শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
পাকিস্তান গণপরিষদ বাতিল ঘোষণা | পাকিস্তান অবজারভার | ২৫ শে অক্টোবর, ১৯৫৪ |
জি-জির গণপরিষদ বিলুপ্তিকরণঃ জরুরি অবস্থা ঘোষণাঃ ৮ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভার প্রধান আলীঃ প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং কমান্ডার ইন চিপ- আয়ুব খান।
করাচীঃ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল আজ পাকিস্তানের সর্বত্র জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন
গণ পরিষদ বাতিল করা হয়েছে।
ঘোষণা পত্রে বলা হয়েছে যে, চুড়ান্ত কর্তৃত্ব তাদের উপর ন্যাস্ত করা হবে যারা পুনঃনির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সাংবিধানিক বিষয়সহ সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত দেশের প্রশাসন একটি পুনর্গঠিত মন্ত্রীসভা কর্তৃক পরিচালিত হবে।
প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রী সভা পুনর্গঠনের জন্যে ডাকা হয়েছে। আহবানটি গৃহীত হয়েছে।
মন্ত্রী সভা সচিবালয় কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “নিম্ন লিখিত ঘোষণা গভর্নর জেনারেল কর্তৃক জারিকৃত এবং আজ একটি গেজেট, এক্সট্রা অরডিনারিতে প্রকাশিত হয়েছেঃ
গভর্নর জেনারেল দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট দেশ এখন যার মুখমুখি, গভীর পরিতাপের সাথে বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন যে দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়েছে। ফলে তিনি পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গনপরিষদ বর্তমান নির্বাচনকর্তা হিসেবে জনগনের আস্থা হারিয়ছে এবং তারা আর কাজ করতে পারেনা।
চুড়ান্ত কর্তৃত্ব তাদের উপর ন্যাস্ত করা হবে যারা পুনঃনির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সাংবিধানিক বিষয়সহ সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্টিত হবে।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত দেশের প্রশাসন একটি সাংবিধানিক মন্ত্রীপরিষদ কর্তৃক পরিচালিত হবে। তিনি এ উদ্দেশ্যে দেশে একটি সবল এবং স্থিতিশীল প্রশাসন গঠনে মন্ত্রীপরিষদ পুনর্গঠনের জন্যে প্রধানমন্ত্রীকে আহবান জানিয়েছেন। আহবান গৃহীত হয়েছে।
দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত, বিভাগীয় ও প্রাদেশিক সকল স্বার্থ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থাধীন।”
নতুন মন্ত্রীপরিষদ
করাচীঃ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনাব মোহাম্মদ আলী সহ ৮ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীসভা আজ সন্ধায় গভর্নর জেনারেলের কার্যালয়ে শপথ করেন।
<001.082.408>
দপ্তর প্রাপ্ত নতুন মন্ত্রীরা হলেনঃ
জেনারেল আয়ুব খান – প্রতিরক্ষা
জনাব গিয়াসুদ্দিন পাঠান – খাদ্য ও কৃষি এবং সংসদীয় বিষয়ক
মীর গোলাম আলী খান তালপুর – তথ্য, প্রচার ও শিক্ষা
জনাব এম.এ.এইচ ইস্পাহানি – শিল্প ও বাণিজ্য
মেজর-জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা – আভ্যন্তরীণ রাজ্য ও সীমান্ত অঞ্চল
চৌধুরী মোহাম্মদ আলী – অর্থ, কাশ্মীর বিষয়ক ও শরনার্থী ও পুনর্বাসন
জনাব মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী – পররাষ্ট্র ও যোগাযাগ।
ড. এ.এম. মালিক- স্বাস্থ্য ও কর্ম।
দুইজন প্রতিমন্ত্রী
জনাব মুর্তজা রেজা চৌধুরী এবং সরদার আমীর আজম খান প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যথা ক্রমে অর্থ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পালন করবেন – এপিপি
জেনারেল আয়ুব খানও পাকিস্তান আর্মির কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
আলীর সম্প্রচার/বার্তা
