শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
জাতীর উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর ভাষন | বাংলাদেশ সরকার
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় |
৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
চলুন সোনার বাংলা গড়ি
আমার প্রিয় দেশবাসি এবং সহযোদ্ধাগন,
পাকিস্তানী জেনারেলরা উপমহাদেশকে একটি ভয়াবহ যুদ্ধে নিমগ্ন করেছে। গত কয়েক মাস ধরেই এটা পরিষ্কার যে তারা তাদের বোকামি ও পাপের শাস্তিস্বরূপ এরকম একটা সমাপ্তির আশাতেই ছিল।
ভারতের প্রতি আগ্রাসন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল এবং ভারত উষ্ণ হৃদয়েই বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছে।
দুই দেশের শত্রু থেকে সৃষ্ট বিপদ পূর্বের থেকে বাংলাদেশ এবং ভারতের মানুষকে পুর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরো কাছে নিয়ে এসেছে। আমাদের যোদ্ধারা এখন ভারতের যোদ্ধাদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে এবং তাদের রক্ত আমাদের রক্তের সাথে আমাদের মাটিতে মিশে যাচ্ছে। এই ছাপ দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধন এটে দিচ্ছে যা বন্ধুত্বের জন্য নির্ধারিত।
ভারতের জনগন সবসময় আমাদের তাদের হৃদয় দিয়ে স্বীকৃতি দিত এবং এখন তাদের সরকারও আনুষ্ঠানিক ভাবে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা যারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছেন তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রদত্ত শ্রদ্ধা এবং বাংলাদেশের সকল শ্রেনীর মানুষের জন্য,তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জন্য একটি বিজয় এবং মুক্তিবাহিনী যাদের চেষ্টা,আত্মত্যাগ এবং তাদের অজেয় একতাবোধ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই কূটনৈতিক স্বীকৃতি জয় করেছে। এটা ভারতের মানুষের জন্যও একটি বিজয় যাদের ঐকান্তিক চেষ্টা ছিল বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য। প্রকৃতপক্ষে এটিই বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশের জন্যই একটি চমৎকার সময়।
বিশ্বের সবথেকে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতেরই উচিত ছিল সবার আগে স্বাধীন রাষ্ট্রের কাতারে বাংলাদেশকে আমন্ত্রন জানানো। স্বাধীনতা ও মানবিকতার প্রতি তার অঙ্গিকার, ১ কোটি উদ্বাস্তু বাঙ্গালিকে সহায়তা প্রদান এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় যুদ্ধে সাহায্য করা এগুলো সবই আমাদের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ভারতের এমন সাহসী সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই, একই সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারত সরকার, ভারতীয় সংসদের সদস্যবৃন্দ এবং ভারতের সাধারণ জনগণ যাদের সাহায্যে আমাদের রাস্ত্রসত্ত্বা স্থায়ী হয়েছে তাদের সকলকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। শ্রীমতী গান্ধীর দুরদর্শিতা ও দক্ষ রাষ্ট্রপরিচালনার গুণের কাছে বাংলাদেশ চিরঋণী হয়ে থাকল। ভারতের পরে ভুটানও আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এজন্য আমরা তাদের রাজার প্রতিও কৃতজ্ঞ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতিদান একটা বিরাট ব্যাপার। যতদিন পর্যন্ত আমাদের সাথে ভারতের সম্পর্কের বিষয় থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এই সম্পর্কের ভিত্তি হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্ব। যুদ্ধের ভয়াবহ সময়ে আমরা ভারতের সাথে যে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি তা ভাল ফলই বয়ে আনবে এবং আমি নিশ্চিত এটা আমাদের দুই দেশের জন্যই সুসংবাদ বয়ে আনবে।
