You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন পাকিস্তান গণপরিষদ ১০ এপ্রিল, ১৯৫২

বিষয় : পাকিস্তান গণপরিষদ এ বাংলা ভাষা কে অন্যতমরাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান,১০ এপ্রিল, ১৯৫২

জনাব নূর আহমেদ (পূর্ব বাংলা:মুসলিম): স্যার,আমি প্রস্তাব করছি যে, “গণপরিষদ একমত যে,বাংলা ভাষা কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত”

স্যার,আমার প্রস্তাব এই পরিষদ এর সম্মানিতসকল সদস্যের নিকট সুস্পষ্ট।আমার প্রস্তাবের সমর্থনে একটিভাষণ প্রদান করে আমি তাই পরিষদ এর মূল্যবান সময় ব্যয় করছি না।

মিস্টার প্রেসিডেন্ট (জনাব নূর আহমেদ এর প্রতি):আপনি কি কিছু বলতে চান?

জনাব নুরুল আমিন(পূর্ব বাংলা :মুসলিম): উনি বলেছেন।

সরদার শওকত হায়াত খান(পাঞ্জাব:মুসলিম): একজন অফিসিয়াল উনাকে বলতে বাধা দিচ্ছেন।

মি. প্রেসিডেন্ট :প্রস্তাব উত্থাপিত : “গণপরিষদ একমত যে,বাংলা ভাষা কে উর্দুর পাশাপাশিপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত”

সম্মানিত জনাব পীরজাদা আবদুস সাত্তার আবদুর রহমান(সিন্ধ:মুসলিম): স্যার,আমি প্রস্তাব করছি, “রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত না হওয়া এবং আশু গৃহীত হবার আবশ্যক না থাকার বিষয়টি বিবেচনায়, উক্ত প্রশ্ন টি এই গণপরিষদ কর্তৃক ভবিষ্যৎ এ প্রয়োজন বোধ এ সমাধা হবে”স্যার,সংশোধনী টি সুস্পষ্ট এবং এটির উত্তরোত্তর স্পষ্টীকরণ নিষ্প্রয়োজন।

মিস্টার প্রেসিডেন্ট : ” রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত কোন সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত গৃহীত না হওয়া এবং আশু গৃহীত হবার আবশ্যক না থাকার বিষয়টি বিবেচনায়, উক্ত প্রশ্ন টি এই গণপরিষদ কর্তৃক ভবিষ্যৎ এ প্রয়োজন বোধ এ সমাধা হবে”

সরদার শওকত হায়াত খান:“স্যার,আমি ব্যথিত এবং আশ্চর্য যে সরকারি দলের একজন সদস্যের একটি প্রস্তাব প্রথমে উত্থাপিত হলেও খোদ সরকারই সেটি মুলতবীর চেষ্টারত।গত দুই মাসে আমরা দেখেছি যে এই ভাষা সংক্রান্তসমস্যা আমাদের পূর্ব বাংলার ভাইদের মানসিক পীড়ন এর কারন হয়েছে।

*মাননীয় সদস্য কর্তৃক বক্তব্য সংশোধিত নয়

আর কেউ নয় বরং পাকিস্তান এর প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এর পরেই সমস্যা টি প্রকট হয় এবং তারপর আসে বিপদ, সংঘটিত হয় আন্দোলন, গুলি চলে,মানুষ এর মৃত্যু হয় এবং আন্দোলন হয় তীব্রতর যা দেখে খোদ পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তার বিধানসভায়, যেখানে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা,একটি প্রস্তাব পাশ করাতে চান, যা পূর্ব বাংলার মানুষের অনুভূতির সহমর্মি। যদি না তিনি পূর্ব পাকিস্তান এর মানুষের চেতনায় বিশ্বাসী হতেন তবে তিনি সেই প্রস্তাবটি পাশ না করালেই পারতেন! নাকি এটি ছিল কেবলই রাজনৈতিক কৌশল, সেই জটিল পরিস্থিতি হতে বেরিয়ে আসার?আমি পূর্ব বাংলার মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী কে প্রশ্ন করতে চাই ঠিক কি কারনে তিনি প্রস্তাবটি পূর্ব বাংলার আইনসভায় পাশ করালেন।যদি তখন সেখানে এটির কোন প্রয়োজন না থেকে থাকে তবে আজ এখানেও প্রস্তাবটির উত্থাপনের প্রয়োজন নেই।যদি তখন প্রস্তাবটি পাশ করানোর প্রয়োজনীয়তা থেকে থাকে,যদি জনগণ এর সিদ্ধান্ত তাকে প্ররোচিত করে থাকে প্রস্তাব টি পূর্ব বাংলার আইনসভায় পাশ করাতে, তবে অবশ্যই স্যার,সেই প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি এবং তাই এই সমস্যাটি হিমঘর এ পাঠিয়ে দেয়া হবে অনুচিত।

আমি এমন এক প্রদেশের অধিবাসী যেখানে উর্দু কে আমরা গত ৩০ কি ৪০ বছর ধরে লালন করেছি ও গড়ে তুলেছি এবং সত্যিই পাঞ্জাব এমন একটি ভাষা লালন করে গর্বিত যা তার নিজের নয়।অত:পর, স্যার,এত বছর ধরে উর্দু ভাষায় কথা বলা এবং ভাষাটির উন্নয়ন ঘটানো সত্ত্বেও আজ এখানে দাঁড়িয়ে আমি বাংলা ভাষার দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলছি, সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই বলছি বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হোক কারন এটি পূর্ব বাংলায় বসবাসকারী আমাদের ৪ কোটি নয় লক্ষ মানুষের মাতৃভাষা।যদি আমরা পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানী জনগণ এর এই দাবীর বিরুদ্ধতা করি তবে আমরাই দায়ী থাকবপূর্ব পাকিস্তান এ অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য যা আমার দেশ ও জাতির কাঠামো ধ্বংসের কারন হয়ে উঠতে পারে।স্যার,আমি তাদের একজন যারা উর্দুভাষী এবং উর্দু ভাষার প্রণয়ী তবু আজ এখানে বাংলা ভাষার দাবীর প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করছি সম্পূর্ণ আন্তরিকতা এবং গভীরতার সাথে কারন আমরা চাইনা পূর্ববাংলার মানুষের দাবীর বিরুদ্ধতা করতে, কারন এতে কোন কল্যাণ নেই। বরং এই সমস্যাটি ঝুলিয়ে রাখলে, সেই অশুভ দিনটি আরও একবার ঝুলিয়ে রাখলে আমরা অস্থিরতা সৃষ্টি তে প্ররোচনা দিয়ে দেব যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙনের কারন হতে পারে।অতএব স্যার,পাকিস্তান এর স্বার্থে,জনগণের স্বার্থে,আমাদের ভবিষ্যৎ ঐক্যের স্বার্থে,ভবিষ্যৎ বন্ধনের স্বার্থে,আমাদের ভবিষ্যৎ শিশুদের স্বার্থে,আমাদের উত্তরাধিকারীদের স্বার্থে,আমি বাংলা ভাষার দাবীর প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি।আসুন,আমরা আর সময়ের অপচয় না করি,আসুন আমরা বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব এর প্রতি সমর্থন জানাই,আসুন আমরা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহন করি। যদি আমরা ইংরেজি গ্রহণ করতে পারি,যদি ইংরেজি এখানে ব্যবহৃত হতে পারে,যদি ইংরেজিকে আমরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ এর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারি,তবে কেন বাংলা ভাষা যা ৪ কোটি লোকের মুখের ভাষা,অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাবেনা? আমি নিশ্চিত যে উর্দু এত দুর্বল নয়, বাংলাও এত দুর্বল নয় যে উভয় কে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিলে যে কোন একটি কে হত্যা করা হবে।এটি কেবলই আগুনে ঘি ঢালা এবং এই আগুন ছড়িয়ে পড়বে স্যার,আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি,যদি আমরা সমস্যাটি কে যথাযথ গুরুত্ব না দিই এবং এই তুচ্ছ প্রাদেশিকতা(সংকির্ণতা) হতে বেরিয়ে না আসি,যদি আমরা প্রাদেশিক মনোভাব নিয়েই চলতে থাকি,যেই প্রাদেশিকতার সাথে বিগত এতগুলো বছর ধরে আমাদের বসবাস তবে আমরা এই দেশ টি কে ধ্বংস করতে চলেছি।স্যার,ভাবালুতা দূরে সরিয়ে রাখি।আমরা অতিদীর্ঘ কাল ধরে ভাবপ্রবণ। আমরা অতিদীর্ঘ কাল ধরে আবেগী।আসুন আমরা যুক্তিবাদী হই।আসুন আমরা নিজেকে প্রশ্ন করে,সন্ধানী প্রশ্ন করুন নিজ কে,আমি এখানে প্রধানমন্ত্রী কে প্রশ্ন করতে চাই,উনি কি নিজেকে জিজ্ঞাসা করবেন,বাংলা কে রাষ্ট্রভাষা করা কি পূর্ব পাকিস্তানী জনগণ এর প্রবল আকাঙ্ক্ষা নয়?

যদি তা না হয়,তাহলে দয়া করে বলুন এসবই বানোয়াট ছিল,বলুন এটি সাধারণ মানুষের দাবী নয়,তবেই আমি বাংলার পক্ষে বলা আমার প্রতিটি শব্দ ফিরিয়ে নিব।কিন্ত যদি তা না হয়ে থাকে তবে যদি এটিই হয় জনগণের দাবী এবং পাকিস্তান এর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দাবী তবে আমি কোন কারণ দেখছি না কেন বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখে সরকার এবং জনগণ এর জন্য আরও ঝামেলা এবং বিপদ ডেকে আনা হচ্ছে।স্যার,আমরা সকলেই জানি এমন অনেক রাষ্ট্র আছে যেখানে তিনটি ভাষায় কথা বলা হয়। যেমন সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ফরাসি এবং ইতালি।কানাডার দিকে তাকান।ইংরেজি এবং ফরাসি দুটিই ব্যাবহার করা হয়।অথচ আমাদের দেশে কেন আমাদের দুটি ভাষা থাকতে পারবে না?কেন আমরা এর বিরোধিতা করব?আমরা,যারা ২০০ বছর ধরে ইংরেজি তে কথা বলে আসছি,আমরা সেই ভাষাটির বিরোধিতা করব যেটি দেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ভাষা?স্যার,আমার এটি বলতে কোন দ্বিধা নেই যে আমরা পাঞ্জাবের মানুষ এবং আমরা পাকিস্তান এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তাশীল তাই বাংলা ভাষার দাবী তথা পূর্ব পাকিস্তানীদের যাবতীয়আকাঙ্ক্ষা কে ভাসিয়ে দেয়ার কোনরকম ইচ্ছা আমরা পোষণ করি না।

স্যার,আমি নিশ্চিত যে যদি আমরা বাংলা কে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিই তবে তা পাকিস্তান এর দুটি অংশের বন্ধন ও বন্ধুত্ব কে দৃঢ়তর করবে।পশ্চিম এর মানুষ বাংলা শিখবে,পূর্বের মানুষ শিখবে উর্দু। ভাষার এই বিনিময় এর মাধ্যমে,উভয় অংশে বাধ্যতামূলক ভাষাশিক্ষার মাধ্যমে যেই বন্ধন আমরা সৃষ্টি করব তা কৃত্রিম কোন উপায় ভাঙা অসম্ভব হবে। অতএব স্যার,যদি আমরা পাকিস্তান এর দুটি অংশের মধ্যে দৃঢতর বন্ধন, বন্ধুত্ব্ব ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে চাই তবে এইসব প্রস্তাব ইত্যাদি একপাশে সরিয়ে রেখে আমাদের উচিত হাতখুলে এগিয়ে এসে বলা,আমরা তোমাদের ভাষা গ্রহণ করছি, এইজন্য নয় যে তোমরা সংখ্যাগুরু বরং এইজন্য যে আমরা পাকিস্তান কে আরও শক্তিশালী করতে চাই আমাদের ভ্রাতৃত্ব আরও শক্তিশালী করতে চাই।আমরা তোমাদের দেশের ভাষা গ্রহণ করতে এগিয়ে আসছি উর্দুর পাশাপাশি, যা পশ্চিম পাকিস্তান এর নির্দিষ্ট কিছু লোকের ভাষা।স্যার,যদি আমরা তা না করি,যদি আমরা যুক্তি তে না এসে আবেগের বশবর্তী হয়ে থাকি,যদি আমরা রাজনৈতিক কারনে এটি ঝুলিয়ে রাখি তবে স্যার আমি নিশ্চিত বিপরীত বলছি আমার বন্ধুদের যে তারা আজ বাংলা ভাষার ইস্যুটি অগ্রাহ্য করছে না বরং পাকিস্তান এর ভিত্তিকেই যার উপর এই রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে, তাকেই অগ্রাহ্য করছে।এই বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখার মাধ্যমে তারা পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে অস্বস্তির সৃষ্টি করবে এবং তারা ভুল বুঝবেন যে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানী রা হয়ত তাদের ওপর প্রভুত্ব করার চেষ্টা করছি।পাকিস্তান এর কোন অংশ,কোন প্রদেশ অথবা কোন ব্যক্তি কেই আমাদের প্রভুত্বের স্বীকার করার ইচ্ছে আমাদের নেই।আমরা চাই সবকয়টি প্রদেশ এবং আমাদের মানুষেরা একত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সহযোগী হয়ে এবং পাকিস্তান কে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করবে যা এর অধিকার।

