You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন সাহেবকে তিনটি মূল ফ্রন্টে কাজ করতে হয়। তিনটি মূল সমস্যার ভেতর তিনি পড়েন। একটি হচ্ছে যে, যারা যােদ্ধা, যুদ্ধ করছে, তার ভেতরে দুটো ধারাএকটা হচ্ছে পাকিস্তান আর্মি থেকে চলে আসা সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ আধা সামরিক বাহিনী অর্থাৎ ইপিআর, পুলিশ, আনসার; আর। অন্যটি হচ্ছে যুবক, কৃষক যারা গ্রামের সাধারণ মানুষ এবং অন্যান্য লােক। এই দুটোকে একসাথে করার একটা দায়িত্ব তাজউদ্দীন সাহেবের উপরে এসে পড়ে। এটি খুবই দুঃসাধ্য ছিল। আরাে একটা সমস্যা যােগ হল, সেটা হচ্ছেমুজিব বাহিনীনামের একটা বাহিনী। শেখ মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর। রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ, , , , রব, আব্দুল কুদুস মাখন প্রমুখ এই বাহিনী গঠন করল। অথচ এরা আমাদের সবচেয়ে বেশি যােদ্ধা শক্তি হিসেবে কাজ করবে আশা করা গিয়েছিল। এই যে আলাদা একটা বাহিনী মুজিব বাহিনী নাম দিয়ে গঠন করা হলএই বাহিনীটা যুদ্ধ করার চাইতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল যে যুদ্ধপরবর্তী ঘটনাগুলাে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনাটা যেন তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়। আমরা লক্ষ্য করি যে, মুজিব বাহিনী যেটা গঠিত হয়েছিল সেই মুজিব বাহিনীর ছেলেরা নিজ নিজ গ্রামে গিয়ে আরাে দশটি ছেলেকে তৈরি করেছে। সেই কাজটি খুব দ্রুত ঘটছিল।মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ওসমানী সাহেব ভেবেছিলেন আমরা যােদ্ধা হিসেবে বেশি লােক পাব না। সে কারণে জেনারেল ওসমানী বললেন, আমার সােনার ছেলে দরকার। তখন আব্দুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ এদেরকে দায়িত্ব দেয়া হল রিক্রুটমেন্টের তখন তারা ওসমানী সাহেবকে এসে বললেন যে, একটা চিঠি লিখে দেন। তখন ওসমানী সাহেব রাজ্জাক এবং তােফায়েলকে অথরাইজ করলেন এইসব ছেলেদের নিয়ােগ করার জন্য। এই চিঠি নিয়েই নাকি ওঁরা‘-এর মাধ্যমে মূলত দিল্লীতে যােগাযােগ করেছিলেন এবং একটা আলাদা বাহিনী গঠন করবার জন্যে দিল্লীর সম্মতি আদায় করে আসেন। দিল্লীর সম্মতি নিয়ে জেনারেল ওবানের অধীনে মুজিব বাহিনীর। একটা প্রশিক্ষণ নেয়ার ব্যবস্থা করলেন। মুজিব বাহিনীতে যারা যেত তারা ভাল সুবিধা পেত। অতএব তারা এভাবে আমাদের বহু কর্মীদেরকে এবং ভলান্টিয়ার বাহিনীতে যেসব কর্মী ছিল তাদেরকে মুজিব বাহিনীতে যুক্ত করলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভেতরে ধরনের একটা বিভক্তি থাকায় অনেক ভুলবােঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে অনেক সময় জটিলতার সৃষ্টি করে। আর একটি জিনিস ঘটে যে, আমাদের যে সমস্ত সামরিক বাহিনীর কমান্ডাররা আছেন তারা তাদের বাহিনীর লােকজন নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন, তাঁদের সাথে আবার স্থানীয় যুবকরা যােগ দেয়। স্থানীয় বলতে আমি বলছি, ওই অঞ্চলের বাংলাদেশ থেকে যারা গেছে এবং তারাও একটা অনিয়মিত বাহিনী তৈরি