সত্যিকার অর্থে বাঙ্গালিদের জয়ের আনন্দ আসলে বিষাদে পুর্ণ। বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মুহুর্তে শত্রুর হাতে বন্দি,যখন বাংলাদেশ,তার স্বপ্ন,আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু,জনগনের দূরে অথবা কাছে যেখানেই থাকুক না কেন,সে সবসময় তাদের হৃদয়ে থাকে। সে চেতনার প্রতীক,যা আমাদের জন্য অতীতকে পরিবর্তন করে দিয়েছে এবং এবং ইতিহাসের একটি অংশ যা ভবিষ্যতে এই জাতিকে আরো প্রতিষ্ঠিত করবে। এবং এটা সত্যি যে এখন থেকে তার অনুপস্থিতি আমাদের জন্য বেদনাদায়ক।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে প্রত্যেক প্রগ্রতিশীল দেশ থেকেই স্বাগত জানান উচিত। নতুন রাষ্ট্র প্রতিনিধিত্ব করছে শান্তিপূর্ন সহবস্থান,আন্তর্জাতিক জোট নিরপেক্ষতা এবং সকল ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবিরোধী এবং এটি গণতন্ত্র এবং একটি অসাম্প্রদায়িক এবং সমাজতান্ত্রীক রাষ্ট্র গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি সমস্ত জাতিদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি ভারত এবং ভুটানকে অনুসরন করবার জন্য এবং ৭৫ মিলিয়ন মানুষের বাস্তবতা মেনে নেবার জন্য।
পশ্চিম পাকিস্তান সরকার শত্রুদের কড়াল গ্রাসে পূর্ণ এই ধারনা তারা সামনে নিয়ে আসছে। অন্যায়ের শাস্তি থেকে রক্ষার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তার সমর্থকদের নেয়া পদক্ষেপ প্রায় ব্যার্থ হচ্ছে। এই বিষয়ে বাংলাদেশে সংঘাতের কারনের গভীরে না গিয়েই এই উপমহাদেশে যুদ্ধ বিরতীর জন্য আমেরিকার সমাধানমুলক আহব্বান আমেরিকার অন্ধত্ব এবং নষ্টামির উদাহরণ। সঠিক বিচারে ব্যার্থ হবার জন্য চীনও একই অপরাধী। বাংলাদেশের মানুষ সোভিয়েত ভেটোর জন্য কৃতজ্ঞ।
আমরা বাংলাদেশের মধ্যে ইতিহাসের দেয়া অসম্পূর্ণ কাজ গুলো অবশ্যই শেষ করতে হবে এবং উন্মত্ত সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া একটি ফেসিস্ট রাস্ট্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে হবে। শত্রুর শেষ ঘন্টা বাজার সময় খুব দ্রুত আসছে। সে সকল জায়গা থেকে পশ্চাদপসরন করছে এবং মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর আঘাতের মধ্যে ঘূর্নিপাক খাচ্ছে। সময় এখন বাঙ্গালিদের পক্ষে এবং দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জেগে ওঠার এবং চরম আঘাত করার এটাই সময়।তাদের অবশ্যই মুক্তিকারীদের সম্ভব্য সকল ক্ষেত্রে সহযগিতা করা উচিত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনকে সহযগিতা করা উচিত। এটা বাংলাদেশের কাউকে বলতে দিয়েন না,তার জীবনের অবস্থান যাই হোক না কেন, যখন ডাক এসেছিল তখন সে ব্যার্থ হয়েছিল।
আমি শত্রু সৈনিক এবং রাজাকারদের আহব্বান করছি তাদের অস্ত্র জমা দিতে এবং আত্মসমর্পন করার জন্য। তারা এখনো এই আহবান মেনে নিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। আমি বাংলাদেশের নাগরিকদের আহবান করছি আইনশৃঙ্খলা হাতে তুলে নেবার প্রলোভন এড়িয়ে যাবার জন্য। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আইন অনুযায়ী অপরাধিকে শাস্তি দেয়া রাষ্ট্রের একটি বিশেষ ক্ষমতা। যদি বাংলাদেশের একটি নাগরিকও তার ভাষা কিংবা গোত্রের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ বা আঘাত প্রাপ্ত হয় তাহলে এটি হবে এই জাতির মূল আদর্শ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।
বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় তার বুকে দখলদারী বাহিনীর একে দেয়া ক্ষত বহন করবে,কিন্তু সেখানে একটি স্বস্তি এবং উল্লাসের বিষয় হল আক্রমণকারীরা শেষ হয়ে আসছে,বাংলাদেশ সম্পূর্ন স্বাধীন হতে যাচ্ছে,এবং তার আশ্রয়হীন আহত শিশুরা শীঘ্রই দুঃখ এবং নির্বাসন শেষে ঘরে ফিরবে।
আমরা যেমন যুদ্ধ জিতেছি,তেমনি আমাদের অবশ্যই শান্তি জয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।“সোনার বাংলা”র ভিত্তি একটি নৃশংস যুদ্ধের ধ্বংসাবশের উপরেই স্থাপিত হবে,এবং প্রত্যেক পুত্র এবং কন্যাদের অবশ্যই বিনির্মান এবং উন্নয়নের এই উল্লাসজনক এবং নতজানু কাজে অংশ নেয়া উচিত। এই বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে কেবল মাত্র শেষ হবে যখন গনতান্ত্রিক,সমাজতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক আদর্শ মানুষ পরিপূর্নভাবে উপলব্ধি করতে পারবে।
জয় বাংলা