তারিখ | সূত্র | শিরোনাম |
২৫শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৮ | পাকিস্তান গণপরিষদ | গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে অন্তর্ভুক্তকরণের প্রশ্নে বির্তক |
জনাব দ্বিরেন্দ্রনাথ দত্ত (পূর্ব পাকিস্তানঃ জেনারেল)ঃ
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, জনাব, আমি প্রস্তাব করছিঃ
“বিধি ২৯ এর উপ-বিধি ১ এর ২য় লাইনে “ইংরেজি” শব্দটির পরে “ অথবা বাংলা” শব্দ সমূহ সংযুক্ত করা হোক”।
জনাব, আমি নিজের নামে এই প্রস্তাব করার ক্ষেত্রে এই কক্ষকে এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, আমি হীন প্রাদেশিকতায় একেবারেই আগ্রহ প্রকাশ করি না বরং এই মনোভাব পোষণ করি যেন এই কক্ষের সকল সদস্যসের কাছে এই প্রস্তাব পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা পায়। আমি জানি, বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা, কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে এটা রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষের ভাষা। সুতরাং, যদিও এটা একটি প্রাদেশিক ভাষা তারপরেও এটা রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হওয়ায় এর একটি আলাদা অবস্হান রইয়াছে। এই রাষ্ট্রে ছয় কোটি নব্বই লক্ষ লোকের বসবাস, যার মধ্যে চার কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাই জনাব, এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ভাষা কী হওয়া উচিত? এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা তাই হওয়া উচিত যা দেশের অধিকাংশ মানুষ ব্যবহার করে। সুতরাং, জনাব, এ কারণে আমি মনে করি বাংলা ভাষা হচ্ছে এই রাষ্ট্রের সর্বসাধারণের ভাষা।
আমি জানি জনাব, আমি আমার রাষ্ট্রের লক্ষ মানুষের ভাবানুভূতি তুলিয়া ধরছি। এরই সাথে আমি এই কক্ষকে জানাতে চাই, আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লক্ষ লক্ষ মানুষের অনুভূতি। এমনকি জনাব, পূর্ব পাকিস্তানে; যেখানে চার কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষের বসবাস; যারা কিনা বাংলায় কথা বলে তারা যদি ডাকঘরে যেয়ে মানি অর্ডার ফরম চায়, তখন সেখানে তারা দেখে যে ঐ মানি অর্ডারখানা উর্দুতে কিংবা ইংরেজিতে মুদ্রণ করা, বাংলায় না! জনাব, একজন গরীব চাষী; যার সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন এবং তাকে যখন তিনি টাকা পাঠানোর জন্য ডাকঘরে যান তখন তিনি দেখেন যে মানি অর্ডার ফরমটি উর্দুতে মুদ্রিত। এমতাবস্হায়, টাকা না পাঠাতে পেরে তিনি দূরবর্তী শহরে ছুঁটে যান এবং ঐ উর্দু মানি অর্ডারখানা অনুবাদ করে তারপর তার সন্তানকে প্রয়োজনীয় টাকা পাঠান। একজন গরীব চাষী যখন কোন জমি বিক্রয় বা ক্রয় করেন; তখন তিনি স্ট্যাম্প বিক্রেতার নিকট যান এবং এর জন্য টাকা পরিশোধ করেন, তিনি বলিতে পারেন না স্ট্যাম্পে কী পরিমান মূল্য নির্ধারিত আছে কারণ এটাও ইংরেজি এবং উর্দুতে লেখা, বাংলায় না। আমাদের রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ এইসব সমস্যা ভোগ করছেন। একটি দেশে রাষ্ট্রীয় ভাষা এমন হওয়া উচিত যাহা কিনা দেশের সাধারণ মানুষের বোধগম্য হবে। এই দেশের সাধারণ জনসাধারণের (চার কোটি চল্লিশ লক্ষ) জন্য সংসদে এমন এক ভাষা নির্বাচিত করা হয়েছে যা তাদের অজানা। আম জানি ধারা ২৯ এ ইংরেজি ভাষা একটি সম্মানসূচক স্হান লাভ করেছে, কারণ এটি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা।