করাচীঃ প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী তার ৮ সদস্যের মন্ত্রীর শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানের কিছুক্ষন পর রেডিও পাকিস্তানে জাতির উদ্দেশ্য বলেন, পাকিস্তানের জনগনকে “যত দ্রুত সম্ভব” একটি গ্রহন যোগ্য মন্ত্রীপরিষদ গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। জনাব আলী বলেন গনপরিষদের কিছু কার্যকলাপ বেশির ভাগ জনগণ দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং তাদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়। প্রকৃত পক্ষে এই কার্যকলাপ বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেছিলেন সংবিধান গঠন দেশের নিরাপত্তা চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
প্রধান মন্ত্রীর সম্প্রচারের পূনার্ঙ্গ অংশঃ
প্রিয় দেশবাসী আপনারা বেশির ভাগেরই নিশ্চয়ই শুনেছেন যে গভর্নর জেনারেল আজ সমগ্র পাকিস্তানে জরুরী অবস্থার ঘোষণা করেছেন। তিনি মনে করেন যে, যেহেতু বর্তমান গনপরিষদ জনগনের আস্থা হারিয়েছে তাই তারা আর কাজ করতে পারে না। চুড়ান্ত কর্তৃত্ব অবশ্যই তাদের উপর ন্যাস্ত করা হবে যারা পুনঃনির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সাংবিধানিক বিষয় সহ সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। এরই প্রেক্ষিতে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত দেশের প্রশাসন যথা নিয়মে পরিচালিত হবে। সেজন্য গভর্নর জেনারেল আমাকে দেশে একটি কঠোর এবং স্থিতিশীল প্রশাসন গঠনের জন্য মন্ত্রীপরিষদ সংস্কারের আহবান জানান। এই আহবান আমি গ্রহন করি। এই সংকটাপন্ন সময়ের এটা দেশের ও আমার প্রিয় দেশবাসী, আপনাদের প্রতি আমার দায়িত্ব। আমি সে অনুযায়ী মন্ত্রীপরিষদ পুনর্গঠিত করেছি যা প্রায় ১৫ মিনিট আগে শপথ গ্রহন করেছে।
<001.082.409>
গণপরিষদের এমন পদক্ষেপ সমগ্র দেশে ধিক্কারের ঝড় তোলে। এর স্বীদ্ধান্ত সর্বজন স্বীকৃত সেই আদেশকে স্থগিত করে যা একটি কার্যকরী ও স্থীতিশীল সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ন। এর ফলে সম্প্রতি আপনাদের বেশিরভাগ তাদের পক্ষে কথা বলার ব্যাপারে এর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ।এটা দেশের জনগণের মনে আস্থা স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
উদ্বেগের সুচনা
বস্তুত সম্প্রতি এর কিছু সিদ্ধান্ত প্রায় বিপরীত প্রভাব ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে, এইটা স্পষ্ট হচ্ছে যে এটা আর কার্যকরভাবে এর কাজ চালানোর অবস্থায় নেই।এই পীড়াদায়ক অবস্থার ক্রমবিকাশের কিছু ইঙ্গিত আমি আমেরিকা উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পর পরই আমার কাছে আসতে থাকে। তখন থেকেই আমি উদ্বেগের সাথে গণপরিষদের মর্যাদা ও কর্তৃত্বের দ্রুত পতনের সাথে সাথে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার ক্রমবর্ধমান অবনতি লক্ষ্য করছি। আমি ফেরার পর লক্ষ্য করলাম যে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যাতে গভর্নর জেনারেল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পাকিস্তানের বৃহত্তর স্বার্থে তা তাকে নিতেই হতো। দেশের ভাগ্য এমন একটি পরিষদের খেয়াল খুশির ওপর আর ছেড়ে দেওয়া যায় না যা পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার বদলে ক্রমেই অভ্যন্তরীন টানাপোড়ন ও ভাঙ্গনের কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।সংবিধান তৈরী জরুরী কিন্তু এখন দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা আরো বেশি গুরুত্বপুর্ন। এটি অবশ্যই সবসময় সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিত করতে হবে।বর্তমান পরিষদের তৈরি সংবিধান এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যা আমাদের জাতীয় ঐক্যকে হুমকির সম্মুক্ষীন করছে।এটা ছিল ব্যক্তিগত, বিভাগীয় এবং প্রাদেশিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সন্দেহজনক পক্ষের প্ররোচিত।
