You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে মুজিব-তাজউদ্দীন ভূমিকা-বিতর্ক কার সৃষ্টি? - সংগ্রামের নোটবুক

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে যান, ফলে এই যুদ্ধে তিনি যে নেতৃত্ব দিলেন সেটা স্পিরিচুয়াল লিডারশিপ, ফিজিক্যাল লিডারশিপ দিতে পারলেন না। এর ফলে কতকগুলাে গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে আমাদের ইতিহাসে, আমাদের মননে, মানসিকতায়। এবং বঙ্গবন্ধু যখন ফিরে এলেন এটা তার স্বীকার করে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল যে, তার অবর্তমানে নতুন একটা দেশ হয়ে গেল যেখানে তিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে পারেননি। এটারই সুযােগ নিয়ে কিছু লোেক, বিশেষ করে যুবকরা যারা একটা আলাদা বাহিনী করতে চেয়েছিল, একটা বিপ্লবী কাউন্সিল তৈরি করতে চেয়েছিল, যারা একটা আইনানুগ সরকারের পরিবর্তে একটা নতুন নেতৃত্বের কথা ভাবছিল, যেখানে তাদের নিজেদের ভূমিকা সামনে আসবে—এই যে কাঁচা আকাঙক্ষা—তারা পরে বঙ্গবন্ধুকে নানাপ্রকারে নানাভাবে বােঝাবার চেষ্টা করেছে যে, তাজউদ্দীনের বােধ হয় তার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার পােটেনশিয়ালিটি আছে। এটা বঙ্গবন্ধু কনশাশলি না হলেও অবচেতনভাবে বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন সাহেবের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার কিছু কারণ ছিল। যেহেতু তার অবর্তমানে বাংলাদেশ স্বাধীন হল, সেখানে বঙ্গবন্ধু ফিজিক্যালি থাকতে পারলেন না, সশরীরে নেতৃত্ব দিতে পারলেন না, এটা যেমন একটা ব্যাপার, আবার তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতার চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াতে পারেন, এইরকম একটা কথা তাকে কেউ কেউ বুঝিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা বা কোন উপদল করবার বিন্দুমাত্র চিন্তা তাজউদ্দীন সাহেবের ছিল না। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের যে ঐতিহাসিক ভূমিকা, সেই ঐতিহাসিক ভূমিকাকে নিরূপণ করতে পারেননি। তিনি রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা পালন করবার জন্য কখনাে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, কখনাে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল জাতির পিতা হিসেবে, রাজনৈতিক ভূমিকারও উর্ধ্বে যার স্থান ছিল—তিনি জাতির পিতা, জাতি তাঁকে সেই জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল ঐতিহাসিকভাবেই—সেই জায়গাটাতে না গিয়ে তিনি রাষ্ট্রীয় নেতা এবং রাজনৈতিক নেতা এবং দলীয় নেতার ভূমিকা পালন করলেন। তাজউদ্দীন ভাই আর দু’চারজন ছাড়া আমরা যারা তার চারপাশে ছিলাম তারা তাঁকে এই ভূমিকা পালন করতে উৎসাহিত করেছিলাম, যে কোন কারণেই হােক না কেন। তাজউদ্দীন সাহেব পদত্যাগ করবেন সেই সময়ে এ ধরনের কথাবার্তা তিনি অনেক সময় বলতেন। কিন্তু সেটা এভাবে দ্রুত ঘটবে তা বুঝিনি। বঙ্গবন্ধু যখন চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থা করলেন, আমরা আশা করেছিলাম যে ওই সময়েই তিনি এটা প্রকাশ্যে বলবেন যে, তিনি এই ধারাতে বিশ্বাস করেন।

কিন্তু সেটা বঙ্গবন্ধুর জন্য যেমন দুর্বলতা, তেমনি বাংলাদেশের জন্য দুর্বলতা, এ দুটো কারণ মিলেই নব্যস্বাধীন দেশে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হবে; এ কারণেই বােধ হয় তাজউদ্দীন সাহেব এটা করতে পারেননি। কিন্তু পেছনের দিকে তাকালে আমার কাছে মনে হয় যে, সেটা যদি করা সম্ভব হত তাহলে বােধ হয় অনেককিছু অ্যাভয়েড করা যেত। এমনও হতে পারত, বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন সাহেব দু’জনই বেঁচে থাকতেন। এই বিরােধটা সামনে আসা উচিত ছিল। যেহেতু রাজনৈতিকভাবে আমরা একদলীয় ব্যবস্থাটা বিশ্বাস করিনি, তার ফলে সবকিছুই কেমন যেন ঘােলাটে হয়ে গেছে। তাজউদ্দীন সাহেবের প্রাণনাশের হুমকির ব্যাপারটা তিনি অনেক সময় নিজেই উল্লেখ করতেন, যে কারণে তিনি আলাদা কোন স্ট্যান্ড নেননি। তাজউদ্দীন সাহেবের প্রাণনাশের হুমকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ওই যুবক ছেলেরা দিয়েছিল। ওই যুবক ছেলেরা ঘৃণা ছড়াবার জন্য আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাত যে, তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমি নাকি বঙ্গবন্ধুকে ধরিয়ে দিয়ে এসেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন ছেলে তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে এসে স্বীকারােক্তিও করেছিল যে, তাজউদ্দীন সাহেবকে হত্যা করার জন্য তাকে পাঠানাে হয়েছে। সে অস্ত্রটা তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে রেখে গিয়েছিল।

Source:

আমীর-উল ইসলাম।

তাজউদ্দীন আহমদ-আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খণ্ড) – সিমিন হোসেন রিমি