অতএব,স্যার,পাকিস্তান এর ঐক্যের স্বার্থে আমাদের জনগণের স্বার্থে,বাংলা,পাঞ্জাব,সিন্ধ,সীমান্ত এবং বেলুচিস্তান এর স্বার্থে গবর্মেন্ট এ আমার বন্ধুদের কাছে আমি চাইছি যেন বিষয়টি আর ঝুলিয়ে রাখা না হয়,যেন দেশের প্রকৃত সমস্যাদি অগ্রাহ্য করা না হয়,যেন সময়ের চাহিদা কে অগ্রাহ্য করা না হয়।সাহসী হোন,কায়েদ-এ-আযম এর সুযোগ্য অনুসারী হোন,কায়েদ-এ-আযম এর প্রকৃত উত্তরসূরি হোন,কায়েদ-এ-আযম এর প্রকৃত উত্তরাধিকারীর ন্যায় আচরণ করুন এবং উঠে দাঁড়িয়ে এরকম অনন্য পরিস্থিতি তে উনি যা করতেন তা করার চেষ্টা করুন এবং এই ভাষার ইস্যু টি গ্রহণ করুন। এমন কিছুই করবেন না যা আমাদের জাতীয় শক্তি কে বিপর্যস্ত করে

স্যার,এইটি বলে রাখা ভাল যে, যখন সংবিধান তৈরি হবে তখন বিষয়টি আমরা আবারও তুলব।এমনকি স্যার,গতকালই একটি প্রস্তাব উঠে ইসলামিক রিসার্চ এর জন্য।প্রতিদিনই বিভিন্ন প্রস্তাব উঠে,কিছু নির্বাচন বিষয়ে,কিছু ভারত শাসন আইন সংস্কার প্রসঙ্গে।এসকল ছোটখাটো বিষয় যেহেতু আলোচিত হয় তবে কেন প্রধান গুরুত্ববহ একটি বিষয় আলোচিত হবে না যাতে করে প্রস্তাব টি পাশ করে দেশে অস্থিরতা দূর করা যায়,যাতে আমরা সকলেই শান্তি তে থাকতে পারি,কারও মনে হীনমন্যতাথাকবে না যে এখানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তান এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে অথবা পশ্চিম পাকিস্তান এর উপর আধিপত্য বিস্তার করছে।স্যার,অল্প কিছু শব্দ,অপর্যাপ্ত শব্দ দ্বারা আমি আবারও প্রার্থনা জানাচ্ছি সকলকে বিবেচক হতে,এবং আবেগের বশে বিষয়টি আটকে না ফেলতে।আমাদের বাঙালী দের সহায়তা করতে দিন,বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কে গড়ে ওঠার সহায়ক হতে দিন এবং উভয়পক্ষের সম্মতিতে পূর্ব ও পশ্চিমের লোকেদের উর্দু ও বাংলা উভয় ভাষার সহজে বুঝতে পারা ও পড়তে পারার জন্য একটি অভিন্ন লিপি চালু করা উচিত।অতএব স্যার,বিষয়টি শান্তভাবে বিবেচনা করার প্রার্থনা করছি এবং সমাধানে এসে আমাদের একটি অভিন্ন লিপির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।আসুন কুরআন এর লিপি,যেটি পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তান উভয় স্থানের মানুষ ই বুঝে সেটিকেই অভিন্ন লিপি হিসেবে গ্রহণ করি।এটিই হতে পারে উভয় ভাষার অভিন্ন লিপি।অতএব স্যার,এইসকল কথা এবং উপদেশ এর সাথে আমি হাউজের কাছে নিবেদন জানাচ্ছি দয়া করে প্রাদেশিকতা মনোভাব হতে বের হয়ে আসতে,যেই প্রাদেশিকতার অভিযোগ এ অভিযুক্ত করছেন আপনারা বিরোধী দের এবং বর্তমান পরিস্থিতির ঊর্ধে উঠে অনুধাবন করতে যে,আপনারাই পাকিস্তান এর প্রকৃত দেশনায়ক এবং এর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও আপনাদের সভাপতিত্বেই সংঘটিত হবে।

জনাব এ কে ফজলুল হক(পূর্ব বাংলা:মুসলিম)* :স্যার,যেহেতু বিতর্কটি আমি মন দিয়ে শুনছি,আমার দৃষ্টিভঙ্গি হাউজের সামনে তুলে ধরাটা দায়িত্ব বলে অনুভব করছি।আমি বাগ্মী, এমন দাবী করছিনা।আমার বন্ধু জনাব শওকত হায়াৎ খান ভাষার যে প্রচণ্ডতারঅধিকারী আমিও সেরকমভাবে হাউজের সামনে একটি প্রস্তাব পেশ করতে পারব তাও বলছিনা।কিন্ত স্যার,আমি দাবী করতেই পারি যে,পরম করুণাময় এর দয়ায় কিছু সংসদীয় অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।আমি সমগ্র ভারতব্যাপী তিনটি সংসদীয় প্রজন্মের খসড়া করেছি এবং আমি জানি এটি কি।যখন রাষ্ট্রের জন্য চরম গুরুত্ববহ একটি বিষয় আলোচিত হচ্ছে তখন কিভাবে কিছু মানুষ তা এড়িয়ে যেতে থাকেন স্বয়ং প্রশ্ন টির গুরুত্ব অনুধাবন না করে।আমি এক মুহূর্তের জন্যেও আমার বন্ধুদের এই অভিযোগ এ অভিযুক্ত করছিনা যে তারা প্রস্তাবটির গুরুত্ব অনুধাবন করছেন না,কিন্ত আমি অবশ্যই বলছি যে তারা প্রকৃত ঘটনা গুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।আমার ৩০ বছর এর রাজনৈতিক জীবন ও ওকালতি থেকে আমি কেবল অভিজ্ঞতাই অর্জন করিনি,বরং মফস্বল থেকে পেশাদারি কাজে আমার কাছে আসা লোকদের সাথে আমি নিবিড়সংস্পর্শে আছি।আমার কাজ শেষে আমি ওদের সাথে আড্ডায় ডুবে যাই,আজকের ভীষণ গুরুত্ববহ প্রশ্ন টি সম্পর্কে মানুষ আসলে কি ভাবে জানতে চেষ্টা করি।এখন,স্যার,আমি সংঘর্ষের ভয় না করেইবলছি যে কারনেই হোক,এই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান এর মানুষের মনোভাব হল বাংলাকে অন্ততপক্ষে পাকিস্তান এর একটি রাষ্ট্রভাষার স্থান দেয়া হোক।স্যার,আমি মনে করিনা এই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান এর এমন কোন বাসিন্দা আছেন যিনি উর্দুকে পাকিস্তান এর একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ভোট দিবেন। এই মনোভাব শুভকর নাকি নয় সেটি বলা আমার কাজ নয়।আমি তা বলছিনা। _________________ মাননীয় সদস্য কর্তৃক সংশোধিত বক্তব্য নয়

পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তান উভয় স্থানের মানুষ ই বুঝে সেটিকেই অভিন্ন লিপি হিসেবে গ্রহণ করি।এটিই হতে পারে উভয় ভাষার অভিন্ন লিপি।অতএব স্যার,এইসকল কথা এবং উপদেশ এর সাথে আমি হাউজের কাছে নিবেদন জানাচ্ছি দয়া করে প্রাদেশিকতা মনোভাব হতে বের হয়ে আসতে,যেই প্রাদেশিকতার অভিযোগ এ অভিযুক্ত করছেন আপনারা বিরোধী দের এবং বর্তমান পরিস্থিতির ঊর্ধে উঠে অনুধাবন করতে যে,আপনারাই পাকিস্তান এর প্রকৃত দেশনায়ক এবং এর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও আপনাদের সভাপতিত্বেই সংঘটিত হবে।জনাব এ কে ফজলুল হক(পূর্ব বাংলা:মুসলিম)* :স্যার,যেহেতু বিতর্ক টি আমি মন দিয়ে শুনছি,আমার দৃষ্টিভঙ্গি হাউজের সামনে তুলে ধরাটা দায়িত্ব বলে অনুভব করছি।আমি বাগ্মী, এমন দাবী করছিনা।আমার বন্ধু জনাব শওকত হায়াৎ খান ভাষার যে প্রচণ্ডতারঅধিকারী আমিও সেরকমভাবে হাউজের সামনে একটি প্রস্তাব পেশ করতে পারব তাও বলছিনা।কিন্ত স্যার,আমি দাবী করতেই পারি যে,পরম করুণাময় এর দয়ায় কিছু সংসদীয় অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।আমি সমগ্র ভারতব্যাপী তিনটি সংসদীয় প্রজন্মের খসড়া করেছি এবং আমি জানি এটি কি।যখন রাষ্ট্রের জন্য চরম গুরুত্ববহ একটি বিষয় আলোচিত হচ্ছে তখন কিভাবে কিছু মানুষ তা এড়িয়ে যেতে থাকেন স্বয়ং প্রশ্ন টির গুরুত্ব অনুধাবন না করে।আমি এক মুহূর্তের জন্যেও আমার বন্ধুদের এই অভিযোগ এ অভিযুক্ত করছিনা যে তারা প্রস্তাবটির গুরুত্ব অনুধাবন করছেন না,কিন্ত আমি অবশ্যই বলছি যে তারা প্রকৃত ঘটনা গুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।আমার ৩০ বছর এর রাজনৈতিক জীবন ও ওকালতি থেকে আমি কেবল অভিজ্ঞতাই অর্জন করিনি,বরং মফস্বল থেকে পেশাদারি কাজে আমার কাছে আসা লোকদের সাথে আমি নিবিড়সংস্পর্শে আছি।আমার কাজ শেষে আমি ওদের সাথে আড্ডায় ডুবে যাই,আজকের ভীষণ গুরুত্ববহ প্রশ্ন টি সম্পর্কে মানুষ আসলে কি ভাবে জানতে চেষ্টা করি।এখন,স্যার,আমি সংঘর্ষের ভয় না করেইবলছি যে কারনেই হোক,এই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান এর মানুষের মনোভাব হল বাংলাকে অন্ততপক্ষে পাকিস্তান এর একটি রাষ্ট্রভাষার স্থান দেয়া হোক।স্যার,আমি মনে করিনা এই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান এর এমন কোন বাসিন্দা আছেন যিনি উর্দুকে পাকিস্তান এর একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ভোট দিবেন। এই মনোভাব শুভকর নাকি নয় সেটি বলা আমার কাজ নয়।আমি তা বলছিনা। _________________ *মাননীয় সদস্য কর্তৃক সংশোধিত বক্তব্য নয়

স্যার, বর্তমানে সংসদে যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছে তা সরকার উৎখাত করা নিয়ে নয়। সরকার কিছুই করে নি, কিন্তু আমাদের কিছু সদস্য বাংলা কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়ার লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। আমার বন্ধু, জনাব নূর আহাম্মেদ যিনি আমাকে ক্ষমা করবেন যদি আমি বলি তিনি একটি যন্ত্রবিশেষ যা প্রতি ঘণ্টায় ১০০ টি করে প্রস্তাবনা ফিরিয়ে দেয় এবং সংশোধন প্রায় একই গতিতে তার থেকে প্রত্যখ্যাত হয়। তাঁর কোন প্রস্তাবনা উত্থাপন না করে এই আনুষ্ঠানিকতা ত্যাগ করার কথা না। তাছাড়াও, চট্টগ্রামের অধিবাসী হওয়াতে সবচেয়ে আগ্রাসী চরিত্রের অনুভূতির কারণে তিনি সংসদে এটি উত্থাপন করে তাঁর কর্তব্য পালন করেছেন মাত্র। অতএব, আসুন এখন আমরা পরিস্থিতিটা বুঝি। সরকার কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে? সরকার এটা পুরোপুরি বুঝে গিয়েছে যে, বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা করার দাবীর পেছনে পাকিস্তানের ৯ কোটি মানুষের সমর্থন আছে। একই সময়ে, এই প্রশ্নটিকেই আরো বেশ কিছু দৃষ্টিকোন থেকে দেখা যায়। বিবেচনা করে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে সময়ের প্রয়োজন হয়। সরকার এখন পর্যন্ত এই প্রস্তাবই দিয়েছে  যে এই ব্যাপারটা নিয়ে এখানে এই মুহূর্তে ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখে সিদ্ধান্ত না নেয়া হোক, বরং আরো সময় নেয়া উচিৎ যাতে করে এই প্রশ্নটা যাবতীয় ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হোক এবং এরপর সিদ্ধান্ত নেয়া হোক যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে। ‘যথাসময়ে’এই কথাটা আমার খুব একটা পছন্দ না। বর্তমানে অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, আমি বোধ করি যে এই ‘যথাসময়’* টা খুব একটা নিকট ভবিষ্যতে আসবে না। এমন হতে পারে যে, ইংরেজি আরো পাঁচ বা আট বছর ধরে রাষ্ট্রভাষা থেকে যাবে। আমরা জানিনা কি ঘটবে, কিন্তু যাই হোক না কেন, যদি সরকারি প্রস্তাব আজ দেয়া হয়। আমরা সরকারকে এই প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে দিব না। পরবর্তী সংসদ যখন অনুষ্ঠিত হবে তখন আমরা একটি সমস্যার সম্মুখীন হব। এই সময়ের মাঝখানে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মতামত নেয়ার যথেষ্ট সুযোগ পাব এবং আমরা যদি পুরো বিশ্বে এটা প্রমান করতে পারি যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের শুধু একটি ভাল দাবী আছে তাই নয় বরং এ দাবীর পেছনে তাদের গনমতামতও আছে তবে যতই ব্যক্তিগত বিষয় থাকুক না কেন  সরকারকে তখন অবশ্যই এই ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে হবে।

