You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২রা জানুয়ারী, ১৯৭৩, মঙ্গলবার, ১৮ই পৌষ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

নয়া আমদানী নীতি

বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব এম. আর. সিদ্দিকী জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত তাঁর এক বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারী-জুন বাণিজ্য মওসুমের আমদানী নীতি ঘোষণা করেছেন। এই নয়া আমদানী নীতিতে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারী-জুন বাণিজ্য মওসুমে ২১৯ কোটি টাকার পণ্যদ্রব্য আমদানীর ব্যবস্থা করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
নয়া আমদানী নীতিতে পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ করার জন্যে লাইসেন্স ইস্যু করার ভিত্তিকে বাড়িয়ে সর্বনিম্ন লাইসেন্সের অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা রাখা হয়েছে। নয়া আমদানী নীতিতে যেসব জিনিসের সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে তা আমদানীর মাধ্যমে পূরণ করার জন্য পরিবর্ধিত লাইসেন্সের ব্যবস্থাও রয়েছে।
নয়া আমদানী নীতিতে ২৪ কোটি টাকার কাপড়, ২৪ কোটি টাকার তুলা এবং ১৯ কোটি টাকার সূতা আমদানীর স্দ্ধিান্ত নেয়া হয়েছে। ওষুধ আমদানী করা হবে ২০ হাজার টাকার। গত বাণিজ্য মওসুমে ওষুধ আমদানীর পরিমাণ ছিলো ১৫ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, ওষুধ আমদানীকারকদের ঋণপত্র খোলার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় ২০ হাজার টাকা মূল্যের লাইসেন্স দেয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এতে করে একই বাণিজ্য মওসুমে প্রত্যেক আমদানীকারকের লাইসেন্সের ভিত্তি দাঁড়াবে ৪০ হাজার টাকা। আমদানী নীতি দ্রুততর করার জন্যে নগদ লাইসেন্সের ভিত্তি আমদানী নীতির সাথে সাথেই ঘোষণা করা হয়েছে।
নয়া আমদানী নীতির প্রধান লক্ষ্য হিসাবে বলা হয়েছে যে, দেশের কলকারখানায় সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব দূরীকরণ এবং রাষ্ট্রের মূলনীতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারী খাতে আমদানীর প্রতি অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
কারখানায় সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব দূরীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে নয়া আমদানী নীতিকে ওষুধ শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রপাতি আমদানীর ষান্মাষিক কোটার শতকরা দু’শো ভাগ লাইসেন্স দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রত্যেক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে তাদের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশের ষান্মাসিক কোটার একশ’ ভাগ পর্যন্ত লাইসেন্স দেয়া হবে।
নয়া আমদানী নীতির অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যতীত আপাততঃ আমাদের দৃষ্টিতে যা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা হলো জানুয়ারী-জুন বাণিজ্য মৌসুমে যেসব পণ্য বা খুচরা যন্ত্রপাতি আমদানী করা হবে তা সবই আসবে ক্যাশ লাইসেন্সের মাধ্যমে তাছাড়া বিলাস দ্রব্য আমদানীকে সম্পূর্ণ বর্জন করা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে ‘এইড’, ‘ক্যাশ’, ‘ক্যাশ-কাম বোনাস’ এবং ‘বোনাস লাইসেন্সের’ বদৌলতে একই পণ্যের চার রকমের মূল্য নির্ধারিত হতো। আর এতে করে ক্রেতারাই সবচেয়ে বেশী দুর্দশার সম্মুখীন হতেন। কিন্তু বর্তমান আমদানী নীতিতে সে রকম কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকাতে পণ্যের মূল্য স্বাভাবিকভাবেই কম হবে। নগদ মূল্যে জিনিসপত্র আমদানীর ফলে বৈদেশিক বাজার নির্বাচনে আর কোন অসুবিধার সৃষ্টিই হবেনা। বৈদেশিক সাহায্য হিসাবে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে পণ্য আমদানী করার ফলে অতীতে নিজস্ব পছন্দ মাফিক বিচার বিবেচনা বা যাচাই করে পণ্য আমদানী করা সাবেক পাকিস্তানী আমলে সম্ভব হতো না। বর্তমানে সে বাঁধা আর রইলো না। প্রস্ঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ গত ডিসেম্বর মাসে কন্সফারেন্স লাইনের সদস্য হওয়ার ফলে বিদেশ থেকে পণ্য সামগ্রী পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়মিত ও সুগম হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পরিশেষে একথা বলা প্রয়োজন যে, গত বাণিজ্য মওসুমে মাত্র ৮৫ কোটি টাকার পণ্য আমদানী নীতি ঘোষিত হয়েছিলো। অথচ এবারে প্রায় তার দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থের অনেক বেশী মূল্যের পণ্য আমদানী করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ হার যদি অপরিবর্তিত থাকে তাহলে চলতি বছরে দু’টো বাণিজ্য মওসুমে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বেশী পণ্য আমদানী করা সম্ভব হবে। এতে স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে ক্রমশঃ এগিয়ে যাচ্ছে। আমদানী নীতির পরিপ্রেক্ষিতে একথাও বলা যায় যে, রপ্তানীযোগ্য পণ্যমূল্যের পরিমাণ প্রায় তাই হবে।
পাক হানাদার বাহিনীর নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞের ফলে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য কারখানায় উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব পূরণের প্রতি লক্ষ্য রেখে যে নয়া আমদানী নীতি ঘোষিত হয়েছে তা ভবিষ্যতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য হ্রাস এবং দেশের শিল্পোন্নয়নের সহায়ক হবে বলে আমরা আশা করছি।
০০০