কিন্তু, জনাব, ইংরেজি যদি বিধি ২৯ এ এমন সম্মানসূচক অবস্হান পেতে পারে যে গণপরিষদের কার্যক্রম উর্দু কিংবা ইংরেজিতে পরিচালিত হতে হবে তাহলে চার কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষের ভাষা বাংলা কেন কার্যবিধি বিধিমালায় বিধি ২৯ এ সম্মানসূচক অবস্হান পাবে না, জনাব। জনাব, আমি জানি, আমি আমাদের রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক মানুষের ভাবানুভূতি নিয়া কথা বলছি, সুতরাং বাংলাকে কেবল একটি প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হবে না। এটাকে রাষ্ট্রীয় একটি ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। এবং এই কারণে, জনাব, আমি অভিমত জানাচ্ছি যে, “ইংরেজি” শদটির পর “বাংলা” শব্দটি বিধি ২৯ এ সন্নিবিষ্ট করা হোক।
জনাব প্রেম হরি বর্ম (পূর্ব বাংলাঃ জেনারেল) জনাব, আমি অন্তরের অন্তঃস্হল হতে এই পরিবর্তনের পক্ষে আমার সম্মানিত এবং শ্রদ্ধাভাজন বন্ধু জনাব ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করিতেছি। জনাব, এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য কোনভাবেই ইংরেজি এবং উর্দুকে পুরোপুরি বিতাড়িত করা নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে গণপরিষদের পরিষদ সদস্যদের বক্ত্যব্যের একটি মাধ্যম হিসেবে বাংলা কে অন্তর্ভুক্ত করা।
সুতরাং, ইংরেজি অথবা উর্দুকে বিতাড়িত করা মোটেই এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য নয় বরং বাংলাকেও এই রাষ্ট্রের একটি রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে পাওয়াই এর উদ্দেশ্য। জনাব, আমার সম্মানিত বন্ধু ইতোমধ্যেই এই কক্ষে বলেছেন, পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলে। এই কারণে, বাংলা কে অবশ্যই এমন একটি স্থান দিতে হবে যেন পরিষদের সদস্যরা গণপরিষদে বক্ত্যব্যের মাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্যবহার করতে পারে। আরেকটি সমস্যা এই হবে যে, যদি কোন সদস্য পরিষদে তার মাতৃভাষায় ভাষণ দেন কিন্তু তা যদি পরিষদে ভাষণদানের গ্রহণযোগ্য মাধ্যম না হয় তাহলে প্রকৃত বক্ত্যব্য টি নথিভুক্ত হবে না বরং কেবলমাত্র এর একটি অনুবাদ নথিভুক্ত হবে। এই কারণে, এটা রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য জরুরী যে, যে বক্ত্যব গুলো বাংলায় প্রদত্ত হবে তা যেন বাংলাতেই নথিভুক্ত হয়। এই বক্ত্যব্যের মাধ্যমে আমি এই সংশোধনীতে মি. ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সাথে সহমত পোষণ করছি।