রাষ্ট্রপতিঃ আমি এখানে একটি ভুল ধারণা দূর করতে পারি। এখানে সরকার প্রতিনিধিত্ব করে না বরং সকল সদস্য তাঁদের নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন।

জনাব এ কে ফজলুল হকঃ “স্যার, এটা কেবলই একটি তত্ব। তাই, যাই হোক না কেন, আমি এখানে যাই মন্তব্যই করি তা মাননীয় পীরজাদাকে ইঙ্গিত করে। ব্যাপার যাই হোক না কেন, আমি নির্দিষ্ট কিছু তথ্য উপস্থাপন করছি। আমি এটা বলছি যে করাচিতে আসার পর আমি এই প্রশ্নটিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে দেখেছি। আমার ধারণা হল বর্তমানে সংসদে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিদ্যমান। যদি আমরা এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে জোর প্রয়োগ করি যাতে আমরা হারতে পারি এবং আমরা যদি তা করি তবে আমরা চিরদিনের জন্য এই দাবীটা হারাবো। কারন এই পরিস্থিতি নিয়ে কেবল ক্ষমতাসীন সংসদের সদস্যরা নন বরং সংসদের সেই বিভাগের একজন সদস্য কাজ করছেন। কিন্তু যদি আমরা এই প্রশ্নটা সবার জন্য উন্মুক্ত রাখি, সংসদ সদস্যদের সাথে প্রশ্নটা বিবেচনা করার সুযোগ পাই এবং আমাদের আশা মোতাবেক সিদ্ধান্ত না পাই তবে, স্যার, আমার বলতে হয় আমরা গভীর আশঙ্কায় পড়ে যাব। আমি আজই কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত চাই না, আমি ওখানে গন মতামত নেয়ার সুযোগ পেতে চাই এবং আমাদের দৃষ্টিকোন মেনে নিতে সরকারকে প্রভাবিত করতে চাই। একটি সুন্দর প্রবাদ আছেঃ যে যুদ্ধ করে এবং পালিয়ে যায় সে আরেকবার যুদ্ধ করার সুযোগ পায় – যদি এটাই অবস্থা হয় তবে আমরা সুবিধার অবস্থানে আছি। কারন যাই হোক না কেন এখনই হার মেনে নেয়ার পরিবর্তে প্রশ্নটা সবার জন্য উন্মুক্ত রেখে সরকার সবদিক বিচার বিশ্লেষণ করে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেই সবার জন্য মঙ্গল।

এখন স্যার, আমি খোলাখুলি ভাবেই বলব। যে আলোচনা হয়েছে এবং যে আলোচনা হবে, সেটায় দেখা যাবে যে পূর্ব পাকিস্তানের এই অধিবেশনের সদস্যরা এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা সদস্যরা যদি থাকে, তাদের খুব বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেওয়া হবে, কারণ তাদের নিজেদের ভাবনাই হলো পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে এখানে এবং এখনই সোজাসুজি ঘোষণা করা উচিত।

সরদার শওকত হায়াত খান: আপনি সেটা কেন বলছেন না?

জনাব এ. কে. ফজলুল হক: “দেখুন, আমি এটা চাই। কিন্তু আমি চাই যথাযথ উদ্যোগ। আমি খোলাখুলি বলছি স্যার, আমি এটা ভাঙতে চাই না। আমি মনে করি, এই এখনকার পরিস্থিতিতে যদি কোনো বিভজন তৈরি হয়, তাহলে আমরা হারব, কারণ যেটাই হোক। আমি হারতে চাই না কিন্তু সুযোগ চাই এবং সাধারণ ভাবে বলতে, আমি প্রশ্নটি স্থগিত করতে চাই কিন্তু আমি পরাজয়টি পেছনে ফেলতে চাই এবং দেখতে চাই যে সফলভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেক বের হতে পারি কিনা।

সরদার শওকত হায়াত খান: আপনাকে কে হারাতে পারে?

জনাব এ. কে. ফজলুল হক : *মুহূর্তের জন্য আমি আমার বন্ধু প্রশ্নের উত্তর তার প্রত্যাশা মতো দিতে পারছি না, কারণ আমি সত্য বদলাতে পারি না। আমি হাউজের কোনো সুনির্দিষ্ট সেকশনের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বলছি না। আমি এখানে কারও পক্ষে বলছি না, স্রেফ হাউজের সামনে বাস্তবতাগুলো তুলে ধরছি। মাননীয় আব্দুস সাত্তারের সংস্কার কি এতটাই যে আর কখনোই হাউজের বিবেচনার জন্য আসতে পারে না? পরের ছয় বা আট মাসের জন্য এটা স্থগিত করা যায়। এই সবকিছুই প্রক্রিয়ার ব্যাপার। এজন্যই স্যার, আমার মতে এটা সঠিক রাজনীতি নয় কারণ আজকে অনৈক সদস্যকেই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয়েছে কারণ নির্বাচনী এলাকার প্রতি তাদের দায়িত্ব আর আজকে হাউজে যে পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে, এটার মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। আমি স্রেফ হাউজের কাছে আবেদন রাখছি উসকানিমূলতক বক্তব্য না দিতে এবং এই প্রসঙ্গটি সরকারকে ধীরস্থির ভাবে বিবেচনার সুযোগ দিতে এবং আমি নিশ্চিত যে একটা সময় আসবে যখন বাংলার গুরুত্ব যথাযথ ভাবে আমরা বোঝাতে পারব।

বসার আগে, আমার বন্ধু সরদার শওকত হায়াত খানকে আমি কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানাই যেভাবে উনি বাংলার প্রয়োজনীয়তা সমর্থন করেছেন। যদি এমন বক্তৃতা উনি না দিয়ে আমি দিতে পারতাম! (করতালি)

 

শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তঃ জনাব সভাপতি, স্যার…………আমার জন্য বরং এটা কঠিন যে পরিস্থিতির কারনে আমাকে আমার সন্মানিত এবং সবচেয়ে জ্ঞানী বন্ধু জনাব এ.কে. ফজলুল হকের পরে কথা বলতে হবে। দীর্ঘ সময় তার সহকর্মী হিসেবে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে এবং আমি জানি তাঁর পরে কথা বলা কত কঠিন। তিনি যেকোন কেস উচ্ছসিত যুক্তিতর্কের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারেন। তার সেই সামর্থ্য আছে।  আমি শুধুমাত্র একটি জিনিস বলতে চাই আর তা হলঃ এই বিষয়টি পূনঃবিবেচনাকে স্থগিত করার প্রয়োজন আছে কিনা। এটা এখন সর্বসম্মত। এবং স্যার এটাকে আমার সন্মানিত এবং সবচেয়ে জ্ঞানী বন্ধু জনাব এ.কে. ফজলুল হকও সমর্থন করেছেন, যে বাংলা ভাষার দাবি ন্যায্য এবং এতে পূর্ব বাংলার সকল জনগনের রায় ও সমর্থন আছে।

স্যার যদি আমরা এই ঘরে পেশকৃত সিদ্ধান্তের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে আমরা বুঝতে পারবো। শুধুমাত্র জনাব নূর আহমেদই নয় যিনি গৃহীত সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দক্ষতা রাখেন, এবং চট্টগ্রাম থেকে এসে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন কিন্তু জনাব শহুদুল হোক টিপাড়া জেলাস্থ আমার বাসা থেকে এসেছেন, সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও করেছেন। আপনি যদি নিজে উক্ত সিদ্ধান্তের দিকে তাকান, দেখবেন যে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পূর্ব বাংলার জনগণের মতামত জয়ী হচ্ছে এবং পূর্ব বাংলা পরিষদের সর্বশেষ পাশকৃত সার্বজনীন মতামত বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে, গণপরিষদ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানে মত দিয়েছে।

তাই সিদ্ধান্তক্রমে এটাই বলা হয়েছে যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জনগণের মতামত আছে এবং একই সাথে পূর্ব বাংলা পরিষদে সর্বসম্মতি পেয়েছে।স্যার, আমি পূর্ব বাংলা পরিষদের একজন সদস্য। স্যার, আমি জানি, পূর্ব বাংলা পরিষদের নেতা, মানে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নিজেই সিদ্ধান্তটি পূর্ব বাংলা পরিষদে তুলেছেন এবং সেখানেই সুপারিশ করা হয় বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে। স্যার, এরপর, পাবনা থেকে আগত জনাব আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদের সিদ্ধান্ত পাই যেখানে একই কথা বলা হয়। চট্টগ্রাম আগত জনাব আবুল কাশেম খানও একই কথা বলেছেন। পূর্ব বাংলার মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি, ময়মনসিংহের একটি কলেজের শিক্ষক, মৌলভী ইব্রাহিম খান অভিন্ন মতামত দিয়েছেন। স্যার, এজন্যই এটা গৃহীত হয়েছে এবং যা কিনা অবহেলা করা যাবেনা কেননা পূর্ব বাংলার সকল জনসাধারণ বাংলা ভাষার পক্ষে মতামত দিয়েছে। আমি জেলার শিশুদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলাম। তারাও স্লোগান দিচ্ছিলো: “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!”

স্যার, এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে পূর্ব বাংলা থেকে আগত আমার সহযোগীরা বেশ নীরব। জনাব নূর আহমেদই শুধুমাত্র সিদ্ধান্তের বিপরীতে কথা বলেছেন। স্যার, অন্যান্য সদস্যরাও নীরবতা পালন করছে। তাই এটা স্পষ্ট যে কর্তৃপক্ষের মানুষেরা এবং বর্তমান শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে নীরব ভূমিকা পালন করতে বাধ্য করেছে। তাছাড়া জনাব এ.কে ফজলুল হক বলেছেন যে এই ব্যাপারটি আপাতত মুলতবি করা হোক এবং সঠিক সময় নিশ্চয়ই আসবে। এ ব্যাপারে গত ৪ বছর যাবৎ তারা নিশ্চুপ যা উদ্বেগজনক কিনা, ভালোভাবেই জানা যে কোনো সংহতির দরকার নেই। স্যার আমি বুঝতে পারছিনা কেন বর্তমান শাসকগোষ্ঠী কোনো দরকারি উদ্যোগ নিচ্ছেনা। আমাদের সবাইকে একেবারেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চুপ থাকার কোনো মানে নেই। জনাব এ.কে ফজলুল হকের চাপের আমি এসব তর্কের ব্যাপারে যথেষ্ট নজর দিয়েছি। যদি সর্বসম্মতিতে স্বল্পসময়েরজন্যস্থগিত করা যায় তাহলে হয়তো পরিস্থিতি শান্ত হতে পারে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি চান পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হোক। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্তের বৈধতা গ্রহণ সংক্রান্ত মুলতবির ব্যাপারে কোনো মতামত দেননি। কিন্তু আমি মুলতবি করার কারণটা জানি স্যার। এই বিষয়টি থেকে চুপচাপ সটকে যাওয়ার জন্য মুলতবি ডাকা দরকার। কিন্তু স্যার এটা স্পষ্ট যে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের সদস্যরা যারা পূর্ব বাংলা শাসন করেন মানে আমার ভায়েরা আজ চুপ। তাদের উপর ব্যাপারটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই আজই প্রদত্ত সিদ্ধান্তের মুলতবি ডাকা সমীচীন হবেনা। ব্যাপারটা  এটি গুরুত্বপূর্ণ যে সহজে আড়ালে নেওয়া যাবেনা।

