বাঙলাদেশের মুক্তির তাৎপর্য
মণি সিংহ
বাঙলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণতম নেতা, বাঙলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির বিশিষ্ট সদস্য মণি সিংহ ঢাকা রওনা হয়ে গেছেন। উনি ঢাকা রওনা হওয়ার আগে বাঙলাদেশের মুক্তি অর্জনের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য সম্পর্কে ওঁর মতামত চেয়েছিলাম উনি বললেন, “বাঙলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সাফল্যের প্রভাব পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর পড়বে, বিশেষ করে বেলুচ ও পাঠানদের উপর।”
ওঁর মতে, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে খুব শীঘ্রই গণতান্ত্রিক আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করবে। বেলুচরা বহুদিন থেকেই আত্মনিয়ন্ত্রধািকর চাইছে। আর পাঠানরা পাখতুনিস্তানের দাবিতে সােচ্চার। এই দুই আন্দোলনই বাঙলাদেশের মুক্তিতে ব্যাপক হয়ে দেখা দিতে বাধ্য। পাশাপাশি সিন্ধু প্রদেশের অধিবাসীরাও ভাষা তথা অপরাপর নিজস্ব স্থানীয় দাবির ভিত্তিতে আন্দোলনে নামতে পারে ; আর এই আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা নিতে পারে হারি’রা (সিন্ধুপ্রদেশের কৃষকসম্প্রদায়”। “ভবিষ্যতে হয়তাে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি কেবল পাঞ্জাবেই সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে পারে।”
বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাফল্য শ্রী সিংহের কাছে এক অভূতপুর্ব ঘটনা—বিশেষত ভারতীয় সৈন্য, জনগণ ও সরকারে সক্রিয় কর্মপ্রয়াস ও সহায়তার পটভূমিতে। উনি বললেন, “এ-ধরনের ঘটনার নজীর ইতিহাসে নেই। আমার দৃঢ় আশা, আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় রক্ত দিয়ে ভারত ও বাঙলাদেশের মধ্যে যে মৈত্রীবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে তা চির অটুট থাকবে উভয় দেশের সমস্বার্থেই।” | বাঙলাদেশের মুক্তির নতুন প্রেক্ষাপটে বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পর্টির আশু লক্ষ্য স্বাধীন জাতীয় গণতন্ত্র। শ্রী সিংহ জানালেন, “মুক্তি লাভের ফলে বাংলাদেশে স্বাধীন জতীয় গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা রূপায়ণের সুযােগ উপস্থিত হয়েছে। সেই সুযােগ কাজে লাগেতে হবে।”
বাঙলাদেশ কৃষিনির্ভর জনবহুল দেশ সেখানে পুঁজিবাদী বিকাশ শুরু হলেও একচেটিয়া পুঁজিবাদে তা এখনও রূপায়িত হয়নি। পূর্ণ বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত হতে ব্যগ্র পাতিবুর্জোয়া শ্রেণীরই আথিপত্য সেদেশে। এমন একটি দেশে পুঁজিবাদের বিকাশপত পরিক্রমা করতেই হবে এমন কোন কথা নেই। শ্ৰী সিংহ স্পষ্ট ভাষায় বললেন, “আমরা চাই অ-পুজিবাদী পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ। অনেকটা মঙ্গোলিয়ার মতাে। যদিও ওখানকার আভ্যন্তরিক অবস্থা ছিল ভিন্নতর।”
আর এই পথে অগ্রসর হতে হলে চাই—ঐক্য। সকল সংগ্রামী শক্তি বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যে সকল দল লড়াই করেছেন তাঁদের সকলের ঐক্য। ঐ ঐক্যের উপর জোর দিয়ে শ্রী সিংহ বললেন, “আওয়ামী লীগ তাদের ম্যানিফেস্টোতে পাটশিল্প জাতীয়করণ এবং রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্য রাষ্ট্রায়ত্তকরণের কথা লিখেছিলেন। এই কর্মসূচি দুটো রূপায়ণে ওঁরা এগিয়ে এসেছেন। আর এটাই আওয়ামী লীগের একচেটিয়া পুঁজিবাদবিরােধী মনােভাবের অভিব্যক্তি। আমরা ওঁদের পাশে আছি।”
মণি সিংহের মতে বাঙলাদেশের সামনে এখন মূল শত্রু দুটোঃ বিভেদপন্থী কার্যকলাপ যা জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরাবে এবং অর্থনতিক্ষেত্রে বিভিন্ন পন্থায় সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশ যা বাঙলাদেশের সদ্যঅর্জিত স্বাধীনতার বনিয়াদ ধ্বংস করবে। “আমি বিশেষ করে মার্কিন অনুপ্রবেশের কথা বলব। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নানা কায়দায় অর্থনীতিতে অনুপ্রবেশ করতে হবেই। আমরা সবাইয়ের সঙ্গে মিত্রতা চাই, কিন্তু কোন খবরদারি বা মাতব্বরি বরদাস্ত করব না। মার্কিন চক্রান্ত সম্পর্কে জনগণকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে।”
সােভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে বাঙলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মণি সিংহ জানালেন, “সােভিয়েতের সহায়তা ছাড়া যেমন আমাদের মুক্তি সম্ভব হতাে না, তেমনি আজ সােভিয়েতের নিঃশর্ত সহায়তা ছাড়া যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের পুনগঠন অসম্ভব।” তার ওঁর ঐকান্তিক কামনা, সােভিয়েত ইউনিয়ন সহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ বাঙলাদেশ পুনগঠনে এগিয়ে আসুন।
চীনের ভূমিকা সম্পর্কে উনি ব্যঙ্গভরে বললেন, “চীন নাকি ‘বিপ্লবের ধ্রুবতারা’ হয়ে আকাশে জ্বলও করছে? কই? আজ সংকীর্ণ উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্য সে ভারত-বিরােধী, সােভিয়েত-বিরােধী ভূমিকা নিয়ে বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লব, প্রগতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার সপক্ষে দাঁড়িয়েছে। একদিন হয়তাে তার ভ্রান্তি কেটে যাবে কিন্তু বাঙলাদেশে আর পৃথিবীতে তার সম্মান আর ফিরে পাবে না।”
কথা শেষ করার আগে উনি দেশজ টানে বললেন, “ঐক্য-বুঝলা, ঐক্যই সব কথার শেষ কথা। ঐ ঐক্যই স্বাধীনতা আনছে, জনগণের সর্বস্তরের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মইধ্যাদিয়া আসবে সমাজতন্ত্রও।”
সূত্র: সপ্তাহ, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১