জনাব লিয়াকত আলী খান (প্রধাণমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী) মহামান্য রাষ্ট্রপতি, জনাব, আমি অত্যন্ত যত্ন এবং মনোযোগের সাথে সংশোধনী প্রস্তাব এর সম্মানিত উত্থাপনকারীর বক্ত্যব্য শুনেছি। আমি আশা করি, সম্মানিত সদস্য পাকিস্তানের ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির জন্য এমন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেননি। আমার সম্মানিত বন্ধু বাকপটুতার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন যে, বাংলা সত্যিকার অর্থেই পাকিস্থানের একটি রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। অন্যভাবে বলা যায়, তিনি বাংলাকে এই কক্ষে ব্যক্ত্যব্যের একটি মাধ্যম হিসেবেই শুধু চান না বরং তিনি এরচেয়েও বড় একটি প্রস্তাব তুলেছেন। তাহার উপলব্ধি করা উচিত, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃস্টি হয়েছে এই উপমহাদেশের দশ কোটি মুসলমানের চাহিদার ভিত্তিতে, এবং এই দশ কোটি মুসলমানের ভাষা হচ্ছে উর্দু এবং এই কারণে, তার জন্য এমন একটা আবহ সৃষ্টি করা অন্যায় হবে যে, পাকিস্থানের অধিকাংশ মানুষ একটি বিশেষ অঞ্চলে বসবাস করে সুতরাং তাদের ভাষাই হবে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং এর রাষ্ট্রভাষা অবশ্যই হতে হবে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের ভাষা। আমার সম্মানিত বন্ধু অসন্তুষ্ট যে উর্দু ইংরেজীকে প্রতিস্থাপিত করবে। বহু বছর ধরে চলে আসা পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা ইংরেজী কে প্রতিস্থাপন করে উর্দু চালু করার উদ্যোগ এর বিরুদ্ধাচারণ করাই উনার অভিপ্রায়; যতদিন ইংরেজী ছিল রাষ্ট্রভাষা ততদিন আমার সম্মানিত বন্ধুর কোন অভিযোগ ছিল না, তখন তিনি বাংলা ভাষা কে প্রস্তাব করেননি। আমি গণপরিষদে বছরের পর বছর কখনো বাংলার মানুষের পক্ষ থেকে শুনি নাই যে, বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হওয়া উচিত। আমি জানতে চাই, কেন এই কথা আজ উত্তোলন করা হল এবং আমি দুঃখিত যে । আমরা বাংলার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অবহিত। বাংলা থেকে বাংলা ভাষাকে বিতাড়িত করার মোটেও কোন অভিপ্রায় আমাদের নাই। প্রকৃতপক্ষে, এটা যেকারো পক্ষেই একটা অন্যায় হবে যদি কোন প্রদেশের জনগনের উপর অন্য এমন একটি ভাষা চাপিয়ে দেয়া হয় যা তাদের মাতৃভাষা নয় কিন্তু একই সাথে আমাদের একটি রাষ্ট্রভাষা থাকতে হবে যে ভাষা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে আন্তপ্রাদেশিক যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হবে
আবার জনাব, আপনি শুধু জনসংখ্যা কে আমলে নিলেই হবে না। আরও অন্যান্য অনেক বিষয় আছে। উর্দু হচ্ছে একমাত্র ভাষা যা পূর্ব বাংলা বা পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলের জনগণকে কে একসুত্রে বেঁধে রাখতে পারে। এটা একটা জাতীর জন্য জরুরী যে তাদের একটি মাত্র ভাষা থাকবে এবং সেটা কেবল উর্দুই হতে পারে এবং উর্দু ছাড়া অন্য কোন ভাষাই নয়। অতএব জনাব, আমি দুঃখিত যে আমি আমি প্রস্তাবিত সংশোধনীটি সমর্থন করতে পারছি না। বস্তুত, যখন সংশোধনী বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছিল, আমি ভেবেছিলাম এর উদ্দেশ্য নিরীহ। বাংলা ভাষাকে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্য ছিল, যারা ইংরেজী বা উর্দুতে দক্ষ নয় তারা যেন বাংলাতে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু এখন দেখছি উদ্দেশ্য টি এত নিরীহ কিছু না, যেমনটা আমি ভেবেছিলাম। এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য পাকিস্থানের জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি। এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমানদের কাছ থেকে তাদের ঐক্যবদ্ধ হবার সেই শক্তি টা কেড়ে নেয়া যা তাদের একত্রিত রাখে।
