You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.18 | মুজিবনগর সরকার গঠনের পরের দিন - সংগ্রামের নোটবুক

১৮ তারিখ সকালবেলা হােসেন আলি সাহেব মিশনের প্রায় সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করেন। হােসেন আলি সাহেবের কাছে মিশনের যে পরিমাণ টাকা ছিল সেই টাকাটা সম্পূর্ণ তুলে নিয়ে তিনি অন্য অ্যাকাউন্টে জমা করার ব্যবস্থা করেন যেন মিশনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের। বেতনের কোন অসুবিধা না হয়। হােসেন আলি সাহেবের স্ত্রী মাত্র কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ থেকে ফিরেছেন। তিনি সেখানকার অবস্থা দেখে এসেছেন। মিসেস হােসেন আলি বিশেষ করে পতাকা তােলার ব্যাপারে নেতৃত্ব দেন। সেই সময়ে তারা দু’জনই খুব সাহসের পরিচয় দেন। হােসেন আলি সাহেব আনুগত্য ঘােষণা করায় আমাদের ব্যাপারে। একটা প্রচণ্ড আন্তর্জাতিক সাড়া পড়ল। কলকাতাতে আমাদের একটা লিগ্যাল এনটিটি হল এবং এটাই আমাদের মিশন হিসেবে কাজ করায় সুবিধা হল যে, বাংলাদেশের প্রথম মিশন হচ্ছে কলকাতার সার্কাস এভিনিউতে। ১৮ তারিখ সকালবেলা আমরা মিশনের বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে আমরা ভেতরে গিয়ে হােসেন আলিকে অভিনন্দন। জানালাম। হাজার হাজার লােক মিছিল করে কলকাতা এসে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে, ফুলের মালা দিয়েছে। প্রায় দু’সপ্তাহ সেই জায়গাটা উৎসবমুখর ছিল। বাংলাদেশ মিশনের সামনে তাঁবু খাটিয়ে দেশাত্মবােধক গান, বক্তৃতা দেয়া এসব চলতে থাকল। এরপর এই মিশনে আমরা একটা স্থায়ী লিয়াজো অফিস স্থাপন করি। ওই লিয়াজোঁ অফিসের দায়িত্বে আমি ছিলাম। বাংলাদেশ থেকে যত লােকজন আসতেন তাদের সকলকে ওখানে অভ্যর্থনা করার পর প্রাথমিক সাক্ষাৎকার নেয়া হত। নূরুল কাদের খান, আসাদুজ্জামান, এঁদের অফিসও এখানেই স্থাপন করা হল। অতএব আমাদের ছােটখাট অফিস ওখানে চলছিল। ইতােমধ্যে আমাদের প্রথম কাজ হল বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্যে তৎকালীন ১০৭টি দেশের কাছে চিঠি লেখা। স্বীকৃতির জন্যে চিঠি তৈরি করতে হবে, তারপর ১০৭টি চিঠি টাইপ করানাের কাজ। একটা বই ছিল আমাদের কলকাতা হাই কমিশনের লাইব্রেরিতে—Forms and Precedence of Diplomatic Correspondence; সেটা থেকে একটি চিঠি বাছাই করে সে ধাঁচে একটি চিঠি তৈরি করা হল। পৃথিবীর সমস্ত দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীদের কাছে চিঠি লেখা হল। চিঠিগুলােতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দস্তখত করলেন।এই চিঠিগুলােতে কাউন্টারসাইন করার জন্য একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, পররাষ্ট্র মন্ত্রী কাউন্টারসাইন করবেন। কিন্তু মােশতাক সাহেব আর সেই চিঠিতে সাইন করতে চান না। শুরুতেই আমাদের এই সমস্ত চিঠিপত্রের যােগাযােগ মােশতাক সাহেবের কারণে কয়েক সপ্তাহ পিছিয়ে গেল। তিনি একটি অজুহাত খাড়া করলেন, তার পরিবার এখনাে আসছে না, সেটা নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত। এর কিছুদিন পর তাঁর পরিবারপরিজন কলকাতায় পৌছলে তিনি চিঠিতে দস্তখত করেন। তারপর চিঠিগুলাে কোথা থেকে পােস্ট করা হবে ? কলকাতা থেকে পােস্ট করলে সেটা কেমন হবে, এই ভাবনার পর শেষকালে তৎকালীন জিডিআর থেকে চিঠি। পােস্টের ব্যবস্থা হল। জিডিআর-এ একটা সম্মেলন