শিরোনামঃ জাতি গঠনে ছাত্রদের ভূমিকা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ
সুত্রঃ কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহঃ স্পিচেস এ্যাজ গভর্নর জেনারেল অব পাকিস্তান ১৯৪৪-১৯৪৮। পৃষ্ঠা- ৮২
তারিখঃ ২৪শে মার্চ ১৯৪৮
জাতি গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতা, ২৪ মার্চ, ১৯৪৮
(ঢাকার রেডিও পাকিস্তান কর্তৃক রেকর্ডকৃত)
ভদ্র মহোদয় ও মহোদয়াগণ,
আপনাদের উপাচার্য মহাশয় যখন আমাকে এসে অনুরোধ করলেন সমাবর্তনে একটা বক্তৃতা দেয়ার জন্য, আমি তাকে স্পষ্ট বলে দিলাম, আমার নানামুখী এত ব্যস্ততা যে সমাবর্তনের জন্য একটা আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা প্রস্তুত করা হয়তো সম্ভব হবে না, যা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহান বিষয়াদি যেমন শিল্প, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, আইন প্রভৃতির সাথে মান সম্মত হয়। যাহোক, আমি অবশ্য প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে সমাবর্তন উপলক্ষ্যে ছাত্রদের সামনে দুটো কথা বলব এবং এখন যে কথাগুলো বলব তা এই প্রতিজ্ঞা পূরণই বলা যায়।
প্রথমেই উপাচার্য মহাশয়কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করব, বিভিন্ন গালভরা বিশেষণে আমাকে বিশেষায়িত করার জন্য। জনাব উপাচার্য, আমি এখন যা করছি কিংবা যতটা করতে সক্ষম হয়েছি, মোটামুটি সবই ছিল আমার দায়িত্ব পালন। একজন মুসলমান হিসেবে সততা এবং নিঃস্বার্থতার সাথে দেশের মানুষের সেবা করাটা দায়িত্ব হিসেবেই বর্তায়।
আপনাদেরকে যখন আমি কথাগুলো বলছি, তা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নয়, বরঞ্চ এমন একজন বন্ধু হিসেবে বলছি যে সার্বক্ষণিক আপনাদের মমতায় বেধে রাখে। অনেকেই আজকে তাদের ডিপ্লোমা এবং ডিগ্রি অর্জন করবেন, আমি তাদের সাধুবাদ জানাই। আপনারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করে জয়মাল্য ছিনিয়ে নিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত পরিসরে যেখানে আপনার প্রবেশ করতে যাচ্ছেন সেখানেও আপনাদের সফলতা কামনা করি। অনেকেই আপনাদের শিক্ষাজীবনের শেষপ্রান্তে এবং জীবনের চরম চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। আপনারা ভাগ্যবান যে একান্ত নিজেদের একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যেতে পারছেন, যা আপনাদের পূর্বপুরুষরা পারে নি। পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মের কারণে যে যুগান্তকারী পরিবর্তনসমূহ সূচিত হয়েছে তা আপনাদের এবং পরবর্তী ছাত্রদের বুঝতে পারাটা জরুরী। পরাধীনতার শিকল আমরা ভেঙেছি, এখন আমরা মুক্ত মানুষ। আমাদের দেশ আমাদের একান্ত নিজেদের। আমাদের সরকার আমাদের একান্ত নিজেদের, জনগণের জন্য, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ এবং রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
যাহোক, স্বাধীনতা মানে কিন্তু লাইসেন্স পাওয়া নয়। এর মানে এই নয় যে তোমার যা ইচ্ছা তুমি করবে, রাষ্ট্রের কে কী মনে করল সেসব না ভেবে যেমন ভাল লাগে তেমন আচরণ করবে। আপনাদের উপর অনেক দায়িত্ব, বলতে গেলে অন্যান্য সময়ের চেয়েও বেশী। আমাদেরকে একতাবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জাতি হিসেবে কাজ করে যেতে হবে। স্বাধীনতা অর্জনের সময় যে সামরিক শক্তির দরকার ছিল, তারচেয়ে এখন বেশী দরকার উন্নয়নমূলক শক্তির। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সামরিক শক্তির প্রয়োগের চেয়ে কঠিন হচ্ছে তাকে গড়া তোলাটা। জেলে যাওয়া কিংবা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করা সরকার পরিচালনার চেয়ে সহজতর।