এগুলো দমন করতেই হবে এবং অবশ্যই সবকিছুর উপরে পাকিস্তানের স্বার্থকে রাখতে হবে। এটাই হল গভর্নর জেনারেলের কাজের উদ্দেশ্য। এটাই হবে আপনাদের সেবায় নিয়োজিত আমি এবং আমার নতুন মন্ত্রীপরিষদের মূল লক্ষ্য। এই ব্যাপারে আমি আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতার বিষয়ে নিশ্চিত। এই পরিস্থিতিতে একটাই পথ খোলা আছে, সেটা হলো আপনাদের কাছে আবারো আবেদন করা যারা পাকিস্তানের প্রকৃত অভিভাবক। এই উদ্দেশ্যে যতদ্রুত সম্ভব আপনাদেরকে আপনাদের নতুন প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হবে। আমি বিশ্বাস করি তাদের কাছে সংবিধান গঠনের জন্য আপনাদের দেওয়া একটি নতুন আদেশপত্র থাকবে, যা আমাদের জনগণকে একটি একক, ঐক্যবদ্ধ, প্রগতিশীল ও শক্তিশালী জাতিতে পরিনত করার প্রক্রিয়াকে উল্টো দিকে নয় বরং সামনের দিকে এগিয়ে নেবে।
<001.083.410>
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবী দিবসে ফজলুল যুক্তফ্রন্ট ১০ই এপ্রিল, ১৯৫৫ হকের ভাষণ ১০ই এপ্রিল রবিবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে পল্টন ময়দানের জনসভায় সভাপতি শেরে বাংলা জনাব এ, কে, ফজলুল হকের ভাষণ আজ দেশ ও জাতির অতি সঙ্কটপূর্ণ মুহুৰ্ত্তে আমি আপনাদিগকে এই “গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দিবস’ প্রতিপালনে আহবান জানাইয়াছি। ইংরাজ শাসনের ১৮২০ সাল হইতে আরান্ত করিয়া ১৯৪৬ সাল পযন্ত সোয়া শত বৎসর ধরিয়া পাক-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সৈনিকগণ বিভিন্ন আন্দোলনের ভিতর দিয়া যে জীবনাহুতি প্রদান করিয়া আসিয়াছেন তাহারই ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালে আমরা আজাদ পাকিস্তান লাভ করিয়াছি। এই আজাদীর সংগ্রামে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক জানমাল কোরবান করিয়া যে ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার স্মরণ করিলে কারাবরণ করিয়া এবং যাবতীয় বিষয়-সম্পত্তি বিসর্জন দিয়া আমার লক্ষ লক্ষ দেশবাসী যে আজাদী হাসিল করিয়াছে সেই আজাদীর ফল কি আমরা ভোগ করার সুযোগ পাইয়াছি? কিরূপ আজাদীর জন্য সংগ্রাম করিয়া ঐ সব মনীষীগণ নিজদিগকে কোরবানী কারিয়াছিলেন এবং সেই আজাদী কাহাকে বলে? যাহাতে প্রত্যেকটি মানুষ তাহার জন্মগত গণতান্ত্রিক অধিকার লাভ করিতে পারে এবং সেই অধিকারের বলে দেশবাসীর জন্য জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনাধিকার প্রাপ্ত হইতে পারে উহারই নাম প্রকৃত আজাদী। আপনারা সকলে সেই আজাদীর জন্যই সংগ্রাম করিয়াছেন, আমরাই সেই আজাদীই চাহিয়াছি। কিন্তু আফসোস আজ পর্যন্ত আমরা সেই আজাদীর স্বাদ গ্রহণ করতে সমর্থ হই নাই। আমাদের আজাদী প্রাপ্তির পর প্রায় ৮ বৎসর উত্তীর্ণ হইয়া চলিল-ইংরাজ জাতির সৃষ্ট ভারত শাসন আইন দ্বারাই আজও আমাদিগকে শাসন করা হইতেছে, আমাদের আজাদ পাকিস্তানের উপযোগী শাসনতন্ত্র আজও আমরা পাই নাই। বিগত ৭ বৎসরের শাসন পাকিস্তানকে প্রায় দেউলিয়া করিয়া ফেলিয়াছে। অতীতের কথা বেশী ঘাটিয়া লাভ নাই-আমি বর্তমান সম্পর্কে এখন আপনাদিগকে কিছু বলিতে চাই। গত বৎসর এই এপ্রিল মাসের ৩রা তারিখে আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কায়েম হয় এবং উহার ৫৭ দিন পরই উক্ত মন্ত্রিসভা বাতিল করতঃ গভর্ণর পরিচালিত আমলাতান্ত্রিক শাসন চালু করা হয়। সভাকে অকেজো করিয়া রাখা হয়। বহু যুক্তফ্রন্ট এম,এল,এ-সহ শত শত কর্মীকে নিরাপত্তা আইন বলে আল্লাহ তাহাদের দুঃখ মোচন করাইবেন। কিন্তু আমরা কোন কাজ করার সুযোগ ও সময়ই পাইলাম না। কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনের ফলে পাঞ্জাবে হাজার হাজার লোক মারা যাওয়ার পর দওলতানা মন্ত্রিসভা ডিসমিস করা হইয়াছিল সত্য কিন্তু ৯২(ক) ধারা জারী করিয়া আইন পরিষদকে অকেজো করিয়া রাখা হয় নাই। কিন্তু আমাদের এই পূর্ব বাংলার বেলায় ঐরূপ অভূতপূর্ব কাৰ্য্য দ্বারা পাকিস্তানের অত্রাঞ্চলের জনগণের মনে ভীষন আঘাত করা হইয়াছে।
<001.083.411>