জনাব ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত (পূর্ব বাংলাঃ সাধারণ): জনাব, আমারা বিরোধীতার কোন বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে এই সংশোধনীর উপর জোর দেয় নি। আমি এই কক্ষের সম্মানিত সদস্যের সদ্য প্রদত্ত বক্তব্যে বিস্মিত। উনি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা আমি আশাই কর নি যে উনি করবেন। এটা অন্যত্র এমনকি পাকিস্থানের অভ্যন্তরে কিছু নির্দিষ্ট অংশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। অতএব, একারনেই এই সংশোধনী টি হওয়া আরও বেশী জরুরী। আমি প্রায়শই দেশের যে অংশে আমার নিবাস সেখানে যাতায়াত করি এবং আমি জানি এই বিষয়ে অনুভূতির তীব্রতা আমি জানি। বাংলা সেখনে অধিকাংশ মানুষের ভাষা, এটা সেখানকার একমাত্র ভাষা যা সেখানে কথিত এবং বোধগম্য। এটা সমগ্র পাকিস্তানেরও ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা। আমি এই কক্ষে প্রায়শই লক্ষ্য করি যে, এখানে অন্য ইউনিয়নটির (ভারতের) কোন কাজের সাথে তুলনা বা তাদের অনুকরণের একটা প্রবণতা রয়েছে। এমনকি গতকালই যখন আসন পুনঃবন্টনের কথা হচ্ছিল, তখন আমার বন্ধু জনাব দত্ত কে বাঁধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “ভারতে কি হচ্ছে”। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটিতে এর ব্যত্যয় ঘটেছে। ভারতে সমগ্র জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ভাষাকে গ্রহণ করা হয়েছে।
সমাবেত কন্ঠেঃ প্রশ্ন, প্রশ্ন।
জনাব ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত: কিন্তু এখানে আমাকে উর্দু কে গ্রহণ করছি। উর্দু পাকিস্থানের কোন প্রদেশের ই ভাষা না। এটা পশ্চিম পাকিস্থানের কিছু উচ্চবর্গীয় মানুষের ভাষা। এই সংশোধনীর বিরোধিতা পশ্চিম পাকিস্থানের উচ্চবর্গীয় মানুষদের পাকিস্থান কে নিয়ন্ত্রন করার দৃঢ় অভিপ্রায়ই প্রমাণ করে…
এটা নিশ্চিতভাবেই কোন গণতান্ত্রিক মনোভাব না; এটা রাষ্ট্রটির একটি নির্দিষ্ট অংশের উচ্চবর্গীয় কিছু মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মনোভাব। আমরা এখন পর্যন্ত এটাকে পাকিস্থানের মিশ্র ভাষা করার দাবী করি নি। আমরা কেবল এটাকে এখানে গ্রহণযোগ্য তিনটি ভাষার একটি হিসেবে অনুমোদনের দাবী করছি। এমনকি আমি এখন যে ভাষায় কথা বলছি, যা আমাদের সাথে দাসত্বের স্মারক হিসেবে রয়ে গেছে, সেই ইংরেজী ভাষা একটা মর্যাদাপূর্ণ স্থান পেলেও এটা সাধারণ মানুষের তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের ভাষা না। আফসোস…
মাননীয় খাজা নাজিমুদ্দিন (পূর্ব বাংলা: মুসলিম): জনাব, আমি মনে করি বাংলা ভাষা প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্থানের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোভাব এই কক্ষে উপস্থাপন করা আমার দায়িত্ব। আমি মনে করি, এবিষয়ে কোন দ্বিমত হবে না যদি আমি বলি যে, প্রদেশগুলোর মধ্যে আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ এবং কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তারা মনে করে যে