কৃষি বিপ্লব প্রসঙ্গ

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছেন। উদ্বোধনী ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, দেশে কৃষি বিপ্লব বাস্তবায়নের জন্যে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রকে নেতৃত্বদানের প্রেরণা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেছেন যে, ‘স্বাধীনতাকে জাতির জীবনে অর্থপূর্ণ করিতে হইলে, গণতান্ত্রিক অধিকার ও সামাজিক ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে নিজেদের এবং বংশধরদের জন্যে সুখ ও সমৃদ্ধির সোনার বাংলা গড়ার মহা লক্ষ্য অর্জন করিতে হইলে আমাদের সবুজ বিপ্লবের প্রকল্পকে অতি দ্রুত বাস্তবায়িত করিতে হইবে। কারণ কৃষির উন্নতি আমাদের সার্বিক আর্থিক উন্নতির চাবিকাঠি। তাই আমাদের কাজ শুধু একটি জীবিকার জন্যে নয়, জাতির স্বপ্ন ও আদর্শ রূপায়ণের মহাব্রত।’ বস্তুতঃ বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতি সম্পূর্ণভাবে কৃষির উন্নতির উপর নির্ভরশীল। কৃষি ক্ষেত্রের উন্নতি ছাড়া এদেশের গোটা মানুষের কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়। দেশের বর্তমান সরকার এ সত্য মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন বলেই কৃষির উন্নতির উপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এখন প্রয়োজন সেই গুরুত্বপূর্ণ কৃষি ব্যবস্থাকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নেওয়া। এ ব্যাপারে সরকারী কার্যক্রমের যেমন আবশ্যকতা রয়েছে তেমনি দেশের জনগণকেও আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। দেশে ব্যাপক কৃষি আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কৃষি উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করতে হবে।
মূলতঃ বাংলাদেশ কৃষি প্রধান বা কৃষি নির্ভর দেশ। কৃষি খাত থেকেই এদেশের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও কৃষিজাত দ্রব্য পাওয়া যায়। কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি হলেই এদেশে খাদ্য ও কৃষিজাত দ্রব্যের অভাব সম্পূর্ণ পূরণ হতে পারে। ইতিপূর্বে পাকিস্তান আমলে এদেশের কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি সম্পর্কে কোন প্রয়োজনীয় বা চাহিদা মতো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়নি। পরিকল্পিত উপায়ে এদেশের কৃষি উন্নতিকে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিলো। এদেশের মানুষকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে না দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মুখাপেক্ষী করে রাখার সেদিনের সেই ষড়যন্ত্র ক্ষমতাসীন ঔপনিবেশিক সরকার অত্যন্ত সুপরিকল্পিত উপায়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে চালিয়েছিলো। তারা জানতো বাংলার মানুষ যদি কোন ব্যাপারেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় তাহলে পাকিস্তানী শোষণের সমাধি রচিত হবে। বাংলাদেশ সেই শাসন ও শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। আজ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মহান শপথ গ্রহণ করতে হবে জাতিকে। আর সেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অন্যতম উপায় হলো এদেশের কৃষি ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি সাধন করা। বাংলাদেশ সরকার কৃষি বিপ্লবের জন্যে আহ্বান জানিয়েছেন। উন্নয়ন বাজেটের এক বিরাট অংক কৃষি খাতে ধার্যও করেছেন। এখন এ প্রকল্পকে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সরকার সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এদেশের কৃষিখাতে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ যদি প্রতিফলিত না হয় তাহলে কৃষির উন্নতি অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিগত কালের কৃষি ব্যবস্থা যেহেতু প্রাচীন পদ্ধতিতে আবর্তিত ছিলো সেহেতু তার আধুনিক উন্নয়ন সম্ভব হয়নি এবং তার জন্যে কোন ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমান সরকার আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন এবং সমবায় ও খামারের মাধ্যমে কৃষির উন্নতি চিন্তা করেছেন। সরকারী খামার যেমন চালু করতে হবে তেমনি দেশে সমবায় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমবায় পদ্ধতিতে দেশের কৃষি ও কুটির শিল্পের দ্রুত উন্নতি সাধন সম্ভব। অথচ একটি অনগ্রসর দেশে দ্রুত সমবায় আন্দোলন কার্যকরী হতে পারে না। এর জন্যে দরকার ব্যাপকভাবে সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা এবং সমবায়ের নিশ্চিত সুফল সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করা এবং দেশে সমবায় আন্দোলন গড়ে তুলে তার কার্যকারিতা মানুষের জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। এদেশে সবুজ বিপ্লব সার্থক করে তুলতেই হবে। আর তার জন্যে একদিকে যেমন প্রয়োজন সরকারী সদিচ্ছা অন্যদিকে তেমনি প্রয়োজন দেশের জনসাধারণের ঐকান্তিক সহযোগিতা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!