এটা কি জানা সত্য নয় যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজে বাঙ্গালী হওয়া সত্বেও বাঙ্গালীদের অনুভূতি বুঝতে পারে নি? আমার মুখ্যমন্ত্রী  আজ উপস্থিত আছেন, বসে আছেন নিশ্চুপ হয়ে। তিনি প্রকৃত অবস্থাটি বুঝতে পারছেন। কিন্তু তিনি কোন উদ্যোগ নেন নি, পূর্ব বঙ্গের সদস্য আমার মুসলিম ভাইয়েরা, তারাও আজ বাংলা ভাষার পক্ষে কোন মন্তব্য প্রদানে উদ্যমী হন নি। আমি তাদের অনুভূতিটা বুঝি এবং পূর্ব বাংলার মানুষদের আবেগও বুঝতে পারি। যাই বলা হয়ে থাকুক না কেন তাদেরকে আজ জোরপূর্বক চুপ করিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রশ্নটার সম্মুখীন হোন সাহস আর নির্ভয়ের সাথে। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের জন্যই লাভজনক। পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য, পাকিস্তানের একাত্বতার জন্য পূর্ব অংশ আর পশ্চিম অংশকে এক হতে হবে এবং তারা তখনি একাত্ব হতে পারবে যখন আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানী বন্ধু বাংলা শিখবে আর আমরা শিখব উর্দু।

শ্রী শ্রীস চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জেনারেলঃ পূর্ব বাংলা): মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আমি জনাব নূর আহমেদের করা সমাধানকে সমর্থন জানাচ্ছি এবং জনাব পীরজাদার করা সংশোধন প্রস্তাবে শঙ্কিত বোধ করে বিরোধিতা জানাচ্ছি।

এই আলোচনায় আমার শঙ্কার প্রথম কারন হল যখন জনাব নূর আহমেদ প্রথম এই সমাধান প্রস্তাব এই কক্ষে উত্থাপন করেন তখন আমার তাঁর বাক্যগুলো শুনে মনে হচ্ছিল কোন শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের মন্ত্র পাঠ শুনছি। আমি জানি যে জনাব নূর আহমেদ, কোন প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য না দাঁড়ালেও কথা কম বলেন না, আর রাষ্ট্রপতির পক্ষেও তাঁকে থামানো কষ্টকর হয়ে পরে, কিন্তু আজ তিনি কি করলেন? তিনি দাঁড়ালেন এবং শ্রাদ্ধের মন্ত্রপাঠের মত করে প্রস্তাব পাঠ করে গেলেন, এর সমর্থনে কিছু না বলেই। আমি সত্যিই মনে করি যে, তাঁর সাথে ঠাট্টা করা হয়েছে…

আমার দ্বিতীয় কথা হচ্ছে পূর্ব বাংলায় যদি কোন উত্তেজনার সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু জানিনা কারন ঐ সময়ে আমি পূর্ব বাংলাতে ছিলাম না – পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী দ্রুত পূর্ব বাংলার সংসদে যান এবং নিজেই বাংলা ভাষাকে সমর্থন জানিয়ে একটি সমাধান প্রস্তাব রাখেন। সেই সাথে তিনি প্রতিশ্রুতিও দিয়ে আসেন যে বাংলা ভাষাকে একটি রাষ্ট্রভাষা অথবা সমগোত্রীয় কিছু যাতে করা হয় তা তিনি দেখবেন।

মহামান্য জনাব নূরুল আমীনঃ (পূর্ব বাংলাঃ মুসলিম)ঃ আপনি কোথা থেকে এটি পেয়েছেন?

শ্রী শ্রীস চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ আপনি কি এটা সমর্থন করেন নি?

মহামান্য জনাব নূরুল আমীনঃ আপনি কেন এমন কিছু বলবেন যেটা সত্যিকার অর্থে আমি বলিই নি?

শ্রী শ্রীস চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ আপনি কি প্রস্তাবটি রেখেছেন নাকি রাখেন নি?

মহামান্য জনাব নূরুল আমীনঃ আমি অন্যকিছু বলেছিলাম।

শ্রী শ্রীস চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ আপনার প্রস্তাবটি আসলে কি ছিল?

মহামান্য জনাব নূরুল আমীনঃ আপনি নিজে পড়তে পারেন।

শ্রী শ্রীস চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ আমি ওখানে ছিলাম না, আমি আপনার সংসদের সদস্যও নই। আমি এর কোন প্রতিলিপি পাই নি বরং খবরের কাগজে দেখেছি।

মহামান্য জনাব নূরুল আমীনঃ তবে কেন আপনি আমার কথা বলবেন; কেন আপনি পা রাখলেন এই বিষয়ে যেটা কিনা আপনি পড়েন নি?

শ্রী শ্রীস চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ আপনি সেই প্রস্তাবটি রেখেছেন এবং এটাও বলা হয়েছে যে আপনি এখানে আসবেন আর সংসদের সমর্থন আদায় করবেন।

সরদার শওকত হায়াত খানঃ আপনি তাঁর নিজের ভুট্টা মাড়াচ্ছেন।

শ্রী শ্রীস চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ আমি সেটা জানি। তারপরও আমি এটা মেনে নিয়েছি যে তিনি যেহেতু পূর্ব বাংলার সংসদ নেতা হয়ে এই প্রস্তাব তুলেছেন তাই তাঁর নিজের থেকে সংসদে এটা পেশ করা সমীচীন ছিল। যেহেতু তিনি প্রস্তাবটি রাখেন নি এমনকি এর সমর্থনেও কিছু বলেন নি তাতে বোঝা যায় যে তিনি বোধহয় বাংলা ভাষার রাষ্ট্রভাষা হওয়ার পক্ষে নন। এটা আমার শঙ্কাবোধ হওয়ার দ্বিতীয় কারন; যাতে করে পরে কেউ বলতে না পারে যে সাধারন সংসদে এ নিয়ে কথা উঠে নি কখনো বরং এ প্রস্তাব শুধুমাত্র হিন্দু পাশ থেকে এসেছে আর তাই এটা শুধুই হিন্দু আন্দোলন। এমনটাও হতে পারে যে এটা কেবলই এক হিন্দু আন্দোলন হিসেবেই ছড়িয়ে পড়বে। আমি যা জানতে পেরেছি – ইতোমধ্যে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে যে পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন মূলত হিন্দু ধুতিওয়ালাদের তৈরি করা, মুসলমানদের নয় এবং নিরাপত্তা আইনকে তাদের কারো কারোর বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হয়েছে। এটাই আমার সমস্যা। তাহলে, স্যার, আমার পুরনো বন্ধু, যিনি এক সময় আমার সহকর্মী ছিলেন- জনাব এ কে ফজলুল হক এই বৃদ্ধ বয়সে অনেক পালটে গেছেন।

জনাব এ কে ফজলুল হকঃ আপনি আমার বয়োজ্যেষ্ঠ।

শ্রী শ্রীস চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ জনাব ফজলুল হক সময় চাচ্ছেন। স্যার, ইনি হচ্ছেন তিনি যিনি ব্রিটিশদের ভারতের মাটি থেকে বিতাড়িত করার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময়ও দেন নি। আজ তিনি এটা বললেন যেখানে তিনি অবগত আছেন বিষয়টা কতটা গুরুতর। এখন চুপ করে থাকুন, তবেই এমন দিন আসবে যখন বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে তবে হয়তো সেটা শেষ প্রলয়ের পরে।

এখন, কে এই আন্দোলনটাকে গড়ে তুলেছেন, কে এর জন্যে দায়ী? ১৯৪৮ এ একবার আন্দোলন হয়েছিল। এরপরে বাংলায় আর কোন আন্দোলন হয় নি। ভাষণটার আগ পর্যন্ত – অনেকে বলতে পারে আমি ভুল উক্তি করছি কিন্তু একজন হোমরা চোমরা ব্যক্তি তাঁর ভাষণে বলে গেছেন উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোন ভাষা নয়। আমি সেখানে ছিলাম না, কিন্তু এই ভাষণটার জন্যই  জল গড়ানো শুরু করে এবং সকল মুসলিম ছাত্ররা তখন একত্রিত হতে শুরু করে। ফজলুল হক হল আর সলিমুল্লাহ হলের ছাত্ররা এগিয়ে আসে আর আন্দোলনের সূচনা হয়।  এটাও বলা হয় যে, ২১ ফেব্রুয়ারির আরো আগে থেকেই তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। এটা যদি তাদের জানা থাকত যে তারা ভাষার জন্য আন্দোলন চালাচ্ছে তবে কেন জনাব নূরুল আমীন ২২ তারিখ রাতে সংসদে প্রস্তাব উত্থাপন করতে ছুটে এলেন? তিনি এই প্রস্তাবনাটি ২০ তারিখে তুললেই সমগ্র আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ত। এই আন্দোলনে কোন প্রভাবকই বিস্তৃত হতে পারত না…

রাষ্ট্রপতিঃ জনাব চট্টোপাধ্যায়, এটা আমাদের সামনে এখন আলোচ্য নয়। আপনি সমাধান এবং সংশোধনের সাপেক্ষে বলতে পারেন।

শ্রী শ্রীস চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ আমি এই সংশোধনের বিষয়েই আছি। আমি এই সংশোধনীর বেশ কিছু বাক্যের সাথে একমত নই,“এখানে এখনি কোন তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নেবার দরকার নেই” – আমি এটার সাথে একমত নই। আমার মতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এরই মধ্যে পূর্ব বাংলার মানুষ রেগে গেছে। সুতরাং, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বিষয়টার সুরাহা করাতে অন্ততঃ পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য মঙ্গল, সেটা যে পক্ষেই হোক না কেন।

এই ক্ষেত্রে তারা আন্দোলনে ফিরে আসবে না এবং তারা পূর্ব পাকিস্থানের সরকারকে কোনরকম নিরাপত্তা আইন বা অন্যান্য আইন প্রয়োগ করে জনসাধারণকে ভয় দেখানোর সুযোগ দিবে না এবং তরুন ও বালকদের প্রতি বন্দুকবাজ দল প্রেরণ করার তাদের জন্য জরুরি নয়, এটা করা তাদের জন্য ভুল হবে। কিন্তু এটা যদি এইভাবে মুলতবি হয়ে থাকে কোনরকম চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছাড়া তবে এটা একটি নতুন আন্দোলনের কারন হয়ে দাঁড়াবে এবং বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলা পূর্ব পাকিস্থানের জনগনকে থামানো যাবে না। আমি এই ভয়ই পাচ্ছি।আবার তারা বলবে যে এটা হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। আমার ধারণা এই ক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র কাজ হবে কিছু সময়ের জন্য ঢাকা শহর ছেড়ে যাওয়া যেন কেউ না বলতে পারে এইসব হিন্দুরা করছে। হিন্দুরা এ আন্দোলনে যোগ দেয়নি এবং ভবিষ্যতেও ভাষা সম্পর্কিত যেকোন আন্দোলন থেকে দূরে থাকবে। আমরা এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে চাই না। আমরা এই বাসভবনের বাইরে বাংলা ভাষা নিয়ে কোন আন্দোলন করবো না। এই বাসভবন আমাদের একমাত্র বিচারালয়। আমরা প্রস্তাব উত্থাপন করেছি এবং এখানেই এই বিষয়ে সমর্থন দিয়েছি এবং পূর্বেও এই বাসভবনে বাঙ্গালীদের জন্য আন্দোলন করেছি; এবং এখানেই এটি সমাপ্ত হয়েছে। আমরা আন্দোলন করতে বাইরে যাই না। বাংলা ভাষার পক্ষে অনেক কিছু শুরু হয়েছে এবং বলা হয়েছে। এই সংযোগে পূর্ব পাকিস্থানের ১২ জন মুসলমান একটি বিবৃতি জারি করেছে, তাদের মধ্যে একজন আজাদের সম্পাদক, যেটির মালিক, আমার বন্ধু, মাওলানা আকরাম খান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার এই দাবি তীব্রভাবে সমর্থন করছে…. ….