করে গেছে। অতএব, তাদের রেশন, কাপড়চোপড় ইত্যাদি জিনিস যেগুলাে দেয়া হত, সেটাকে আবার অনেকজনের সাথে ভাগ করতে হচ্ছে। এই ধরনের একটা সমস্যা সৃষ্টি হল। অর্থাৎ একটা লিয়াজোর সমস্যা দেখা দেয় যে, প্রয়ােজনীয় সংখ্যক পােশাক তারা পাচ্ছে না, প্রয়ােজনীয় পরিমাণ রেশন তারা পাচ্ছে না। এই রকম অবস্থার সৃষ্টি হয় বিভিন্ন ক্যাম্পে। সেগুলাে কোঅর্ডিনেট করতে হত। দ্বিতীয় যেটা হয়, আওয়ামী লীগের যে সমস্ত এমএলএ বা এমপি গেছেন তাদেরকে দায়িত্ব এবং কাজ গুছিয়ে দেয়া, এবং তাঁদেরও ব্যক্তিগত সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা সবকিছুই আছে, অতএব এই সমস্ত কিছুই তাজউদ্দীন সাহেবকে দেখতে হত এবং এসব ব্যাপারে বেশি সময় দিতে হতএই সমস্ত সমস্যার কিভাবে সমাধান দেয়া যায়, কাকে কীভাবে দায়িত্ব দেয়া যায় প্রত্যেক জেলার এমপিদেরকে এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে কীভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করানে। যায় সেজন্য আমরা দ্রুত কিছু ইয়ুথ ক্যাম্প তৈরি করি। প্রতি ইয়ুথক্যাম্পে একজন এমপিকে দায়িত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধে যাবার জন্য যে সমস্ত যুবকরা আসত তাদেরকে সাথে সাথেই আমরা ট্রেনিংয়ে পাঠাতে পারতাম না। তারা এই ক্যাম্পে থাকত। এখান থেকে তাদেরকে পরে ট্রেনিং দেয়া হত। কিছুটা পলিটিক্যাল মােটিভেশন দেয়া হত, তারপর তাদেরকে ট্রেনিং ক্যাম্পে নেয়া হত। এই ট্রেনিং ক্যাম্পে একজন এমপিকে দায়িত্ব দেয়া হত যে, তিনি এই ট্রেনিং ক্যাম্পে থাকবেন। এই সমস্ত কিছুকে ঠিক করে একটা গােছালাে অবস্থায় আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তৃতীয়ত, বৈদেশিক প্রচার এবং বিদেশী কূটনৈতিক তৎপরতা বাংলাদেশের জন্য। এই কাজটাও মূলত তাজউদ্দীন সাহেবকে দেখতে হয়। এই যে বিভিন্ন ধরনের কাজ, এই সমস্ত কাজের ব্যাপারে আমি তার সাথে জড়িত ছিলাম প্রধান সহায়তাকারী হিসেবে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আমার কাজ কী?’ বললেন যে, ‘আমি যা যা কাজ করি সবই আপনার কাজ ধরে নিতে পারেন, এবং আমার সমস্ত কাজের সাথেই আপনাকে থাকতে হবে।তার ফলে যুদ্ধ পরিকল্পনা হােক বা কোন ক্যাম্পের বা কোন শাখায় কোন সমস্যা হােক বা জেনারেল ওসমানীর সাথে কোন সময়ের ব্যাপার হােক বা বিদেশীদের সাথে কোন কোঅর্ডিনেশনের কোন ব্যাপার হােক বা বিদেশ থেকে কোন এমপি প্রতিনিধি দল আসছে বা কোন রিলিফের ব্যাপারএই সবটা জিনিস নিয়েই আমাকে খুব ব্যতিব্যস্ত এবং দৌড়াদৌড়িতে থাকতে হত। তাজউদ্দীন সাহেব সমস্ত বিদেশীদের সাথে বাংলাদেশের ভেতরে গিয়ে দেখা করতেন। বিভিন্ন সময়ে বিদেশী এমপি বা প্রতিনিধিরা আসতেন বাংলাদেশ সরকারের সাথে কথা বলতে বা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করতে। তখন এমনভাবে ব্যবস্থা করতাম যে, তাজউদ্দীন সাহেবকে নিয়ে আমরা বাংলাদেশের ভেতরে চলে যেতাম। আমরা প্রবাসে সরকার গঠন করেছি এটা সবাই জানতেন, কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে দেখা করার যে মর্যাদা এবং ফলাফল তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলে আমরা একটা বিরাট প্রচার পেতাম। সক্রিয় কোন ক্যাম্প যেখানে আমাদের ছেলেরা যুদ্ধ করছে, পাশে যুদ্ধক্ষেত্রে গােলাগুলি হচ্ছে, এই রকম একটা অবস্থাতেই মাঠের ভেতরে এক ধরনের ক্যানভাসের চেয়ারে বসে আলােচনা এবং দেখাশােনা চলত। হয়ত কখনও পাশের ক্যাম্প থেকে / পেয়ালা চায়ের ব্যবস্থা হত। এভাবে বহু সাক্ষাৎকারঘটেছে। হয়ত সাক্ষাঙ্কার চলছে সে সময়েই সেই এলাকাতে খুব যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, কামান গর্জে উঠেছে; বাধ্য হয়ে তখন আমাদের কথা শেষ করতে হয়েছে। সেখানে সঙ্কেত দেবার জন্য ফিল্ড ফোন থাকত। এই ফিল্ড ফোনে খবর। আসত যে, শক্র হয়ত এদিকে আসছে, আপনাদের নিরাপদ জায়গাতে যাওয়া দরকার। এই রকম অবস্থার ভেতরে আমরা বহু সাংবাদিকদের সাক্ষাকার দিয়েছি। যেমন, একেবারে প্রথমদিকে এসেছিলেন বৃটিশ এমপি মি, ডগলাস ম্যানএটা আমাদের সরকারের আত্মপ্রকাশ করার আগের ঘটনা। মি, ডগলাস ম্যান বৃটিশ হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনারের বাড়িতে উঠেছিলেন। আমি তার সাথে যােগাযােগ করলাম এবং তাঁকে নিয়ে সীমান্তে চলে গেলাম। তাজউদ্দীন সাহেব তার আগেই বেনাপােলের ভেতরে যশােরের কোন একটা জায়গায় গিয়ে থাকলেন। আমরা তাঁকে সেখানে নিয়ে গেলাম। যেখানে। আমাদের বেনাপােল কাস্টমস চেক পােস্ট সেখানে বাংলাদেশের ভেতরে সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করলাম। সেখানে স্থানীয় মুক্তিবাহিনী কমান্ডার মেজর ওসমান। চৌধুরীকে ডেকে আনা হল। আমাদের যখন কথাবার্তা চলছে ঠিক সেই সময়েই খবর এল যে, শত্রুপক্ষ কিছুদূরেই আছে এবং তাদেরকে মােকাবেলা করার জন্য ওসমান চৌধুরীর এখনি যাওয়া দরকার। ওসমান চৌধুরী তখনই চলে গেলেন। তাে এই রকম অবস্থায় অনেক মিটিং হয়েছে। জন স্টোনহাউসের সাথে, পিটার শােরের সাথে, ডন সেজুয়াসের সাথে, তারপর টাইমস্এর সাংবাদিক পিটার হেজেল হান্টএর সাথেএমন অনেকগুলাে সাক্ষাৎকার হয়েছে। এটা আমাদের বৈদেশিক তৎপরতার একটা দিক ছিল। তারপর জার্মান মন্ত্রী এসেছিলেন এক সময়, তার সাথেও তাজউদ্দীন সাহেব দেখা করেছিলেন এই রকম একটা জায়গাতে বসে। তিনটি ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন সাহেবকে খুব ব্যস্ত থাকতে হত। একটা হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বদেরকে সংগঠিত করা এবং তাদেরকে কাজের দায়িত্ব দেয়া। আর একদিকে আমাদের যােদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা, অস্ত্রের ব্যবস্থা করা, তাদেরকে দেশের ভেতরে পাঠানাে ইত্যাদি। তৃতীয়ত, বিদেশের সাথে আমাদের যােগাযােগ করা। দিল্লীর সাথে আমাদের যােগাযােগ রাখাটা ছিল সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাজউদ্দীন সাহেবের ব্যক্তিত্ব এবং চারিত্রিক গুণাবলীর কারণে দিল্লীর একটা বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল তার উপরে যে, তিনি একজন নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। ফলেতাজউদ্দীন সাহেবের উপরে দিল্লী নির্ভর করত এবং সেখানে তার একটা