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ডিসমিস করিবার পর হইতে আজ পর্যন্ত দশ মাসের বেশী সময় চলিয়া গিয়াছে আমরা এবং আমাদের দেশবাসী তদবধি শামিত্ম পূর্ণমাত্রায় বিরাজ রাখিয়া চলিয়াছি উচ্চপদস্থ সরকারী লোকেরাও এ কথা বহুবার স্বীকার করিয়াছেন। কোথাও কোন গোলমাল বা কোন জরুরী অবস্থা আদৌ দেখা দেয় নাই, তথাপি ৯২(ক) ধারা শাসনের অবসান হইতেছে না, জনগণের শাসন জনপ্রতিনিধিদের হাতে ফিরাইয়া দেওয়া হইতেছে না। কিছুদিন যাবৎ যুক্তফ্রন্ট দলের ভিতর বিভেদের অজুহাত দেখাইয়া গণ-শাসনকে দাবাইয়া রাখার প্রচেষ্টা চলিয়াছে। অল্পবিস্তর মতান্তর সব দেশে সব পার্টিতেই থাকে কিন্তু উক্তরূপ মতান্তরের অজুহাতে কোন স্বাধীন দেশে কোনকালে পার্লামেন্টারী শাসন আটকাইয়া রাখার রীতি নাই। ইউরোপীয় বহু দেশে কোন দলের যথোযুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবেই মন্ত্রিসভা পুনঃ পুনঃ ভাঙ্গাগড়া হইয়া থাকে কিন্তু তথাপি ঐ অজুহাতে পার্লামেন্টারী শাসন হইতে দেশবাসীকে বহির্গত করা হয় না। কোন কোন মহল হইতে সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হইতেছে না। এইরূপ অহেতুক উক্তির তাৎপর্য আমি বুঝিতে অক্ষম। কেন্দ্রীয় সরকার বা তাহার নিয়োজিত প্রাদেশিক গভর্ণর যাহাকে আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের আস্থাভাজন বলিয়া মনে করিবেন তাহাকেই আইনানুসারে মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য আবেদন করিতে পারেন সুতরাং কোন ব্যক্তি গ্রহণযোগ্য বা কোন ব্যক্তি গ্রহণযোগ্য নয় ইহা যাচাই করার গভর্ণরের নিকট একমাত্র মাপকাঠি হইতেছে পরিষদ সভ্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। নিবৰ্বাচনের প্রাক্কালে আমি পূর্ব বাংলার সবর্বত্র ঘুরিয়া ঘোষণা করিয়াছিলাম। যে যুক্তফ্রন্ট দলের সভ্যদের ভোট দেওয়া হইলে সেই ভোট আমাকেই দেওয়া হইবে। দেশবাসী আমার সেই আহবানে আশাতীত সাড়া দিয়াছিলেন, সুতরাং আমার দেশবাসী আমাকে ত্যাগ না করা পর্যন্ত আমি তাহাদিগকে ন্যায়তঃ ও ধর্মতঃ ত্যাগ করিতে পারি না। কিন্তু তাই বলিয়া আমার জন্য পার্লামেন্টারী শাসন আটকিয়া থাকার কোনই কারণ নাই। প্রাদেশিক গভর্ণর যদি মনে করেন আমাকে ছাড়া অন্য কেহকে দিয়া জনগণের ও পরিষদের গরিষ্ঠসংখ্যক সভ্যদের আস্থাভাজন কোন মন্ত্রিসভা গঠন করা সম্ভব তিনি বিলক্ষণ তাহা করিতে পারেন। আমি আজ এই প্রকাশ্য সভায় ঘোষণা করিতেছি যে আমি চাই জনগণের আস্থাভাজন পার্লামেন্টারী শাসন কোন ব্যক্তির জন্য তাহ রহিত হইয়া থাকিতে পারে না কারণ ব্যক্তি চেয়ে দেশ ও জাতি অনেক বড়। যে যুক্তফ্রন্ট দল শতকরা সাতান্নববইটি ভোট পাইয়া জয়ী হইয়াছে সেই দলকে তথা সাড়ে চারি কোটি পূর্বপাকিস্তান বাসীকে তাহদের জন্মগত গণতান্ত্রিক শাসনাধীকার হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখার কোন অধিকার কোন সরকারের বা কেহরই নাই। এতক্ষনে শুধু পার্লামেন্টারী শাসনের কথা আমি বলিয়াছি এখন উহা হইতেও গুরুতর একটি বিষয়ের কথা আপনাদিগকে বলিব। আপনার জানেন গত বৎসর ২৪শে অক্টোবর তারিখে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল একটি ঘোষণা দ্বারা গণপরিষদ বাতিল করিয়া দিয়া উক্ত ঘোষণায় বলিয়াছিলেন যে জনগণই সকল ক্ষমতার অধিকারী এবং জনগণের ইচ্ছানুসারেই সব কিছু করা হইবে। সারা দেশের লোক গভর্ণর জেনারেলের উপরোক্ত ঘোষণা শুনিয়া বড়ই আশাম্বিত হইয়াছিল। গত ১০ই মাচ্চ তারিখে পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টে জনাব তমিজদিন সরকারের নির্দেশানুসারে নিবেদন করিয়াছিলেন যে গভর্ণর জেনারেল বৰ্ত্তমান প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলির মাধ্যমে নিবৰ্বাচনের সাহায্যে একটি নূতন গণপরিষদ গঠন করিতে ইচ্ছুক রহিয়াছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কতগুলি ঘটনাপ্রবাহের ফলে জনগণ উদ্বিগ্ন ও আশঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু উদ্বেগ ও আশঙ্কার কারণ এই যে ইদানীং সরকার সভ্য মনোনয়ন দ্বারা একটি শাসনতন্ত্র রচনাকারী