আমি আশা করছিলাম তার এ সংকল্পের সমর্থনে আন্দোলনকারীরা কিছু বলবে। আমি আশা করেছিলাম আমাদের বাসভবনের পূর্ব পাকিস্থানের কিছু মুসলিম সদস্যপ্রকাশ করবে যেসমর্থন করছে নাকি বর্জন করছে। জনগনকে নীরব রেখে এটাই বোঝানো হয় যে তারা বাংলা ভাষাকে সমর্থন করছে না। যার ফলে, পূর্ব পাকিস্থানের জনগন ভুল পথে চালিত হবে।

সম্মানিত জনাব নুরুল আমিনঃ আইনসভার বিরোধিতার প্রধাণ জনাব চট্টোপাধ্যায়ের প্রস্তাবিত ভুল বিবৃতি সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই।

(বিরাম)

আমি বুঝি যে উনি গণপরিষদের প্রধাণ যেটাতে উনাকে আইনসভার প্রধান হওয়া অপেক্ষা বেশি দায়িত্ব বর্তায়। যখন আমি শুনলাম উনার মুখ থেকে এরূপ বিবৃতি প্রকাশ পাচ্ছে-মিথ্যা বিবরণ, ভুল বিবৃতি- আমি ভাবলাম কেবল মাত্র বাংলা ভাষাই উনার মধ্যে ভারসাম্য হ্রাসের সৃষ্টি করেনি বরং এটা অন্য কিছু যেটা তার মাথায় আছে এবং তা বাসভবনের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এটা একটা বিল যেটা সরিয়ে নেওয়া হবে পূর্ব বাংলার আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতির বিবেচনায় যেটা পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর উপর ভিত্তি করে হবে। আমার ক্ষেত্রে, আমি কথা বলি না কেননা যে সংশোধনী সম্মানিত সদস্য জনাব আব্দুস সাত্তারের দ্বারা তৈরি হয়েছিলোসেটা প্রাদেশিক আইনসভায় আমার দ্বারা প্রস্তাবিত সমাধান বা পূর্ব পাকিস্থানের আমার কোন সম্মানিত বন্ধুর উত্থাপিত প্রস্তাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না। কিন্তু আমার কথা না বলার পেছনে আরো একটি কারন আছে। আমি দেখতে চাই, আমার অধিকারে হস্তক্ষেপ করা সম্মানিত সদস্যরা আমাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার জন্য কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে; বিতর্ক কি হবে, প্ররোচনা কি হবে, আমাদের অনুভূতিসমূহের আপিল কি হবে, কিসে তারা অংশ-কর্তা হবে, কিসের মাধ্যমে তারা বিভাজন সৃষ্টি করবে। এই আশায় যে আমি তাদের ভালো করে প্রকাশ করায় সমর্থ হয়েছি। এটা পূর্ব বাংলার মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রত্যাখ্যান নয়;

এটা পুর্ব পাকিস্তানের মানুষের ইচ্ছাকে অস্বীকার করা নয়, এটা প্রশ্নটাকে ধামাচাপা দেওয়াও ছিল না বরং এটা ছিল খুবই সুন্দর একটা প্রস্তাবনা যার মাধ্যমে একটি ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।পুর্ব বাঙলায় বাংলা ভাষার জন্য একটি দাবি উঠেছে, সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নাই। বাংলার জনগণ এটাও চায় যে, এইদিকের জনগন-তাদের এই পাশের ভাইয়েরা তাদের অনুভুতি, যুক্তি, এবং ন্যায্যতা সম্পর্কে জানবে এবং অবগত হবে। সুতরাং স্যার, আমার মনে হয় এই স্থগিতকরন ভাল কিছুর জন্যই এবং আমার সন্মানিত বিরোধী বন্ধু যেরকম বলছেন সেরকম খারাপ কোন কিছুর জন্য নয়। এরা প্রত্যেকে এমনভাবে কথা বলেছেন যেন এরাই বাংলা ভাষার একমাত্র সমর্থক, বাংলা এদের বাপ দাদার ভাষা, এবং পুর্ব বাংলার মুসলমানদের বাংলা ভাষার ওপর কোন অধিকার নেই এবং এই ভাষার প্রতি তাদের কোন ভালোবাসা নেই। এটা একচেটিয়া তাদের নয়। কিছু বিষয়ে তারা বিশ্বের কাছে এটা নিয়ে দম্ভ করে যে, এই ব্যাপার গুলোতে তাদের একচেটিয়া অধিকার-একটি গণতান্ত্রিক দেশে অধিকার রক্ষার বিষয়্যে, জনগণকে অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে, জনগণকে বাকস্বাধীনতা দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং আরো কিছু। কিন্তু তাদের এটা বোঝা উচিত যে আমরা যারা এখানে বসে আছি, যাদের ওপর দেশের প্রশাসন চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা তাদের থেকে বেশি দায়িত্ববান।

(বিরতি)

স্যার, পুর্ব বাংলার সমাবেশ যেটাতে বিরোধীদলীয় নেতাসহ এদিকের বিভিন্ন সন্মানিত সদস্যদের পাঠানো হয়েছে আমার সেখানে স্থানান্তর হওয়ার রেজল্যুশন যা ছিল। এটা খুবই সাধারন রেজল্যুশনঃ

            “এই রেজল্যুশন পরিবর্তনের কারন হল, জনগণের সদস্যদের একটি অংশের মনে বেশ বড় একটি সন্দেহ আছে যে, গতকাল সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তা বাঙ্গালি ছাত্রদের বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা গুলোর একটি করার দাবির ভিত্তিতে নিয়েছিল। বিষয়টা বিভ্রান্তিকর হয়েছে কারন যতদূর এই দাবিটির প্রশ্ন আসে, ছাত্ররা দুইটি উপলক্ষে দুইটি শান্তিপুর্ন মিছিল বের করে এবং সরকার কোন হস্তক্ষেপ করেনি।”

            ওটাই ছিল সেই ঘটনা যেটাতে এই রেজল্যুশন পরিবর্তিত হয়েছিল।এর প্রতিক্রিয়ায় সেখানে সেই সমাবেশের একজন সদস্য-বেগম আনোয়ারা খাতুন একটি সংশোধনী ছিল।

            “যে পাকিস্তানের পরবর্তী গণপরিষদে এই বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।”

            এই ছিল সংশোধনী এবং আমার উত্তর ছিলঃ

            “বেগম আনোয়ারা খাতুনের সংশধোনী থেকে আমি এটাও বুঝতে পারি যে এটা গ্রহন যোগ্য নয় কারন বিষিয়টি গণপরিষদের পরবর্তী অধিবেশনে উত্থাপিত হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যক্তি, কতৃপক্ষ আমরা নই।”

            সুতরাং এই সংশোধনীটি অসমর্থিত হল। এটা গৃহীত হয়নি। সুতরাং আমি এই রেজল্যুশন দ্বারা যা বোঝাচ্ছি এবং আমি এখনও তা মনে করি যে- এই রেজল্যুশনটি যথাযথ কর্তৃপক্ষ, গণপরিষদের সভাপতি যিনি গণপরিষদের এই সকল বিষয় পরিচালনা সংক্রান্ত নিয়্মানুযায়ী বিষয়টি তদারক করবেন তার কাছে কাছে পাঠানো উচিত এবং এটা রাষ্ট্রপতির নিকট পাঠানো হয়েছে। আমি জানিনা সেটার কি হবে কিন্তু বিষয়টি যখন এই পরিষদের কাছে সময় মত পৌছেছে, আমি অবশ্যই পুর্ব বাংলার বিধান সভাকর্তৃক পাশ হওয়া রেজল্যুশনের কথা বলব।

এটা প্রকৃত সময় নয়। এই বিষয়টা উপস্থাপিত হয়েছিল সাংবিধানিক জোটের আগে,কারণ সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এই জোটের কিছু সদস্যা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল এবং এখানে একটা এই প্রস্তাবের সংশোধনী ছিল। এবং আমি দেখিনা কিভাবে সংশোধনীটা যেকোন একটি দৃঢ়চিত্ততার পরস্পরবিরোধী হয় যেখানে প্রস্তাবিত করা হয়েছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। তাই দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা ভাষার এই প্রশ্নটি ঝুলে ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে পূর্ব বাংলার দাবির বিরুপ সিদ্ধান্ত হয়নি। আমি এর মধ্যে কোন আশঙ্কা দেখিনা। বরঞ্চ এ থেকেই কোন উত্তম ফলাফল আসবে বলে আমি মনে আশাবাদী। কিন্তু এই জোটের কিছু সদস্য আছে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে খেতে চায়। যখনই তারা হঠাৎ করে যে কোন সুযোগ পেয়ে যায় এবং এটি তার মধ্যে একটি।

স্যার! আমি এই ব্যাপারে নিশ্চিত করছি। স্যার! সেখানে বিভাজন পূর্ব বাংলার পরিষদের। আমি এখন পূর্ববাংলার আইনী পরিষদ এর বিভাজন এবং এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ঘোষণা করছি। সুতরাং প্রশ্ন সেটা নয় যে কেন আমি এই সমাধানের কোন পদক্ষেপ নিচ্ছিনা। এখানে বিরোধী পার্টির সম্মানিত নেতা কর্তৃক একটি উদ্দেশ্য আরোপিত হয়েছে। সুতরাং সেই দিক থেকে ভদ্রলোকের এই বক্তব্যের পরে আমাদের লোকজনের মধ্যে যে চাওয়া-পাওয়া সৃষ্টি হয়েছে সে ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়। আমি সেই দফাগুলো বলবোনা যা সেই আসন থেকে সর্দার শওকত হায়াত খান উত্তাপিত করেছিল।কারণ আমি জানি তার দল একটি ছোট দল। সে আমার বন্ধু জনাব চট্টোপাধ্যায়ের অনুকুলে থাকবে।

জনাব রাষ্ট্রপতিঃ আমি এই সংশোধনীর উপর ভোট করছি।

প্রশ্ন হলো যেঃ প্রকৃত প্রসাবের জন্য খারিজ অনুসারে হবে- “সে পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে এখনো কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন তৎক্ষণাৎ গ্রুরুত্বও নেই। আরো এটা সমাধান হবে যে জোট দ্বারা প্রশ্ন ঠিক করতে হবে যখন নির্দিষ্ট সময়ের আগে এটি ঘোষিত হয়।

(তারপর জোট ভেঙে যায়)

(হ্যাঁ-৪১)

১. জনাব আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ

২. মাওলানা মোঃ আব্দুল্লাহ-আল-বাকী

৩. মাওলানা মোঃ একরাম খান

৪. মাননীয় জনাব আজিজুদ্দীন আহমেদ

৫. মাওলানা ইব্রাহীম খান

৬. মাননীয় জনাব ফজলুর রহমান

৭. জনাব গিয়াস উদ্দীন পাঠান

৮. জনাব শাহাদুল হক।

৯. মাননীয় ড. ইসতিয়াক হোসাইন কোরাঈশী।

১০. মাননীয় জনাব মফিজুদ্দীন আহমেদ।

১১. মাননীয় ডঃ মাহমুদ হুসেন.

১২. মাননীয়া ডঃএ এম মালিক.

১৩. মাননীয় জনাব মো. হাবিবুল্লাহ বাহার

১৪. জনাব নূর আহমেদ.

১৫. মাননীয় জনাব নুরুল আমিন.

১৬. মাননীয়া খাজা নাজিমুদ্দিন.

১৭. জনাব আসাদুল্লাহ.

১৮. এইচ. ই  খাজা শাহাবুদ্দীন.

১৯. মাননীয় জনাব আবদুল হামিদ.

২০. সৈয়দ এ বি এম হোসেন.

২১. শ্রী ধনঞ্জয় রায়.

২২. জনাব অক্ষয় কুমার দাস.

২৩. জনাব আবদুল মোনেম খান.

২৪. জনাব চৌধুরী জহিরুদ্দিন মোয়াজ্জাম হোসেন (লাল মিয়াঁ).

২৫. এইচ.ই মালিক মোঃ ফিরোজ খান নুন.

২৬. মাননীয় জনাব মোহাম্মদ আলী.

২৭. মাননীয় স্যার মুহম্মদ জাফরুল্লাহ খান

২৮. মাননীয়া সরদার আবদুর রব খান নিশতার

২৯. খান IftlHv.r Hnrain VH, এন nfMnmHnt

৩০. সৈয়দ খলিলুর রহমান.

৩১. সরদার আমির আজম খান.

৩২. শায়খ সাদিক হাসান.

৩৩. সৈয়দ গোলাম ভিক নৈরাং

৩৪. মালিক শওকত আলী.

৩৫. মাননীয় এবং পীরজাদা আব্দুস সাত্তার আবদুর রহমান.

৩৬. জনাব এম এইচ গজদার

৩৭. জনাব এম এ খুহরো

৩৮. জনাব এম এইচ কিজিলবাশ

৩৯. মাননীয় জনাব মুশতাক আহমদ গুরমানি

৪০. জনাব পি ডি ভান্দ্রা.

৪১. জনাব আহমেদ ই এইচ জাফর

না-১২

১. জনাব প্রেম হরি বর্ম.

২.সিধীর চন্দ্র নাথ দত্ত

৩. শ্রী কামিনী কুমার দত্ত

৪. প্রফেসর রাজকুমার চক্রভেনি

৫. শ্রী শ্রীসচন্দ্র  চট্টোপাধ্যায়

৬. জনাব ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত

৭. জনাব যুনেন্দ্রচন্দ্র মজুমদার.

৮. জনাব বিরাট চন্দ্র মন্ডল.

৯. জনাব ভবেশ  চন্দ্র নন্দী.

১০. সরদার শওকত হায়াত  খান.

