তাজউদ্দীন সাহেবের দেশপ্রেমের প্রকৃষ্ট প্রকাশ ঘটে এভাবে—যেহেতু মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধ অবস্থাতে থাকার ফলে তাদের পারিবারিক জীবন যাপন করতে পারছেন না, সে কারণে তাজউদ্দীন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পণ করেছিলেন, যতদিন যুদ্ধ চলবে, বাংলাদেশ স্বাধীন না হবে, ততদিন তিনি তাঁর পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না। তিনি তার এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন। সে সময়ে অনেক দুর্যোগ, দুর্বিপাক তাঁর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনে এসেছে। যেমন তার বুকে একটি ফোড়া হয়, ডায়াবেটিসের কারণে এতে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর খুবই সেবাযত্নের প্রয়ােজন হয়। কিন্তু তিনি সেই সময়েও (তখন তাঁর পরিবার কলকাতাতে) তার পরিবারের কাছে যাননি। আর একটি ঘটনা আমার মনে আছে। তার একমাত্র ছেলে সােহেল খুব অসুস্থ, এই অসুখ খুব মারাত্মক রূপ নিচ্ছিল। আমার নিজের এক ছেলেও সেই সময় এইরকম ইনফেকশান হয়ে মারা যায়, এ ব্যাপারে সবাই খুব উদ্বিগ্ন। তাকে বহুবার অনুরােধ করা হয়েছে, কিন্তু তিনি একটা কথাই বলতেন যে, আমি তাে ডাক্তার নই, আপনারা ডাক্তার দেখান। আমরা যখন একদিন বাংলাদেশের ভেতরে কাজ করে ফিরছি সেই সময় গােলােক মজুমদার প্রায় এক রকম জোর করে তার পরিবার যেখানে থাকতেন সেই ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন। তিনি কিছুক্ষণ তাঁর সন্তানের বিছানার শিয়রে দাঁড়ালেন, দুই চোখ বুজে হয়ত তিনি তাঁর প্রার্থনা করলেন দুই-এক মিনিট, তারপর তিনি ফিরে গেলেন। এগুলাে তাঁর দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্ষমতার প্রতি তাজউদ্দীন সাহেবের যে কোন আকর্ষণ ছিল না, সে কথা আমি আগেও বলেছি। যখন তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা বলা হল, তখন তিনি সবচাইতে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর সহযােগীরা যদি এটা অপছন্দ করেন বা তাকে প্রতিযােগী ভাবেন, তাতে যদি যুদ্ধের কোন ক্ষতি হয়, অসুবিধা হয়—এই ব্যাপারগুলাে তার খুব দুশ্চিন্তার কারণ ছিল। আমরা একই রুমে পাশাপাশি বেডে থাকতাম কিছুদিন। অনেক কথা হত রাতে। তিনি বলতেন যে, দেখুন, প্রত্যেক দিনই ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে। তার সাথে আমরা সম্পৃক্ত। আসুন আমরা এমনভাবে কাজ করি, যেন ঐতিহাসিকদেরও ভবিষ্যতে আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয় যে আমরা এর পেছনে কীভাবে কাজ করেছিলাম । তিনি খুব আত্মপ্রচারবিমুখ ছিলেন। নিজেকে খুব আড়াল করে রাখতে চাইতেন। নিজের ভূমিকাকে গােপন করে রাখতেন। যেটা তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। এই বৈশিষ্ট্য যুদ্ধের সময়ও প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে।
Source:
আমীর-উল ইসলাম।
তাজউদ্দীন আহমদ-আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খণ্ড) – সিমিন হোসেন রিমি