কমিটি গঠন করিতে চান বলিয়া বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশ পাইয়াছে, আবার এমন কথাও শুনা যাইতেছে যে অর্ডিন্যাসের সাহায্যেও সরাসরি একটি শাসনতন্ত্র জারী করা সম্ভব। এইভাবে জনগণের সম্মতি ব্যতিরেকে যদি কোন শাসনতন্ত্র রচনাকরী কমিটি গঠন করতঃ উহার সাহায্যে বা সরাসরি কোন অর্ডিন্যান্স জারী করিয়া কোন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয় তাহা হইলে উহা দ্বারা স্বাধীনতার মূলনীতিকেই অস্বীকার করা হইবে এবং উহা কিছুতেই জনগণের গ্রহণযোগ্য হইবে না। উপরোক্ত দুইটি বিষয়ে বিশেষ উৎকণ্ঠিত হইয়া মানুষের জন্মগত নাগরিক গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে আমি আদ্যকার দিবসটি ঘোষণা করতঃ আমার দেশবাসীকে যথাযথভাবে ইহা প্রতিপালন করিবার অনুরোধ জানাইয়াছি। গভর্ণর জেনারেলের ২৪শে অক্টোবর ঘোষণার ভাষায় চূড়ান্ত ক্ষমতায় অধিকারী আপনারা
<001.083.412>
জনগণই তাই আপনাদের সমবেত অভিমত জ্ঞাপন উদ্দেশ্যে এই সভার আয়োজন করা হইয়াছে। আপনারা দলমত নিবির্বশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে সাড়ে সপ্তকোটি কণ্ঠে আওয়াজ তুলুন গণতন্ত্র বিরোধী কোন কাৰ্যকলাপ আমরা এই আজাদ পাকিস্তানে বরদাস্ত করিব না। দেখিবেন আপনাদের সমবেত আওয়াজের ফলে গণতন্ত্র বিরোধী সকল চক্রান্ত ধূলিসাৎ হইয়া যাইবে মনে রাখবেন গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধী, বেলুচি, বাঙ্গালী সকলেরই সমান। যুক্তফ্রন্টের অন্যতম নেতা মওলানা ভাসানী আজ দেশের বাহিরে। তাঁহার স্বদেশে প্রত্যাবৰ্ত্তন সম্পর্কে সরকারী কোন বাধানিষেধ আছে কিনা তাহা আমার জানা নাই। পাকিস্তানের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে স্বদেশে প্রত্যাবৰ্ত্তনের সম্পূর্ণ অধিকার মওলানা ভাসানীর রহিয়াছে। প্রকৃতই যদি তাহার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকিয়া থাকে তবে তাঁহার বিচার হইতে পারে কিন্তু তাই বলিয়া তাঁহার স্বদেশে প্রত্যাবৰ্ত্তন সম্পকে কোন বাঁধানিষেধ থাকিতে পারে না। ঐরূপ বাঁধা-নিষেধ গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আমি বহুবার রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য সরকারের নিকট আবেদন জানাইয়াছি। আজ পর্যন্ত বহু রাজবন্ধীকে জেলে পচান হইতেছে। ইহার প্রতিবাদ আমি এবং অন্যান্য বহু ব্যক্তি পুনঃ পুনঃ জানাইয়াছি। সরকার আমাদের কথায় কানই দিতেছে না। উপসংহারে আমি কাৰ্যকলাপের বিরুদ্ধে মাথা উচু করিয়া দাঁড়াইতে আহবান জানাইতেছি। আপনারা আজ ওয়াদা করুন এবং সমস্বরে আওয়াজ তুলুন পাকিস্তানের গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হইব না। আমীন! পাকিস্তান জিন্দাবাদ! যুক্তফ্রন্ট জিন্দাবাদ!! গণতন্ত্র জিন্দাবাদ!!!
<001.084.413>
শিরোনাম সূত্র তারিখ ভাসানীকে দেশে প্রবেশ করতে দেবীর ঢাকা রাজনৈতিক কর্মবৃন্দ এপ্রিল, ১৯৫৫ দাবী দীর্ঘদিন পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী ঢাকায় আগমন কররিতেছেন। রোগমুক্তি এবং কেন্দ্রীয় সরকার যোগদানের পর শহীদ সাহেবের এই আগমনী সংবাদ নিঃসন্দেহে আনন্দদায়ক হইতে যদি না এই তথাকথিত কনভেনশনে পূবর্ববঙ্গ হইতে প্রতিনিধি মনোনয়নের জন্য তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পুলিশ মন্ত্রী মিঃ এস্কান্দার মির্জাসহ ঢাকায় আগমন করিতেন। তিনি যে তথাকথিত কনভেনশনের সদস্য মনোনয়নের জন্য পূবর্ববঙ্গে আগমন করিতেছেন তাহাকে ইতিমধ্যেই বেআইনী ও গণতন্ত্র বিরোধী বলিয়া বিভিন্ন দায়িত্বশীল মহল হইতে অভিমত প্রকাশ করা হইয়াছে। বিশেষভাবে এই কনভেনশনে গণতন্ত্র বিরোধী সংখ্যাসাম্যের ব্যবস্থা করিয়া পূবর্ববঙ্গের ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে পদদলিত করা হইয়াছে। এবং ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আইনে জনসংখ্যার অনুপাতে গণপরিষদের আসন বন্টনের যে মূলনীতি ঘোষণা করা হইয়াছিল, সংখ্যাসাম্যের ব্যবস্থা করিয়া