১১. সরদার আসাদুল্লাহ জান খান

১২. শেঠ সুখদেব

প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে

জনাব রাষ্ট্রপতিঃ ভাষা সংক্রান্ত সকল প্রস্তাব গৃহীত হল

সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা ২৭শে এপ্রিল, ১৯৫২ সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ-সম্মেলন বার এসোসিয়েসন হল, ঢাকা ২৭শে এপ্রিল, ১৯৫২ সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খানের ভাষণ বন্ধুগণ, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবী করার অপরাধে পূবর্ব পাকিস্তানে যে বিপর্যয় ও বিভীষিকার ঝড় বয়ে গেল তার একটা মোটামোটি ইতিহাস আপনাদের সামনে পেশ করতে চাই। উনিশ শ আটচল্লিশ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রথম উৎপত্তি, ছাত্রসমাজের উপর মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতন ও আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন এবং শেষ পর্যন্ত তখনকার পূবর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, খাজা নাজিমউদ্দীনের চুক্তিপত্র স্বাক্ষর- সবই আপনারা জানেন। আপনারা এও জানেন যে, উক্ত চুক্তির শৰ্ত্ত কখনও কার্যকরী করার চেষ্টা হয়নি, পক্ষান্তরে আরবী হরফে বাংলা ভাষা প্রচলনের এক উদ্ভট পরিকল্পনা তারপর চার বছর কেটে গেলো। রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে সবাই একরকম চুপচাপ। ঠিক এমনি সময় একদা জানুয়ারী শেষ ভাগে খাজা নাজিমউদ্দীন সাহেব, ঢাকার জনসভায় উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বলে ঘোষণা করে বসলেন। বারুদে আগুন লাগলো। সাড়ে চার কোটি মানুষের দাবীকে উড়িয়ে দিয়ে, নিজের প্রতিশ্রুতি ও চুক্তি ভঙ্গ করে নাজিমউদ্দীন সাহেব যখন এই ঘোষণা করলেন, তখন সারা পূবর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ বিস্ময়ে স্তম্ভিত ও হতবাক হয়ে পড়লো। চারদিক থেকে তীব্র প্রতিবাদের রোল পাকিস্তানের আকাশেবাতাসে ধ্বনিত হলো। তারপর তিরিশে জানুয়ারী তারিখে ছাত্র ও জনসাধারণের বিরাট মিছিল, জনসভা, একত্রিশ তারিখে মৌলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সবর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন এবং চৌঠা ফেব্রুয়ারী তারিখে শহরে হরতাল পালন ও স্কুল-কলেজ বন্ধ, এসব পর পর হয়ে গেলো। কর্মপরিষদের এক সভাতে একুশে ফেব্রুয়ারী তারিখে দেশব্যাপী হরতাল, শোভাযাত্রা সভাসমিতি করার প্রস্তাব ঘোষণা করা হলো। এগারো, বারো ও তেরো তারিখে কর্মপরিষদের সদস্যদের সাথে আলোচনা করার জন্যে দিন, তারিখ ও স্থান ধার্য করার অনুরোধ জানিয়ে এক চিঠি দেওয়া হয়। সে চিঠির জবাব অবশ্য কোনদিনই পাওয়া যায়নি। হঠাৎ বিশে ফেব্রুয়ারী অপরাহ্নে ঢাকার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট একশ চুয়াল্লিশ ধারা ঘোষণা করে শোভাযাত্রা ও সভাসমিতি বন্ধ করার আদেশ দেন। বিনা মেঘে বজ্রপাত। এর আগে আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্র ও জনসাধারণ সৃশুঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে সভা, হরতাল ও মিছিল চালিয়ে গেছে- নিষেধাজ্ঞা জারী করার কোন

প্রয়োজন কোনকালেও হয়নি। ছাত্র ও জনসাধারণ এই হঠকারিতায় ভয়ানক বিক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু কর্মপরিষদ সভা আহবান করে তৎক্ষণাৎ ঘোষণা করে যে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন করা হবে, কিন্তু নিষেধাজ্ঞার দরুন সভা ও শোভাযাত্রা বন্ধ রাখা হবে। একুশে তারিখের মৰ্ম্মম্ভদ ও শোকাবহ ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি করে আপনাদের মনে কষ্ট দিতে চাই না। ঐদিন পর ইতস্তত গমনরত ছাত্রদের উপরে লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ, দলে দলে ছাত্রদের গ্রেফতার এবং শেষ পর্যন্ত মেডিকেল ছাত্রাবাসের ভেতর অনধিকার প্রবেশ করে নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর বেপরোয়া গুলী চালনা ও মৃত্যুর ঘটান এবং অসংখ্য ছাত্র জখম-এ দৃশ্য কারবালার দৃশ্যকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। সভ্য জগতে এর দৃষ্টান্ত বিরল। সারা শহরের প্রত্যেকটি নর-নারীর মনে শোকের ছাড়া পড়ে গেলো। এই নিৰ্ম্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রত্যেকটি নাগরিক প্রতিবাদ করে উঠলো। পরদিন সারা শহরে শোকাৰ্ত্ত মিছিল; বিক্ষুব্ধ জনতার তীব্র নিন্দা শহরের প্রতি কোণে ধ্বনিত হলো। এই দিনও পুলিশ গুলী চালিয়ে কতিপয় লোকের মৃত্যু ঘটায় ও অনেকগুলি লোককে জখম করে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শহরে কয়দিন “সরকার” ছিল বলে মনে হয় না। একুশে বাইশের ঘটনা যারা দেখেছেন তাঁরাও একথা মনে করেছেন যে কোন সুসভ্য ও গণতান্ত্রিক সরকার তখন ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ছিল না, কারণ নিরস্ত্র, শান্তিপ্রিয় ও সুশৃঙ্খল তরুণ সরলপ্রাণ ছাত্রদের উপর কোন সরকার কোন অবস্থায়ই গুলী চালাতে পারে একথা চোখে দেখলেও অনেকে বিশ্বাস করতে রাজী হবেন না। এত বড় অন্যায় কাজ করার ফলে সরকারের আসন টলমল করে উঠলো। চারদিক থেকে মন্ত্রিমণ্ডলীর গদী ছাড়ার দাবী তীব্রভাবে জানানো হতে লাগলো। মন্ত্রী সমর্থক সদস্যরাও পদে ইস্তফা দিতে কৃতসঙ্কল্প হলেন। এটা পরিস্কার বুঝা গেল যে এই মন্ত্রিত্ব আর একদিনও টিকে থাকতে পারছে না। ঠিক এমনি সময়ে পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। মন্ত্রিমণ্ডলী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন- চাকরি রয়ে গেলো। এর আগেই বেগতিক দেখে নুরুল আমিন সাহেব রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে একটি সোপারেশ প্রস্তাব পরিষদে পাশ করিয়ে নিয়ে জানিয়ে দিলেন যে এর পর আন্দোলনের আর কোন দরকার নেই। বশংবদ পত্রিকাগুলিও সুরে সুর মিলিয়ে গাইতে লাগলো। পরবর্তীকালের ঘটনাবলী পরিষ্কাররূপে প্রমাণ করেছে যে আন্দোলনের কত প্রয়োজন ছিল এবং আছে সরকারের ঘোষণা ও মিষ্টিবুলি কত মারাত্মক ধোঁকাবাজী। সরকার কিন্তু নিৰ্ম্মম হত্যাকাণ্ডের কোন কৈফিয়ৎই দিবার চেষ্টা করেন নি। পক্ষান্তরে মন্ত্রীত্বের সিংহাসন অবৈধ উপায়ে নিরাপদ করতে দমন নীতির আশ্রয় গ্রহণ করলেন। নানা প্রকারের কুয়াশার জাল সৃষ্টি থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে বানচাল করে দেওয়ার জন্য নিতান্ত জঘন্য মিথ্যা প্রচার আরম্ভ করে দিলেন। প্রথম থেকে বাঙালী-অবাঙালী বিরোধ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টাও চলছিল, কিন্তু সে চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। গোটা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কমু্যনিষ্ট রাষ্ট্রদোহী ও বিদেশী দালালদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল এবং তারাই ছাত্রদের উস্কানি দিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিয়েছে, রাজনৈতিক সুবিধাবাদীরা এর সাথে হাত মিলিয়ে সহায়তা করেছে, ফলে গোটা রাষ্ট্রটাই বিপন্ন হয়ে পড়েছিলো- এই সব প্রচার করে লক্ষ লক্ষ ইস্তাহার হাওয়াই জাহাজে দেশময় ছড়িয়ে সরকার দেশে একটা ভীষণ আতঙ্কের সৃষ্টি করে তোলেন। মুসলিম লীগও সময় বুঝে ঠিক ঐ মৰ্ম্মে প্রস্তাব পাশ করে দেশবাসীকে সাবধান করে দেন, যেন কেউ এসব আন্দোলনে যোগ না দেন। সঙ্গে সঙ্গে ধরপাকড় আরম্ভ হয়ে যায়। ছাত্র, যুব কর্মী, পরিষদের সদস্য, বিরোধী দলের নেতা ও কর্মী, এবং কতিপয় অধ্যাপককে জেলে ঢোকানো হলো। সলিমুল্লা মুসলিম হলে হামলা করে অনেকগুলি ছেলেকে ধরে আনা হলো। শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যে ছাত্রবন্ধুগণ মেডিকেল কলেজ হোষ্টেলে যে স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুলেছিলেন সরকার তা নিৰ্ম্মমভাবে ধূলিসাৎ করেন। ববর্বরতার এমন নজির কোথায়ও মিলে না।

সারা দেশের লোক আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। মুখ ফুটে কথা কইবার জো নেই। বশংবদ সংবাদপত্রগুলি আন্দোলনের কথা, কৰ্ম্ম পরিষদের বিবৃতি ইত্যাদি সব ছাপানো বন্ধ করে দিলো। তাদেরও নাকি টুটি টিপে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু নাজিমউদ্দীন সাহেবের শ্যালক খাজা নুরুদ্দীন সাহেবের মনিং নিউজ শুরু থেকেই জঘন্য প্রচারণা শুরু করে। দেশের যুবক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়, শহরের সর্দার সবাইকে রাষ্ট্রদ্রোহী, গুণ্ডা ইত্যাদি আখ্যা দিনের পর দিন দিয়ে যেতে লাগলো-এখানো দিচ্ছে। সারা দেশ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও সরকার এর কোন প্রতিকার করেন নি। পক্ষান্তরে সরকার মর্নিং নিউজের গল্পই বিশ্বাস করে তদনুযায়ী দমন নীতি চালিয়ে যান। এই পত্রিকাটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ, অধ্যাপক, ছাত্র সবাইকে ষড়যন্ত্রকারী, রাষ্ট্রদ্রোহী বলে অতি জঘন্য ভাষায় গালি দেয়। সরকারও তা সমর্থন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরুদ্ধে এরূপ মিথ্যা অভিযোগের নজির ইতিহাসে আর নেই। কোথায় কোন বিদেশী পত্রিকা কি বলেছে, কোথায় কোন সিপাহীকে কে বা কাহারা নিহত করেছে, তার বিচার না করে, দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের উপর। একথাও বলা হয়েছে যে নারায়ণগঞ্জেও জয়হিন্দ’ ও যুক্ত বাংলার ধ্বনিও কেউ কেউ করেছিল। আজ কিন্তু এ কথা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেছে যে এই সব অভিযোগ, কটাক্ষ, দৃষ্টান্ত, মিথ্যা ও বানোয়াট এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে গলাটিপে মারার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। এতো প্রচার সত্ত্বেও কয়েকটি সরকারী ধামাধরা কর্মচারী আর মুসলিম লীগের কোন কোন সভ্য ছাড়া পূবর্ব পাকিস্তানের কোন ব্যক্তিই এসব কথা বিশ্বাস করতে পারেনি। গণপরিষদের দু’একজন সদস্য পরিষ্কার বলেছেন যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকার ও মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যারা বাস্তবিক পক্ষে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চালিয়ে গেল তারা কোনদিন কমু্যনিষ্ট, রাষ্ট্রদ্রোহী বা বিদেশী দালালদের অস্তিত্ব ভিতরে বাইরে কোথায়ও খুঁজে পায়নি। সরকারও আজ পর্যন্ত একটি রাষ্ট্রদ্রোহীকে গ্রেফতার করে তাদের বহু উচ্চারিত ভাষণের পোষকতা করতে পারেননি। বিদেশী সাহয্যের কোন দলিল বা প্রমাণ আজ পর্যন্ত লোকসমক্ষে ধরতে পারেননি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তি পাহারারত কোন সিপাহীর হত্যার ব্যাপারে জড়িত হতে পারে এ কথা কোন বুদ্ধি ও বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি বিশ্বাস করতে পারে না। পাকিস্তানের বুকে দাঁড়িয়ে “জয় হিন্দ” বা “যুক্ত বাংলা” ধ্বনি উচ্চারণ করার মত দুঃসাহস কারো হতে পারে এ কথা কোন পাগলও বিশ্বাস করতে রাজী হবে না। অথচ নুরুল আমিন সাহেব ও তাঁর মুরবিব নাজিমউদদীন সাহেব অম্লান বদনে তা শুধু বিশ্বাসই করেননি, পরিষদ ভবনে ঐ মৰ্ম্মে বিবৃতিও দিয়েছেন। হলফ করে বলা যেতে পারে যে, তাঁরাও এ কথা অন্তরে বিশ্বাস করেন না কিন্তু ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে জনগণের মনে ঘৃণা সৃষ্টি করার জন্য তাঁরা নিজেরাই এ সমস্ত গল্প সৃষ্টি করে বারবার প্রচার করছেন- এটা তাঁদের স্বভাব। তাঁরা যেন বোঝাতে চান যে, গোটা পাকিস্তানটাই মূর্থের আবাসভূমি আর তাঁরা এবং তাঁদের কুক্ষিগত মুসলিম লীগ সমস্ত জ্ঞানের একমাত্র অধিকারী। নিৰ্ম্মম দমন নীতির মুখেও আজ পূবর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি নর-নারীর মুখে এই ধ্বনিই স্পদিত হচ্ছে যে, মুসলিম লীগ ও তার সরকার কোনদিনই জনগণের কোন দাবী মেটাতে পারেনি ও পারবে না। চিরদিন যারা মিথ্যার বেসাতি করে এসেছে তাদের কাছে জনগণ কিছুই আশা করতে পারে না-করেও না। সেদিন পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষার দরদীগণ যে নির্লজ্জ প্রহসনের পালা সাঙ্গ করলেন তার কালিমা ইতিহাসের পাতা হতে কোনদিনই মুছে যাবে না। সমগ্র জাতির ইতিহাস কলঙ্কিত হয়ে রইলো। যাঁরা বাং ভাষাকে ভালোবাসার ভান করে পরিষদের সোপারিশ প্রস্তাব পাশ করে জনগণকে আন্দোলন হতে বিরত থাকার কালের জন্য চাপা রইলো। সমস্যাটি জরুরী নয়- পূবর্ব বাংলার তরুণ-প্রাণ মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আত্মাহুতি দিয়েও সমস্যাটিকে জরুরী প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। ইসলাম ও পাকিস্তানের নামে মুসলিম সংহতির নামে আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তারা সমস্যার মোকাবেলা না করে ধামাচাপা দেবার সহজ পথই বেছে নিলেন।