বরঞ্চ যেসব বিপদ আমরা কাটিয়ে উঠেছি এবং যেসব কতিপয় ঝামেলা সামনে আসছে সেসব সম্পর্কে আপনাদের দু’কথা বলি। পাকিস্তান জন্ম ঠেকাতে না পারার অতৃপ্ত বাসনা মেটানোর জন্য শত্রুরা এখন নজর দিয়েছে আমাদেরকে দূর্বল এবং ধ্বংস করার পথ খুঁজতে। একারণেই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই পাঞ্জাব এবং দিল্লির ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল। হাজার হাজার পুরুষ, নারী এবং শিশুকে জবাই করা হয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষ ঘর ছাড়া হয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই এমন পঞ্চাশ লাখ মানুষ পাঞ্জাবে এসে হাজির হয়েছে। দেহ এবং মন উভয় ক্ষেত্রেই বিপর্যস্ত এই দূর্ভাগা অভিবাসীদের পরিচর্যা এবং পুনর্বাসন করতে যেসব সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে, তা যে কোন বৃহৎ রাষ্ট্রকেও পথে নামাতে পারে। কিন্তু, পাকিস্তানের জন্মকে আঁতুড় ঘরেই যারা মেরে দিতে চেয়েছিল তারা এতে হতাশ হয়েছে। পাকিস্তান সেই বিপর্যয় কেবল কাটিয়েই উঠে নি বরঞ্চ আরো শক্তিশালী, মার্জিত এবং পূর্বের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশী ভাবে সজ্জিত।
এর সাথে সারি বেধে আরো কিছু সমস্যা উদ্ভুত হয়েছে, যেমন, ভারত কর্তৃক আমাদের উদ্বৃত্ত এবং সামরিক যন্ত্রপাতির প্রতি প্রতিসংহারমূলক আচরণ এবং অতি সম্প্রতি আপনাদের এই প্রদেশের সাথে পুরোপুরি অর্থনৈতিক অবরোধ স্থাপন। আমার কোন সন্দেহ নেই যে, ভারতীয় প্রদেশের সুচিন্তার মানুষগুলো এইসব ঘটনাকে সমর্থন করেন না এবং যারা এসব ঘটাচ্ছেন তাদেরও মন মানসিকতার পরিবর্তন হবে, তারপরও, এসব বিষয়ে আপনাদের ধারণা থাকাটা জরুরী। আমাদের অংশের উপর কড়া নজর রাখার উপর তারা জোর দিচ্ছে। বিশেষ করে সম্প্রতি আপনাদের প্রদেশের উপর আক্রমনের ঘটনা রহস্যময় রূপ নিয়েছে। অতি দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আমাদের শত্রুদের মধ্যে কিছু মুসলমানও আছে, যারা প্রাদেশিকতাবাদের জোর প্রচারণা চালাচ্ছে যাতে পাকিস্তান দূর্বল হয়ে পড়ে এবং আগের মত ভারতীয় আধিপত্যের সাথে একাত্ম হয়। যারা এই সব ভাবছে তারা বোকার স্বর্গেই বসবাস করছে, যদি তা তাদের চেষ্টা থেকে নিরস্ত রাখছে না। প্রতিটা দিন এক গাদা মিথ্যে বানোয়াট ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে যাতে দেখানো যায় যে মুসলমানদের মধ্যে সৌহার্দ্য নেই এবং তাদেরকে আইনবিরোধী কাজ কামে উদ্বুদ্ধ করা যায়। সাম্প্রতিক কালের ভাষা বিষয়ক বিতর্কের কথাই ধরুন, আমি অতীব দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনাদের অনেকেই প্রাদেশিকতাবাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন, যা অতি সুহ্মভাবে এই প্রদেশে বুনে দেয়া হয়েছে, যদিও আপনাদের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সুস্পষ্ট মত দিয়েছেন। আপনাদের মনে কি এটা কখনও জাগে না যে, যে দেশের পত্রিকাসমূহের কাছে পাকিস্তান কেবল একটি অভিশাপের নাম, তারাই ভাষার ব্যাপারে আপনাদেরকে অধিকার শেখাতে আসছে? এটা কি মনে হয় না যে, অতীতে যে লোকটা মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করেছে কিংবা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, হুট করে ভাষার ব্যাপারে সে এখন আপনাদের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, আপনাদেরকে অধিকার সচেতন হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শেখাচ্ছে? এই ফিফথ কলামনিস্টদের থেকে সাবধান হোন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি আরেকটিবার ব্যাখা করি। এই প্রদেশের অফিশিয়াল ব্যবহারের জন্য এই প্রদেশের লোকজন যেমনটা চায় তেমন এক ভাষা তারা পছন্দ করতে পারে। এই ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই, দেশের লোকজন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে নিজেদের পছন্দমত ভাষা পছন্দ করে নিবে। যাহোক, লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা- অর্থাৎ বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে আন্তযোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত ভাষা অবশ্যই উর্দু হবে, অন্য কিছু নয়। সুতরাং, রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং অবশ্যই উর্দু, যা এমন একটি ভাষা যা উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ মুসলমানদের নিবিড় পরিচর্যায় বেড়ে উঠেছে, পাকিস্তানের প্রতিটি কোণায় কোণায় যে ভাষা অন্য যে কোন প্রাদেশিক ভাষার চেয়ে লোক ভাল বুঝতে পারে, মুসলমানদের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ এবং অন্যান্য ইসলামি রাষ্ট্রের ভাষাগুলোর মোটামুটি কাছাকাছি।
<001.030.088>
ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে উর্দুর বিতাড়ন এমনকি অফিশিয়াল ব্যবহার থেকে উর্দুকে বাদ রাখা বিনা কারণে ঘটে নি। ভাষা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে যারা জল ঘোলা করতে চাইছে ব্যাপারটা তাদের অজানা নয়। এই ঝামেলা সৃষ্টি স্বীকার না করে উপায় নেই, যদিও তারা স্বীকার করবে না কেননা তা তাদের মনোবাসনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাদের ভাষা বিতর্ক সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি এবং অ-বাঙালি মুসলমানদের প্রতি ঘৃণার প্ররোচনা প্রদান। অবশ্য ভাষা বিতর্কে আপনাদের প্রধানমন্ত্রী করাচি থেকে ফিরে যে স্পষ্ট বয়ান দিয়েছেন যে বাঙালিরা ইচ্ছে করলে বাংলাকে অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ বানাতে পারে, শুনে তারা তাদের কর্মপরিকল্পনা পরিবর্তন করেছে। এখন তারা চাচ্ছে বাংলাকে পুরো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বানাতে, এবং একটি মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর দাবিকে তারা অগ্রাহ্য করছে। তারা বলছে, বাংলা এবং উর্দু দুটিকেই রাষ্ট্র ভাষা করতে। এই বিষয়ে ভুল করবেন না আপনারা। রাষ্ট্রের একাত্মতার স্বার্থে কেবল একটাই রাষ্ট্রভাষা থাকতে পারে, এবং আমার মতে তা উর্দু; এই বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছি, আমাদের শত্রুদের এবং কিছু সুবিধাবাদি রাজনীতিবিদদের ব্যাপারে তাই আপনাদের সতর্ক করছি। আপনারা যারা জীবনের বিস্তীর্ন পথে হাঁটতে যাচ্ছেন তারা নিজেদেরকে এই সব মানুষ থেকে দূরে রাখবেন। যারা আরো কিছুদিন পড়াশুনা চালিয়ে যাবেন তারা নিজেদেরকে স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের বলির পাঠা হতে দিয়েন না। আগের দিন যেমনটা