সেই নীতিকেই হত্যা করা হইয়াছে। আর আট কোটি অধিবাসী অধুষিত একটি দেশের শাসনতন্ত্র রচনার মত একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিবৰ্বাচিত গণপরিষদ ছাড়া অন্য কোন কনভেনশন, কনফারেন্স দ্বারা সম্পন্ন হইতে পারে না। তাহা ছাড়া পূবর্ব-বঙ্গের সাড়ে চার কোটি নির্যাতিত মানুষ আকুল আগ্রহে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষা করিতেছি। জনাব শহীদ সোহরাওয়াদী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় হামিদ খান ভাসানীর দেশে প্রত্যাবৰ্ত্তনের প্রতীক্ষা করিতেছে। জনাব শহীদ সোহরাওয়াদী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগদানের পূবেৰ্ব এবং পরে বারবার ঘোষণা করিয়াছেন যে, মওলানা সাহেবকে সঙ্গে লইয়া তিনি পূবর্ববঙ্গে আগমন করিবেন কিন্তু কার্যত আমরা দেখিতে পাইতেছি যে, যে ব্যক্তি মাওলানা সাহেবকে কমু্যনিষ্ট, দেশদ্রোহী এবং দেশের সমগ্র মানুষের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে নানারূপ জঘন্য উক্তি করিয়াছেন, সেই ব্যক্তিকে সঙ্গে লইয়াই শহীদ সাহেব পূবর্ববঙ্গে আগমন করিতেছেন। আমরা তাঁহারা এই যুগল আগমনের তীব্র প্রতিবাদ করিতেছি। দীর্ঘ পাঁচ মাস জনাব শহীদ সাহেব কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগদান করিয়াছেন। মওলানা ভাসানীর যেখানে আজ পর্যন্ত প্রত্যাবৰ্ত্তনের কোন ব্যবস্থা তিনি করিতে পারেন নাই সেখানে তাহার (শহীদ সাহেবের) কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগদান করাই উচিত হয় নাই বলিয়া জনসাধারণ মনে করে। গণতন্ত্রকামী দেশবাসীর ন্যায্য অধিকারকে তিনি কার্যকরী করিবেন ইহাই দেশবাসী তাঁহার নিকট চায়। কোনরূপ আপোস আলোচনা অথবা শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নের জন্য আহুত সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর অনুপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার কাহারও নাই। এই অবস্থায় আমরা মাননীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিদিগকে সুস্পষ্টভাবে জানাইয়া দিতেছি যে মওলানা ভাসানীকে জাতির মাহসঙ্কটক্ষণে দূরে সরাইয়া রাখিয়া যদি কোনরূপ অবৈধ কাৰ্যকলাপ দেশবাসীর উপর চাপাইয়া দেওয়া হয় তবে দেশবাসী তাহা কখনও বরদাস্ত করিবে না। দেশবাসী গণতন্ত্র ও আইনের শাসন চায়। ডিক্টেটরী ও জবরদস্তির নিকট আট কোটি অধিবাসী কখনও পরাজয় স্বীকার করিবে না, করিতে পারে না। ইহাই ইতিহাসের শিক্ষা। গণতন্ত্র জিন্দাবাদ। ঢাকার রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দ ২১ দফা কায়েম কর। রাজবন্দীদের মুক্তি চাই। ভাসানীর প্রত্যাবৰ্ত্তন চাই।
১৯৫৪ সালের মে মাসে মওলানা ভাষানী ষ্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করেন। ৯২-ক ধারা প্রবর্তনের পর ভাসানীর পক্ষে দেশে ফেরা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, কারণ ইস্কান্দার মীর্জা: হুমকি দেন যে মওলানা ভাসানী দেশে ফিরলে তাঁকে গুলি করা হবে।
<001.085.414>
শিরোনাম সূত্র তারিখ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক প্রচারপত্র মাওলানা ভাসানী মে, ১৯৫৫ দেশের ডাক! মুক্তি ডাক!! পূর্ব-বঙ্গ আওয়ামী লীগ কর্মী সম্মেলন কৃষক-মজদুর, ছাত্র-যুবক, শিল্পী ও ব্যবসায়ী দলে দলে যোগদান করিয়া সুষ্ঠু কৰ্ম্মসূচী গ্রহণ করুন। তাং- ২৬শে নভেম্বর, ১০ই আগ্রহায়ণ, শনিবার, কর্মী সম্মেলন ২৭শে নভেম্বর, ১১ অগ্রহায়ন, রবিবার, বিরাট জনসভা স্থানঃ কাগমারী (টাঙ্গাইল) আগামী ১ মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সভা আহবান করিতে হইবে। বর্তমান সরকার ২১ দফা পালন করিতে ধৰ্ম্মত ও আইনতঃ বাধ্য। বিশ্বাসঘাতকতা করিলে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়িয়া গণ আন্দোলনের ঝড় বহিয়া যাইবে। ১। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধু সামরিক বিভাগ (নৌ বিভাগের সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে থাকিবে), মুদ্রা প্রস্তুত, বৈদেশিক নীতি (বৈদেশিক বাণিজ্য পূবর্ব পাকিস্তানে থাকিবে); এই ক্ষমতা তিনটি ছাড়া সমস্ত ক্ষমতা এবং যুক্ত নির্বাচন আদায়ের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট সোপারেশ করিয়া প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ হইতে পূর্ব বঙ্গের আইন পরিষদের আসন্ন বৈঠকে প্রস্তাব পাশ করিতে হইবে। ২। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিতে হইবে। ৩। নুরুল আমিন সরকার ৬০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিবার ব্যবস্থা করিয়া জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ নামে যে প্রজা উচেছদ আইন করিয়া রাখিয়াছে, সেই আইন বাতিল করিয়া সত্বর আইন সভা আহবান করিয়া বিনা ক্ষতিপুরনে ২১ দফা ওয়াদা অনুযায়ী জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের আইন পাশ করিতে হইবে। খাজনার হার কম, সার্টিফিকেট প্রথা রহিত, বকেয়া খাজনার সুদ ও নদী সিকস্তি জমির নজরানা মওকুব করিতে হইবে। ৪। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়াটাে চুক্তি, পাক-বাগদান চুক্তি প্রভৃতি জাতীয় সংহতির পরিপন্থী সাম্রাজ্যবাদী চুক্তি বাতিল করিতে হইবে। গত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত অধিকাংশ পরিষদ সদস্য ওয়াদাবদ্ধ হইয়া সামরিক চুক্তি বাতিলের জন্য যে মর্মে দস্তখত দিয়াছিলেন সেই মর্মে আইন পরিষদে প্রস্তাব পাশ করিতে হইবে। ৫। স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজের ছাত্রদের বর্তমান বেতনের হার এবং হোষ্টেল খরচ অবিলম্বে হ্রাস করিতে হইবে। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সরকারী নিয়ন্ত্রণাধীন করিতে হইবে। ৬। লিকুইডেটেড ও গ্রাম্য সমবায় সমিতিসমূহের খাতক নিৰ্দ্ধারত কিস্তিবন্দী মোতাবেক কিস্তির টাকা আদায় করিতে হইবে। ঋণসালিসী বোর্ড কর্তৃক মাফ দেওয়া সুদ (কনট্রবিউশন) আদায় ও সার্টিফিকেট বন্ধ করিতে হইবে। যাহাদের কিস্তিবন্দী করা হয় নাই তাহাদের জন্য কিস্তি নিৰ্দ্ধারণ করিতেই হইবে। ৭ (ক) পাটের মূল্য নূনপক্ষে প্রতিমণ ৩০ টাকা বাঁধিয়া দিতে হইবে। শুধু কয়েকজন ব্যবসায়ীকে পাট বিক্রয়ের লাইসেন্স না দিয়া বহুসংখ্যক ব্যবসায়ী যাহাতে লাইসেন্স পায় তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
<001.085.415>
(খ) পাট জন্মানোর লাইসেন্স ফি ও তামাকের ট্যাক্স রহিত করিতে হইবে। (গ) সর্বত্র পাকি (৮০ তোলা) ওজনের প্রবৰ্ত্তন করিতে হইবে। ৮। (ক) বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদানের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে গড়িমসি করা চলিবে না- সত্বর নির্মাণ করিতে হইবে। (খ) ২১শে ফেব্রুয়ারীকে কাল বিলম্ব না করিয়া সরকারী ছুটি ঘোষণা করিতে হইবে। (গ) বৰ্দ্ধমান হাউসকে অবিলম্বে বাংলা ভাষার গবেষণাগার করিতে হইবে। ৯। (ক) ভিসা প্রথা রহিত করিতে হইবে। (খ) সবর্কহারা মোহাজেরদের পুনবর্বাসনের ব্যবস্থা করিতে হইবে। ১০। ৯২(ক) ধারার আবরণে ৯৩ ধারা কার্যকরী করা চলিবে না। বাংলার যে সমস্ত গণপরিষদ সদস্য ৯৩ ধারা, বেঙ্গল রেগুরেশন এ্যাক্ট ও ফ্রন্টিয়ার ক্রাইমস আইন পাস করিতে ভোট দিয়াছেন তাহারা সমাজের ও গণতন্ত্রের শক্রইহা সবর্বত্র প্রচার করা হইবে। ১১। (ক) পাকিস্তান হইবার পর রাস্তাঘাটের অবস্থা অতীব শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছে, ইহার আশু সংস্কার চাই। (খ) নদী, খাল,বিল ইত্যাদি সংস্কার করিয়া প্রবল বন্যাকে প্রতিরোধ ও সেচের ব্যবস্থা করিতে হইবে। (গ) মুসলমানের ওয়াকফ সম্পত্তি ও হিন্দুদের দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর প্রভৃতি সম্পত্তির আয় জনহিতকর কাজে মোটেই ব্যয় হইতেছে না; ইহার প্রতিকার চাই! ১২। মাথাভারি শাসন অর্থাৎ গভর্ণর জেনারেল, গভর্ণর, মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত, কমিশনার ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বেতন