১৭ এপ্রিলের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ভীষণভাবে গােপনীয়তা রক্ষা করা হল। ইতােমধ্যে আমাকে স্বাধীনতার ঘােষণা লেখার দায়িত্ব দেয়া হল। সেটা আমি লিখলাম। এই ঘােষণার ভেতরেই আমাদের সরকার গঠনের কথা থাকল। ঘােষণাটি তাজউদ্দীন সাহেবকে দেখালাম। তাজউদ্দীন সাহেব দেখে বললেন এটা এখানে কাউকে দেখানাে যায় কিনা, যাদের সংবিধান সম্পর্কে জ্ঞান আছে। গােলােক মজুমদার সুব্রত রায় চৌধুরীর কথা বললেন, তিনি কনস্টিটিউশনাল লইয়ার হিসেবে খুব প্রসিদ্ধ। তার সাথে যােগাযােগ করলাম। তিনি খসড়াটি দেখে বললেন যে, খুব সুন্দর হয়েছে খসড়া এবং সমস্ত বিষয়গুলাে এতে এসে গেছে। সুব্রত রায় পরবর্তীকালে আমাদের স্বাধীনতার ঘােষণা নিয়ে একটা বইও লিখেছেন Genesis of Bangladeshi সুব্রত রায় চৌধুরীর বাড়ি থেকে এসেই আমরা খসড়াটি চূড়ান্ত করে ফেললাম। এটাকে সাইক্লোস্টাইল করা, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের বক্তৃতা সাইক্লোস্টাইল করা, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের বক্তৃতা সাইক্লোস্টাইল করা, এই সমস্ত কাজ শেষ করে সাংবাদিকদের কীভাবে সমবেত করা যায় সে জন্যে আমি আর মান্নান সাহেব ১৬ তারিখ সন্ধ্যাবেলা কলকাতা প্রেস ক্লাবে গেলাম। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করবেন। লােকে লােকারণ্য প্রেস ক্লাব, তিল ধারণের স্থান নেই। আমরা সাংবাদিক সম্মেলনে প্রথমেই বললাম, “আমরা এসেছি আপনাদের নিমন্ত্রণ জানাতে। আপনাদের সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং ক্যাবিনেট কথা বলবেন, সে ব্যবস্থা করার জন্যই আমরা এসেছি। আপনারা আগামীকাল সকালে এখানে উপস্থিত থাকবেন। আমরা আপনাদের কোন এক জায়গায় নিয়ে যাব। কোথায় নিয়ে যাব, বাংলাদেশের ভেতরে না বাইরে এমন অনেক প্রশ্ন করলেন সাংবাদিকরা। আমরা একটা কথাই বললাম, এর চেয়ে বেশি আমরা আপনাদের বলতে পারব না। আমরা কোথায় যাচ্ছি তা সব জায়গায় গােপন রাখলাম। আগে থেকে কেউ এই বিষয়ে জানতে পারেনি। তাদের সাথে কথা হল যে, সকাল ৮টার সময় তারা প্রেস ক্লাবে উপস্থিত থাকবেন।রাত ১২টা থেকে আমাদের কাজ শুরু হল। সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হল আমাদের কর্নেল ওসমানী সাহেবের পােশাক নিয়ে। তাকে ইউনিফর্ম পরাতে হবে। কিন্তু ভারতীয় বিএসএফ-এর যে সমস্ত কাপড়চোপড় এগুলাে একটাও তার শরীরে ঠিক হয় না। সে জন্য বড় বাজার থেকে দর্জি নিয়ে এসে তার মাপের একটা ইউনিফর্ম তৈরি করা হল। এভাবে সারা রাত এবং ভাের পর্যন্ত কাজ চলল। ভােরে আমাদের ক্যাবিনেট, কর্নেল ওসমানী এবং আমাদের লােকজন বৈদ্যনাথতলার পথে চলে গেলেন। আমি আর মান্নান সাহেব প্রেস ক্লাবে গেলাম। প্রেস ক্লাব থেকে সাংবাদিকদেরকে নিয়ে রওনা দিলাম। প্রায় এক-দেড়শ ট্যাক্সি ভর্তি সাংবাদিক। সবাইকে নিয়ে আমরা চলেছি বৈদ্যনাথতলাতে। আমরা সকাল ১১টার দিকে পৌছলাম। ৩ ঘণ্টা লাগল পথে । আমরা আগে থেকেই আম্রকাননে সবকিছু ঠিক করে রেখেছিলাম। স্টেজ তৈরি করা হয়েছিল। ওখানে আমি দ্রুত ইংরেজিতে লেখা স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রটি বাংলা করে দিয়েছিলাম। সমস্ত পার্লামেন্ট সদস্যদের পক্ষ থেকে চীফ হুইপ হিসেবে ইউসুফ আলি সাহেবকে প্লেনিপােটেনশিয়ারি নিযুক্ত করে স্বাধীনতার ঘােষণা দেয়া হয়, ইউসুফ আলি সাহেব ঘােষণাপত্রের বাংলা অনুবাদটি পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব, তাজউদ্দীন সাহেব তাঁদের লিখিত বক্তৃতা দিলেন এবং এই বক্তৃতার কপি সাংবাদিকদের দেয়া হল। সে দিনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সাংবাদিকরা কাভার করলেন যে, এটা হল আমাদের সরকারের আনুষ্ঠানিক সূচনা বা আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ। তৌফিক এলাহী, মাহবুব মেহেরপুরের আম্রকাননে গার্ড অফ অনার দিলেন। তাজউদ্দীন ভাই এক বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে এই জায়গার নামকরণ করেন ‘মুজিবনগর’ । আর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, যুদ্ধের সময় সরকার শুধু এক জায়গায় উপস্থিত থাকবে না, যেখানে সরকার থাকবে সেটাই মুজিবনগর। তারপর আমরা চলে আসি। হােসেন আলি সাহেব তখন কলকাতায় পাকিস্তান মিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার। হােসেন আলি সাহেবকে খবর দেয়া হয় এবং কোন একটা হােটেলে হােসেন আলি সাহেবের সাথে তাজউদ্দীন সাহেবের একটা সাক্ষাক্তারের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। কারণ হােসেন আলি সাহেবও চাচ্ছিলেন এবং তাজউদ্দীন সাহেবও চাচ্ছিলেন পরস্পরের সাথে আলাপ করতে।
Source: আমীর–উল ইসলাম
তাজউদ্দীন আহমদ-আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খণ্ড) – সিমিন হোসেন রিমি