বলেছিলাম, আমাদের নিজেদের জন্য, পিতামাতার জন্য, রাষ্ট্রের জন্য আপনারা পুরোদস্তুর পড়াশুনায় মনোনিবেশ করুন। একমাত্র এই পথেই ভবিষ্যতের জীবন যুদ্ধের জন্য আপনারা নিজেদেরকে সজ্জিত করতে পারবেন। একমাত্র এভাবেই আপনি নিজেকে দেশের সম্পদ, শক্তি এবং অহংকার রূপে গড়ে তুলতে পারেন। একমাত্র এভাবেই সামনের নানাবিধ সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে দেশকে বিশ্বের মধ্যে উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন।
নবীন বন্ধুরা, একারণেই আমি কিছু ব্যপারের প্রতি আলোকপাত করব যা সম্পর্কে আপনাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে। প্রথমত, আমাদের অন্তর্বর্তী ফিফথ কলামিস্টদের ব্যপারে সাবধান থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, সকল স্বার্থপর ব্যক্তিদের ব্যপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা ধারণ করতে করতে হবে এবং তাদের মূলোৎপাটন করতে হবে কেননা তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আপনাকে কাজে লাগাবে।তৃতীয়ত, প্রকৃত সৎ এবং পরপোকারী সরকারী কর্মচারী, যারা তাদের সবটুকু দিয়ে জনগণের জন্য কাজ করতে চায়, তাদেরকে চিনতে হবে এবং সমর্থন করতে হবে।চতুর্থত, মুসলীম লীগকে আরও দৃঢ়ভাবে গড়ে তুলতে হবে কারণ তারা প্রকৃত অর্থেই এক মহান পাকিস্তান গড়ে তুলবে। পঞ্চমত, এই মুসলীম লীগই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এখন পাকিস্তানকে গড়ে তোলার সে পবিত্র দায়িত্বের রক্ষক হিসেবে এটা মুসলীম লীগেরই দায়িত্ব।ষষ্ঠত, এমন অনেকেই আছেন যারা আমাদের সংগ্রামের সময় আমাদের বিন্দুমাত্র সহযোগিতা করেনি, এমনকি আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন এবং খোলামেলা ভাবেই আমাদের মহান সংগ্রামের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন এবং এই শত্রুপক্ষের সহযোগিতাকারীদের সংখ্যা মোটেই অপ্রতুল নয় তারা হয়ত এখন তাদের চটকদার স্লোগান, বাধা-বুলি, আদর্শ আর কর্মসূচি নিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু, তাদেরকে অবশ্যই বিশ্বস্ততা কিংবা তাদের অন্তর্ণিহিত চিন্তাধারার যে প্রকৃত পরিবর্তন ঘটেছে তার প্রমাণ দিতে হবে। আর এর সত্যতা পাওয়া যাবে এই ভয়ংকর সন্ধিক্ষণে যদি তারা ব্যাঙের ছাতার মত দল গঠন না করে তাদের মত ও বিশ্বাস নিয়ে মুসলীম লীগে যোগদান করে এবং এই দলকে সমর্থন করে, এমন একটা সময় যখন আমরা নানবিধ বহির্মুখী এবং অন্তর্মুখী বিপদের সম্মুখীন হচ্ছি যার সাথে সাত কোটি মানুষের ভাগ্য জড়িত। এ জন্য প্রয়োজন সম্পূর্ণ সংহতি, ঐক্য আর শৃঙ্খলা। একটা ব্যপারে আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি যে “একতায় উত্থান, বিভেদে পতন”
এরকম আরও একটা ব্যাপার আছে যার প্রতি আমি আলোকপাত করতে চাই। নবীন বন্ধুরা, এখন পর্যন্ত আপনারা প্রচলিত গৎবাধা রীতিই অনুসরণ করে আসছেন। যখন আপনারা আপনাদের ডিগ্রী নিয়ে হাজারে হাজারে ইউনিভার্সিটি থেকে বের হন, তখন আপনাদের একটাই চিন্তা আর আকাঙ্ক্ষা থাকে আর তা হল সরকারি চাকরি। আপনাদের উপাচার্য যথার্থই বলেছেন যে অদ্যাবধি শিক্ষা-দীক্ষার পুরণো আর প্রচলিত রীতি হল সু-প্রশিক্ষিত, সুসজ্জিত কেরাণী তৈরি করা। অবশ্যই তাদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু পুরো সিস্টেমটাই ছিল সুদক্ষ কেরানী তৈরি করার জন্য। সিভিল সার্ভিসে মূলত বৃটিশ কর্মীরাই নিযুক্ত হতেন, পরে ভারতীয়রা এতে যোগদান করতে শুরু করেন এবং এই ধারা বাড়তেই থাকে। এর সামগ্রিক উদ্দেশ্য ছিল এমন একটা মানসিকতা তৈরি করা যে একজন সাধারণ মানুষ বি.