ছিল এবং মস্কোতেও তখন শান্তি সম্মেলন ছিল, সেই সম্মেলনে আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেবকে পাঠানাে হয়। ওখানে গিয়ে তিনি চিঠিগুলাে পােস্ট করেন। আর ভারতবর্ষের চিঠি তাজউদ্দীন সাহেব যখন পরবর্তীতে দিল্লী যান তখন তিনি সাথে করে নিয়ে যান। আমাদের এই সময় খুব দ্রুত সাংগঠনিক তৎপরতা নিয়ে এগুতে হচ্ছিল। আমরা তখন বালিগঞ্জে একটা বাড়ি ভাড়া নেই—বালিগঞ্জ সার্কেল হাউস, এটা সুব্রত রায় চৌধুরীর বাড়ির খুব কাছেই। এই বাড়িতেই মান্নান সাহেব, আমি এবং আরাে অনেকেই থাকি সেই সময়। আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেবও এখানে থাকেন। এখানেই আমাদের মিটিং সিটিং হয়। আর মিশনটাকে আমরা ব্যবহার করতে থাকি আমাদের ফ্রন্ট অফিস হিসেবে। কিন্তু মােশতাক সাহেবের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কিছুটা অনীহার ভাব রয়ে গেল। তিনি বললেন যে, যদি আমরা আগরতলা থেকে দু’জন লােক, মাহবুবুল আলম চাষী এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে এনে দেই তাহলে তিনি দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এই দু’জন লােককে আমরা খবর পাঠালাম আসার জন্য। তারা এলেন। মােশতাক সাহেব এরপর শর্ত দিলেন, সার্কাস এভিনিউর বাংলাদেশ মিশনকে তিনি ফরেন অফিস হিসেবে ব্যবহার করবেন। এবং যেহেতু মিশনটা ফরেন অফিসের অধীনে তাই সেখান থেকে অন্যান্য সমস্ত অফিস সরিয়ে নিয়ে আসতে হবে, আমার অফিসও সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমরা তখন সব অফিস সরিয়ে ৮ নম্বর থিয়েটার রােডে নিয়ে এলাম। হােসেন আলি সাহেবের অফিসই ফরেন অফিস হিসেবে রইল এবং একই সাথে আমাদের মিশন হিসেবেও কাজ চলত। এর ফলে ফরেন অফিস সম্পূর্ণভাবে চলে গেল মাহবুবুল আলম চাষী এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের হাতে। মাহবুবুল আলমচাষীকে ওখানে পররাষ্ট্র সচিব করা হয়। যার ফলে দুটো ধারা কাজ করতে লাগল। কারণ তারা একটা সমঝােতা করে আমেরিকার সাথে যােগাযােগ করে নানারকমের চিন্তাভাবনার ভেতরে এগুতে চাচ্ছিলেন, যেগুলাে আমরা অনেক সময় ইন্টারসেপ্ট করেছি। বিদেশীদের সাথে যে বৈদেশিক তৎপরতা করতে হয়েছে, সেটা প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকেই চালাতে হয়েছে এবং সেটার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমাকেই বহন করতে হত। যেমন, বিদেশের সাথে যে সমস্ত লবি করা, অন্যান্য দেশের পার্লামেন্টের সদস্য, সিনেটর, আইনজীবীদের সাথে যে সমস্ত যােগাযােগ হত সেগুলাে আমাকেই করতে হত। আমরা প্রথম থেকেই আঁচ করতে পারছিলাম যে, খন্দকার মােশতাক মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করছিলেন। কিন্তু আমরা সেই সময়ে ৫ জনের যে হাইকমান্ড সে হাইকমান্ডে তাকে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম যাতে কোন বিভক্তি না হয় ৫ জনের মধ্যে, কেউ যাতে না বলতে পারে এরা স্বাধীনতার পক্ষে নন বা অন্য কোন সমঝােতা করতে তারা রাজি আছেন। মােশতাক সাহেবকে তখন যদি আমরা বিদেশে চলে যেতে দিতাম তাহলে তিনি হয়ত অন্য কোন লাইন ধরতেন বা পাকিস্তানিদের সাথে মিশে কিছু করতেন। সেটা আমরা চাইনি, সেইজন্য তাকে আমরা কাছে রাখতে চেয়েছিলাম।

Source:

আমীর-উল ইসলাম।

তাজউদ্দীন আহমদ-আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খণ্ড) – সিমিন হোসেন রিমি