  পূবর্ব বাংলার প্রতিটি নাগরিক বুঝতে পারলো এ সমস্যার সমাধান তারা কখনও করবে না। এদিকে মুসলিম লীগের পাণ্ডারা কেউ কেউ দেশে ফিরে এসে এর কৈফিয়ৎ দিতে গিয়ে নতুন নতুন ভাঁওতা সৃষ্টি করলেন; জনসাধারণের ন্যায্য ও পবিত্র দাবী দাবিয়ে রাখার অপরাধের সাফাই গাইতে হবে ত! পূবর্ব পাকিস্তানের জনগণ আজ জাগ্রত। বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে তারা জগতকে দেখিয়ে দিয়েছে যে সমগ্র জাতির ন্যায্য দাবী কোন স্বৈরাচারী সরকারই কোন হিংস্র উপায় অবলম্বনে দমিয়ে রাখতে পারে না। জীবন দিয়ে যে জাতি তার দাবীর সত্যতা ও পবিত্রতা প্রমাণ করেছে সে দাবীকে অগ্রাহ্য করবার সাধ্যি কারো নেই। বন্ধুগণ, মুসলিম লীগ ও লীগ সরকারের কার্যাবলী আজ আয়নার মত আপনাদের চোখের সামনে-তার বিশ্লেষণ বা তফছিরের কোন প্রয়োজন নেই-বন্ধুবেশে এরা গত পাঁচ বছরে আমাদের জাতীয় জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে-প্রত্যেকটি সমস্যাকে ধামাচাপা দেবার জন্য এরা চিরদিন চেষ্টা করে এসেছে। এত বড় একটা স্বতঃস্ফূৰ্ত্ত আন্দোলনের ভিতরও ভাঙ্গন ধরাবার জন্য এরা নানা অলীক ও মিথ্যা অভিযোগ সৃষ্টি করেছে, দালাল লেলিয়ে দিয়েছে, মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সরকার ও মুসলীম লীগ জানে যে, পূবর্ব পাকিস্তানের জনগণ সমবেত কণ্ঠে তাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, তাই কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্যে তারা জনগণের বুকে দিয়েছে মারণ কামড়। যে উপায়ে হোক এ আন্দোলনকে দাবীয়ে দিতে পারলে-কিংবা অন্ততঃ ভাঙ্গন ধরাতে পারলেও তাদের খানিকটা লাভ। সেই লাভের আশায় তারা নতুন নতুন ফন্দী আবিষ্কার করে যাচ্ছেন। এদের অনেককে আমরা দেখেছি আন্দোলনের পুরোভাগে অংশগ্রহণ করে আন্দোলনকে বিপথগামী করার চেষ্টাও করেছেন। তা’ না পেরে শেষে পাততাড়ি গুটিয়ে উল্টা সুর গাইতে শুরু করেছেন। সবর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ দাবী জানিয়েছিল যে, সরকারের কার্য্যাবলী তদন্ত করার জন্য সরকারী ও বেসরকারী সদস্য দ্বারা গঠিত প্রকাশ্য তদন্ত কমিশন নিযুক্ত করা হোক। সে দাবী উপেক্ষা করে মাত্র একুশে তারিখের পুলিশের গুলীবর্ষণ আইনসঙ্গত হয়েছিল কিনা- এ ব্যাপারে তদন্ত করার জন্যে একটি গোপন তদন্ত কমিশন নিযুক্ত করা হয়েছে। বাইশে তারিখের ঘটনাবলী সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। একশ’ চুয়াল্লি ধারা জারি করার কোন আইনসঙ্গত কারণ ছিল কিনা সে সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হবে না। অথচ এই নিষেধাজ্ঞাই সমস্ত দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী। পূবর্ব পাকিস্তানের যেসব জায়গায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি সেখানে কোন গোলমালই ঘটেনি। সুতরাং কমিশন নিযুক্তির ব্যাপারেও সরকার যে জনগণকে ধোঁকা দিয়েছেন-তা স্পষ্ট বোঝা যায়। জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজের দিক দিয়ে তদন্তের কোন মূল্যই নেই। তাই রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ এতে যোগদান করেনি। কথা এখন মুসলিম লীগ ও লীগ সরকারকে নিয়ে নয়, কথা হচ্ছে এখন আমাদের নিয়ে। সরকার প্রচার করছে যে, মুসলিম লীগ ও সরকারের রোপিত বিষবৃক্ষ ফল দিতে আরম্ভ করেছে- জনসাধারণ দমে গিয়েছে, ছাত্র সমাজও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। বাংলা ভাষার দাবী মেটাবার ভার মুসলিম লীগ ও সরকার গ্রহণ করেছেকথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এত বড় একটা স্বতঃস্ফূৰ্ত্ত আন্দোলন কতকগুলি মিথ্যা ভাঁওতার চাপে দমে যাবে-যে জাতি জীবন দিতে শিখেছে সে জাতি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে-এরূপ কল্পনা করা অন্যায়। সাময়িক প্রতিক্রিয়া বিশ্বাসপ্রবণ সরল মনে কিছুটা কুয়াশা সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু তার অন্তরের অন্তঃস্তলে বাসা বাঁধতে পারে না। প্রয়োজন হলে সে আবার দাঁড়িয়ে উঠে, বুক ফুলিয়ে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার স্বরূপ প্রকাশ করতে পারে। বন্ধুগণ, জানি আপনাদের উপরও সরকারের আক্রোশ কম নয়-আপনারাও কম নির্যাতন ভোগ করেননিকিন্তু তা সত্ত্বেও যে আজ এখানে সমবেত হয়েছেন এতেই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে সরকারের বুজরগী ব্যর্থ ও বিফল হয়ে গিয়েছে। তারাই যে পাকিস্তান ও ইসলামের একমাত্র রক্ষক আর পূবর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের মনে পাকিস্তান ও ইসলামের জন্যে বিন্দুমাত্র দরদ নেই- এ কথা বলে যে দুর্বিষহ অপমানের ভার আমাদের ঘাড়ে

চাপিয়ে দেয়- তার প্রতিবাদের দিন এসেছে। আপনারা প্রমাণ করে দিন- যারা ইসলাম ও পাকিস্তানের একমাত্র জিম্মাদার বলে দাবী করে- তরা ভণ্ড। পাকিস্তানের অস্তিত্ব তাদের অনুগ্রহ-নিগ্রহের উপর নির্ভর করে নাপাকিস্তান বেঁচে থাকবে, আর তার কোটি কোটি বাসিন্দা নিজেদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে- তাদের অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস, শক্তি ও সামর্থ্যের জোরে। রাষ্ট্রভাষা সমস্যাই আমাদের একমাত্র সমস্যা নয়। বহু ছোট-বড় সমস্যা আমাদের জীবনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে- তারও সমাধানের প্রয়োজন। সমগ্র জাতিকে সংঘবদ্ধ করে এসব সমস্যার সমাধান আমাদের নিজেদেরকেই করতে হবে, কারণ রাষ্ট্র আমাদের। কিন্তু তার জন্যে চাই শৃঙ্খলা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতা। আপনারা শক্তি অর্জন করুন, প্রতিটি মানুষের প্রাণে দেশাত্মবোধ, জীবন ধারণের প্রয়োজন বোধ জাগিয়ে তুলুন। ঘরে ঘরে একই আওয়াজ তুলুন- “আমাদের দাবী মানতে হবে।” আমাদের সংগ্রাম এক দিনের নয়। যে প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব বৰ্ত্তমানে আমাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তারা সহজে কাবু হবার নয়-তাড়াহুড়া করে হৈচৈ করে বা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে আমাদের কাজ উদ্ধার হবে না দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামের নীতি অবলম্বন করে ধীরে ধীরে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে। হট্টগোল করে যেন এর গুরুত্ব আমরা নষ্ট না করি এদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ধীর বিচারবুদ্ধির একান্ত প্রয়োজন। আপনারা সারা পূবর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। সারা দেশ আপনাদের দিকে চেয়ে আছে। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থী আপনারা নির্ধারণ করুন। প্রত্যেক শহরে, মহকুমায়, থানায় গ্রামে কর্মপরিষদ গঠন করে তুলুন। -এই হবে আপনাদের আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায়। আর আওয়াজ তুলুন : রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বন্দীদের মুক্তি চাই।” পাকিস্তান জিন্দাবাদ

বাংলাভাষার পক্ষে ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের ইসলাম ভ্রাতৃসংঘ ঘোষণা ইসলাম, ভাষা সমস্যা ও আমরা ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের প্রচার দপ্ত ৬নং নয়া পল্টন, ঢাকা হইতে প্রকাশিত “আমাদের প্রেস’ ১৯নং আজিমপুর রোড হইতে মুদ্রিত। ২১শে ফেব্রুয়ারী পূর্ব পাকিস্তানের গণজাগরণের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় দিন। পূর্ব বাংলার সাড়ে চার কোটি অধিবাসী এইদিন দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেছে: বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই হবে। কিন্তু কেন এই দাবী? সাড়ে চার কোটি অধিবাসীর প্রাণের পরতে পরতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল কোন যুক্তির ভিত্তিতে? সে যুক্তি একটি নয়, দুটি নয়, অগণিত। ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ বিশ্বাস করে, জনসাধারণের সেই সব যুক্ত ইসলামের আলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রতিটি নাগরিকের দেহ এবং মনের সর্বাংগীণ বিকাশ ইসলামী রাষ্ট্রে সর্বপ্রধান লক্ষ্য। ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, মাতৃভাষার সাহায্য ছাড়া এ বিকাশ সাধন করা একেবারেই অসম্ভব। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে জাতীয় উন্নয়নের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে মাতৃভাষার উন্নতিসাধনের মধ্যদিয়ে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (দঃ) আবির্ভাবের সময় হিব্রু ভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী ভাষা হিসেবে পরিগণিত হতো; কিন্তু সাধারণ মানুষের বোধগম্য হওয়ার জন্যই অপেক্ষাকৃত সহজ ভাষা আরবীতে পবিত্র কোরান শরীফ নাজেল হয়। আরবীর পরিবর্তে সেদিন যদি অন্য কোন ভাষায় কোরান শরীফ নাজেল হতো তবে আরববাসীদের পক্ষে ইসলামের বাণী অতি অল্প সময়ে গ্রহণ করা সম্ভব হতো না। পূর্ব পাকিস্তানে সত্যিকার ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে ঠিক তেমনি করে মাতৃভাষার মাধ্যমে আজ ইসলামী সমাজবাদের বাণী পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষার মাধ্যমে এ চেষ্টা করার অর্থ হবে আমাদের অগ্রগতি ব্যাহত করা। ইংরেজ আমলে বাংলাদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন হিন্দুদের তুলনায় ঘোর পশ্চাৎপদ ছিল। এর একমাত্র কারণ, ইংরেজ বাংলায় শাসন-বিস্তারের সাথে সাথেই মুসলমানদের মধ্যে ভাষা-সংকট সৃষ্টি করে। রাজভাষা ফারাসীকে বিতাড়িত করে ইংরেজরা সেখানে নিয়ে এল ইংরেজী। সদ্য আজাদীহারা মুসলমানদের ইংরেজী ভাষার প্রতি অবহেলা এবং সর্বব্যাপী অসহযোগিতা ও অজ্ঞানতার সুযোগ