এ. অথবা এম.এ. পাশ করেই একটি সরকারি চাকরি খুঁজতে থাকবে। যদি সে এটা পেয়ে যেত তবে ভাবত সে তার সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। আমরা সবাই জানি যে এর প্রকৃত ফলাফল কি ছিল। আমরা অভিজ্ঞতায় দেখেছি একজন এম.এ. পাশ ব্যক্তি একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের থেকেও কম আয় করেন এবং তথাকথিত অধিকাংশ সরকারি চাকুরীজীবীই স্বচ্ছল পরিবারে নিযুক্ত ভৃত্যের থেকেও দুর্দশায় জীবন অতিবাহিত করেন। এখন, আমি চাই আপনারা সেই প্রচলিত রীতি আর মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসুন কারণ আমরা এখন মুক্ত পাকিস্তানের বাসিন্দা। সরকার হাজারে হাজারে চাকরি দিতে পারবেনা। এটা অসম্ভব। কিন্তু সরকারি চাকুরির এই প্রতিযোগিতায় আপনাদের মধ্যে অধিকাংশই মনোবলহীন হয়ে পড়েন। সরকার কেবল সীমিত জনকেই চাকরি দিতে পারে এবং যারা বাকি থাকে তারা কোনকিছুতেই স্থির হতে পারে না আর এই হতাশ মানুষগুলো সহজেই স্বার্থান্বেষীদের শিকারে পরিণত হয়। আমি চাই আপনারা আপনাদের মন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এমন পথে পরিচালিত করুন সেসব ক্ষেত্রে যেসব ক্ষেত্র আপনার জন্য উন্মুক্ত এবং ভবিষ্যতে আরও উন্মুক্ত হবে। কায়িক পরিশ্রম করার মধ্যে কোন লজ্জা নেই। কারিগরী শিক্ষায়ও প্রচুর সুযোগ আছে কারণ কারিগরী জ্ঞানে দক্ষ লোকজনের ভীষণ প্রয়োজন আমাদের। আপনারা অর্থ ও ব্যাংকিং, বানিজ্য, আইন প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে পারেন যা বর্তমানে অপরিসীম সুযোগের সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যেই আপনারা জানেন যে নতুন নতুন কারখানা, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, বানিজ্যিক ফার্ম প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং সেগুলো সময়ের সাথে সাথে বাড়তেই থাকবে। এই পথগুলোই আপনাদের জন্য অবারিত। এগুলো সম্পর্কে ভাবুন এবং আপনার মনোযোগকে এদিকে পরিচালিত করুন। বিশ্বাস করুন, এভাবে আপনি সরকারি চাকরির তুলনায় অনেক বেশি লাভবান হবেন। অনেক বাশি খুশি থাকবেন আপনি কারন অনেক বেশি সুযোগের মাধ্যমে আপনি অনেক বেশি উন্নতি করতে পারবেন যদি আপনি বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আর কারখানাগুলোতে যোগদান করেন।আর এভাবে আপনি আপনার নিজের পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও সহযোগিতা করবেন। আমি আপনাদের একটি উদাহরণ দিতে পারি। আমি একজন তরুণকে চিনি যিনি সরকারি চাকরিতে ছিলেন। চারবছর আগে দুইশত রুপিতে তিনি একটি ব্যাংকিং কর্পোরশনে যোগদান করেন কারণ তিনি ব্যাংকিং বিষয়ে পড়েছিলেন। আজ তিনি ওই কর্পোরেশনের একটি ফার্মের ব্যবস্থাপক এবং মাত্র চার বছরের মাথায় তিনি এখন মাসিক ১৫০০ রুপি আয় করেন। এই সুযোগগুলোর সদব্যবহার করতে হবে এবং আমি সত্যি আপনাদের উপর খুশি হব যদি আপনারা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন।
পরিশেষে, আমি আচার্যকে ধন্যবাদ জানাই আর বিশেষত ধন্যবাদ জানাই উপাচার্যকে, আমাইয় উষ্ণ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন আর ওইসব প্রশংসাসূচক বাক্যবর্ষনের জন্য। আমার আশা নয় বরং আমার দৃঢ় প্রত্যয়, পূর্ব বাংলার তরুণেরা আমাকে আশাহত করবে না।