কম ও পদ লোপ করিয়া নুি বেতনভোগী কর্মচারী ও পুলিশের বেতন বৃদ্ধি করিতে হইবে। ১৩। শিক্ষিত বেকার, ভূমিহীন কৃষক-মজুরদের জন্য কাজের ব্যবস্থা চাই। রেল, সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও শ্রমিকদের ছাঁটাই ও রিভার্সন বন্ধ করিতে হইবে। ১৪। বাধ্যতামূলক প্রাইমারী শিক্ষার আইন সতুর কার্যকরী করিতে ও শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতনের ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাদ্রসা ও কলেজ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করিতে হইবে। ১৫। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম অগ্নিমূল্য হওয়ায় চাষী-মজুরদের ক্রয়ক্ষমতা একেবারেই নাই। অতএব লবণ, কেরোসিন তেল, নালী, নারিকেল তেল, হলুদ, মসলা ও লাঙ্গলের ফাল, কোদাল, কাঁচি, পাচন ইত্যাদি তৈয়ার করিবার জন্য লোহা, জমির সার, কাপড়, তাঁতের সুতা, কৰ্ম্মকারের কাঁসা, পিতল, করাতির করাত, সুতারের হাতুড়ি, বাটাল, রাদা ইত্যাদি যন্ত্রের এবং মাঝিদের জালের সুতা ও ছাত্রদের পুস্তক, কাগজ ও কালির মূল্য কমানোর সত্বর ব্যবস্থা চাই। ১৬ (ক) আখচাষীর আখ খরিদের সুব্যবস্থা ও উপযুক্ত মূল্য চাই। (খ) তাঁতীদের জন্য বিশেষ সূক্ষ্ম সুতা ও মোটা সুতা আশু সরবরাহের ব্যবস্থা করিয়া তাঁতী সমাজকে ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করিতে হইবে। ১৭ মগ, গাঁজা, ভাং, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি হারাম কাজ আইন করিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করিতে হইবে।
<001.085.416>
১৮। মুসলমানগণ যাহাতে নামাজ, রোজা, হজু, জাকাত ইত্যাদি শরিয়ত সংগত কাজে অবহেলা না করেন এবং সকল শ্রেণীর নাগরিকদের চরিত্র গঠনের জন্য সরকারী প্রচার (তবলীগ) বিভাগ খুলিতে হইবে। হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও অনুরূপ ব্যবস্থা করিতে হইবে। ১৯। ঘুষ ও স্বজনপ্রীতিতে দেশবাসী অতিষ্ঠ, সত্বর ইহার স্থায়ী প্রতিকার চাই। শুধু চুনোপুটিকে শাস্তি দিলে চলিবে না, বড় বড় রুই-কাতলাকেও কঠোর শাস্তি দিতে হইবে। ২০। রেলের তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়া কমাইতে হইবে এবং যাত্রীদের জন্য মোছাফেরখানা ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করিতে হইবে। ২১। সামরিক বিভাগে উচ্চ ও নিপদে উপযুক্ত পরিমাণে বাঙ্গালী গ্রহণ করিতে হইবে। ২২। গরীব কৃষকদের ঘরদরজা ও নৌকা নিৰ্ম্মাণের জন্য প্রচুর পরিমাণে শাল কাঠ ও টিন সরবরাহ করিতে হইবে। ২৩। প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীসংখ্যা ৯ জনের বেশী কিছুতেই রাখা চলিবে না, ডেপুটি মন্ত্রী, পালামেন্টারী সেক্রেটারী ইত্যাদি ২১ দফার ওয়াদানুযায়ী (মাথা ভারী শাসন মান) মোটেই নিযুক্ত করা চলিবে না। ২৪। বৰ্ত্তমানে বন্যাৰ্ত্তদের সাহায্যার্থে যে সমস্ত চাউল, ধান, চিনি ইত্যাদি জিনিসপত্র স্বল্প মূল্যে সরকার সরবরাহ করিতেছেন তাহাতে সত্যিকারের গরীব জনসাধারণের উপকার হইতেছে না। বরঞ্চ সরকারের সুষ্ঠু নীতির অভাবে উহাতে চোরাকারবার ও মোনাফাখোরীদের বৃটিশ ও মুসলিম লীগ আমলের চেয়ে বেশী সুযোগ দেওয়া হইয়াছে। একজন সত্বর ইহার প্রতিকারার্থে বিক্রয়ের নির্দিষ্ট দর বাঁধিয়া সুষ্ঠুভাবে সরবরাহের ব্যবস্থা করিতে হইবে। বিঃদ্রঃ- কিছু দিনের মধ্যেই গণপরিষদে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র পাশ হইয়া যাইবে। অতএব, সারাদেশময় আন্দোলন করিয়া যদি ২১ দফা শাসনতন্ত্রে গ্রহণ করাইতে না পারি তাহা হইলে পাকিস্তান ও আমাদের বংশধরগণের সর্বনাশ হইবে। তাই দলে দলে এই সম্মেলনে যোগদান করিয়া ২১-দফাকে বাস্তবে রূপদান করিতে সুষ্ঠু কর্মপন্থা গ্রহণ করিবার জন্য আকুল আবেদন জানাইতেছি।
ময়মনসিংহ হইতে মটর-বাসে, ঢাকা হইতে লঞ্চ-ষ্টিমারে, সিরাজগঞ্জ ঘাট হইতে লঞ্চ ও নৌকা যোগে যাতায়াত করা যাইবে।
আরজ গোজার মোঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