উর্দুই একমাত্র ভাষা যা গ্রহণ করা সম্ভব। কিন্তু এব্যাপারে খুব শক্তিশালী একটা মনোভাব আছে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং প্রাদেশিক প্রশাসনের ক্ষেত্রে ভাষা হতে হবে বাংলা। এটা জেনে আনন্দিত যে, এই কক্ষের সম্মানিত নেতা এটা স্পষ্ট করেছেন যে, প্রদেশটি থেকে বাংলা উৎখাতের কোন প্রশ্নই উঠে না এবং আমি নিশ্চিত ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ উর্দু কে সামগ্রিক ভাবে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবার পক্ষে। আরেকটি বিষয় আমি ঠিক করে দিতে চাই। পূর্ববর্তী বক্ত্যারা যারা এই সংশোধনীর পক্ষ নিয়েছেন, তারা দৃষ্টান্ত দিয়েছেন যে অপর রাষ্ট্রটিতে অধিকাংশ মানুষের ভাষা হচ্ছে হিন্দি। যেটা আমি মনে করি, সঠিক নয়। মাদ্রাস, বোম্বে, সিপির বহির্ভাগ, উড়িষ্যা এসব প্রদেশের মাতৃভাষা হিন্দি না। আমি মনে করি, আমি এটাও বলতে পারি যে উত্তরপ্রদেশের (ইউপি) অধিকাংশ মানুষ উর্দু তে কথা বলে এবং যারা হিন্দি সমর্থন করেছিল তারা সমাবেশে অথবা জনসভায় হিন্দিতে অনর্গল বক্তৃতা দিতে যথেষ্ট সম্যস্যার সম্মুক্ষীন হন। সুতরাং, হিন্দি ভারতের সকল প্রদেশের মাতৃভাষা না, তারপরেও হিন্দি ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। সুতরাং জনাব, সেই তুলনা থেকে থেকে এই তত্ত্ব সমর্থনের কোন ভিত্তি ই নাই যে বাংলা হবে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা, তবে বাংলা প্রদেশের ভাষা প্রসঙ্গটি আমি গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারি। আমি যথাসময়ে প্রস্তাব টি উত্থাপন করব যে, সাধারণ প্রশাসন এবং সরকারী কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বাংলার অভ্যন্তরে যেন বাংলা ভাষা ব্যাবহৃত হয়।
জনাব শ্রীস চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (পূর্ব বাংলাঃ সাধারণ): মহামান্য রাস্ত্রপতি, জনাব, এটা আমাকে ব্যাথীত করে যখন এই কক্ষের মাননীয় নেতা বলেন যে পাকিস্থান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। এতদিন আমি ভাবতাম, পাকিস্থান এর জনগণের রাষ্ট্র এবং এটা যতটা মুসলিমদের ততটাই অমুসলিমদেরও। আজকে যদি মাননীয় সংসদ নেতার এই বক্ত্যব্য গৃহীত হয় তবে এই রাষ্ট্রের অমুসলিমদের জন্য এটা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয় হবে যে তাদের আদৌ রাষ্ট্রের সংবিধান গঠনের কোন অধিকার আছে কি না। এই প্রশ্নটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কারন সেক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ভাবেই কেবল মাত্র মুসলিমরা তাদের নিজস্ব সংবিধান গঠন করবে। আমি ইতিমধ্যেই আমার বক্ত্যব্যে এবং এই কক্ষে আপনাদের বলেছি যে, আমি এদেশের আমার অংশের মানুষদের বলেছি; পাকিস্থান কেবলমাত্র একটি মুসলিম রাষ্ট্র নয় বরং এটা মুসলিম এবং অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের রাষ্ট্র, এটা জনগণের রাষ্ট্র। এই ব্যাপারটি আমি আশা করি মাননীয় সংসদ নেতা স্পষ্ট করবেন যেন ভবিষ্যতে আমরা আমাদের কার্যপ্রণালী স্থির করতে পারি এবং এই রাষ্ট্রে আমাদের অবস্থান নিশ্চিত হতে পারি।
