ের দিন এনেছিলেন। সেই বেশী ফুলের গয়না পরেই আম্মার বিয়ে হয়। বিয়ের আগে আম্মা আব্বকে বলেছিলেন, ‘আমার সােনার গয়নার দরকার নেই। আমি বেলী ফুল ভালোবাসি। তা দিয়েই আমার বিয়ে হােক।’ সমাজের কিছু আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা রীতি ও সংস্কারকে ওনারা সেদিন চূর্ণ করে দেন, হৃদয়ের মিলনকে প্রাধান্য দিয়ে। | বিয়ের স্থান : কাজি বাড়ি, মগবাজার। ১৯৫৬ সালে ঢাকা কলেজের অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণের পর নানা পরিবারসহ মগবাজার বিলের উল্টো দিকের বিশাল গাছপালায় হাওয়া এই বাড়িটি ভাড়া করেন। খালাতাে ভাই সাঈদ ভাই এই বাড়ির নতুন নামকরণ করেন স্বপ্নদ্বীপ। এই বাড়িতেই আমার জন্ম।
মেহমান : ৫০-৬০ জন। অধিকাংশই আত্মীয়স্বজন। আব্দুর সাথে এসেছিলেন ছােট কাকু, দলিল ভাই ও আনার আপা।
আব্দুর বন্ধুদের মধ্যে ডাক্তার করিম কাকু বরযাত্রী হয়ে এসেছিলেন। বিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঠিক হওয়ায় বেশি মানুষকে দাওয়াত দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিয়ের খাবার : খাসির বিরিয়ানি, মুরগির রােস্ট, কাবাব ও মিষ্টি। নানি যেমন রান্নায় পারদর্শী ছিলেন, নানাও কোনাে অংশে কম ছিলেন না। বিয়ের খাবার রাঁধা হয়েছিল নানার রেসিপি অনুযায়ী ও নানার তত্ত্বাবধানে।
২৮ জুলাই ২০১১: আমার জন্মদিনটির স্মৃতিচারণা। আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আম্মাকে টেলিফোন করি। আম্মা বললেন, “এই কদিনের মধ্যেই রােজার মাস শুরু হবে। তােমার কথা খুব মনে পড়ছে। তােমার জন্ম হয়েছিল। ১ রােজার দিন। তুমি জন্মাবার পর তােমাকে দেখে তােমার আব্বুর সে কী আনন্দ! আঁতুড়ঘরে তােমাকে নিয়ে সারারাত কাটালেন।’ নানা-নানির ইচ্ছা ছিল যে ওনাদের বাড়িতে আমি জন্মগ্রহণ করি। আমি জন্মাবার ৫/৬ দিন আগে আম্মা কারকুন বাড়ি লেন থেকে মগবাজারে নানা-নানির কাছে চলে যান। কাজের পর আব্ব প্রতিদিন আম্মাকে দেখতে মগবাজারে চলে আসতেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আম্মাকে দেখতে এসে আব্দু সে রাতে থেকে গেলেন। ডা, খােদেজা সরকারের তত্ত্বাবধানে পরদিন ১ রমজান ২৯ ফেব্রুয়ারি (১৯৬০) সােমবার ভাের ৬টায় আমি ভূমিষ্ঠ হই। সপ্তাহ খানেক পর নবজাতককে নিয়ে আম্মা কারকুন বাড়ি লেনে ফিরে আসেন। আম্মা যেন সেই সময়ে ফিরে গিয়েছেন এমনি এক আবেগ ভরা কণ্ঠে বললেন, “তােমার আব্দু সাইকেলে বেঁধে একটি সাদা দোলনা তােমার জন্য নিয়ে এসেছিল। তােমার জন্য সেই সাদা দোলনা কিনে তােমার আব্দুর খুব গর্ব। আমি ঠাট্টা করে বলতাম, ভারি তাে এক দোলনা এনেছ মেয়ের জন্য, তাই নিয়ে এত ! আমার ঠাট্টা শুনে তােমার আব্ব খুব অভিমান করলেন। সেই দোলনায় তুমি শুতে আমরা দুজনে দোলা দিতাম। তােমার মুখে যখন একটি দুটি বুলি ফুটছে তােমার আব্দুর সে কী আনন্দ!’

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ- নেতা ও পিতা – শারমিন আহমদ