নিয়ে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজ স্বাভাবিকভাবেই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষা-সংস্কৃতিতে মুসলমান সম্প্রদায়কে অতিক্রম করে গেলেন। এদিকে মুসলমানদের অবস্থা কি? তাঁরা হয়ে রইলেন না ঘরকা না ঘটকা। বাংলাভাষাও ভাল করে চর্চা করলেন না, ইংরেজীকেও বয়কট করলেন। ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বিরাট মুসলিম জাতি অশিক্ষিত মৎসজীবীর পর্যায়ে নেমে আসতে বাধ্য হলেন। অন্যদিকে একদল “শেরিফ” সম্পূর্ণভাবে বাংলাভাষাকে বর্জন করবার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। একদিকে ইংরেজী বর্জন, অন্যদিকে “শেরিফ’ দের বাংলা বর্জন করে উর্দু প্রচলিত করার প্রচেষ্টায় যে বিপর্যয় দেখা দেয় তাতে সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। কিন্তু আস্তে আস্তে অবস্থার পরিবর্তন সূচিত হলো। বিশেষ করে গত ত্রিশ বছর ধরে এই অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষিত মুসলিম সমাজ ধীরে ধীরে মাতৃভাষার কদর বুঝতে শিখেছেন এবং ক্রমে ক্রমে বাংলা সাহিত্যের সাধনায় মুসলমানদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ নিশ্চিত পথে অগ্রসর হচ্ছিল। বাংলা-ভাষাভিত্তিক একটি মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজও বাংলাদেশে গড়ে উঠল। সরকারী চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কৃষি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই বাংগালী মুসলমানের ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করা গেল এবং বলাই বাহুল্য, এই নবগঠিত মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-সভ্যতার বাহন হল বাংলা-উর্দু বা ইংরাজী নয়। এরপর এল দেশ বিভাগ। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এদেশের সাড়ে চার কোটি জনসাধারণ আশা করে যে, স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সাথে সাথে বাংলা ভাষার মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানের উন্নয়ন আরও ব্যাপক ও সর্বাত্মক হয়ে উঠবে। যে ভাষার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই একটি মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছে, সেই ভাষাকে কেন্দ্র করেই পূর্ব পাকিস্তানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন চলবে, এটা অত্যন্ত ন্যায়সংগত ও স্বাভাবিক কথা; কিন্তু এখানেও একটা সংকটের সৃষ্টি করা হয়েছে। ইংরেজ সরকার বাংলাদেশের শাসন হাতে নেবার সাথে সাথেই যেভাবে ভাষাসংকটের সৃষ্টি করে, এবারেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ইংরেজ ফারসী তাড়িয়ে আমদানী করেছিল ইংরেজী, এবার বাংলাকে হটিয়ে দিয়ে আমদানী করার কথা চলছে উর্দু। পৃথিবীর কোন দেশের ইতিহাসে বহিরাগত রাষ্ট্রভাষার স্থায়িত্বের নজীর নেই। ইরান ও তুরস্কের ইতিহাসে এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এই ভারত ও পাকিস্তানেও ইংরেজী শিখে বহু ভারতীয় যশের শিখরে আরোহণ করেছেন সত্যি কথা, কিন্তু ইংরেজ চলে যাবার সাথে সাথে ইংরেজী ভাষাকেও এদেশ থেকে পাততাড়ি গুটাতে হচ্ছে। তার স্থান দখল করতে যাচ্ছে ভারতে হিন্দী এবং পাকিস্তানে বাংলা ও উর্দু। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে একশ্রেণীর লোকের কাছে একটা সস্তা যুক্তি প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে এই যে, বাংলা সংস্কৃতি ভাষা থেকে উৎপন্ন ও হিন্দু সাহিত্যিকদের দ্বারা পরিপুষ্ট বলে এই ভাষা ইসলামী ভাবধারা প্রচারের উপযোগী নয়। যাঁরা এই যুক্তি দেখিয়ে থাকেন, তাঁদের জানা আছে (এবং না জানলে জানা উচিত) যে ভারত ও পাকিস্তানের প্রায় প্রত্যেকটি প্রধান ভাষা অল্পবিস্তর সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপন্ন। উর্দু ভাষায় অজস্র সংস্কৃত শব্দের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কারুর কোন সন্দেহ আছে কি? যদি না থাকে তাহলে কি উর্দু ভাষার জাত খোয়া গেছে বলতে হবে? আমাদের প্রশ্ন, পবিত্র কোরান শরীফ যে সময় অবর্তীণ হয়, সে সময় আরবী ভাষা কাদের ভাষা ছিল? পুতুল-পূজারী পৌত্তলিক নাসারাদের নয় কি? যদি তাই হয়, তাহলে আরবী ভাষাকে পবিত্র ভাষায় মর্যাদা দেওয়া হয় কেন? আসলে, ভাষা ভাবপ্রকাশের বাহন মাত্র। ভাব যদি সমৃদ্ধ হয় এবং ভাষা যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে যে কোন সমৃদ্ধ ভাবধারা যে কোন শক্তিশালী ভাষায় প্রকাশ করা চলবে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ ভাষা- এই ভাষায় যদি ইসলামী ভাবধারার প্রচার ও প্রসার ঘটা অসম্ভব হয়, তাহলে বুঝতে হবে, হয় বাংলা ভাষা দুর্বল, নয় ইসলামী ভাবধারারই দুর্বলতা রয়েছে; কিন্তু এ দুয়ের যে কোন একটি স্বীকার করে নেবার প্রগলভতা কারুর আছে কি?

ভাষাতেই নিরীশ্বরবাদী কমু্যনিষ্ট কাব্য সাহিত্যের প্রচার সম্ভব হচ্ছে কি করে? উর্দু ভাষা যদি এতই সাফ-সুতরা ও পাক-পবিত্র হবে, তাহলে সে ভাষায় কমু্যনিষ্ট সাহিত্য রচনা করা হচ্ছে কেন? বস্তুতঃ বাংলা ইসলামী ভাবধারা নিজস্ব আদর্শের দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল। পৃথিবীর যে কোন ভাষায় যে কোন যুগে সার্থক রূপায়ণ চলতে পারে। বাংলাভাষার ইতিহাস আলোচনা করলে এ সত্য পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। বাংলাভাষার প্রাথমিক বিস্তারের মূলে ছিলেন মুসলমান, হিন্দুরা নয়। তৎকালীন বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবী-ফারসী শব্দের অস্তিত্ব ছিল। নবাব হোসেন শাহের আমলে প্রধানতঃ মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সংস্কৃত-ঘেঁষা রূপ অতি অল্পদিনের ঘটনা। বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা ভাষা থেকে আরবী ফারসী শব্দের প্রায় বিলোপ সাধন করেন এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের উপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপ দেন। বলা বাহুল্য, বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত সাধন-ঘেষা বাংলা আজ হিন্দুসমাজও ব্যবহার করেন না। ভাব ও সংস্কৃতির বিবর্তনের সাথে সাথে বাংলা ভাষায়ও বিবর্তন এসেছে- এই বিবর্তনের মুখে কাজী নজরুল ইসলামের আরবী-ফারসী মধুর আমেজ দেওয়া কাব্য ও ছন্দের রাজা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের আরবী-ফারসী শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগবিশিষ্ট কবিতা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা পূর্ববাংলার মুসলমানদের মনোজগতে এক বিরাট ভাববিপ্লবের সৃষ্টি করেছে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি যদি না করা হয় এবং উপর থেকে কোন কিছু চাপিয়ে দেবার কোন চেষ্টা যদি না হয়, তাহলে বাংলা ভাষা উর্দু ভাষা থেকেও তার আহরণী-প্রতিভার পরিচয় দেবে, নিঃসেন্দেহে এ আশা আমরা করতে পারি। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবী করতে গিয়ে আমরা হীন প্রাদেশিকতার মনোভাবকে প্রশ্রয় দিচ্ছি না। আমরা বিশ্বাস করি, গোষ্ঠীগত ও দেশগত রূপ ছাড়াও প্রত্যেক মুসলমানের একটি বিশ্বজনীন রূপ আছে- প্রাদেশিকতার পঙ্কিলতায় নিমগ্ন হয়ে আমরা ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ দৃষ্টভংগীর পরিপোষকতা করার বিরোধী। সাথে সাথে একথাও বলে রাখা দরকার যে উর্দুকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে আমাদের কোন বক্তব্য নেই। বরং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ভাববিনিময়ের প্রয়োজনে আমাদের উর্দু শিখতে হবে। তাই অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর দাবীও আমরা সমর্থন করি। ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে একের বেশী দুইটি রাষ্ট্রভাষার অস্তিত্ব থাকলে জাতির ঐক্যে ফাটল ধরবে, কেউ কেউ এই অভিমতও পোষণ করে থাকেন। বলা বাহুল্য, এ যুক্তিও ইসলামের আলোকে মেনে নেওয়া চলে না। ঐক্য হৈরঃ) ও সমতা (হরভড়ৎসরঃ) এক হবে, একই ভাষায় কাজ-কারবার করতে হবে, একই ধারায় চিন্তা করতে হবেথ-এ যুক্তি ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অচল। বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলন- ইংরেজীতে যাকে বলা হয়, হরঃ রহ ফরাবৎংরঃ-সেই লক্ষ্যে পৌছানোই ইসলামের আদর্শ। একমাত্র সাধারণ আদর্শ ও জীবন-নীতির মাধ্যমেই একটি জাতিকে একতাসূত্রে আবদ্ধ করা যেতে পারে। পাকিস্তানের সংগ্রামে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বহু ভাষা-ভাষী মুসলমানের এগিয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশে লীগ ও পাকিস্তানের প্রচার চলেছিল বাংলা ভাষাতেই, মাদ্রাজে মাদ্রাজীতে, উড়িষ্যায় উড়িয়াতে। এতে পাকিস্তানের দাবী দূর্বল না হয়ে বরং জোরালোই হয়েছিল। পাকিস্তান সংগ্রামের অভাবিতপূর্ব সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল এই যে, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মুসলমানেরা আকৃতিগত, প্রকৃতিগত এবং ভাষাগত বিভেদ সত্ত্বেও একই আদর্শের পতাকাতলে সমবেত হতে পেরেছিলেন। আজ পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর বাংলা-পাঞ্জাব-সিন্ধু-বেলুচিস্তান-সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানেরা যদি সমান প্রেরণা নিয়ে হুকুমাতে রববানিয়াৎ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এগিয়ে আসেন, তাহলে ভাষার বিভিন্নতা, প্রাকৃতিক দূরত্ব এবং অন্যান্য অসুবিধা কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারবে না। তা-ছাড়া আমরা বিশ্বাস করি আজকের যুগের ভাষার মাধ্যমে নয় বরং একমাত্র আদেশের মাধ্যমেই পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দুনিয়ার বুকে বেঁচে থাকতে পারবে। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইরা যদি বাংলা শেখেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ

উর্দু শেখেন তাহলে উভয় অংশের জনগণ একে অপরের ভাবধারা, সুখ-দুঃখ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংগে পরিচিত হতে পারবেন এবং উভয় অংশের জনসাধারণের মধ্যে ঐক্য সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত হবে। তাই উপসংহারে এ কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমরা ঘোষণা করতে চাই যে, বাংলাভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের ঐক্যে ফাটল ধরায়নি বরং এক ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথে এ আন্দোলন আমাদের এগিয়ে দয়েছে। ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে উপরে যেসব যুক্তি দেওয়া গেল, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের কর্মীবৃন্দ মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করে বলেই সাংগঠনিক সমস্ত অসুবিধা অপেক্ষা করেও কর্মীরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলো। এই আন্দোলনে কারাবরণ ও নির্যাতনের সম্মুখীন হতে তারা মোটেই দ্বিধাবোধ করেনি। আমরা বিশ্বাস করি, প্রাদেশিকতার সংকীর্ণ মনোবৃত্তি বা উর্দু ভাষাভাষীদের প্রতি কোনরকম বিদ্বেষের মনোভাব ভাষা আন্দোলনের জন্মদান করেনি। গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই পূর্ব-পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি জনসাধারণ বাংলাকে আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সংগ্রাম আরম্ভ করেছেন। মহান উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে যে আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে তাকে পাটিগত বা ব্যক্তিগত স্বার্থের কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ রুখে দাঁড়াবে। ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ বিশ্বাস করে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে যারা রাষ্ট্রভাসানো আন্দোলনে পরিণত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে সদাজাগ্রত প্রহরীরূপে কাজ করে যাবেন পূর্ব-বাঙ্গলার প্রতিটি সন্তান। তাই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার কাজে সহায়তা করার জন্য পাকিস্তানের প্রতিটি কল্যাণকামী সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবীকে আমরা উদাত্ত আহবান জানাই।