যােগাযােগ ছিল এবং সেই যােগাযােগটা মি. নাথ নামক ভদ্রলােকের মাধ্যমে হত। কয়েক সপ্তাহ পরপর তাজউদ্দীন সাহেব দিল্লীতে গিয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করতেন, কথাবার্তা বলতেন। কখনাে তিনি একা গেছেন, কখনাে সম্পূর্ণ মন্ত্রিসভা নিয়ে গেছেন, কখনাে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এবং তাজউদ্দীন সাহেব এই দুজন গেছেন, এরকমভাবে দিল্লীর সাথে যােগাযােগটা হয়েছে। এছাড়া দিল্লীর সাথে চিঠিপত্রেও যােগাযােগ ঘটেছে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যখন বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতার কাজে যান তার আগে তাজউদ্দীন সাহেব ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটা ব্রিফিং পাঠান এবং তিনি সেটা নিয়ে বিদেশে যান। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে তাজউদ্দীন সাহেবের যে ভূমিকা তা। পরিষ্কার ছিল প্রথম থেকেই, যে কারণে তিনি শ্রীমতি গান্ধীকে প্রথম সাক্ষাতে বলেছিলেন যে, এটা মূলত আমাদের যুদ্ধ এবং আমরাই এই যুদ্ধ করতে চাই। এবং আমরা ভারতবর্ষের কাছ থেকে যেটা চাই সেটা হচ্ছে ভারতবর্ষের সাহায্যসহযােগিতা, যযাদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, অস্ত্রের ব্যবস্থা, বিদেশে কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং প্রচারের ব্যবস্থা করা। এই যুদ্ধ যেন ভারতপাকিস্তান যুদ্ধে পরিণত

হয় এটা যেমন তিনি প্রথম দিন বলেছিলেন, তেমনি স্বাধীনতার পর ২২ তারিখে যখন তিনি ফিরে যাচ্ছেন ঢাকায় সেই সময় গােলােক মজুমদার, রুস্তামজী উপস্থিত ছিলেন দমদম এয়ারপাের্টে সেই সময় বিদায় জানাতে গিয়ে রুস্তামজী বলেন যে, আমাদের বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন থাকবে; তখন তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, অবশ্যই দুটি স্বাধীন দেশের মর্যাদার ভিত্তিতে আমাদের বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন থাকবে। তিনি তাদেরকে এটা বােঝাতে চেয়েছিলেন যে, বন্ধু, তােমরা আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছ। সেই জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এখন আত্মপ্রকাশ করেছি এবং সেই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আমরা তােমাদের কাছ থেকে সেই ভালবাসা এবং মর্যাদা আশা করি। প্রথম যেদিন আমরা ভারতবর্ষের বর্ডারে ঢুকি সেদিন এবং যেদিন আমরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে আসি সেদিনও সেই একই কথা তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন। আমরা যখন বর্ডারে ঢুকি তখন তিনি বলেছিলেন, একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদেরকে যদি ভারত উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করতে রাজি থাকে তবেই আমরা ভেতরে যাব।

 

Source:

আমীর-উল ইসলাম।

তাজউদ্দীন আহমদ-আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খণ্ড) – সিমিন হোসেন রিমি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!