এই সংশোধনীতে যা আছে তা কখনই রাষ্ট্র ভাষা সম্পর্কে বলেনি, কিভাবে এই কক্ষের কার্যক্রম পরিচালিত হবে উল্লেখ করেনি। এখানে উর্দুর এবং ইংরেজীর কথা বলা আছে। আমরা কেবল বাংলা সংযুক্ত করতে চাই।
যদি সংসদীয় কক্ষ এটা সমর্থন করে তাহলে বেশ ভাল কিন্তু রাষ্ট্র ভাষা আজকের প্রস্তাবনার বিষয় নয়, উর্দুকেও যদি রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করা হয় তা মেনে নিতে আমার কোন আপত্তি নাই কিন্তু কেউ উর্দু জানে না। আমরা ইংরেজী শিখেছিলাম এবং প্রয়োজন হলে আমরা এখন উর্দু শিখব।
আমি নিজে আমার সম্মানিত বন্ধু জনাব তমিজুদ্দিন আহমেদ সাহেবের সাথে জেলে থাকার সময় উর্দু শেখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে আমি ভুলে গেছি। (হাসি) সুতরাং সংসদীয় কক্ষের কার্যকলাপ পরিচালনার ভাষা নির্ধারণ করা, রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের চেয়ে বেশ একটা ভিন্ন ব্যাপার। তার সংশোধনীর বিষয় হচ্ছে কিভাবে এই সংসদের কার্যকলাপ পরিচালিত হবে। উর্দু, ইংরেজী অথবা বাংলায়? এটাই একমাত্র বিষয় যা এই সংশোধনীতে উত্থাপন করা হয়েছে এবং আমি নিশ্চিত যে এই সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি সম্মানিত সংসদ নেতার বিরাগভাজন হবার মত কিছু করেননি। এই বক্ত্যব্যের সাথে আমি সংশোধনীটি সমর্থন করেছি……………
জনাব তমিজুদ্দিন খানঃ জনাব, আমার সম্মানিত বন্ধু জনাব দত্ত সাহেবের উত্থাপিত সংশোধনীর বিরুদ্ধে যা কিছু বলা হয়েছে তার সাথে আমার খুব সামান্যই যোগ করার আছে। একটা কথা যা কংগ্রেস পার্টির সম্মানিত ভারপ্রাপ্ত নেতা বলেছেন তা আমার কাছে কিছুটা তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন যে, সংসদের সম্মানিত নেতা তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন যে, এটি একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং তার দুশ্চিন্তা এই যে যদি তাই হয় তাহলে সংখ্যালঘুদের অবস্থান কোথায়। এই প্রসঙ্গে আপনি জনাব একদম প্রথম দিনেই এটা স্পষ্ট করেছেন এবং এযাবত, আরো হাজারো অবস্থান থেকে এটা পরিষ্কার করা হয়েছে যে পাকিস্থানের সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে সমঅধিকার ভোগ করবে। সংখ্যাগরিষ্ঠদের যে অধিকার আছে তাদেরও ঠিক সেই অধিকারই থাকবে। আমার বিশ্বাস সেই অবস্থান এখনও অটুট আছে। মাননীয় সংসদ নেতা পাকিস্থানকে একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। ভারতে এমন মানুষ আছে যারা ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বলে। আমরা তুরস্ক আর মিশরকেও মুসলিম রাষ্ট্র বলি। কিন্তু এর মানে কি এই যে সেইসব দেশে কোন অমুসলিম নেই? এখন পর্যন্ত আমেরিকায় সকল ভারতীয়কে হিন্দু, মুসলিম, পার্সি অথবা খ্রীষ্টান নির্বিশেষে হিন্দু বলা হয়। কোন কিছুর বৈশিষ্ট এর নামের উপর নির্ভর করে না। এটা একদমই পরিষ্কার যে পাকিস্থানের প্রতি অনুগত পাকিস্থানের যেকোন নাগরিকের অনুরূপ অধিকার এবং সুযোগ আছে। আর অন্য প্রসঙ্গে এযাবত যা বলা হয়েছে তার বাইরে আমার আর কিছু বলার নাই। জনাব, আমি সংশোধনী টি গ্রহণ করতে পারছি না।
রাস্ত্রপতি মহোদয়ঃ আলোচ্য প্রস্তাবনাটি হচ্ছেঃ “বিধি ২৯ এর উপবিধি ১ এ “ইংরেজী” শব্দটির পর দ্বিতীয় পঙ্কতিতে “বংলা” শব্দটি সংযুক্ত হোক”।
“না” জয়যুক্ত হয়েছে।
* বক্তব্য মাননীয় সদস্য কর্তৃক সংশোধিত হয়নি।